প্রেমের রূপকথা

এই মেয়েটিই কি তানজিলা?
সে আবার তাকাল, মেয়েটিকে বুঝতে দিতে চাইল না, তবে সে তাকাল—এই মেয়েটিই?
প্রেমের যে উপন্যাস লেখার কথা সে ভাবছে, সেটা সে কিছুতেই গুছিয়ে আনতে পারছে না। অন্য কোনো সময় হলে, অন্য কোনো গল্প বা উপন্যাসের বেলায়, সে জানে, গোছানোর কাজটা বেশি সময় নিলে, সে তখনকার মতো সেটা সরিয়ে রাখত। তারপর, লেখার তাড়া থাকলে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ভাবত, তাড়া না থাকলে—ভাবতই না। এবার সে আশ্চর্য হয়ে দেখল, সরিয়ে রাখতে গিয়ে, প্রেমের উপন্যাস লেখার ব্যাপারটা তার মাথার ভেতরে থেকেই যাচ্ছে। সে তখন এরকম ভেবে চিন্তাটা মাথা থেকে সরাতে চাইল যে—প্রেমের উপন্যাস এমন কোনো জরুরি ব্যাপার নয় যে ওটা নিয়ে পড়ে থাকতে হবে। আর, যদি জরুরিও হয়, সে কিছুদিন পড়েও লেখা যেতে পারে। আবার, এমনও সে ভাবল—এমন কোনো জরুরি নয়—এভাবে না ভেবে—আদৌ জরুরি নয়—এভাবেও ভাবা যেতে পারে। প্রেমের উপন্যাস লিখতেই হবে, সে এমন দিব্যি কোথাও কাউকে দেয়নি। একটিও প্রেমের উপন্যাস না লিখেও ঢের লেখক তাদের লেখক-জীবন পার করেছেন, এখন পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। সে বরং প্রেমের উপন্যাস লিখেছে কয়েকটি, প্রেমের উপন্যাস সে লিখতেও চায়, কারণ, প্রেম ব্যাপারটা আছে—সুতরাং, লিখেছে যখন ও লিখবেও, তখন, এই এখনই হচ্ছে না বলে অস্থির হওয়ার কিছু নেই।
এরকম ভেবে সে ঠাণ্ডা মাথায় মাথা থেকে প্রেমের উপন্যাস লেখার ব্যাপারটা সরাতে চাইল—পারল না। যখন পারল না, যখন কোনো কাহিনিই সে গুছিয়ে আনতে পারছে না, সে তার নিজের লেখা প্রেমের উপন্যাসগুলোর কথা ভাবতে আরম্ভ করল। এই যেমন মামুলী ব্যাপার, জ্যোতির্ময়ী তোমাকে বলি, দূরের গল্প ও আরো কয়েকটি, যেগুলো একটু ঘুরিয়ে হলেও প্রেমের। তার প্রেমের উপন্যাস ঘুরেফিরে বেশ কয়েকটিই, প্রেম সেখানে প্রচ্ছন্নভাবে এসেছে, ফলে অনেকের তা চোখে পড়ে না। ওসব লেখার কথা আপাতত সে না হয় বাদই দিলো, এখন সে বরং তার প্রথম উপন্যাস মামুলী ব্যাপারের কথা ভাবতে পারে, তারপর জ্যোতির্ময়ী তোমাকে বলি’র কথা।
সে সায়রাকে জিজ্ঞেস করল—তুমি মামুলী ব্যাপার পড়েছ?
সায়রা উলটো প্রশ্ন করল—মামুলী ব্যাপার পড়েছি মানে!
— আহা! আমি বহু আগে মামুলী ব্যাপার নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম না? সেটার কথা বলছি।
— বলো, আমি শুনছি।
— আশ্চর্য, আমি জানতে চেয়েছি, তুমি ওটা পড়েছ কি না।
— আমিও আশ্চর্য। পড়ব না কেন!
— পড়েছ কি না, আমি এটুকু জানতে চেয়েছি। হ্যাঁ বা না বললেই চলে।
— তুমি জিজ্ঞেস করবে কেন! তোমার কোন লেখাটা আমি পড়িনি! তা ছাড়া, মামুলী ব্যাপার নিয়েই-বা হঠাত্ কী হলো!
— মামুলী ব্যাপারের কাহিনি মনে আছে তোমার?
— কাহিনি? মনে আছে কি না?… ওটার উত্সর্গ ছিল—এই শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে, আমাদের এই ব্যাপারগুলো মামুলী ছাড়া আর কী বলো?… শোনো, উত্সর্গ যখন মনে আছে, কাহিনি মনে না থাকার কোনো কারণ নেই। পাশাপাশি দু’ ফ্ল্যাটের এক ফ্ল্যাটে খালিদ আরেক ফ্ল্যাটে জয়া। সম্পর্ক বন্ধুত্বের, সম্পর্ক খুনসুটির…।
— ওটা আমার খুব প্রিয় লেখা।
— আমারও।… সম্পর্ক বন্ধুত্বের আর খুনসুটির, কোনোদিন পরস্পরের প্রতি দুর্বলতার কথা বুঝতে পারেনি, কিংবা পারলেও প্রকাশ করেনি।… শেষে এসে মন খুব খারাপ হয়ে যায়।
লেখকের তেমন কিছু হওয়া উচিত না, তবে আমারও কেমন কেমন যেন লাগে। বলতে বলতে আমি পাশের ঘরে উঠে গেলাম। পাশের ঘরে সায়রা। খবরের কাগজে চোখ। আমার কিংবা সায়রার খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস যায়নি। আজকাল শুনি অনেকেই খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। টেলিভিশনে হরদম স্ক্রল যাচ্ছেই, মোবাইল ফোনেও নোটিফিকেশন আসছে, আর, ফেসবুক তো আছেই। ওখানে আধা-এক ঘণ্টা থাকলেই সব জানা হয়ে যায়। ফেসবুকে আমার প্রথমে একটা অ্যাকাউন্ট ছিল। দেখলাম ওখানে কিছু একটা লিখলে যে যা ইচ্ছা মন্তব্য করে। অবদমন মেটানোর ও নিজেকে বিচারকের আসনে বসিয়ে রায় দেওয়ার এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর বুঝি নেই। আমি আমার আইডিটাকে পেজ বানিয়ে নিয়েছি। লেখালেখি নিয়ে, নিজের লেখালেখি নিয়ে এটাওটা বলি, কখনো নিজের লেখা আপলোড দিই। ইনবক্সে মেয়ে সাজা কিছু ফেইক আইডির উপদ্রব এখানেও আছে। তবে সব মিলিয়ে এটা আমার কাছে উপকারীই মনে হয়। নিজেকে নিজের ইচ্ছামতো প্রমোট করার এরচেয়ে ভালো ব্যবস্থা আরো কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।
সে বলল—খবরের কাগজ পড়তে আমার ভালো লাগে না।
— আমারও না। সায়রা জানাল। পড়ি আর কি। … তুমি হঠাত্ মামুলী ব্যাপার নিয়ে পড়লে কেন!
— পড়লাম। … আমার একটা প্রেমের উপন্যাস লিখতে ইচ্ছা করছে।
সায়রা তার দিতে তাকাল। হাসল।
— হাসির কী হলো! প্রেমের উপন্যাস লিখতে পারব না?
— আমাদের পাঠক, তুমি বলো সমালোচকও, প্রেমের উপন্যাসকে যথেষ্ট পরিমাণে হালকা একটা ব্যাপার মনে করে।
— করে। কিন্তু আমি মাথামোটাদের কথা মাথায় রেখে কখনো লিখিনি, তুমি জানো।… এখন প্রেমের উপন্যাস লিখতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু কোনো কাহিনি মাথায় থিতু হচ্ছে না।
— ওই যে, তুমি একটা কাজ করলে না মাঝখানে—তোমার উপন্যাসের চরিত্ররা তোমার কাছে চলে আসে, তাদের পরিণতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে, তোমাদের নতন করে লিখতে বলে তাদের কাহিনি, সেরকম কিছু লিখে ফেলো, সহজ হবে।
সে মাথা নাড়ল—না, সেরকম কিছু না।
সায়রা খবরের কাগজ থেকে চোখ উঠিয়ে একবার তাকাল।
— আমার মনে হয় মামুলী ব্যাপার বা জ্যোতির্ময়ী তোমাকে বলি নিয়ে ওরকম কিছু লিখলে ওই লেখাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। প্রেমের উপন্যাস তো বটে, কিন্তু যার বোঝার তারা বোঝেন ওখানে ক্লাস কনফ্লিক্ট কতটা…।
— হ্যাঁ, ওই যে, জ্যোতির্ময়ীর কথাই যদি ধরো, মেয়েটির বিয়ের ঘোষণায় ছেলেটি মর্মাহত হয়। তার অবচেতনে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল—মেয়েটার বাবা তার কথাই বলবে। কিন্তু প্রকাশ্যে সে কিছুই বলতে পারে না…।
— কষ্ট আর অভিমান নিয়ে ঘরে চলে আসে…।
— কিন্তু আশা ও অপেক্ষা করে, মেয়েটা সবাইকে লুকিয়ে তার কাছে আসবে।
— অপেক্ষা করে, কিন্তু যদি আসে মেয়েটি, তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাও তার মাথায় ঘুরপাক। সে ঠিক করে রাখে, এরকম কিছু বলবে—যাও, তুমি যাও, এ হয় না, তুমি কেন বোঝো না—এ হয় না।… দেখো, অবচেতনে সে কিন্তু তার ও মেয়েটির শ্রেণি-অবস্থান নিয়েও সচেতন। সেটা সে এড়াতে পারছে না।
— এটা অনেকেই বুঝতে পারেনি। নিছক একটা প্রেমের উপন্যাস ভেবেছে।… এসব কিছুই না—এ উপন্যাসটা নিয়ে কিছু করার আছে? ওই যে, বিয়ের রাতে, বর এসেছে, কনেকে রেখে সবাই সেদিকে, কনে সে-ফাঁকে পেছনের বারান্দায় গিয়ে সামনের বারান্দার ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে, একটি-দুটি কথা, এই যেমন—যাচ্ছি, ভালো থেকো… দেখা হবে… হয়তো। অথচ কী আশ্চর্য, এই ছেলেটি উপন্যাসে এর আগে এক সেকেন্ডের জন্যও আসেনি।
— হুমম। একবারও আসেনি।… আচ্ছা, এতবছর পর কি ওদের দেখা হয়ে যেতে পারে? কী দেখাব? দুজনই খুব সুখী?
— ভাবো। দেখো কোনটা মানানসই হয়।
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—সায়রা…।
— শুনছি। তাড়াতাড়ি বলো। যে খবরটা পড়ছি সেটা ইন্টারেস্টিং।
— আমি একটা অদ্ভুতুড়ে প্রেমের উপন্যাস লিখতে চাই।
— অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটবে?
— বলতে পার।… অনেকটাই।
— তাহলে ফেসবুকে যাও। ওর চেয়ে অদ্ভুত আর কিছু নেই।
— তাতে প্রেমের উপন্যাস লেখা হবে?
— আহা, তুমি ইনবক্সে কত মেয়ের সঙ্গে চ্যাট করো না? খুব সুন্দর একটা মেয়ে, ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে, তোমার খুব ভক্ত। পরে বুঝলে সে আসলে একটা ছেলে।… এরকম। চলবে না?
— আরে, না।
— তাহলে ধরো কারো সঙ্গে দেখা করতে গেলে…।
— সে বলল—তুমি খবরের কাগজ পড়ো।
সে আবারও বোঝার চেষ্টা করল, এই মেয়েটিই কি তানজিলা!
এই মেয়েটির চেহারার মধ্যে একইসঙ্গে স্নিগ্ধতা ও চটক আছে। হিসাবে মিলছে, তার ধারণা তানজিলার চেহারায় চটক, লাবণ্য, স্নিগ্ধতা সব মিলেমিশে থাকবে। ধারণা এরকম না হলে এ বয়সে সে এ মেয়েটার জন্য একঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করত না। বিশেষ করে বিকেলের দিকে এখানে এসে অপেক্ষা করাটা বেশ রিস্কি। সে বেশকিছুটা লজ্জায় আছে, এতক্ষণ অপেক্ষা করে সে কিছুটা বিরক্তও। এখানে, শাহবাগের এই বইয়ের মার্কেট আজিজে সে সাধারণত আসে না। আসে, খুব কম, পছন্দের বা প্রয়োজনীয় বই নজরে পড়লে একটা-দুটো কিনে নিয়ে যায়, আড্ডায় জড়ায় না। এখানে আড্ডা দেয় তার তুলনায় অনেক অল্পবয়সীরা, তার বয়সীরাও আছে; কিংবা তার চেয়ে বয়সে বড় যারা, তারাও। তারা আসে আড্ডা দিতেই। তরুণ লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া তাদের জন্য জরুরি। সে তেমন কোনো আড্ডায় আসে না, এটা প্রায় সবাই জানে, জানে বলে তার লজ্জা লাগছে, তার মনে হচ্ছে—তাকে এখানে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে দেখলে অনেকেই নিশ্চয় বুঝে ফেলবে সে আসলে এসেছে তানজিলা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে।
কিন্তু তানজিলা এমন জেদ ধরল—এই এখানেই সে দেখা করবে।
সে বলল—আহা…!
তানজিলা বলল—আহা তো তুমি আমাকে দেখে বলবে।
— তা-ই বুঝি? তা, কেন আহা বলব?
— আমাকে দেখলে তোমার অমন বলতে ইচ্ছে করবে।
— আচ্ছা, বলব, অনেকবারই না হয় বলব। কিন্তু তানজিলা, আজিজ বাদ দিলে হয় না?
— তোমার মাথা খারাপ!
— তোমার সঙ্গে পরিচয়ের পর মাঝে মাঝে অমন মনে হয়।
— ডাক্তার দেখিয়েছ?
— না। … তোমাকে দেখাব।
— দেখিও। এর চিকিত্সা আমি জানি।
— কিন্তু আজিজ বাদ দাও, প্লিজ।
— আবারও তাহলে বলতে হয়—তোমার মাথা খারাপ!
— ওখানে অনেক জুনিয়র…।
— লেখক?
— হুঁ।
— ওখানে আমার সঙ্গে তোমাকে কেউ দেখলে তোমার ইমেজ খারাপ হবে?
— না না, ঠিক তা নয়।
— তুমি তো লেখক, না?
— আমার অবশ্য অধিকাংশ সময়ই তেমন মনে হয় না। কী আর লিখি!
— হয়েছে। লেখক বলেই আমি তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি।
— জানি। বলেছ।… তোমার তরফ থেকে ব্যাপারটা যে এরকম, বুঝি।
— টের পাও আমাকে?
— হুঁ। খুব।
— তাহলে আমার সঙ্গে তোমাকে কেউ দেখলে দেখুক না! লজ্জা পাবে?
— আরে না, লজ্জা না। লজ্জা কীসের?
— ইমেজও নষ্ট হবে না, লজ্জাও পাবে না। তাহলে আসতে অসুবিধা কীসের?
— অসুবিধা কীসের।… সে ভাবতে গিয়ে বুঝতে পারছিল সে যুক্তিতে হেরে যাচ্ছে।
— তোমার সঙ্গে আমাকে কেউ দেখলে আমার খুবই গর্ব হবে। যদিও আমাকে কেউ চেনে না। না চিনুক। তোমার সঙ্গে থাকাটাই গর্বের।
তানজিলার সঙ্গে কথায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে আজিজে আসা। সে ঠিক করে রেখেছিল তানজিলার সঙ্গে দেখা হলে সে পাঁচ মিনিটের বেশি থাকবে না আজিজে। প্রথম দেখা, সুতরাং কয়েকটা বই সে কিনে দেবে তানজিলাকে। নিজের লেখা বই সে আনতে পারত। ভেবে, এই ইচ্ছা সে বাদ দিয়েছে, এটা কেমন কেমন যেন দেখাবে। তাছাড়া তানজিলার সঙ্গে কথা বলে তার ধারণা হয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য সব লেখাই তানজিলার পড়া। তার পড়া বই, তার কাছে আছেও নিশ্চয়, তাকে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। যদি এমন হয়, তানজিলা উত্সাহ দেখাল, বলল, তার নাম লিখে বই দিলে তার ভালো লাগবে, তবে অন্য কথা। আচ্ছা, এটা পরে দেখা যাবে। আপাতত সে যা করবে, তানজিলা এলে তাকে নিয়ে একটা চক্কর দেবে আজিজে, কেউ যদি দেখে—দেখবে, কোনো ভক্তের সঙ্গে সে হাঁটাহাঁটি করতেই পারে। চক্কর দেয়া শেষ হলে তানজিলার পছন্দমতো বই কিনবে, তারপর বলবে—চলো।
— আসলে অন্য কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। তানজিলা বরং বলে রেখেছে—এরকম—কী করব, জানো? তোমার আমার দেখা হলে?
— তুমি আর কী করবে! করব আমি।
— তুমি আবার কী করবে?
— তোমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকব।
— আচ্ছা, থেকো। কতক্ষণ পারো, দেখব।… তুমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কতদিন চা খাও না, এটা মনে আছে তোমার?
— একটুও মনে নেই।
— আজ খাবে। আমরা খাব। প্রথমে তোমাকে নিয়ে বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরব, তারপর চা খাব। ততক্ষণে একটু সন্ধ্যা হয়ে আসবে। তা-ই না?
— তা আসবে।
— তারপর তোমাকে নিয়ে চারুকলার সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসির দিকে চলে যাব। তারপর আরেকটু এগিয়ে বাংলা একাডেমির দিকে। ওখানে কোথাও তোমাকে নিয়ে ফুটপাথে বসে থাকব।
সর্বনাশ হতে পারে, সে বুঝল। তাই সে ঠিক করল, আজিজে দশ-পনের মিনিট কাটিয়ে সে খুব সহজ গলায় বলবে—চলো?
— কোথায়! চা খাবে না?
— কফি। ধানমন্ডির দিকে যাই।
— তানজিলা কফি খেতে ধানমন্ডির দিকে যাবে কি যাবে না, সেটা আসলে অনেক পরের ব্যাপার। তানজিলা এখনো যে এসে পৌঁছায়নি। সে এসেছে পাঁচটায়, ঠিক পাঁচটায়। তানজিলার অবশ্য আপত্তি ছিল—এই রোদের মধ্যে…।
— আমরা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকব না।
— তবু। গরম।
— শোনো, পাঁচটায় না এলে আমরা বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। তুমি কি এসে দেখা দিয়েই চলে যেতে চাও?
— কক্ষনো না।
— তাহলে ঠিক পাঁচটায়।
এখন ছটা বাজে। কয়েকবার মোবাইল ফোনে ফোন করেছে সে, রিং হয়েছে, কিন্তু কেউ ধরেনি। সে মেসেজ পাঠিয়েছে, মেসেজের রিপ্লাই আসেনি। প্রথমটায় নানারকম চিন্তা ছিল তার, এখন চিন্তা তার মোটামুটি একইরকম—তানজিলা মেয়েটা তার সঙ্গে মজা করছে। হয়তো এসেছে এখানে, একা কিংবা বন্ধুদের নিয়ে, দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। নিজেদের মধ্যে কী বলছে তারা, মোটামুটি আন্দাজ করা যায়।
— দেখেছিস, বারবার কেমন ঘড়ি দেখছে!
— ওশান ব্লু জিন্স প্ল্যান্ট আর টি-শার্ট পরে এসেছে। বেশ লাগছে।
— যা যা, তুইই যা তাহলে।
— হ্যাঁ, জিনিস তানজিলার আর যাব আমি! আমার যেন কম পড়েছে।
— কবিতা তো লেখেন না, তা, অমন কবি কবি দেখাচ্ছে কেন।
— ওই দেখ, রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল।
— আহা, কবিদের কি ঘাম মোছা মানায়!
— এখনো অভ্যস্ত হতে পারেনি। তানজিলার প্রতি গভীর প্রেম তাকে কবি করে দিয়েছে—এখন এই স্টেজে আছে।
— ঘটনা কি এরকম? আজিজের এদিক-ওদিক হাঁটতে হাঁটতে বার-দুই এটা ভেবেছে—সে কি প্রেমে পড়েছে তানজিলার? না হলে, তানজিলা একবার বলামাত্র তার এভাবে চলে আসার মানে কী! মেয়েরা যে এসব নিয়ে মজা করে, এমন না সে জানে না। তা হলে?
মেয়েটা তাকে নিয়ে মজা করছে, এমন চিন্তা, তার মাথায় যেমন এসেছে, আবার চলেও গেছে। তবে গেছে মানে, চলে যায়নি, আছে। তার মনে হচ্ছে, সে যতদিন কথা বলেছে তানজিলার সঙ্গে, কখনো তাকে ওরকম কিছু মন হয়নি। তার তানজিলাকে অন্যরকম মনে হয়েছে। একটু দুষ্টুমির স্বভাব তার আছে যদিও, একটু মজা করার, কোনো একটা নরম কথা বলে তার প্রতিক্রিয়া দেখার, তবু, এতকিছুর পরও মেয়েটা অন্যরকম। কীরকম—এটা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করলেই সে হরহর করে বুঝিয়ে বলতে পারবে না। সে এটুকুই শুধু বলতে পারবে—তানজিলা অন্যরকম।

তবে অন্যসব কথা বাদ দিয়ে এ মুহূর্তে কথা হচ্ছে—তানজিলা আসছে না কেন!

কোনো ঝামেলায় পড়েছে? ঝামেলায় পড়লে তাকে জানাতে পারত, কথা বলার অবস্থায় কোনো কারণে না থাকলে ছোট করে মেসেজ দিতে পারত।

এরমধ্যে পরিচিত দু’জনের মুখোমুখি হয়েছে সে। মাত্র লিখতে আরম্ভ করেছে, এমন একজন তাকে দেখে প্রায় ছুটে এলো—স্যার, আপনি….।

সে চিনতে না পেরে তাকিয়ে থাকল ছেলেটির দিকে।

— আমাকে চিনবেন না, স্যার। আমি লেখালেখির চেষ্টা করছি। আপনার সঙ্গে স্যার, আমার আগে একবার কথা হয়েছে।

সে হাসল—তা-ই? তোমার নাম?

ছেলেটা তার নাম বলল।

— হুম, মনে পড়েছে। ‘ছোটরা নদীতে যায়’ তোমার লেখা, না? ভালো লেগেছিল।

— আপনার মনে আছে! ছেলেটা হা হয়ে গেল। স্যার, আমাদের লেখা কেউ পড়তেই চান না।

সে হাসল—পড়ে। … আমি পড়ি।

এরপর ছেলেটা একটু জোঁক হতে চাইলে সে তাকে নিরুত্সাহিত করল—আমি একটু একা ঘুরব।

— নিশ্চয় নিশ্চয়, স্যার, … স্যার, আমি একদিন আপনার বাসায় যাব যদি অনুমতি দেন।

এরপর দেখা হলো সমবয়সী না হলেও ইয়ার্কি-ফাজলামো করা যায় এমন একজনের সঙ্গে—আরে, আপনি এখানে!

— আপনি এমনভাবে বলছেন, যেন এখানে আমার আসা নিষেধ।

— সে-রকম কিছুই না। দেখি না এদিকে, তাই বললাম।

— এলাম। নতুন বই কী এল, দেখব।… একজনের সঙ্গে দেখা করার কথাও আছে।

— মেয়ে ভক্ত?

সে হাসল, জিজ্ঞেস করল—আপনার খবর কী?

এখন সে এসে দাঁড়িয়েছে বাইরের দিকে। তার সামনে ব্যস্ত রাস্তা। যত গাড়ি, ট্যাক্সি, স্কুটার, রিকশা এসে থামছে, সে খুঁটিয়ে লক্ষ করছে। দূর থেকে কেউ তাকে নজরে রেখেছে কি না, এটাও সে খেয়ালে রেখেছে। কিন্তু কিছুই তার মনমতো কাজ করছে না।

সে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবল—চলে যাবে। এক ঘণ্টার বেশি হয়েছে। এখন তার বোঝা উচিত, তানজিলা আসবে না। এই যে সে দাঁড়িয়ে আছে, ক্যাবলার মতো—তার ধারণা, এর কোনো মানে হয় না। এদিকে আকাশও একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে। বৃষ্টি নামতে পারে। নামলে যা হবে, আশপাশের অনেক লোক বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে এখানে উঠে আসবে। ধাক্কাধাক্কি, গুঁতোগুঁতি ছাড়াও অনেক মানুষের ঘামের গন্ধ তাকে বিরক্ত করবে। সে-বিবেচনায় এখনই উপযুক্ত সময় সরে পড়ার। কিন্তু তানজিলা যদি এসে পড়ে তার চলে যাওয়ার পরপরই, পরে যদি তাকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে—ঝামেলা কতরকম থাকতে পারে, তা-ই না? তুমি আরো কিছুটা সময় আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারলে না!

— আরো কিছুটা সময়! এক ঘণ্টার বেশি সময়কে তুমি আরো কিছুটা সময় বলবে?

— তুমি… আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?

— করছিলাম।… এক ঘণ্টার বেশি করেছি, তানজিলা। তুমি অনন্তকাল আমাকে অপেক্ষায় রাখতে পার না।

— কে বলল! পারি।

তানজিলা এভাবে ‘পারি’ বললে অসুবিধা হয়ে যাবে। সে না পারবে পক্ষে বলতে, না পারবে বিপক্ষে। শেষপর্যন্ত তাকে হয়তো পক্ষেই বলতে হবে—হ্যাঁ, পার। কিন্তু তাই বলে…!

— তাই বলে কী?

— নিজেই বুঝতে পারছ।

— জীবনে অপেক্ষা একটা বড় ব্যাপার, না?

— ও কথা আমিই তোমাকে বলেছিলাম।

— হ্যাঁ, তুমিই বলেছিলে, তোমার কাছ থেকে শুনেছি। তারপর ব্যাপারটা আমার ভেতর থেকে গেছে। আমি ভাবতে ভাবতে বুঝেছি—জীবনে অপেক্ষা একটা বড় ব্যাপার।… আর, এদিকে, তোমার অপেক্ষার মেয়াদ এক ঘণ্টা।

— ঠিক না।

— ঠিক। তুমি কি জানো, তুমি চলে যাওয়ার পরপরই আমি এসেছিলাম?

— তা-ই কি?

— হ্যাঁ, আমি যখন রিকশা থেকে নামছি, দেখলাম তুমি তখন গাড়িতে উঠছ। তখন আর তোমাকে থামানোর উপায় নেই।

— তুমি সেদিন আমাকে কল করতে পারতে।

— আমি ইচ্ছে করে তোমাকে কল করিনি।

— এটা কেমন কথা!

— তোমাকে বুঝতে হবে তুমি চলে যাচ্ছিলে।

— তো?

— চলেই যখন যাচ্ছিলে, কল করব কেন!

— তোমার ফোনও কিন্তু বন্ধ ছিল।

— এখন নানা মিথ্যা বলতে পারি। যেমন, বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ফোন খুঁজে পাচ্ছিলাম না, হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিংবা, রিকশায় ওঠার সময় ফোন ছিনতাই হয়ে গেল। কিন্তু আমি ওসব কিছু বলব না। ফোন আমিই বন্ধ করেছিলাম। ঠিক করেছিলাম, একদম তোমার কাছে পৌঁছে ফোন অন করব।… তুমি আমার দিকে অমনভাবে তাকিয়ে আছ কেন! আমি কিন্তু সত্যি কথা বলছি।

— আমি কি একবারও বলেছি, তুমি মিথ্যা বলছ?

— না, বলোনি। কিন্তু তোমার তাকানোর ভঙ্গি ওরকম।

— ভেবে বলছ?

— শোনো, আমি মিথ্যুক না।

তানজিলা মিথ্যুক কি-না, এটা তাকে কিছুটা হলেও চিন্তায় ফেলেছে। তানজিলার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম কয়েকটা দিন তার সন্দেহ ছিল, সে সন্দেহ চলে গেছে, আজ বিকাল পর্যন্তও সেটা আর ফিরে আসেনি, এলে সে আজিজে এসে দাঁড়িয়ে থাকত না। তবে, এখন তার একটু একটু সন্দেহ হচ্ছে—কেউ বোকা বানাল কি?

সে একটু গুছিয়ে ভাবতে চাইল—কে, কে কে তাকে বোকা বানাতে পারে। সে একটা নামও খুঁজে বের করতে পারল না। ভাবল, বোকা তাকে অনেকেই বানাতে পারে। একটু মজা করল তার সঙ্গে, পরে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে হাসাহাসি করবে, হয়তো এক মুখ থেকে আরেক মুখ—এভাবে ছড়িয়েও পড়বে…। তাকে পছন্দ করে না, এমন লোকের সংখ্যা কম নয়, তারা কেউ বা কয়েকজন মিলে এমন মজা করতেই পারে। আবার, তার ঘনিষ্ঠ কেউ হতে পারে। পরে হয়তো বলবে—দোস্ত, ফেসবুকে আলাপ, একটু না হয় খুনসুটিও, তারপর তোকে ফোন করল, আর তুই চলে গেলি! উচিত হয়নি।

— সমস্যা হচ্ছে, এরকম মাঝেমাঝে ভাবছে বটে সে, এরকম ভাবনায় সে স্থির হতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে না তানজিলা মিথ্যা। তার মনে হচ্ছে না তানজিলা নামে কেউ নেই, তার মনে হচ্ছে না তানজিলাকে কেউ বানিয়ে তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাহলে তানজিলা কি সত্যি?

— সত্য। সে বলল।

— তা হলে কোথায় সে?

— আছে।

তানজিলাও তাকে একদিন এই কথা বলেছিল—কখনো ভেবো না আমি নেই।

— ভাবব না। কেন আমি ওরকম ভাবতে যাব!

— ভাবতে পার।… মানুষ অনেককিছু ভাবে।

— আমি তোমাকে নিয়ে ওরকম কিছু ভাবছি না।

— ভাববে না। দেখা হবে আমাদের।… খুব শিগগির।

— দেখা কিন্তু আমরা আরো শিগগির করতে পারি।

— দেখা করার কথা আমিই বলেছি। না?

— তুমিই বলেছ।

— আমি সময় নিচ্ছি একটু। একদিন কথা হলো, পরদিন দেখা হলো—এমন হলে আমাকে তুমি অনুভব করতে পারবে না। কিছুদিন যাক।

— যাক তাহলে। তুমি যখন বলছ।

— আরেকটু থিতু হই আমরা।

— তুমি এলোমেলো?

— বেশ।… তুমি?

— দেখলে বুঝবে, লেখকরা এমনিই এলোমেলো।

— আমি কখনো এলোমেলো ছিলাম না। আমি হলাম।

— আমি করতে চাইনি। স্যরি স্যরি।

— স্যরি কেন!

— আমি ধরেই নিয়েছি আমি তোমাকে এলোমেলো করেছি।

— আর কে!

— আমি?

— চুপ! … আমাকে নিয়ে লিখবে?

— জানি না। মাঝেমাঝে মনে হয় কিছু কিছু বিষয় ব্যক্তিগত থেকে যাক।

— হুম।… এই প্রশ্নটা আমি আবার তোমাকে করব। কিছুদিন পর।

— কোন প্রশ্ন?

— এই যে, আমাকে নিয়ে লিখবে কি না। তখন কী উত্তর দাও দেখব।

সে ছোট করে আড়মোড়া ভাঙল। মাঝেমাঝে তার খুব বড় করে আড়মোড়া ভাঙতে ইচ্ছে করে। খুব বড় আর শব্দ করে। বাসায় থাকলে কখনো অমন করেও সে। এখন অমন একটা শব্দ আর আড়মোড়ার খুব ইচ্ছা জেগেছে তার। শব্দে সবাই যদি ফিরে তাকায়, তাকাবে, সে মিস্টার বিনের মতো একটা হাসি দেবে, সবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়বে। তা, এখন তাহলে ভাঙবে অমন একটা আড়মোড়া? তানজিলা তার ভেতর এক অবসাদ তৈরি করেছে। তানজিলা করেছে, কিংবা, তানজিলার জন্য তার এই যে অপেক্ষা, অবসাদ সে কারণে। দেখা হলে তানজিলাকে বলতে হবে—কোথায় তুমি আমার অবসাদ দূর করবে…!

— দূর করিনি?

— কোথায় তুমি আলো হয়ে থাকবে…!

— থাকিনি?

— কোথায় তুমি আমার সব অবসাদ দূর করে দেবে…!

— আহা, বললে একবার। করিনি!

— আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। তারচেয়ে বরং দেখা হওয়াটা অন্যভাবে হলে ভালো হতো।

— কী রকম?

— তুমি থাকতে কোথাও অপেক্ষায়, আমি যেতাম।

— তা-ও হতো। হতে পারত।

— আমি যেতাম আর ভাবতাম, আমি আমার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি।

— তা-ই? আমি তোমার গন্তব্য?

সে ছোট করে আরেকটা আড়মোড়া ভাঙল, পাশ ফিরল, মেয়েটিকে দেখতে পেল। তার মনে হলো—এই মেয়েটিই কি তানজিলা? তার মনে হলো—এই মেয়েটিই। সে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে, মেয়েটির মুখে সামান্য হাসি, খুব সামান্য, খুব হালকা প্রলেপের মতো। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হলো, এই মেয়েটিই তানজিলা। না হলে মেয়েটির মুখে এই সূক্ষ্ম হাসি থাকত না, তাকিয়েও থাকত না তার দিকে।

সে দু-সেকেন্ডের জন্য চোখ ফিরিয়ে নিল, তারপর, যেন ওপাশে কিছু দেখল, এভাবে সে আবার মেয়েটির দিকে তাকাল। সে দেখল মেয়েটি যেন ইতস্তত করছে কোনো এক বিষয়ে। এটা তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলল। তানজিলার কি আদৌ ইতস্তত ভাব থাকার কথা? যুক্তি বলে—থাকার কথা না। তাকে তানজিলার চিনতে না পারারও কথা না। তার ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়, বইয়ের ফ্ল্যাপে থাকে, সে টেলিভিশনে যায়। ইতস্তত ভাব থাকলে, তার থাকবে—কারণ সে তানজিলাকে সেভাবে দেখেনি, ফেসবুকে তানজিলার একটা স্পষ্ট ছবিও নেই। কোনোটায় মুখ ফেরানো, কোনোটায় আকাশের দিকে তাকানো, কোনোটায় সে মুখ নিচু করে আছে, কোনোটায় সে কাঠামো ঠিক রেখে ঝাপসা। সে নিজেই বলেছে, সে অস্পষ্ট, ঝাপসা থাকতে পছন্দ করে। আর, তানজিলা না বললেও, এটুকুও সে বুঝেছে, তানজিলা চমক পছন্দ করে। চোহরায় এই যে সে একটু ইতস্তত ভাব এনেছে, তা সম্ভবত তার সঙ্গে মজা করার জন্য।

এরকম ভেবেও, সে কী করবে বুঝতে পারল না।

যদি এ মেয়েটিই জানজিলা হয়, পরে নির্ঘাত্ তাকে খেপাবে—হু, খুব বলেছিলে আমাকে দেখলেই নাকি চিনে ফেলবে।

— ফেলিনি?

— কতক্ষণ সময় নিয়েছিলে?

— তুমি ইচ্ছা করে অন্যরকম হওয়ার চেষ্টা করছিলে।

— সেটা পরীক্ষা, পরীক্ষায় তুমি ফেল।

— আমাকে পুরো বিভ্রান্ত করে আমাকে ফেলটুশ বানিয়ে দিলে।

— আমার ব্যাপারে তোমার ভেতরে কখনো কোনো বিভ্রান্তিই কাজ করবে না, সবসময়ই এরকম হওয়া উচিত।… তোমার ভেতর বিভ্রান্তি কাজ করেছে।

সে ভাবল, তানজিলা পরে যেন এরকম কিছু বলতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সে অবশ্য নিজেও চায় না তানজিলার ব্যাপারে তার ভেতর কোনো বিভ্রান্তি কাজ করুক। এর জন্য আপাতত প্রয়োজন—এই মেয়েটি তানজিলা কি তানজিলা না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া।

তা, সহজ কোনো উপায় আছে নিশ্চিত হওয়ার?

সে কি একটু হাসবে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, এমন একটা হাসি, যার অর্থ—লাভ নেই, বুঝে ফেলেছি।

মেয়েটি তানজিলা না হলে একটা সমস্যা, হাসির কী কারণ—মেয়েটি ভাববে। এমন হতে পারে মেয়েটা তাকে চেনে, অনেকেই তাকে চেনে—এটা ব্যাপার না, তবে, সেক্ষেত্রে তার হাসি মেয়েটার কাছে বেমানান ঠেকবে, উপায় নেই, একটু রিস্ক বোধহয় নিতেই হবে।… কিছু জিজ্ঞেস করবে সে?

কী জিজ্ঞেস করা সে-ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে এল—আমি কি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

— ঢঙ! সে মনে মনে বলল। এই মেয়েটি যে তানজিলা, সে নিশ্চিত, এবং এ-ও সে বুঝতে পারছে তানজিলা তার সঙ্গে মজা করার পরিকল্পনা করেছে।

—হ্যাঁ, সে বলল। নিশ্চয় বলতে পারেন।

— আমি ভুল না করলে—আপনি একজন লেখক।

সে উত্তর না দিয়ে পরের কথা শোনার অপেক্ষায় থাকল।

— অবশ্য আমার ভুল করার কথা নয়।… মানে, আপনি যে একজন লেখক এটা আমার ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।

সে ঠিক বুঝতে পারল না, তানজিলা কোন পথে এগোচ্ছে। তার কী ধরনের ভাব নেওয়া উচিত, সেটাও সে বুঝল না। সে শুধু একটু হাসল—অদ্ভুত কথা!

— কোনটা?

— এই যে বললেন—আমি লেখক, এখানে আপনার ভুল করার সুযোগ নেই।

— নেই।… আপনার অবশ্য সহজেই আমাকে চিনতে পারার কথা না। মনে করতে পারলে বুঝতেন, আমার কথায় কোনো ভুল নেই।

— শোনো, তুমি একঘণ্টা দেরি করে এসেছ। সে হিসেবে তোমাকে আমার চিনতে না পারারই কথা, তা-ই না?

মেয়েটিকে অবাক দেখাল—জি…?

মুহূর্তের মধ্যে তার মনে হলো, এই মেয়েটি তানজিলা না। কেন তার এরকম মনে হলো, তা সে বুঝল না, কিন্তু তার অমনই মনে হলো। সে বলল স্যরি, আমি আপনাকে তানজিলা ভেবেছিলাম।

এরকম বলে সে নিজেকে গর্দভ বলে গালি দিল। তানজিলার নাম উল্লেখ কি আদৌ দরকার ছিল? সে কারো নাম উল্লেখ না করেও কথাটা বলতে পারত।

মেয়েটি জিজ্ঞেস করল—তানজিলার জন্য অপেক্ষা করছেন?

সে মনে মনে বলল—এটা তোমার জানার কী দরকার!… এভাবে বলা যায় না, সে তাই সামান্য মাথা ঝাঁকাল।

মেয়েটিকে বেশ উত্সাহী দেখাল—তানজিলা আপনার কোনো গল্পে আছে?

— মানে!

— গল্পটার নাম কী?

— কোন গল্পের নাম!

— যেটায় তানজিলা আছে?

— তানজিলা আমার গল্পে আছে, এটা আপনাকে কে বলল!

— ওহ! মেয়েটি হাসল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম তানজিলা কোনো গল্পের।… স্যার, এখন কি আপনি আমাকে চিনতে পারছেন?

তার মনে হলো এ এক ঝামেলা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ থাকে এরকম, এমন ভাব—যেন চিনতেই হবে। হয়তো চার বছর আগে কোনো বিয়েবাড়িতে কেউ পরিচয় করিয়ে দিলে দু’মিনিট কথা হয়েছিল, সেই ধরে বসে আছে।… সে দু’পাশে মাথা নাড়াল, না, সে চিনতে পারছে না।

— আমার নাম মেহের। মেয়েটির মুখে সামান্য হাসি।

— হ্যাঁ, আপনি আপনার নাম বললেন মেহের, আর আমি চিনে সারা হলাম—সে মনে মনে বলল।

মেয়েটি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল—চিনতে পারেননি, বুঝতে পারছি। আসলে এতজনের মধ্যে মনে রাখার কথাও হয়তো নয়।

— আপনার সঙ্গে আমার কোথায় দেখা হয়েছিল?

— শাফিনের কথা মনে আছে আপনার?

— শাফিন?… তার একবার মনে হলো এই মেয়েটি তার স্ত্রী সায়রার দিককার আত্মীয়। বছর দুয়েক আগে সায়রার জেদাজেদিতে ওর এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছিল, ছেলে আর মেয়ে তার দু’পাশে বসে ছবি তুলেছিল, এই মেয়েটি সেই মেয়েটিই হতে পারে। হতে পারে যখন, নাও হতে পারে। তাই সে মৃদু হাসল—দেখুন, আমি ঠিক চিনতে পারছি না। লজ্জাই লাগছে…।

সে বলল ও মেয়েটিকে ডিঙিয়ে সামনের দিকে তাকাল—তানজিলা চলে আসেনি তো?

তাকে অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখলে তানজিলা সহজভাবে নেবে না, সে জানে তানজিলা বলেছে তাকে—একটা কথা তোমার জেনে রাখা দরকার। কখনো যদি দেখি বিনাকারণে তুমি অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েছ, আমি তোমার চোখ উপড়ে ফেলব।

— একদম উপড়েই ফেলবে?

— আমি থাকতে তোমার অন্য কারো দিকে তাকাতে হবে কেন?

— তা-ও ঠিক। তোমাকে দেখাই মানে যাবতীয় দেখা।

— মনে রাখবে। আর, খামাখা কথাও বলবে না কারো সঙ্গে। আমার সঙ্গে কথা বললে তোমার আর কিছু বলার থাকবে না।

তানজিলা কিংবা তানজিলার মতো কাউকে দেখা গেল না। সে ফিরল মেয়েটির দিকে। মেয়েটি বলল—আমাকে আর শাফিনকে নিয়ে আপনি একটা গল্প লিখেছিলেন।

— গল্প! সে অবাক হলো। আপনাকে আর শাফিনকে নিয়ে!

— অবাক হচ্ছেন কেন! আপনি গল্পই লেখেন। নাকি?

— না না, সে ঠিক আছে।

— গল্পের নাম ছিল ‘ইচ্ছা’।… আপনার কি মনে পড়েছে?

তার মনে পড়ল না। সে অবশ্য মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু মনে করতে পারল না। এমন হওয়ার কথা না। সে প্রায় সবসময়ই তার নিজের লেখা গল্পের কথা মনে করতে পারে। এখন মেয়েটা বলছে, অথচ সে মনে করতে পারছে না, এটা কি তানজিলা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বলে? সে হাসার চেষ্টা করল—এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না, কিন্তু একটু পরেই হয়তো মনে পড়বে।

— গল্পটা অনেকেই খুব পছন্দ করেছিলেন।

এই কথার পিঠে তার কিছু বলার নেই। সে শুধু হাসল।

— ওই গল্প নিয়ে আমার আর শাফিনের খুব খুনসুটি হতো।… এখনো হয়। আমি হয়তো বললাম—এই গল্প উনি আমাকে নিয়ে লিখেছেন, শাফিন সঙ্গে সঙ্গে বলবে—উঁহু, আমাকে নিয়ে।

সে আবারও একটু হাসল ও প্রাণপণ চেষ্টা চালাল গল্পটা মনে করার। এবারও সে পারল না। একটু মাথা চুলকানোর ভঙ্গি করল—গল্পটার নাম ইচ্ছা। না?

— জি। ইচ্ছা।

— গল্পটা কি আমি আপনার, বা কী যেন নাম বললেন…!

— শাফিন। শাফিন ছিল গল্পের নায়ক। ও তো বলে, ওই গল্পে ওই সব।

— একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না। গল্পটা, মানে ওই গল্পটা কি আপনার বা শাফিনের মুখ থেকে শুনেছিলাম, নাকি আপনাদের পরিচিত কারো মুখ থেকে?

প্রশ্নটা করে সে নিজের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। সে কি কখনো অন্যের মুখে কিছু শুনে গল্প লিখেছে! বরং অন্য কেউ ‘গল্প’ শোনাতে এলে সে বরাবরই নিরুত্সাহিত করেছে। হ্যাঁ, এমন হয়, কখনো কোনো গল্পে নিজের বা অন্যের কোনো ঘটনা বা কোনো পরিচিত চরিত্রের কিছুটা পরোক্ষভাবে ঢুকে পড়ে, তাই বলে—পুরো গল্প! কখনো না। তাহলে কেন সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করতে গেল—ওর বা শাফিনের মুখ থেকে শুনে সেই গল্প লেখা কি না।

মেয়েটিকেও খুব অবাক দেখাল—না স্যার, তা হবে কেন!

— তাহলে?

— তাহলে কী, স্যার?

— আমি কি চিনতাম আপনাদের?

— আমাদের? মেয়েটি একটু ভেবে নিয়ে মাথা নাড়ল—নাহ, আমাদের নিয়ে লেখার আগে নিশ্চয় আমাদের চিনতেন না।

— সে বিব্রত বোধ করল।

— তবে এমন হতে পারে, আমাদের মতো কাউকে আপনি চিনতেন, বা তাদের কথা শুনেছিলেন, সেখান থেকে গল্পটা এসেছে।

— তাহলে আপনারা কারা?

— মেয়েটি অবাক হয়ে গেল—আমরা দুজন স্যার আপনার গল্পের নায়ক-নায়িকা।… স্যার, আপনি অবাক হচ্ছেন কেন!

— আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না, মাথায় ঢুকছে না, সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, তাই অবাক হচ্ছি।

মেয়েটি হেসে ফেলল—স্যার, একবার এক সাহিত্য সম্পাদক খুব করে ধরলেন আপনাকে তার পাতায় একটা গল্প দেওয়ার জন্য।

সে মাথা ঝাঁকাল—বুঝলাম, কিন্তু এরকম লেগেই আছে।

— তার চাপে, সে আপনার প্রিয়জনও বটে, অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আপনি একটি গল্প লিখে ফেললেন। গল্পের নাম, ইচ্ছা। আর, গল্পের যে নায়িকা, সে হচ্ছি আমি।

সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকল।

— স্যার, আমি কিন্তু সত্যি বলছি।

— সেই গল্পের নায়িকা আপনি!

— জি।

— আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন?

— জি।… তবে, এভাবে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, কখনো ভাবিনি।

সে অসহায় বোধ করল।

— কখনো কখনো মনে হয়েছে যাই আপনার কাছে, দেখা হোক। শাফিনের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা হয়েছে অনেক। আমাদের দুজনেরই কিছু কথা তো বলার আছে। কিন্তু স্যার, আপনার কাছে ইচ্ছা করলেই যাওয়া যায় না।… এখন স্যার, আমার সত্যিই খুব ভালো লাগছে।… আপনি কেমন আছেন?

দুই

বাড়ি ফিরে সে গল্পটা খুঁজে বের করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বাড়ি অবশ্য সে তখনই ফেরেনি। স্যার, আপনার অসুবিধা না থাকলে খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেখা হবে—এই বলে মেহের বিদায় নেওয়ার পর সে অনেকক্ষণ ওই ওখানেই দাঁড়িয়েই ছিল। তানজিলা আসবে কি আসবে না—এই চিন্তাটা তার মাথায় ছিল না। তানজিলার কথা তার মনে হয়নি, এমনও অবশ্য নয়। একবার সামান্য সময়ের জন্য এমনও তার মনে হয়েছে—সম্ভবত তানজিলাই অমন অভিনয় করে গেল। মজা আর কি। পরে তাকে খোঁচাবে—দেখেছ, আমার ক্ষমতা দেখেছ! তুমি কিছুই বুঝতে পারলে না।

তানজিলার সঙ্গে তার পরিচয় ফেসবুকে। তার নিজের নামে পেজ আছে। সেখানে সে তার বইয়ের খবরাখবর দেয়, লেখালেখির কথা বলে। কে তার কোন বইয়ের কোন লেখার কী প্রতিক্রিয়া জানাল—তার অপেক্ষায় থাকে। ওখানে ইনবক্স আছে। অনেকেই মেসেজ পাঠায়। অধিকাংশই জানতে চায়, সে নতুন কী লিখছে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, অমুক বইটি কোন প্রকাশনীর, সামনের মেলায় নতুন কী আসবে, অনেকদিন কেন তার গল্প দেখা যাচ্ছে না, এসব।

এই ইনবক্সে একদিন তানজিলার মেসেজ এলো—স্যার…।

এই মেসেজের কি কোনো উত্তর হয়! কী বলবে সে। কিছুই জানতে চায়নি মেয়েটি। আর, মেয়ে কি না, সে ব্যাপারেও নিঃসন্দেহ হওয়া যাচ্ছে না, নাম মেয়ের, সঙ্গে ছবি যেটা, সেটাও মেয়ের, তবে পাশ থেকে এমনভাবে তোলা, শুধু কাঠামো বোঝা যাচ্ছে তার, চেহারার কিছুই না। সে মেয়েটির প্রোফাইলে গেল, তেমন কিছুই নেই। কিছু কিছু কবিতার লাইন, কখনো কিছু গদ্যাংশ, কবিতার লাইন বা গদ্যাংশ সবই বিখ্যাত লেখকদের। হোক, সে তানজিলা নামের মেয়েটির মেসেজ সিন করে রেখে দিলো।

পরদিন আবার মেয়েটির মেসেজ এল—স্যার…।

সে তখন তার পেজেই, এবার উত্তর দিলো—জি, বলুন।

— আপনার লেখা ভালো লাগে।

— আচ্ছা, (হাসির ইমো) ধন্যবাদ।

— একটু বেশিই ভালো লাগে।

— আবারও ধন্যবাদ। (এবার হাসির দুটো ইমো।)

— সব পড়েছি, এমন বলব না, তবে অধিকাংশই পড়েছি।

— শুনে ভালো লাগছে।

— একটা কথা বললে রাগ করবেন?

— শুনি।

— বুঝতেই পারছেন, আমি আপনার ভক্ত। আমি যদি মাঝে মাঝে এখানে আপনার সঙ্গে কথা বলি, বিরক্ত হবেন?

— না, না, তা কেন হব! তবে এখানে আমি খুব একটা আসি না।

— মাঝে মাঝে আসেন। সে সময়ে যদি কথা বলি, মানে মেসেজ…।

— না, বিরক্ত হব না।

— অনেক ধন্যবাদ।

— জানতে পারি, আপনি কে?

— আপনার ভক্ত।

— সেটা পরিচয় হতে পারে না।

— আমি তানজিলা।

— এ নামটা দেখতে পারছি। তবে তানজিলা যে কেউ হতে পারে।

— তা পারে। … আমি ঢাকা শহরেই থাকি। পড়াশোনা শেষ হয়নি। প্রচুর বই পড়ি।

— এটুকু?

— আপাতত।… আপনার অনুমতি নিলাম না—মাঝে মাঝে কথা হওয়ার—তখন সবই জানা যাবে।… আপনার ধারাবাহিক ‘অপার’ শেষ হবে কবে? মনে হচ্ছে, অনেক বড় ক্যানভাস।

— হ্যাঁ, সম্ভবত বেশ বড় হবে।… আরেকটা কথা…।

— জি?

— আপনার সবগুলো ছবিই অমন কেন, স্পষ্ট করে কোনোটাতেই কেন আপনার চেহারা বোঝার উপায় নেই?

— এটা হয়তো খেয়াল আমার। কিংবা হয়তো কোনো কারণ আছে।… বলব।

মাঝখানে সে নির্ভেজাল প্রেমের উপন্যাস লেখার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। এই নিয়ে সায়রার সঙ্গে তার কথা হয়েছিল। সায়রা, সে যখন বলেছিল—সে অদ্ভুতুড়ে এক প্রেমের উপন্যাস লিখতে চায়, উত্তরে বলেছিল—তাহলে ফেসবুকে যাও, ফেসবুকের চেয়ে অদ্ভুত আর কিছু নেই।

এই তানজিলার সঙ্গে সপ্তাহ দুয়েক কথা বলার পর মনে হলো—ফেসবুকের চেয়ে অদ্ভুত জায়গা সত্যিই আর কিছু নেই। নইলে, যে তানজিলা সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না, তার সঙ্গে এত অল্পসময়ে এমন এক নৈকট্য তৈরি হয় কীভাবে! সে ইনবক্সে তানজিলাকে জিজ্ঞেস করল—ব্যাপারটা খুব অবাক করা না?

পাল্টা প্রশ্ন এল—কীরকম?

— এই যে কোথায় ছিলাম আমি…!

— আহা! তুমি তো ছিলেই…।

সে সময়ের কিছুদিন আগেই তারা পরস্পরকে ‘তুমি’ সম্বোধন শুরু করেছে। প্রস্তাবটা তানজিলার, ইচ্ছাটা তার। দু-চারদিন কথা বলার পর তার মনে হলো, মেয়েটির বয়স কম, তার প্রতি ভক্তিও অগাধ বলেই মনে হয়, তো, একে আপনি আপনি করে বলার কী দরকার! তবে প্রস্তাবটা সরাসরি দিতে তার লজ্জা লাগল। এভাবে কি সরাসরি বলা যায়—তোমাকে তুমি করে বলব, হ্যাঁ?—তার মনে হলো—না। অবশ্য কিছুই না করে তুমি তুমি করে লিখতে শুরু করে দেওয়া যায়। তবে সে সে-পথেও হাঁটল না। সে একদিন ইচ্ছে করে দু’বার ‘তুমি’ করে লিখল, তার পরপরই লিখল—‘স্যরি, আপনি’। তৃতীয়বারের বার তানজিলা বলল—বলি, তুমি করে বলতে নিষেধ করেছে কে!

— না না, নিষেধ করবে কে!

— তা হলে অত কাটাকাটির কী দরকার!

— এমনিতে ধরো, অসুবিধার কিছু নেই। তবে আমাদের পরিচয় বেশিদিনের নয়।

— অনন্তকালের।

সে মুচকি হাসির ইমো পাঠাল।

— সুতরাং আপনি আমাকে তুমি করে বলতেই পারেন।

— পারি, মনে হচ্ছে।

— দ্বিধা থাকলে বলি—আপনার কাছ থেকে তুমি সম্বোধন আমি ডিজার্ভ করি।

— তা-ই? (সঙ্গে ভুরু কোঁচকানো ইমো)।

— হ্যাঁ, সুতরাং তুমি করে।

— বেশ, তুমি করে।

পরদিন তানজিলা বলল—আমার একটা কথা ছিল।

— অপেক্ষা করছি।

— আমিও তোমাকে তুমি করে বলব।

একটুস সময় নিল সে—এ তো ভালো কথা…।

— তুমি যদি ভাবো আমি বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাচ্ছি…।

— আমি মোটেও সেরকম কিছু ভাবছি না।

— কথা শেষ করতে দাও। তুমি যদি ভাবো আমি বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাচ্ছি, তবে তোমার ভাবনা ভুল।

— আমি কিছুই ভাবিনি, আমি খুশি হয়েছি।

— আমি বয়সে ছোট। বেশ ছোট। তা হলে কেন তোমাকে তুমি করে বলব?

— আমরা বন্ধু বলে।

— উঁহু। তোমাকে তুমি করে বলব সম্মানের জায়গা থেকে। একজন যখন অনেক বেশি সম্মান অর্জন করে ফেলে, তখন তাকে সম্মান জানিয়েও তুমি করে বলতে পারি।

— বেশি বেশি বলছ। আমি মোটেও অতটা নই। আমরা বরং বন্ধু…।

— অবশ্যই আমরা বন্ধু। তবে তারও আগে আমার ওই কথা।

— বেশ, সে তোমার ব্যাপার। আমি কিছু বলব না।

এরপর সে একদিন বলল—ব্যাপারটা খুব অবাক করা না—আর, তানজিলা প্রশ্ন করল—কীরকম? সে বলল—এই যে কোথায় ছিলাম আমি… উত্তরে জানজিলা বলল—আহা, তুমি তো ছিলেই। সে তখন বলল—আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি।

— কোথায় ছিলে তুমি আর কোথায় ছিলাম আমি, এই তো বলবে ভেবেছিলে।

— বুঝে ফেলেছ!

— অবাক হচ্ছ! এটা বোঝার জন্য বেশি বুদ্ধিমান হতে হয়?

— না, এটা বোঝার জন্য অল্প বুদ্ধি দরকার।… তোমার বুদ্ধি অনেক।

— অনেক না, আবার কমও না।

— এটা আমার খুব ভালো লাগে।

— কোনটা?

— তোমার বুদ্ধির ব্যাপারটা।

— আচ্ছা, বুঝলাম। এখন বলো কী বলছিলে…।

— পুরনো কথা। পুরনো কথাই আবার বলছিলাম—আমরা দুজন কে কোথায় ছিলাম…।

— আমার সেরকম লাগে না…।

— কেন! তার ভুরু কুঁচকে ছিল।

— কেন, জানি না। তবে আমার কাছে স্বাভাবিক লাগে। যেন এমনই হওয়ার কথা ছিল।

— আমার রূপকথা রূপকথা লাগে…।

তানজিলা হাসতে আরম্ভ করেছিল।

— হাসি পাওয়ার মতো কিছু কি বলেছি আমি?

— মনে হচ্ছে যখন, একটা রূপকথা লিখো। একালের রূপকথা।

— লিখব।… রূপকথা কেন বলি, জানো? আরো বলি এ কারণে যে—তুমি দেখতে কেমন, সে সম্পর্কে আমার ধারণা নেই।

— আমি দেখতে একদম আমার মতো।

— খুবই আশ্চর্যের কথা!

— খুবই…। শোনো, আমার নাক খাড়া…।

— হুমম…।

— ঠোঁট পাতলা…।

— আহা তানজিলা, একটা ছবি দিলে কী হয়!

— অনেক ছবি আছে প্রোফাইলে।

— একটাও স্পষ্ট নয়। আবার কোনোটা মুখ ফেরানো…।

— তুমি লেখক, তুমি স্পষ্ট করে নাও না…।

— সে তো নিয়েছিই কিছুটা। তবু…।

— এক কাজ করি বরং। আমার ফোন নাম্বার তোমাকে দেই। এই মেসেঞ্জারেই অবশ্য কথা বলা যায়। কিন্তু ব্যবস্থাটি আমার পছন্দ নয়। আমি সেল নাম্বার দিচ্ছি। তুমি যখন ইচ্ছে আমাকে ফোন করতে পারবে, আমার অসুবিধা নেই। দেখা যাক, কথা বলে তোমার সুবিধা হয় কি না।

— সুবিধা হয় কি না! কী ধরনের সুবিধার কথা তুমি বলছ?

— ধরো, আমার সঙ্গে কথা বলে তুমি আমার চেহারা সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পার কি না।

— পারা যাবে?

— সেটা নির্ভর করছে তোমার ওপর। দেখো চেষ্টা করে।

সে বলল—দেখি।

তারা কথা বলল বেশ কয়েকবার। ওটা একটা বড় সুবিধা—তানজিলাকে যেকোনো সময়ই ফোন করা যায়। সে হয়তো রাত বারোটায় ফোন করল—হ্যালো।

— এত রাতে কী হলো!

— কিছু না। শুধু একটু হ্যালো বলার ইচ্ছা হলো।

— কথা বলে যা হলো, তানজিলা সম্পর্কে তার জানার পরিধি বাড়ল। তার মনে হলো মেয়েটাকে সে ইনবক্সের চেয়ে অনেক বেশি বুঝতে পারছে। তবে সবসময় ফোনে কথা বলা তার পক্ষেই সম্ভব না, সুতরাং সে ইনবক্সে তানজিলাকে বলল—ফোনে কথা বলার একটা বড় সুবিধা কী, জানো?

— নাহ, জানা হয়ে ওঠেনি।

— কথা বললে আরো বেশি অনুভব করা যায়।

— আচ্ছা! তাহলে তুমি আমাকে আগের চেয়ে বেশি অনুভব করছ?

— আমার তেমনই মনে হচ্ছে।

— আমার সম্পর্কে দু-চারটে মতামত দাও দেখি।

— এই যেমন তুমি বুদ্ধিমান।

— এ তুমি আগেই বলেছ।

— তোমার গলা একটু ভাঙা ভাঙা।

— এ কথা বললে যে কেউ মনে করবে।

— হুমম। তুমি একইসঙ্গে স্থির ও চঞ্চল।

— তা-ই? এটা নিয়ে ভাবতে হবে।

— তোমার রসবোধ দারুণ…।

— আর?… দাঁড়াও। আরো বলার দরকার নেই। বরং মূল ব্যাপারটি বলো। আমার চেহারা সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছ?

— না।

— একটুও না?

— না।

— তুমি দেখছি ডাহা ফেল।

— এটা খুব কনফিউজিং।

— কনফিউজিং? … কী রকম?

— একেকবার একেকরকম মনে হয়।

— আমি কথা কিন্তু বিভিন্নভাবে বলি না।

— তা বলো না। কিন্তু আমি স্পষ্ট ছবি তৈরি করতে পারছি না।

— তোমার লেখা পড়ে কিন্তু মনে হয় তোমার কল্পনাশক্তি অসীম।

— আমিও সে-রকমই জানতাম। (সে একটা মন খারাপের ইমো বসাল)।

— আরও কিছুদিন চেষ্টা করবে?

— তাতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।

— তাহলে কী আর করা, আমি অস্পষ্টই থাকি তোমার কাছে।

— নাহ।

— তুমি স্পষ্ট করতে পারছ না।

— অন্য একটা উপায় আছে।

— স্পষ্ট ছবি কিন্তু আমি দেবো না।

— আমি ছবির কথা বলছি না। অন্য উপায়।

— বলো, শুনি।

— তুমি আন্দাজ করতে পারছ না?

— পারছি।… পারার কথা, তা-ই না?

— তাহলে আমার বলার দরকার নেই, না?

— ভুল। দরকার আছে।

— কেন?

— আমি তোমার মুখ থেকে শুনব।

সায়রা জিজ্ঞেস করল—তোমার নতুন উপন্যাস কি শুরু করেছ? ওই যে, বলছিলে না—এবার একটা প্রেমের উপন্যাস লিখবে।

সে মাথা নাড়াল—নাহ, কোনো ডেভলপমেন্ট নেই।

— গোছাতে পারছ না?

— কাহিনিই ঠিক করতে পারলাম না।

— কেন, মেয়েটা কি যথেষ্ট সহযোগিতা করছে না?

— কোন মেয়ে?

— আচ্ছা, তুমি তালগাছ থেকে পড়লে কেন?

— তালগাছ থেকে কেন পড়ব!

— কোন মেয়ে তুমি সেটা বুঝতে পারছ না?

— নির্দিষ্ট করে না বললে…।

— যে মেয়ের সঙ্গে তুমি ইনবক্সে ব্যস্ত। তোমাকে মাঝে মাঝে উদাসীন দেখায়।

— মোটেও আমাকে উদাসীন দেখায় না।

— বেশ, তোমাকে চটপটে দেখায়। এখন বলো, মেয়েটা কি কাঠখোট্টা টাইপের? তোমার মধ্যে প্রেমভাব জাগাতে পারছে না?

— তুমি আমার ইনবক্স দেখেছ?

— আমার দায় পড়েছে…।

— এমনভাবে বলছ যেন কত কী জেনে বসে আছ। শোনো, ইনবক্স বলো বা আউটবক্স, কোথাও কোনো মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই।

— না, মানে বলছিলাম কি, এমন নিমগ্ন হয়ে চ্যাট করো…।

— কী আশ্চর্য, তুমিই-না আমাকে ফেসবুকে ঠেলে পাঠালে!

— গল্পের যেন একটা প্লট পাও, সেজন্য পাঠিয়েছি। না?

— হুঁ। সেজন্যে।

— কিন্তু তোমার প্লট আসছে না, প্রেম চলে আসছে…।

— আহা, সায়রা…!

— নাম কী মেয়ের?

— তানজিলা।

— বাহ! চেহারা কেমন?

— ধারণা নেই। প্রোফাইলে যতগুলো ছবি আছে, সবগুলো আড়াল করা বা ঝাপসা।

— সায়রা হাসতে আরম্ভ করল।

— হাসির কিছু হয়নি। কারো কারো এরকম বাতিক থাকতে পারে।

— হাসছি, কারণ আমি নিশ্চিত তুমি কোনো ফেইকের পাল্লায় পড়েছ।… সাবধান।

সে পরদিন তানজিলাকে ইনবক্স করল—ব্যস্ত?

— তুমি নক করলে, আর, আমি ব্যস্ত! কক্ষনো না।

— একটা কথা বলব।

— যে কথাটা আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।

সে বলল—হুমম, সে কথাই। দেখা করার কথা।

বাড়ি ফিরে সে গল্পটা খুঁজে বের করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লে সায়রা জিজ্ঞেস করল—কী খোঁজো? তারপর বলল—এই যে বুকসেলফ থেকে এত কাগজ নামিয়েছ, সব কিন্তু গুছিয়ে তোমাকেই ওঠাতে হবে। আমার কোমরে ব্যথা, আমি পারব না।

— তোমার কী মনে আছে? সে জিজ্ঞস করল।

— নেই। সায়রা বলল। সংসারের চাপে আজকাল অনেক কিছুই মনে থাকে না। তবে তানজিলার কথা মনে আছে।

— তানজিলা না, মেহের।… আমার কি ‘ইচ্ছা’ নামে কোনো গল্প আছে?

— মেহের আবার কে!… জানি না। তোমার ইচ্ছার কথা তুমি জানবে।

— আহা, বলোই না। আছে?

— আছে। মেয়েটার জন্য আমার খুব খারাপ লেগেছিল।

— কোথায়?

— কোথায় মানে! খারাপ লাগলে মনে লাগবে।

— না না, গল্পটা কোথায়?

— আচ্ছা, সেটাও কি আমার জানার কথা!

— গল্পটা দরকার। খুব।

— খোঁজো, থাকলে এখানেই আছে।

— আচ্ছা, ওই গল্পের নায়িকার নাম কি মেহের?

— নাম মনে নেই। গেলাম। একটু পর হয়তো জিজ্ঞেস করবে—মেয়েটা কি সবুজ শাড়ি পরত?

— ধ্যাত্। এই তো। পেয়েছি।

— চোখের সামনে রেখে খুঁজে বেড়াচ্ছ, সমস্যা কী?

— গল্পটা পড়তে হবে।

— এটাকে সমস্যা মনে হচ্ছে না।

— আছে, পরে বলব।

— কোনো সুন্দরী পাঠিকা কিছু বলেছে। তার জীবনের সঙ্গে মিলের কথা?

সে হাসল—অনেকটাই।… এখন এককাপ কফি করে দাও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।

একটু ইতস্তত করল সায়রা—দিচ্ছি।… আমার একটা সবুজ শাড়ি লাগবে।

সায়রা চলে গেল, সে গল্পটা পড়তে আরম্ভ করল।

— ওটা ওয়াটার কালার। জলরঙ। একটু পেছন থেকে না দেখলে ছবিটা তোমার ভালো লাগবে না?

শাফিন দেওয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে এগোচ্ছিল। মেহেরের কথা শুনে সে থমকে দাঁড়াল। মেঝেতে তার ছায়া পড়েছে। নিজের ছায়ার দিকে সে তাকিয়ে থাকল কিছুটা সময়। ছায়া থেকে চোখ সরিয়ে সে তাকাল তার সামনে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে। মেহের বারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু সে বুঝতে পারছে না—যেমন সামনে এগোচ্ছিল তেমন এগোবে, না পিছিয়ে আসবে। সামনে এগোলে, তার মনে হচ্ছে, ছবিটা কাছ থেকে ভালোভাবে দেখা যাবে। পেছনে গেলে কি সেটা সম্ভব? ব্যাপারটা বুঝতে পারল না শাফিন, সে যখন বুঝতে পারে না, তার মুখে একধরনের হাসি ফোটে, তার মুখে সেই হাসিটা ফুটল। সে বলল—পিছিয়ে গিয়ে দেখলেই ছবিটা ভালো লাগবে।

মেহের মাথা নাড়ল—নিশ্চয়তা নেই।… তবে ছবিতে নাক লাগিয়ে দেখলেই ছবিটা ভালো লাগবে, তা কখনো নয়। এই নিশ্চয়তা দিতে পারি।

শাফিন হাসিমুখে মেহেরের দিকে ফিরল—ছবির আসলে আমি কিছুই বুঝি না।

মেহের হাসল—জানি।

— কীভাবে জানো?

— এমনি এমনি জানি। তবে দেখতে যখন এসেছ…।

— নিয়ম মানতে হবে?

— হ্যাঁ, সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। ছবি দেখারও। সেটা তোমাকে মানতে হবে।

— বেশ। ওয়াটার কালার কি পেছন থেকে দেখতে হয়?

— সব ছবিই একটু দূর থেকে দেখতে হয়।

— কারণটা জানা যাবে?

— যাবে।… তুমি তাজমহল দেখতে গেছ?

— যাইনি। তবে যাব।

— তোমাকে তাজমহলের গায়ের সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া হলো। তুমি তাজমহলের বুঝবে কিছু? ছবিও তেমনি। সৌন্দর্যটুকু নেয়ার জন্য একেক দূরত্বে দাঁড়াতে হয়।

— একটু পিছিয়ে যাব তাহলে?

— কয়েক পা পেছনে আসো।… হ্যাঁ, আরেকটু… আরেকটু। দাঁড়াও।… শোনো, অত শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে না। শক্ত হয়ে না দাঁড়িয়েও ছবি দেখা যায়। … আহা, তোমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে, জানো?

অদ্ভুত একটা কিছু বলবে মেহের, শাফিন বুঝতে পারল। এড়াবার উপায় নেই, সে জিজ্ঞেস করল—কী মনে হচ্ছে?

— তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। তুমি ছবিটা দেখো। ছবি দেখার জন্য কিন্তু তুমিই জোরাজুরি করেছ। এখন তুমি যদি ঠিকমতো ছবি না দেখো, আমার মেজাজ গরম হবে।

— প্রায়ই হয়?

— কী?

— মেজাজ গরম।

— হুম, প্রায়ই হয়।

শাফিন হাসল—তোমার আবার মেজাজ…। শাফিন ছবিটার দিকে তাকাল। সামান্য সময় পরই সে বুঝতে পারল মেহের ঠিকই বলেছে। ছবিটার কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে নিলে ছবিটা এভাবে সে দেখতে পেত না। এখন, যেটা হয়েছে, পুরো ছবিটা সে দেখতে পাচ্ছে।

আরো কিছুটা সময় নিয়ে ছবিটা দেখল সে। মেহেরের দিকে তাকাল—আগুনের রঙ সবুজ রেখেছ কেন? আগুনের রঙ কি সবুজ হয়?

— হয়। এমনভাবে ‘হয়’ বলল মেহের, যেন শাফিনের প্রশ্নটাকে সে এতটুকু গুরুত্ব দিল না।

— কীভাবে হয়? কোথায় হয়? আমাকে একটু বোঝাবে?

— এখানে কেন সবুজ, সেটা তোমাকে বলব না। তবে আমি অন্য একটা উদাহরণ দিতে পারি।

— অলরাইট, সেটাই শুনি। আফটার অল, শিল্পীর ব্যাখ্যা।

— আগুনের আসলে কী রঙ? মূলত?

— লাল।

— ধরো কোথাও আগুন লেগেছে। খুব বাজে ধরনের আগুন। আমি যদি তখন আগুনের লালকে বেশ কিছুটা কালো করে ফেলি, অসুবিধা আছে?

তোমার ব্যাখ্যা পছন্দ হয়েছে—এরকম কিছু বলতে যাচ্ছিল শাফিন। তার আগে ঘরের বাইরের দিকের দরজায় লুবনাকে দেখা গেল। তার মুখে হাসি। সে বলল—যে ছবি দেখে কিছু বোঝা যায় না, সে ছবি দেখা বন্ধ। সে তাকাল শাফিনের দিকে, ইয়ার্কির ভঙ্গিতে বলল—ফোন এসেছে ফ্রম হার রয়াল হাইনেস, শাফিন ভাইয়াজান, আপনি কি দ্রুত, অর্থাত্ পঙ্খিরাজের মতো উড়ে গিয়ে ফোনটা ধরবেন?

— এখন ফোন। শাফিন বলল, তার গলায় বিরক্তি না বিস্ময় ঠিক বোঝা গেল না। লুবনা একটু সরে দাঁড়ালে সে ‘আসছি’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। লুবনা তার পেছনে-পেছনে গেল না, সে দরজার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকল, মেহেরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল—কী করছিলে?

— তুমিই বললে যে ছবি দেখে কিছু বোঝা যায় না…।

— সে ঠিক আছে। করছিলে কী?

— শাফিন ভাই ছবি দেখতে চেয়েছিল…।

— নাকি তুমি ছবি দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছিলে?

— তুমি যা মনে করো।

— শুধু আমি কেন! মনে করলে এ বাড়ির সবাই করবে।

সামান্য হাসি মেহেরের ঠোঁটের কোণে উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল—তা-ই?

— তা-ই।

— লুবনা। মেহের বলল, তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ইচ্ছে করছে না।

— তা তো করবেই না। যখন-তখন তোমার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। লুবনা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরতে নিয়ে ফিরে দাঁড়াল—ছবি ঘরের দরজা খোলা রেখেও দেখানো যায়। ছবি দেখানোর জন্য ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিতে হয় না।

শাফিনের বিয়ে সামনের মাসে। সে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে থাকে। ছবি দেখলেই বোঝা যায় শিল্পীর আঁকা ছবির মতন একটা জায়গা। যেন পাল্লা দিয়ে সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। এই সৌন্দর্যের কথা, আড্ডায় কথা উঠলে, শাফিন কয়েকবার বলেছে।

ভ্যাঙ্কুভারে যাওয়ার পরের দিনগুলো শাফিনের খুব কষ্টের ছিল। সেটা ছিল শীতের সময়। ওতেই সে কিছুটা কাবু, সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও কম ভোগান্তির নয়। এখন সব কষ্ট সব সমস্যা সে কাটিয়ে উঠেছে। এখন ওখানে চমত্কার এক জীবন সে যাপন করে। পরিশ্রমের, তবে গোছানো ও স্বাচ্ছন্দ্যেরও। তবে সবকিছুর পরও ওখানে সে একা। সে দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য।

এই নিয়ে সমবয়সীদের মধ্যে অল্পবিস্তর রসিকতা হয়েছে—

— সে কী রে! ওই দেশে তুই মেয়ে খুঁজে পেলি না!

— নাকি ওই দেশে একটা করেছিস, এখন এ দেশেও করবি একটা?

— কাজটা কি ভালো হবে, এ দেশে বিয়ে করা? বিয়েটা ও দেশেই করতি, আমরা বলতে পারতাম আমাদের শাফিনের বিদেশি বউ!

পাত্র হিসাবে সে যথেষ্ট যোগ্য বলে, পরিচিত মহলে মেয়ে খোঁজার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। শেষে তার বড় খালা বহু দেখেশুনে তার জন্য পাত্রী ঠিক করেছেন। অতি রূপসী সে মেয়ে। এ নিয়েও রসিকতা কিছু কম হয়নি—

— চেহারা দেখেছিস মেয়ের? এ মেয়েকে তো শাফিন কিছু করতে পারবে না।

— কেন কেন?

কারণ এ মেয়েকে বাঁধিয়ে রাখতে হবে।

বড়খালা অবশ্য মেয়ের রূপের পাশাপাশি তার উচ্চবংশের ব্যাপরটিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন। আজকাল উচ্চবংশের মেয়ে পাওয়া, তিনি বারবার বলছেন, খুবই কঠিন ও ভাগ্যের একটা ব্যাপার। মেয়ের নাম জরিনা। তাদের পরিবারে উর্দুর কিঞ্চিত চল আছে। তাদের আভিজাত্য মেয়ে দেখতে ও বাড়িতে গেলেই টের পাওয়া গেছে। এতে বড় খালার মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। সাধারণত ছেলের জন্য মেয়ে ঠিক করার ক্ষেত্রে মায়ের একটা বড় ভূমিকা থাকে। শাফিনের মা ছেলের জন্য মেয়ে ঠিক করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। তিনি সহজ, সরল, নিরীহ টাইপের মহিলা। অপছন্দ হলেও অন্যের কথা মেনে নিতে তার অসুবিধা হয় না। জরিনাকে অবশ্য তার পছন্দ হয়নি। বরং মেয়ে দেখার আসরে তাকে মেয়ের দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। মেয়ে দেখে নির্দিষ্ট কোনো কথা না দিয়ে কিছু সময় নিয়ে ফিরে আসার পর রাতে শাফিন যখন জিজ্ঞেস করল—মা, তোমার কেমন লেগেছে মেয়েকে, তুমি এখনো কিছুই বলোনি, তুমি বলো—তিনি বললেন—ভালোই তো রে, বাবা।

শুনে হা হা করে উঠলেন শাফিনের বড় খালা লুবনার মা—ভালোই তো মানে!

— ভালো না?

— তাহলে ভালোই তো বলছ কেন! এত সুন্দর মেয়ে কি আজকাল পাওয়া যায়! পাশাপাশি খানদানটাও দেখবে না?

— হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো বটেই। শাফিনের মা তখনই বললেন। এমনভাবে বললেন, যেন ভালোই তো বলে তিনি মহা অপরাধ করে ফেলেছেন, এখন অপরাধ খণ্ডন করার জন্য তিনি উদগ্রীব।

— বুবুকে দিয়ে হবে না। বুবুর কিছু ঠিক নেই। শাফিন, তুই বল, বড়খালা বললেন।

— ভালোই তো। শাফিন বলল।

— তুইও—ভালোই তো।

— আহা, আর কী বলব!

— বেশ, বড় খালা বললেন। তাহলে এখানেই তোর বিয়ে, আমি ওদের পাকা কথা দিয়ে দিচ্ছি।

ছবি আঁকতে মেহেরের সবসময় ইচ্ছা করে না। তবে কখনো এরকম হয়, সে ঠিক করে রাখে কোনো একটা ছবি সে অমুক সময়ের মধ্যে ঠিক করবে। তাতে ছবিটা যদি না দাঁড়ায়, না-দাঁড়াক। আবার বেল কয়েকটা ছবি আছে অসমাপ্ত। কোনোটায় সামান্য কাজ বাকি, কোনোটার কিছুটা বেশি। ওসবের মধ্য থেকে একটা ছবি সে আলাদা করে রেখেছিল। সে ঠিক করে রেখেছিল, এই যে ছবিটায় লালের প্রাধান্য বেশি, সেটা সে আগে শেষ করবে। এখন ছবিটা ধরা যায়। ঘণ্টাখানেক টানা কাজ করতে পারলে ছবিটা নামিয়ে ফেলা যাবে। সে একপাশে জড়ো করে রাখা ছবিগুলোর দিকে এগোল, যে ছবিটা শেষ করতে চায়, সেটা সে তুলে আনল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ; ছবির কোথায় কোথায় কাজ করতে হবে, তা তার মাথায় আছে। মাথায় না থাকলেও চলে, ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই হয়, আবার এমনও হয়—মাথায় যা ছিল, বিরতি নিয়ে তাকানোর পর তা বদলে যায়, কাজ শুরু করার পরও নতুন কিছু এসে যায় মাথায়। এ ছবির ক্ষেত্রেও যে ওরকম কিছু ঘটবে, সে জানে। মেহের ছবিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নামিয়ে রাখল, তার হঠাত্ মনে হলো, ছবিটা নিয়ে কাজ করতে আসলে এখন তার ইচ্ছা করবে না।

একটু আগে লুবনা তার সঙ্গে খামাখা খারাপ ব্যবহার করে গেছে, এটা তার মন খারাপ করে দিয়েছে, তবে এতটা খারাপ করে দেয়নি যে ছবির বাকি কাজ তার সারতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তার ইচ্ছা করছে না। শাফিন নিজের ইচ্ছায় ছবিগুলো দেখতে এসেছিল, আর, দরজা বন্ধ না, খোলাই ছিল, ভেজানো ছিল হয়তো, সে আসলে খেয়াল করেনি। তাছাড়া খেয়াল করলেই দরজা সে হা করে খুলে দিত, এমনও নয়। কারণ, দরজা ভেজানো বা ভেজানো না থাকলে কী, এসব তার মাথায়ই আসেনি। ওসব নিয়ে লুবনার কথায় তার মন কিছুটা খারাপ হয়েছে বইকি। অন্য সময় হলে, সে জানে, ওরকম কোনো ব্যবহার একটুও মন খারাপ হতো না তার। এদের খারাপ ব্যবহারে, খারাপ ব্যবহার যদি নাও বলে সে, তাচ্ছিল্য বলবেই, সে অনেকদিন ধরে অভ্যস্ত। কিন্তু একটু আগে শাফিন ছিল তার সঙ্গে, তার ভালো লাগছিল শাফিন তার আঁকা ছবিগুলো দেখবে বলে, এমন সময়ে লুবনার উপস্থিতি তাকে একটু হলেও বিব্রত করেছে। মেহের ভুরু কুঁচকে, লালের প্রাধান্য যে ছবিতে, সে ছবির দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।

এর আগে শাফিন তার দু-চারটা ছবি দেখেছে। সেগুলো বারান্দায় ও করিডোরে টানানো। ছবি নিয়ে শাফিনের উত্সাহ নেই। তার মা কী কথায় তাকে বলেছেন, ছবিগুলো মেহেরের আঁকা, তারপর থেকে তার উত্সাহ—তোমার ছবি?

— আমার আঁকা ছবি।

— আহা, সে তো বুঝেছি। তুমি ছবি আঁকো?

— তোমার কী মনে হয়?

— তুমি যে ছবি আঁকো, এটা আগে বলোনি কেন?

— বলিনি কেন? মেহের উলটো প্রশ্ন করেছিল। তার আগে বলো, বললে কী হতো?

— ধরে নাও, কিছুই হতো না। আমার জানা হতো।

— তাতেই বা কী হতো!

— মেহের, শোনো, কথা একটু বেশি বলছ।

— মাঝে মাঝে বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করে।… শাফিন ভাই, তুমি ছবি বোঝো?

— নাহ।… কয়েকজন শিল্পীর নাম অবশ্য জানি।

— তাহলে দেখে কী করবে?

— আমি অনেক কিছুই বুঝি না। যা যা বুঝি না, তার সবকিছু দেখা ও শোনা তো বন্ধ নেই।

— আচ্ছা, দেখাব।

— মা বলেছে, তুমি নাকি একটা পুরস্কারও পেয়েছ।

— ও কিছু না। একটা পুরস্কার মাত্র।

— শাফিন আরো দু’বার বলার পর মেহের তাকে ছবি দেখাতে নিয়ে এসেছিল। কাউকে ছবি দেখাতে তার ভালো লাগে না। আবার লাগেও। এ বাড়ির কাউকে দেখানো মানে অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু কথা শোনা। বড় খালা তার ছবি দেখে একবার বললেন, এইটা কী! তা, সেটা যে কী, সেটা কী করে বোঝায় মেহের! যে ছবি দেখে বলে—এইটা কী—তাকে কি ছবি বোঝানো যায়! সে অবশ্য বলতে পারত—এটা কলা। এখনো পাকেনি যদিও। এরকম বলার বেশ একটা ইচ্ছাও হয়েছিল তার। তবে সে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। বড় খালাকে এরকম কিছু বললে, ঝাল যে কতরকম হতে পারে, সেটা পরে বুঝতে হবে।

যা-ই হোক, বাসায় আসলে এরকম—এ বাড়ির কেউ একজন যেচে পড়ে তার ছবি দেখতে চেয়েছে, এটা মেহেরের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ বাড়িতে তার ছবির খোঁজখবর মাঝে মাঝে নেয় তার মা। ওটাকে অবশ্য, বিবেচনা করলে, খবর নেওয়া বলে না। মেয়ে একটা কাজ করছে, তাই সেটা সম্পর্কে হঠাত্ এরকম কোনো জিজ্ঞাসা—কীরে, ছবি আঁকছিস তো, কিংবা, আজ কি কিছু এঁকেছিস, কিংবা, আঁকা মনে হয় কমিয়ে দিয়েছিস—ব্যাপারটা আসলে এরকম, এ পর্যন্ত।

লুবনা একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল—আচ্ছা, তুমি ছবি আঁকো কেন!

— এমনি আঁকি। মেহের উত্তর দিয়েছিল।

— বোঝাই যায়। এখানে ওখানে কিছু রঙ ঢেলে দাও শুধু। এমনি এমনি না আঁকলে আর এরকম হয়। অসুবিধা নেই অবশ্য। তোমার রঙ তোমার তুলি তোমার টাকা…।

টাকার কথা অবশ্য বড় খালাও বলেছিলেন, সরাসরি—মেহের, তোর জিনিসপত্রের দাম কি সত্যিই এত বেশি!

—জি খালা, বেশি। মেহের বেশ সংকুচিতই ছিল।

— এত এত খরচ করে এসব আঁকা! খালা বলেছিলেন।… আমার কথায় আবার কিছু মনে করিস না। জানিস তো শুধু ওটাই।

— এটা ঠিক না খালা! মেহের বলেছিল। আপনি যা ভালো মনে করেন, বলতেই পারেন।

— হ্যাঁ, পরে তো আবার মুখ কালো করে থাকবি।… যত খারাপই লাগুক, একটা কথা মনে রাখিস, তোদের তো আর সেভাবে ইনকাম নেই। বাড়িটা সবার, আর বড়, তাই থাকার জায়গার অভাব নেই, কিন্তু তোদের ভাগের টাকা যে দিন দিন কমে যাচ্ছে।

এমন হতে পারে, এজন্য তার ছবি আঁকাই বন্ধ হয়ে গেল একসময়। একদিন দেখা গেল, নানা তার মেয়েদের জন্য যে টাকা রেখে গিয়েছিলেন, সে টাকায় তাদের অংশ শেষ। অন্য দুই খালার ক্ষেত্রে এমন হওয়ার আশঙ্কা নেই। বড় খালুর ব্যবসা চলছে তরতর করে, আর, মেজো খালু যদিও নেই, তার ছেলে ভ্যাঙ্কুভারে বসে টাকা কামাচ্ছে অনেক, তার একটা বড় অংশ চলে আসছে দেশে, এদিকে তাদেরটাই শুধু ফুরোচ্ছে, জমছে না। শুধু ফুরিয়েই যখন যাচ্ছে, তখন এত টাকা দিয়ে রঙ তুলি ক্যানভাস কিনবে সে! কেনেও যদি, আর, ছবি যদি এঁকেও যায়, তাতে কী আর এমন হাতিঘোড়া হবে!

ছবিটার দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল মেহের। লালের এমন সুন্দর ব্যবহার সে আগে কোনো ছবিতে করতে পারনি। শেষ করতে পারলে এটা একটা অন্যরকম ছবি হবে। কিন্তু এখন না, এখন এই ছবি ধরবে না সে। মেহের তবু আরেকটু সময় নিল, তারপর দু’পাশে মাথা নাড়ল—না, এখন না। ছবিটার দিক থেকে সে চোখ সরিয়ে নিল। পরে ধরবে এটা, যখন তার ইচ্ছা করবে। কিন্তু এখন সে কী করবে, সেটা সে বুঝতে পারল না। ব্যাপার না—মেহের হাসল—না বুঝেও অনেক কিছু করা যায়, করে যেতেও হয়।

শাফিন তাকে জিজ্ঞেস করল।

মেহের জানত শাফিন তাকে জিজ্ঞেস করবে। এরমধ্যে বারকয়েক এই কথাটা উঠতে উঠতেও ওঠেনি। কিন্তু কথা হয়তো কিছুটা উঠেছে, তারপর অন্য কথার চাপে সরে গেছে। তারা ছাদে উঠেছে বিকেলের দিকে। এর আগে হঠাত্ শাফিনের ডাক—মেহের মেহের… আমাদের আর্টিস্ট কোথায় গেল! শিল্পী কোথায়?

মেহের তার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল—এভাবে চিত্কার করছ কেন গলা ফাটিয়ে!

— একটা কথা বলব।

— সেজন্য চিল্লাতে হয় না।… বলো।

— চিল্লিয়ে বলব, না এমনি বলব?

— চেরা বাঁশের শব্দ শুনতে কার ভালো লাগে! এমনি বলো।

— দু’কাপ চা বানাতে হবে। রান্নাঘরে গিয়ে কাউকে বললে হবে না। তোমার নিজের হাতে বানাতে হবে। তারপর চা নিয়ে সোজা চলে যাবে ছাদে।

— কেন? ছাদ কি চা খাবে?

— না। কারণ ছাদে আমি থাকব। এই এখনই আমি ছাদে যাচ্ছি।

চা বানাতে সময় লাগবে না। লাগত, যদি লুবনা বা তিথি থাকত বাসায় কিংবা বড় খালা যদি শুনতে পেতেন শাফিনের কথা। ও রকম কিছু নেই, তাই চা বানানো হয়ে গেল সহজে। চা নিয়ে ছাদে গেল মেহের। এক কাপ শফিনের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল—শাফিন ভাই, তুমি একটু পাগল আছ।

শাফিন হাসল—সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে!… তোমাকে চা বানাতে বললাম, কারণ চা তুমি খুব ভালো বানাও।

মেহের হেসে ফেলল।

— হাসির কী বললাম!

— যে না এক চা, তার আবার বানানো!

— না, ব্যাপার আছে, সবাই চা বানাতে পারে না।

— বেশ, ব্যাপার আছে।

— আর, চা নিয়ে তোমাকে ছাদে আসতে বললাম, কারণ ছাদে হাঁটব আর তোমার সঙ্গে গল্প করব।

— কী গল্প?

— অনেক গল্প। ধরো, এভাবে আমাদের গল্প শুরু হতে পারে—এই যে তুমি এত ছবি আঁকো, এদিকে আমি কেন ছবির কিছুই বুঝি না!

— এটার কোনো ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। এটুকু বলি—তোমারও অনেক ব্যাপার আছে, যার কিছুই আমি বুঝি না।

— আমার কী তুমি বোঝো না?

— দেখো, এখানে ‘তুমি’ বলতে ঠিক তুমিই না…।

— বুঝেছি… আসলে, ছবি আমি কেন বুঝি না—এই গল্প করার জন্য আমি তোমাকে ডাকিওনি।… একটা কথা জিজ্ঞেস করব আমি।

—জিজ্ঞাসাবাদ! মেহের চোখ বড় করে তাকাল। জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব?

শাফিন হাসল—না, গল্পও আছে।

— ঠিক আছে। শুরু হোক।

— তুমি রাগ করতে পারবে না।

— করব না। রাগ ব্যাপারটা আমার মধ্যে তেমন নেই।

— জানি।… দেখছি তো।… মেহের, তোমার বাবা, মানে খালুর ব্যাপারে…।

মেহের স্থিরচোখে শাফিনের দিকে তাকাল—এই বিকেলে আমার বাবাকে আবার ছাদে টেনে আনা কেন?

—অবশ্য তোমার ইচ্ছা না হলে বলবে না। তোমার বলার ইচ্ছা না-ই হতে পারে।… আমি কিন্তু প্রথমেই বলেই নিয়েছি, তুমি আমার ওপর রাগ করতে পারবে না।

— রাগ করব না। আমার ভেতর ইচ্ছা-অনিচ্ছাও কাজ করছে না। বলো, কী জানতে চাও?

— খালু এরকম করলেন কেন?

মেহের কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই শাফিন তাকে থামাল—আমি কি খুব সরাসরি কথাটা জিজ্ঞেস করলাম?

— না। এই প্রশ্ন ঘুরিয়ে করার মতো নয়। ঘুরিয়ে করলেও অর্থ একই দাঁড়ায়।

— আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি কথা ঘুরিয়ে বলতে শিখিনি।… হ্যাঁ, বলো, তিনি এরকম করেছিলেন কেন?

মেহের হাসল—আমি অনেককেই দেখি, আমার বাবার ওপর আমার ওপর তাদের রাগ বেশি।

— আমার রাগ না।

— এখানেও ‘তুমি’ মানে তুমিই না।

— আমার ঠিক রাগ না।… কৌতূহল।

— কৌতূহলের মধ্যে অনেক সময়ই একটা রাগ বা বিরক্তি লুকিয়ে থাকে। যে জিজ্ঞেস করে, সে হয়তো বোঝে না, কিন্তু আমি বুঝি।

— দেখো, শুধু রাগ বা বিরক্তি, কৌতূহলের মধ্যে বিস্ময় কাজ করে না?

মেহের মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল—হ্যাঁ, তা-ও করে।… শাফিন, বাবার ওপর আমার রাগ হয় না। বাবার ওপর আমি বিরক্তও হইনা। বরং তার জন্য আমার মন খারাপ হয়। মানুষটা জীবনে একটা বড় ভুল করেছিলেন।

— কী ভুল?

— বিয়ে করেছিলেন। বিয়ে করা বাবার উচিত হয়নি। কোনো কোনো মানুষ থাকে, সংসার তার জন্য না। বাবা অমন একজন মানুষ।

— তাই বলে তোমাদের কিছু না জানিয়ে হুট করে একদিন উধাও হয়ে যাবেন! দায়িত্ব…।

— দায়িত্ব পালন করার মতো মানুষ তিনি নন। ভুলটা তার করা উচিত হয়নি, বিয়ে করার ভুল, সংসার যে তার জন্য নয়—এটা তার বিয়ের আগেই বোঝা উচিত ছিল।

— বুঝলে কোথাও কোনো সমস্যা তৈরি হতো না। কিন্তু ভুল মানুষই করে, অন্যায় যদি বলো, সেটাও।… যে সংসার করার মানুষ না, একসময় সংসার তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠতেই পারে।

— কিন্তু তার স্ত্রী… তার মেয়ে…। খালা… তুমি…।

— যে সংসার অসহ্য হয়ে উঠেছে, তারা সেই সংসারেরই অংশ, না? দেখো, আমার ধারণা, অসহ্য হয়ে উঠেছে সংসার, তার নয়।… আর, সংসার থেকে যারা যায়, তাকে এসবের কিছুই বেঁধে রাখে না।… পথে পথে ঘুরে বেড়াতেই তার আনন্দ।

শাফিন এমনভাবে তাকিয়ে থাকল, যেন সে ব্যাপারটা মেহেরের মুখ থেকে বুঝতে চাচ্ছে।

— আরো একটা ব্যাপার আছে। মেহের বলল। ধরো, সংসার বিবাগী হওয়ার ব্যাপারটা বাবার মধ্যে সংসারী হওয়ার আগে ছিল না। কিংবা ছিল, লুকানো। তিনি বুঝতে পারেননি। সংসারী হওয়ার পর, যতই দিন যেতে লাগল, ততই হয়তো একধরনের অর্থহীনতা তার মধ্যে বিশাল হয়ে উঠতে লাগল…। ভেবো না আমি বাবার দোষ ঢাকছি, আমি এরকমই ভাবি।

চায়ের কাপে রেলিং-এর ওপর নামিয়ে রাখল শাফিন। তাকে কিছুটা চিন্তিত ও অস্থির দেখাল। সে মেহেরের দিকে ফিরল না, সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল, বলল—তোমাকে আরেকটা কথা বলব।

— বলো।… ওটাই কি আসল কথা?

— জানি না।… মেহের, এইটা একটা কথা।

— বলো।

— খালুর কথা তুলেছি হয়তো একথাটা বলার জন্যই।

— বলো।

— আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, খালুর মতো আমিও সংসারী হতে পারব না।

— মানে? মেহের স্থির চোখে তাকাল। তুমিও যাবে?

— না। আমি যাব না। আমার যাওয়ার সাহস নেই।

— তাহলে?

— আমি সংসারেই থাকব।

মেহের জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকল।

— তুমি বুদ্ধিমান, তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি?

— তুমি সংসারে থেকেও সংসারী হবে না—এরকম কিছু?

—মেহের… হ্যাঁ, এরকম কিছু।

— তোমার এরকম মনে হচ্ছে?

শাফিন মাথা ঝাঁকাল।

— কেন তোমার এরকম মনে হচ্ছে?

শাফিন বলল—বুঝে নাও।

— কী বুঝব?… কথাবার্তা পাকা হয়ে যাওয়ার পর তোমার এখন জরিনাকে পছন্দ হচ্ছে না?

মূহূর্তেই শাফিনের চেহারা বোকা বোকা হয়ে গেল—তুমি বুঝলে কী করে? এই প্রশ্ন করেই শাফিন হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেলল—আমার অবশ্য বোকা হওয়ার দরকর নেই। আমি জানতাম তুমি বললেই বুঝবে।

মেহের সামান্য হাসল—কিন্তু এখন এমন একটা অদ্ভুত কথা বললে হবে?

— তুমি এটা বুঝলে কী করে, মেহের!

— তুমিই না বললে—তুমি বললেই আমি বুঝব।

— হুঁ, বলেছি বটে।

— তোমার আরেকটু সময় নেয়া উচিত ছিল।

— বড় খালা আমার হয়ে সব কথা দিলেন যে!

— বড় খালা সংসার করবেন, না তুমি?

— না না, আমিই করব…।

— মেয়েটকে আমার কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছে।

— তো? মেয়েটার সঙ্গে সংসার কি তুমি করবে?

— নাহ, আমি কিছুুদিনের মধ্যে আমার নিজের সংসারে চলে যাব।

শাফিন বোকার মতো তাকাল—মানে?

—মানে আবার কী! এটা কি না-বোঝার কিছু?

— তোমার বিয়ে!

— শোনোনি কিছু? কেউ কিছু বলেনি?

শাফিন দু’পাশে মাথা নাড়ল।

— বড় চাচা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। ঠিক মানে, পুরো ঠিক না, প্রায় ঠিক। ছেলে মফস্বলের এক কলেজে অঙ্কের মাস্টার।

শাফিনকে বোকা বোকা দেখাল।

— মফস্বল ছোটবেলায় আমার খুব ভালো লাগত। এখনো লাগবে বলেই মনে হয়।

— কবে বিয়ে?

— তবে অঙ্ক আমার একেবারেই ভালো লাগে না।

— বিয়ে কবে?

— আমার কেন যেন মনে হচ্ছে—এই অঙ্কের মানুষটা খুব নিরস হবে। বিষয় অঙ্ক, সেজন্য নয়। অঙ্ক অনেক ইন্টারেস্টিং হতে পারে, জানি। মানুষটা নিরস হবে অঙ্কের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই। আমাকে ছবি আঁকতে দেখে বলবে—আরে, লাল নীল সুবজ হলুদ, এসব কী, বলো তো আমাকে—এসব কী!… শাফিন ভাই, তোমার কী মনে হয়? এরকম কিছু বলবে?

— জানি না। শাফিন মৃদুগলায় বলল। সে তাকিয়ে থাকল মেহেরের দিকে।

— সমস্যা হচ্ছে, ছবি না-এঁকে আমি থাকতে পারব না। এছাড়া অন্য কোনো সমস্যা নেই।

— হুঁ… আর কী সমস্যা…?

— হুঁ… শুধু ছবিটাই।

— এই ছবি ব্যাপারটা আমিও বুঝি না। শাফিন বলল। ছোটবেলায় স্কুলে ড্রয়িংক্লাসে ছবি আঁকতাম—ঘর নদী নৌকা ফসলের খেত। ঘরের পেছনেই নদী। নদীতে নৌকা। সেই নৌকা আবার সামনের ঘরের চেয়ে আকারে বড়…।

— খুবই ক্রিয়েটিভ ছিলে দেখছি! মেহেরের মুখে চাপা হাসি।

— আমার একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

— মানুষের কত কী জানতে ইচ্ছা করে…।

— আমার জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি ছবি আঁকো কেন?

— বলে লাভ নেই। ছবি যখন বোঝো না, ছবি কেন আঁকি—সেটাও বুঝবে না।

— তবু…। শুনি একটু।

— এই ধরো—ছবি আঁকতে আঁকতে একটু একটু করে নিজেকে মুক্ত করে আনি।… কিছু বুঝলে?

— নাহ।… কঠিন কথা।

— জানতাম, তোমার কাছে কঠিনই লাগবে।

— ভুল জানতে। শাফিন মুচকি হাসল। আমি বুঝেছি।… তবে কী বুঝেছি, সেটা আবার জিজ্ঞেস কোরো না।

একসময় সে টের পেল, সে গল্প যথেষ্ঠই মনোযোগের সঙ্গে পড়ছে যদিও, মাঝে মাঝেই মোবাইল ফোনের দিকেও তাকাচ্ছে। তাকানোর অবশ্য দরকার নেই, ফোন বা মেসেজ এলে শব্দ হবে। তবে মাঝে মাঝে তাকানো সে বন্ধ করতে পারছে না। সে অবশ্য মনে মনে বলছে—দরকার নেই, দরকার নেই তানজিলার আমাকে ফোন করার বা মেসেজ পাঠানোর। তবে এ-ও ঠিক, তানজিলা তাকে কিছু না জানিয়ে নিশ্চুপ—এটাও সে মেনে নিতে পারছে না।

তার অভিমান হচ্ছে। সে পড়ায় মন দিলো।

ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে, মেহেরের ধারণা ছিল না।

ছুটির সকালে ছবি আঁকা ছাড়া তার আর কীইবা করার আছে। যদিও লালের প্রাধান্য যে ছবিটায়, সেটা সে এবারও ধরেনি। সে আরম্ভ করেছে নতুন এক ছবি। রঙ বসানো ও ওঠানোর জন্য সে তুলির পাশাপাশি আরো কিছু জিনিস ব্যবহার করছিল। যেমন টিস্যু পেপার, সুতি কাপড়, স্পঞ্জ। তার ধারণা হয়েছিল, এ ছবির প্রাথমিক কাজটুকু সে সহজেই শেষ করে ফেলতে পারবে। তার আগেই তার ঘরে এলেন শাফিনের মা।

মেহের খালার দিকে তাকাল না। এ সময় খালা আসায় সে বিরক্ত। ছবিটা একটানে সম্ভব এগিয়ে নিতে না পারলে পরে অসুবিধা হতে পারে। এ সময় খালার কী এমন দরকার পড়ল! এরকম ভাবনা ভর করলে মেহের আরো অবাক হলো এই ভেবেও—খালা এর আগে কখনো এভাবে তার ঘরে ঢোকেননি।

— ছবি আঁকছিস মা? খালা জিজ্ঞেস করল।

মেহের রেগে যেতে নিয়ে হেসে ফেলল—হ্যাঁ।

— তুই বোধ হয় ব্যস্ত…।

— তুমি কিছু বলতে এসেছ?

— একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম রে।

— বলে ফেলো।

খালা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন—অবস্থা তো ভালো না।

— খালা, অবস্থা ভালো না—কথা কি এটাই?

— শাফিন ওই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না।

মেহের ছবির দিক থেকে চোখ সরাল, তুলি নামিয়ে রাখল, খালার দিকে তাকাল—কেন?

— আমি বলতে পারব না। আমি জানি না। আমাকে খুলেমেলে কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে, ওই মেয়েকে তার পছন্দ না।

— এ সময়? বিয়ের আর কতদিন বাকি?

খালা বড় করে শ্বাস ফেলে চুপ করে থাকলেন।

— আপনি শাফিন ভাইকে বোঝান। এসময়ে এধরনের ইয়ার্কি মারার কোনো মানে হয় না।

— আমি বলেছি। কিন্তু একবার গোঁ ধরলে ও কি কোনোদিন কারো কথা শুনেছে?

মেহের সামান্য মাথা ঝাঁকাল। তাকে অন্যমনস্ক দেখাল।

— তুই কি ওকে একটু বুঝিয়ে বলবি?

মেহের হেসে ফেলল—খালা, তুমি না মাত্র বললে ও কারো কথা শোনে না।

— তোর তো অনেক বুদ্ধি। তুই একটা বুদ্ধি দিতে পারবি আমাকে?

মেহের আবারও হাসল—খালা, কে বলেছে আমার অনেক বুদ্ধি! আমার একটুও বুদ্ধি নেই।

খালা অসহায় গলায় বললেন—তাহলে আমি এখন কী করব!

প্রায় একই কথা বললেন বড় খালা। তিনি অবশ্য মেহেরের ঘরে এলেন না। তিনি মেহেরকে ডেকে নিয়ে গেলেন। ঘরে আর কেউ ছিল না। মেহের—খালা, ডেকেছেন—বলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। খালা চোখের ইঙ্গিতে তাকে বিছানায় বসতে বললেন। মেহের বিছানায় বসল না, তবে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। খালা তার দিকে তাকালেন। সে তাকানোর মধ্যে মেহেরের মনে হলো, কিছু ভর্ত্সনা আছে, কিছু তাচ্ছিল্যও আছে, কিছু বিদ্রূপও আছে। মেহের, ভুলটা সে কোথায় করেছে, বুঝতে পারল না। সে বুঝতে পারল—এই এখনই তাকে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

খালা বললেন—তুইই বল, আমি এখন কী করব?

এটুকুতে পরিষ্কার করে কিছুই বোঝা যায় না, বরং জটিলতা বাড়ে। মেহের পরবর্তী কথা শোনার অপেক্ষায় থাকল।

— তুই এই কাজটা কেন করতে গেলি?

মেহের প্রথমে ভাবার চেষ্টা করল সে কী করেছে। ভেবে যখন কিছুই বুঝতে পারল না, জিজ্ঞেস করল—খালা, আমি কী করেছি?

— কী করেছিস!.. কেন, তুই জানিস না শাফিন এখন ওই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না?

— শুনেছি। সেজো খালা আমাকে বলেছেন।

— শুনে কি বেশ খুশি হয়েছিস?

মেহের অবাক চোখে তাকাল। কী উত্তর দেবে, বুঝতে পারল না।

— নাকি তুই আগে থেকেই জানতিস?

— খালা। মেহের মৃদু গলায় বলল, আমি এসব কী করে জানব!

— হ্যাঁ তা বটে, তুই এসব কী করে জানবি!

মেহের চুপ করে থাকল।

— শাফিনের দুই গালে দুইটা চড় বসাতে পারলে শান্তি পেতাম। এসব কি ইয়ার্কি নাকি?

— আপনি বোঝান তাকে। আপনার কথা শাফিন ভাই শুনবে।

খালা কঠিন চোখে তাকালেন—ও কী শুনবে কী শুনবে না, তা আমি জানি।

মেহেরের কিছু বলার ইচ্ছা হলো না।

— সব দোষ আমি ওকে দিচ্ছি না। খালা মেহেরের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে বললেন। বলতে বলতে তার মুখ কঠিন হয়ে গেল—কিন্তু তুই কেন ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খেলি, বলবি?

— আমি! মেহেরের মুখ হাঁ হয়ে গেল। সে টের পেল। কিন্তু সে মুখ বন্ধ করতে পারল না।

—চিবানোর জন্য আর কোনো মাথা খুঁজে পেলি না?

— খালা, আপনি এসব কী বলছেন!

— কী বলেছি শুনতেই পেয়েছিস । ঠিক বলেছি।

— আমি শাফিন ভাইয়ের মাথা চিবিয়ে খেয়েছি?

— তুই চিবিয়ে খেয়েছিস।

মেহের টের পেল তার কান্না পাচ্ছে। তার সহজে কান্না পায় না। কিন্তু এখন তার কান্না পাচ্ছে। কান্না লুকানোর জন্য সে হেসে ফেলল।

— হাসবি না। খবরদার, হাসবি না।

— আপনি এমন একটা কথা বলেছেন…।

— এমন একটা কাথা মানে! তুই কি ভেবেছিস আমি কিছু বুঝি না?

মেহের কান্না চাপল—খালা, আপনি কিছুই বোঝেন না।

খালার মুখে হাসি দেখা গেল। তিনি আপাদমস্তক মেহেরকে দেখলেন। বললেন—তাহলে তুই বলছিস আমি কিছুই বুঝি না?

মেহের চুপ করে থাকল।

— ছবি দেখানোর নামে করে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া, ছাদে গিয়ে আর নামার নাম না করা, বারান্দায় এসে ফিসফাস…।

— খালা…!

— এসব কিছুই না, না? এসব তো আমার বোঝার কথা না, না?

গভীর হতাশায় দু’পাশে মাথা নাড়ল মেহের। কিছু বলল না সে, চুপ করে থাকল।

খালা ধমকে উঠলেন—এখন চুপ করে থাকলে হবে।

— কী বলব!

— তুই নিজে কোথায় আছিস, সেটা বুঝিস না?

— বুঝি।

— বুঝিস?

— আমার চেয়ে ভালো সেটা কেউ বোঝে না।

— তাহলে বামন হয়ে চাঁদের দিকে কেন হাত বাড়াস?

কান্নাটুকু সামলে নিয়েছে মেহের। সে খালার দিকে তাকাল। গোছানো, শান্ত গলায় বলল—আমি খুব ভালো করেই জানি আমি কোনোদিকে হাত বাড়াইনি। আমাকে আপনার এতসব বলার দরকার নেই।

গল্পের এ পর্যন্ত এসছে সে, তার মোবাইল ফোন বাজতে আরম্ভ করল। সে খুবই বিরক্ত বোধ করল। এখন কারো সঙ্গে কথা বলতে তার ইচ্ছা করছে না। এমন না, এই গল্পে সে মোহিত হয়ে আছে, কিন্তু গল্পে কী হয়েছিল মেহেরের, মনে নেই, মনেও পড়ছে না। জানতে ইচ্ছা করছে তার। সে পাশে রাখা ফোন একবার তুলে দেখল। আচেনা নাম্বার। অচেনা নাম্বারের সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে। অসুবিধা হলো—অনেকে সময় নাছোড়বান্দা ভক্ত হয়, সে সকালে শেভ করেছে কি না, এটাও জিজ্ঞেস করে বসে, কখনো হয় অপছন্দের প্রকাশ করা, কখনো অন্য নাম্বার থেকে ফোন করা সাহিত্য সম্পাদকরা। আবার, সে দেখেছে—অনেক সময় অচেনা নাম্বার থেকে জরুরি ফোন আসে। এ ফোনটা সেরকম হতে পারে। আবার, চকিতে তার এমনও মনে পড়ল—ফোনটা আবার তানজিলার হতে পারে। সে এবার মজা করার জন্য অচেনা নাম্বার থেকে ফোন করেছে। বেশ, দেখা যাক কী মজা করে। সে কল রিসিভ করল—হ্যালো।

ওপাশে নারীকণ্ঠ বলল—অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি ফোন করব…।

— তানজিলা? গলার স্বর বদলিয়েই সে চুপ করে থাকল।

— কিন্তু সাহস পাচ্ছি না, বিরক্ত হন কি না…।

— না, বলুন আপনি।… একটু তাড়াতাড়ি।

— স্যার, আপানি কি এখন তানজিলাকে নিয়ে গল্পটা লিখছেন?

— তানজিলাকে নিয়ে গল্প!… ওহ, আপনি।

— জি স্যার, আমি মেহের।… স্যার, ঐ গল্পটা কি আপনি পেয়েছেন?

— পেয়েছি। পড়ছি।

— এখন পড়ছেন, স্যার?

— হ্যাঁ, এই তো, লেখাটা হাতেই।

— কোন পর্যন্ত এসেছেন, স্যার?

— ওই যে, বড় খালা মেহেরকে বললেন—বামন হয়ে কেন চাঁদের দিকে হাত বাড়াস।…

— লেখকরা বড় নিষ্ঠুর হয়।

— কেন! সে হঠাত্ই একটু বিরক্ত বোধ করল।

— অমন একটা কথা আপনি বড় খালাকে দিয়ে আমাকে শুনিয়েছিলেন।

— পরিস্থিতি ও বড়খালার চরিত্রবিচারে ও কথাটা বড়খালার মুখে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল, না বেমানান?

— বেমানান না, স্যার। বড় খালার তখন অমন কথাই বলার কথা।

— তাহলে আর, লেখাকরা নিষ্ঠুর—এ কথা বলছেন কেন!

— এমনি স্যার, এমনি বলে ফেলছি।… আমি হয়তো খুব ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে গিয়ে, মানে ঠিক ওই ঘটনার কথা মনে পড়ল, তার আবেগতাড়িত হয়ে গেলাম।

— হুমম। তবে ওই কথাই—লেখকরা বোকা না, তারা সেরকম হওয়া দরকার, সেরকম।

— জি, স্যার… তবে, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, লেখকরা সবসময় বুদ্ধিমান না, লেখকরা মাঝে মাঝে বেশ বোকা।

— লেখকরা বোকা!

— এটা অবশ্য স্যার, কোনো লেখকই স্বীকার করবেন না।

— একটা অযৌক্তিক, অবাস্তব কথা কেন স্বীকার করবে!

— হয়তো… হয়তো স্যার লেখকরা বুদ্ধিমান… ধরে নিই বেশ বুদ্ধিমান। কিন্তু আপনি এটা কি মানবেন, লেখকদের দেখার পরও আরো কিছু থাকে?

একটু ভাবল সে—এটা হয়তো মানা যায়।

— এ বিষয়ে স্যার, আমি আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব।

— এ বিয়য়ে আরো কথা বলতে হবে?

— আপনার ফোন নাম্বার যখন নিতে পেরেছি, মাঝে মাঝে ফোন তো করবই।… বেশি করব না। আপনি খুব বিরক্ত হবেন, এতটা না।… আপনি কি ফোন বন্ধ রাখেন?

— না, সে বলল। তার মনে হলো মাঝে মাঝে ফোন বন্ধ রাখা উচিত।

— একটা কথা। আমি যেভাবে কথা বলছি, তার সঙ্গে গল্পের মেহেরের কথা বলার ধরন মিলছে না। তা-ই না?

— গল্পের মেহের একটু অন্যরকম তো বটেই। নরম, লাজুক, চাপা।

— আমি ওরকমই ছিলাম স্যার, মানে যে পর্যন্ত আপনি লিখেছিলেন, সে পর্যন্ত আমি ওরকমই ছিলাম। তারপর…। স্যার, একথাটা অন্যদিন বলব।… এখন অন্যরকম কথা বলি স্যার। এই যে আপনি গল্পটা পড়ছেন, মেহেরের জন্য কি আপনার খারাপ লাগছে?

— কিছুটা।… কিংবা হয়তো লাগছে না।… আসলে আাামার এখানে কী করার আছে…!

— কিন্তু স্যার, আমার ওই সময়ের কথা যখন ভাবছি, খারাপ লাগছে, নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে।

— ওই সময় আমি খুব চাপের মধ্যে থাকতাম… মানে, আপনি রাখতেন।

— আমি? সে হাসল। আমি কি রাখি?

— আপনি যেভাবে লিখতেন, মানে, যা লিখতেন… ওটাই রাখা।

— বেশ।… এখন গল্পটা পড়ে শেষ করি?

— জি স্যার, পড়ুন। আমি কাল ফোন করব।… স্যার, একটা কথা।…

— হ্যাঁ।

— তানজিলা কে স্যার?

— কেউ না।

— কেউ তো বটেই।

— সত্যিই কেউ না।

— ঠিক আছে। পড়ুন স্যার। কাল কথা হবে।

সে ফোন একপাশে রেখে গল্পে চোখ নামাল। তখন কফি খেয়ে ভালো লাগেনি তার। এখন চা খেতে ইচ্ছা করছে। কে বানাবে? বললে সায়রা ঠিকই বানিয়ে দেবে। কিন্তু তার বলতে ইচ্ছা করল না। সে পড়তে আরম্ভ করল।

এমন একটা প্রশ্নের উত্তর এমন হতে পারে, মেহেরের এতটুকু ধারণা ছিল না। তার অনুমানশক্তি ভালো। প্রশ্ন-উত্তর পর্বেও সে সহজে হেরে যাওয়ার নয়। কিন্তু শাফিনের এমন উত্তর তার আন্দাজের মধ্যেও ছিল না।

সে শাফিনের দিকে তাকাল। বিকালের শেষ আলোর কিছুটা এসে পড়েছে শাফিনের মুখের ওপর। শাফিনের মুখে মৃদু হাসি। বিকেলের আলো আর তার হাসি—এই দুই মিলে মনে হচ্ছে সে খুব কাছের, আবার খুব দূরেরও। মেহের একটু যেন থমকে গেল। তার মনে হলো—আচ্ছা, ব্যাপারটা কি এরকম। আমি শাফিনের কাছ থেকে এমন উত্তরই চাচ্ছিলাম।

তারা ছাদে এসেছে বিকেলে। মেজো খালা বলেছেন—মা, তুই পারবি। তুই ওকে একটু বোঝা। আর, মেহেরের মা বলেছেন—এসব কীরে মেহের, এসব কী শুনি! শাফিন এমন কেন করছে! তোর বড় ভাই ও…। মেহের বলেছে—আমি দেখব, মা।

যদিও কী দেখবে সে, তার নিজেরই ঠিকঠাক জানা নেই। তার নিজের অজান্তেই সে যখন জড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু কিছু তো তাকে দেখতেই হয়। সেজন্যই শাফিন যখন ছাদে যাওয়ার কথা বলল, সে রাজি হয়ে গেল, ও ছাদে এসে একটু পর যখন ওই কথা উঠল, মেহের বলল—তুমি যে এই বিয়েতে এখন রাজি হচ্ছে না, তুমি কি জানো, বড় খালা আমাকে কী বলেছেন!

— সম্ভবত এরকম কিছু বলেছেন—তুমি যেন আমাকে ভালো করে বোঝাও।

— এটাও বলেছেন বইকি, তবে এটা তিনি বলতেই পারেন। যেটা পারেন না, সেটাও বলেছেন।

— কী সেটা?

— বলেছেন, আমি তোমার মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছি।

— খালা কেন এটা বলতে পারেন না?

— কেন বলবেন! কী আশ্চর্য!

— খালা ভুল কিছু বলেছেন বলে আমার মনে হচ্ছে না।

— মানে! কী বলো এসব!

— কথা সত্যি। তুমি সত্যিই আমার মাথা চিবিয়ে খেয়েছ।

মেহের তাকাল শাফিনের দিকে। শাফিনের মুখে তখনো রোদ ও হাসি মিলেমিশে খেলা করছে। মেহেরের প্রথম মনে হলো, এমন উত্তর সে কখনো আশা করেনি। একটু পর সে অবশ্য অন্যরকম ভাবতে আরম্ভ করল। তার মনে হলো, আসলে এরকম কিছুই সে শুনতে চেয়েছিল। সে হাসল, তারপর বড় করে শ্বাস ফেলে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে-নাড়তে বলল, শাফিন ভাই, তুমি কিছু ইয়ার্কি মারতে পারোও বটে।

শাফিন শান্ত গলায় জবাব দিল—এটা ইয়ার্কি না।

— তা-ই? এটা ইয়ার্কি না?

শাফিনের মুখে একটা হাসি হাসি ছাপ ছিল, সেটা মিলিয়ে গেল। সে বলল—তোমাকে কে বলেছে, এটা ইয়ার্কি!

— সবাই বলেছে। যারা নতুন করে শুনবে, তারাও বলবে।

— আশ্চর্য! কথাটা বলেছি আমি, আমি জানি না আমি কী বলেছি!

— দেখো… বড়খালা আমাকে আর কী বলেছেন, জানো?

— জানি না। … তুমি এত বড়খালা বড়খালা করো কেন!

— বড়খালা বলেছেন, বামন হয়ে যেন চাঁদের দিকে হাত না বাড়াই।

— কে বামন কে চাঁদ—বড়খালা সব জেনে বসে আছেন!

— শোনো শাফিন ভাই, মা আর মেজোখালাও খুব করে বলেছেন—আমি যেন তোমাকে বোঝাই। যেন হঠাত্ করে আরম্ভ করা তোমার এই পাগলামো তুমি বন্ধ করে দাও।… বুঝতেই পারছ, আমি এখন তোমাকে বোঝাব।

— তার আগে আমার কিছু কথা আছে।

— কী কথা? তুমি জারিনাকে বিয়ে করতে রাজি আছ? নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ?

— আমাকে আমার কথাগুলো বলতে দাও।

— আগে আমি তোমাকে বুঝিয়ে নিই, তারপর বলো।

— না, আগে আমার কথা শুনতে হবে।

— ঠিক আছে, বলো।

— তোমার কি সত্যিই ঐ অঙ্কের মাস্টারের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে?

— অনেকটাই।

— কিন্তু তিনি ছবির কিছুই বুঝবেন না, তুমিই বলেছ।

— তো?

— তুমি বলোনি?

— বলেছি। কিন্তু উলটোটাও হতে পারে। হয়তো আমার আঁকা ছবি দেখে সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাবে। বলবে—কী সুন্দর, মেহের, কী সুন্দর! হয়তো আমাকে বলবে—শোনো, সামনে জ্যোত্স্না। জ্যোত্স্নায় তুমি পুকুরপাড়ে বসে ছবি আঁকবে, আমি পাশে বসে দেখব।… জীবনে রহস্যের শেষ নেই। এরকম ভাবতে দোষ নেই।

— দোষ আছে। শাফিনের গলা কঠিন শোনাল। কারণ, সে সত্যিই ছবি বুঝবে না।

— সেটা তুমি কী করে জানো?

— আমি জানি। শাফিনের গলা একইসঙ্গে কঠিন ও শীতল।

মেহের হাসল—ভালো।

— তোমাকে একটা কথা বলব আমি।… এখন বলব?

— এখনই বলো।

— এটা অন্য কথাও। এটা তোমাকে আমার বলতেই হবে। তুমি শুনবে না?

— শুনব। বলো।

— তুমি কি আমাকে পছন্দ করো?

— করি।

— কতটা?

— অনেক।

— এখন তোমাকে আরেকটা প্রশ্ন করব।… করব?

— করো। আমি অবশ্য আন্দাজ করতে পারছি তুমি কী প্রশ্ন করবে।

— তুমি আমাকে বিয়ে করবে?

— না।

মেহের ভেবেছিল রাতটা সে পার করে দেবে ছবি এঁকে এঁকে। ছবি সে আঁকতেও আরম্ভ করেছিল। কিন্তু সে দেখল, কোনো ছবিই তার এগোচ্ছে না। বরং কিছু হ্যান্ডমেড পেপার নষ্ট হলো তার, কিছু ক্যানভাস। অসমাপ্ত ছবির দু-তিনটাও যেরকম হওয়ার কথা ছিল, সেরকম না হয়ে অন্যরকম হয়ে গেল। মেহের তখন ছবি ছেড়ে উঠল।

সে ছবি ছেড়ে উঠল বটে, কিন্তু কিছু করারও নেই তার। আজ, যত চেষ্টাই করুক, তার ঘুম হবে না, সে জানে। ঘুম যখন হবে না, বিছানায় যেতে তার ইচ্ছা করল না। তাহলে কী করবে? পর্দা একটু সরিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে? কিন্তু জানালার বাইরে সামনের বাড়ির কিছু অংশ ছাড়া আর কিছুই নেই দেখার। হাঁটবে তাহলে, সারা ঘরে, ঘুরে ঘুরে? নাকি ছাদে যাবে?

ছাদে গেলে সমস্যা আছে। আছে, বা হতে পারে। দেখা গেল শাফিনও হাঁটছে ছাদে। তাকে দেখে ছুটে এসে বলল—আমার মন বলছিল তুমি আসবে। কিংবা, সে যাবে ছাদে, দেখবে, কেউ নেই, কিন্তু একটু পর উঠে আসবে ছাদে—আমি জানতাম।

তাহলে কি ছাদেই যাবে সে?… মেহের দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না, সে ছাদে যাবে না। এখন, সে বরং অন্য একটা কাজ করতে পারে। শাফিনকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। সেই উত্তর সে এখন ঠিক করতে পারে।

শাফিন জিজ্ঞেস করেছিল—কেন?

সে বলেছিল—এ হয় না।

— কেন হয় না! শাফিন চেঁচিয়ে উঠেছিল। তুমিই বললে তুমি আমাকে পছন্দ করো।

— করি। তো? বিয়ে করতে হবে?

— হ্যাঁ হবে।

মেহের হেসেছিল—যা হয় না, যা হওয়ার নয়, যে প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হিসেবেই নির্ধারিত হয়ে আছে, আমি সে প্রশ্নের উত্তরে কী করে ‘হ্যাঁ’ বলব?

— আশ্চর্য!

— এখানে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সবাইকে সবার অবস্থানটা বুঝতে হয়।

শাফিন রেগে গিয়েছিল—তাহলে কেন, কেন তুমি আমাকে কথাটা বলতে দিয়েছিলে?

এই প্রশ্নের উত্তরটা দেওয়া হয়নি—কেন সে শাফিনকে কথাটা বলতে দিলো।

শাফিন বারবার চেঁচাচ্ছিল—বলো বলো বলো, বলো তুমি।

— কী বলব?

— কী বলবে মানে! শাফিন আরো রেগে গিয়েছিল। তুমিই-না বললে আমি কী বলব, সেটা তুমি আন্দাজ করতে পারছ।

— বলেছি।… ভুল বলিনি। আন্দাজ করতে পারছিলাম।

— উত্তর যদি তোমার ‘না’ই হবে, তবে তুমি কেন আমার কথাটা শুনলে! কেন তুমি আমি বলার আগেই বললে না, তুমি কথাটা শুনতে চাও না?

শাফিনের এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি।

দেওয়া যায়। এখন এই প্রশ্নের উত্তর মেহেরের কাছে আছে। আগে অস্পষ্ট ছিল উত্তরটা, একটু একটু করে সেটা এখন অনেক স্পষ্ট।

নাকি, কে জানে, স্পষ্ট হয়ে অনেক আগেই ছিল, সে স্বীকার করেনি?

সে যা-ই হোক, শাফিন যদি তাকে জিজ্ঞেস করে আবার, কিংবা জিজ্ঞেস না-ই করুক শাফিন, সে নিজেই বলতে পারে শাফিনকে—বলব? কেন আমি তোমাকে কথাটা বলতে বাধা দেইনি?

শাফিন হয়তো অবাক হয়ে যাবে—বলবে? কিংবা সে হয়তো অবাক হবে না, তবে কৌতূহলী হবে অবশ্যই—উত্তরটা আছে তোমার কাছে?

— আছে। তুমি শুনতে চাইলে বলতে পারি।

— বলো।

সে তখন মৃদুগলায়, শোনা যায় কি যায় না, এমনভাবে বলবে—শাফিন ভাই, আমার যে তোমার মুখ থেকে শুনতে বড় ইচ্ছা করছিল।

— স্যার, শেষটা নিশ্চয় আরে নানারকম হতে পারত? মেহের এই কথা জিজ্ঞেস করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

সে নিজের আগ্রহ থেকে আজ মেহেরের সঙ্গে দেখা করেছে। গতরাতে গল্পটা শেষ করার পরই তার মেহেরকে ফোন করার ইচ্ছা হয়েছিল, ঠিক নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে নয়, এমনিই তার কথা বলতে ইচ্ছা করছিল—মেহের, গল্পটার কথা আমি আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম।… এইমাত্র শেষ করলাম।

— বেশ আগের গল্প কিন্তু, স্যার।

— হ্যাঁ, তা-ই তো দেখছি।

— কেমন লাগল আপনার?

— নিজের লেখা খারাপ বলতে ইচ্ছা করে না।… তবে অবশ্যই গল্পটা এমন কিছু নয়, তবে, আবার, ফেলে দেওয়াও যায় না।

— কিন্তু যাদের নিয়ে লেখা, তাদের জন্য ইমপর্ট্যান্ট। তা-ই না, স্যার?

— হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই।

— মানুষের জীবনে এরকম অনেক গল্প…।

— হ্যাঁ, অনেক। কতরকম…।

— লেখকদের একটা বড় সুবিধা কি জানেন?

— লেখকদের আসলে বিশেষ কোনো সুবিধা নেই।

— আছে। তারা যেখান থেকে ইচ্ছা গল্প শুরু করতে পারেন, আবার যেখানে ইচ্ছা শেষ করে দিতে পারেন। পাঠককে শুধু এই ভাবনাটা দিতে হয়—হ্যাঁ, এখানে বা এভাবে শেষ হতেই পারে। পাঠক মেনে নেয়। ভাবে—হ্যাঁ, এই তো, এরকমই।

— অসুবিধা কী?

— তারপর লেখকের আর কোনো দায় নেই। এই হলো অসুবিধা।

কাল রাতে গল্পটা শেষ করার পর যা হয়েছে, মেহেরের সঙ্গে সেই বিকেলে দেখা।

হয়েছিল বলেই ভাবনাটা মাথায় এসেছে, এটা বোঝাই যায়, তার মনে হলো—আচ্ছা, শেষ হলো এক জায়গায়, গল্প এভাবেই শেষ হয়, কিন্তু তারপর কী হলো? কী খবর এখন মেহেরর? কাল রাতে ফোন করার ইচ্ছাটা আসলে এ কারণেই হয়েছিল। তবে সে নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছিল। নিজের চরিত্রকে লেখক তার উতলা হওয়া বুঝতে দিতে পারে না।

তার ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে পড়ার অভ্যাস। ঘুমোতে-ঘুমোতে রাত একটা-দেড়টার মতো হয়ে যায়, উঠতে উঠতে সাড়ে পাঁচ-ছয়। আরো কিছুক্ষণ ঘুম দরকার, ইদানীং সে বুঝতে পারছে—হ্যাঁ, কিছু বয়স তো হলো।

সে ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণ পর এক মগ কালো কফি হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কখনো বসে, কখনো ছোট বারান্দায় কফিতে চুমুক দিতে দিতে এদিক-ওদিক করে। আজও ওরকম। বসল কিছুক্ষণ, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। সকালে তার মেহেরের কথা যত না মনে পড়ল, তার চেয়ে বেশি মনে হলো তানজিলার কথা।

রাতে তানজিলাকে সে ফোন করেছিল। সে আর সায়রা টিভি দেখছিল। সাউন্ডটা কমিয়ে দাও—বলে সায়রা ঘুমিয়ে পড়ল, আর, সে টিভি দেখে গেল ও মাঝে মাঝে ফোন করল তানজিলাকে। সে বুঝতে পারছিল, তানজিলার ফোন সে আজই পাবে। কিন্তু তার হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করছিল না। তাছাড়া, এরকমও তার মনে হচ্ছিল—হঠাত্ দেখা যাবে তানজিলার ফোন খোলা। তার ফোন চলে যাবে তানজিলার ফোনে, সে বলবে—এসবের মানে কী! বলো আমাকে, এসবের মানে কী!

— ওহ, তুমি! আমি ভাবলাম এত রাতে কে না কে!

— অন্য কাউকে আশা করছিলে?

— অন্য কাকে আশা করব!

— সে তুমি জানো।

— আজেবাজে ছাড়া তোমার আর কোনো কথা নেই?

— আছে। একটাই।… কাল আসোনি কেন?

— এমন কি হতে পারে না, খুব বড় ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম?

— তানজিলা, সেটাই আমি জানতে চাচ্ছি।

— বলব।… আমি কি তোমাকে সব বলি না?

— বলো! তুমি কি সব বলো?

— তুমিই বরং বলো না। আমি আশা করেছিলাম, তোমার সবকিছু বলবে আমাকে।

— বলি।… বলতে চাই।… তানজিলা, আমি আসলেই বলতে চাই।

— বলবে। আমি আছি শোনার জন্য।

— হুঁ। … কাল আসোনি কেন?

— তোমার কি আর কোনো কথা নেই?

— আছে। তবে এটাও আমার জানা দরকার কাল কেন আসোনি।

— কাল যাইনি বলে কখনো যাব না, কথা নিশ্চয় এমন নয়।

— কী কথার কী উত্তর! কাল কেন আসোনি, এটুকু বলো।

— বলব।… খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে।

— সে তুমি জানো।… আমি অপেক্ষা করতে করতে…!

— মানুষটার অভিমান হলো বুঝি!

— অভিমান হলে খুব কি অন্যায় হয়ে যাবে?

— শেনো, তোমার সবুজ রঙ পছন্দ?

— খুব।

— জানি। আমি সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরব। কপালে সবুজ টিপ। লিপস্টিক দেবো না। কাচের চুড়ি থাকবে হাতে, পায়ে পাতলা স্যান্ডেল, কানে লম্বাটে দুল—আমি এভাবে যাব তোমার কাছে।

— সত্যি? বলো, কবে?

— আমি তোমার হাত ধরব, তুমিও আমার হাত ধরবে। আমরা দুজন দুজনের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে যাব।

— তানজিলা, আমি আজ অপেক্ষা করে ছিলাম,… আমি অপেক্ষা করে থাকি…। তুমি বোঝো না?

— আমি আরেকদিন তোমার কাছে যাব জিন্সের প্যান্ট আর ফতুয়া পরে। ওভাবেও আমাকে দারুণ লাগে, জানো? সেদিন তোমাকে একটু কামড়াব।

— কামড়াবে?

— হ্যাঁ। কারণ, আমাদের মধ্যে এমন কথা প্রচলিত আছে জিন্স-ফতুয়া পরা মেয়েরা একটু অ্যাগ্রেসিভ হয়।… তবে আলতো করে কামড়াব।… তুমি জোরে বললে জোরে।

— আমি বুঝি ছেড়ে দেবো?

— দিও না।… ঘুমাও এখন, রাত হয়েছে। আমাদের কথা বলার জন্য বহুবহু দিন পড়ে আছে।

মেহেরের সঙ্গে তার কথা হলো সকালে। সে কফির মগ হাতে বারান্দায় এসে বসেছে। নতুন একটা গল্প তার মাথায় ঘুরতে আরম্ভ করেছে। এ সময় মেহেরের ফোন। নতুন গল্প নিয়ে ভাবার সময় কারো ফোন এলে সে খুব বিরক্ত হয়। মেহেরের ফোন তাকে বিরক্ত করল না, সে বলল—আমি জানতাম তুমি ফোন করবে।

— এটা স্যার, জানা খুব সহজ।… এখন লিখতে বসবেন?

— না। কিছুটা সময় আছে হাতে।

— আমার কথাও বেশি না, স্যার।… আসলে আপনাকে আমার কিছু কথা বলার আছে।

— এখন নিশ্চয় বলবে না?

— এখন না, স্যার, এখন না।… মুখোমুখি বলব। কিছু সময় দেবেন?

— হ্যাঁ, দেবো। কখন?

— বিকেলে, স্যার। ওই জায়গায়ই পাঁচটার দিকে?

সে রাজি হয়ে গেল। ফোন ছাড়ার পর সে একটা ব্যাপার অবাক হয়ে ভাবল—মেহের একবার বলতেই সে রাজি হয়ে গেল, অথচ, তানজিলা যখন আজিজে দেখা করতে চেয়েছিল, সে ইতস্তত ও বিব্রতবোধ করছিল, মেহেরের সঙ্গে ওখানে দেখা করতে তার ওসব কিছুই হচ্ছে না।

বিকেলে যখন দেখা হলো মেহেরের সঙ্গে, চারপাশে আরো অনেক লোক, তাদের অনেকেই তার চেনা, কিন্তু সে সহজ থাকল। মেহের যখন ভিড় কাটিয়ে তার সামনে এসে থামল, হাসল, সে-ও হাসল—তুমি সেই আগের মতোই স্নিগ্ধ।

— কিন্তু আপনি আমার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। আমাকে চিনতেই পারছিলেন না।

— আমি গতরাতে তারিখটা দেখলাম। গল্পটা বেশ আগের।

— তা ঠিক। সময় কম পার হয়নি। তবু আমার কী মনে হতো, জানেন? মনে হতো আপনি আমাকে দেখলেই চিনতে পারবেন।

— তোমাকে কিন্তু আমার চেনা চেনা লাগছিল।

— আমার ধারণা, আপনি আমাকে অন্য কেউ ভেবেছিলেন।

সে একটু হাসল।

— তার কথা আমাকে বলবেন?

— তার কথা পড়ে। তোমার কথা শুনি।

— স্যার, খেয়াল করেছেন, আমি লাল শাড়ি পরেছি…।

— হুমম।… তোমার একটা ছবিতে লালের প্রাধান্য ছিল।

— সেজন্যই।… বসি কোথাও?

— হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো।

— একটা কথা, স্যার।… আপনার হাতটা একটু ধরব।… মানে আপনার হাত ধরে হেঁটে যাব।

— ধরো। সে হাত কিছুটা বাড়িয়ে দিলো। মেহের হাত বাড়িয়েই রেখেছিল। তারা এগোতে আরম্ভ করল।

সে ভেবেছিল, একটু অস্বস্তি তার লাগতেও পারে। তেমন কিছু হলো না। যেন মেহেরের হাত ধরে এভাবে হেঁটে যাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই।

কিছু নেই?… কিছু দূর এগিয়েই তার ভয় করতে শুরু করল। সে তানজিলার কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। এখন তার মনে পড়ছে, এখন সে ভয় পাচ্ছে। এখন যদি তানজিলা তাকে দেখে, সে থাকতেই পারে এখানে, আর, তাকে দেখতেও পারে, কী হবে!

— একটা সত্যি কথা বলবে তুমি? প্লিজ, শুধু একটা সত্যি কথা।

— বলব না কেন! তোমাকে না বলার কিছু নেই আমার।

— মেয়েটা কে ছিল?

— কোন মেয়ে?

— ভুলে গেছ? এখন কিছুই মনে পড়ছে না!

— বুঝেছি। মেহের। তুমি মেহেরের কথা বলছ।

— তুমি মেহের বললে, আর আমি চিনে গেলাম!

— ওকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। লিখেছিলাম মানে, ও ছিল ওই গল্পে।

— গল্পে ছিল, শুধু এটুকুতেই হতো! হাত ধরা!

— না, না, মানে ও নায়িকা হিসেবেই ছিল।

— গল্পের নায়িকা। তোমার না।

— আহা, হাত ধরা এমন কী ব্যাপার! সহজভাবে নিলেই হয়।

— সম্ভব না।… আমার মনোভাব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে রাখতে চাই।

— তুমি একটু বেশি রিঅ্যাক্ট করছ…।

— চুপ। একদম চুপ। আর কোনোদিন যদি দেখি তুমি কোনো মেয়ের হাত ধরেছ, তাহলে আমি কী করব, তুমি তার কিছুই জানো না।

— আমি কি মেয়েদের হাত ধরেই থাকি? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে মেয়েদের হাত ধরাই আমার পেশা।

— আমি ছাড়া আর কারো হাত তুমি ধরবে না। ভুলেও না।… ধরলে আমি থাকব না।

— কোথায় যাবে?

— তোমার কাছে থাকব না, এটাই কথা।

— তুমি আমাকে ছেড়ে থামতে পারবে?

— হাহ্!

মেহের তাকে বলল—স্যার, শেষটা নিশ্চয় আরো নানারকম হতে পারত।

সে মাথা ঝাঁকাল—অন্যরকম হওয়ার একটা ব্যাপার সবসময়ই থেকে যায়।

— কিন্তু তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যায় অন্য গল্প। তা-ই না, স্যার?

— হ্যাঁ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা নতুন গল্প।… তুমি দেখি অনেক বোঝো!

মেহের একটুক্ষণ চুপ করে থাকল—না, এটা ঠিক কথা না। আমি অনেক বুঝি না। যদিও আমার নিজেরও একসময় তেমনই ধারণা ছিল। কিন্তু পরে দেখেছি আমার ধারণা ভুল।

মেহেরের কথা কানে বাজল তার। সে মেহেরের মুখের দিকে তাকাল, তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। সে বলল—এভাবে বলছ!… কী হয়েছে?

— আছে স্যার।… বলব আপনাকে।… আচ্ছা স্যার, এমন কি হতে পারত, আমি গল্পটার কথা বলছি—ওখানে আমার বিয়ে প্রায় ঠিক, কিন্তু এমন কি হতে পারত—আমার বিয়ে পুরোই ঠিক ওই অঙ্কের মাস্টারের সঙ্গে।

— সে সামান্য মাথা ঝাঁকাল, মৃদু হাসল—তারপর?

— আর সবকিছু ঠিক থাকবে।

— বেশ। তারপর?

— তারপর শাফিন আমাকে তার দুর্বলতার কথা বলবে।… আপনি এভাবে লিখতে পারতেন।

— সেটা অন্য গল্প হতো। আর, এখন, আমি কীভাবে পারতাম সেটা কথা না। তুমি কী বলতে চাও, সেটাই কথা।

— আমি, যা বলতে চাই। মেহেরকে ভাবতে হলো না। আমি চাই শাফিন দুর্বল হলো ও একপর্যায়ে এসে আমাকে গভীর ক্রোধ ও ক্ষোভের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল—তুমি জানো! তুমি জানো এ বিয়েতে তুমি সুখী হবে না, তাও, তাও কেন তুমি এ বিয়েতে রাজি হয়েছিলে?

— আচ্ছা! সে দেখল সে বেশ কৌতূহল বোধ করছে। তারপর?

— আমাকে তখন একটা উত্তর দিতে হতো। হতো না?

— হতো। গল্প শেষ করতে হবে। অবশ্য উত্তর না দিয়েও গল্প শেষ করা যায়।

— যায় হয়তো। কিন্তু আমি উত্তর দিতে চাই।

— তোমার উত্তর তাহলে শোনা যাক।

— শাফিন ওই প্রশ্ন করলে আমি ভাবব। অনেক ভাবব। ভাবতে ভাবতে আমি একটা উত্তর তৈরি করব। উত্তরটা হবে এরকম— শাফিন তো জানতে চাইবে—কেন, কেন ওই বিয়েতে আমি রাজি হয়েছিলাম, আমি এর উত্তরে, এর উত্তরে আমি বলব—আমি কি জানতাম, আমি কি জানতাম তুমি আসবে!

— সুন্দর! তার মুখে হাসি দেখা গেল।

সেই হাসি কিছুটা ছড়াল মেহেরের মুখে—সত্যি?

— হ্যাঁ, সত্যি।… কিন্তু মেহের, এটা প্রায় একই ব্যাপার। এভাবে শেষ করলে বাড়তি কী লাভ?

— আছে। বিয়ের ব্যাপারটা থাকছে না।

— কিন্তু তুমি বিয়ের ব্যাপারেই বলছ!

— তা বলছি। পার্থক্য হলো, আমার এখানে বিয়ের ব্যাপারটা ফাইনাল। সেজন্যই আমি বলব, আমি কি জানতাম শাফিন আসবে।

— একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। বিয়ের ব্যাপার থাকলে সমস্যা কী।

— আছে।

— আছে যখন, বুঝতে দাও। শুনি।

— তাহলে বিয়েটা হতো না।

— কিন্তু তোমার অতদূর যাওয়ার দরকার কী!

— আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না, না?

— কী বুঝব, সেটাই বুঝতে পারছি না।

— চলুন, উঠি। একটু হাঁটব আপনার সঙ্গে।

— ব্যাপারটা কী, সেটা বলো।

— হাঁটতে হাঁটতে বলব। তবে আপনি প্রিয় তানজিলাকে দূরে রাখবেন।

— তুমি এর মধ্যে তানজিলাকে পেলে কোথায়!

— একটা কথা বলেই ফেলি, তানজিলাকে আমার পছন্দ না।

— কেন কেন! তোমার সমস্যা কী?

— সে আপনি বুঝবেন না। লেখকরা সব বুঝতে পারে, এ আমি কখনো বিশ্বাস করি না।

— সেটা কোনো লেখক দাবিও করে না।

— দাবি করে না, কিন্তু ভাবটা নেয়।… স্যার, আপনার হাতটা দিন।

— আমার হাত দিয়ে কী করবে?

— ধরব। ধরে হাঁটব। এই সুযোগ আদৌ আর পাব কি না, জানি না।

সে অনিচ্ছায় হাতটা বাড়াল। তার এই অনিচ্ছা মেহের টের পেল। সে অবশ্য হাত ছাড়ল না। তবে সে হাসল—হাসলাম কেন, জানেন?

— ভাবছিলাম, জিজ্ঞেস করব, কেন?

— পরে বলব। এখন অন্য একটা কথা বলি। এটাও জরুরি।

সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

মেহের হাসল—শোনার ইচ্ছা কতটা?

— অনেক।

— আমার আর শাফিনের বিয়ে হয়েছে।

বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করল না তার। সে গেল এক বন্ধুর বাসায়। বন্ধুটি অবিবাহিত, অবশ্য ইদানীং সে হঠাত্ হঠাত্ বিয়ের কথা বলে—বয়স হচ্ছে। যতই বয়স হচ্ছে, বুঝতে পারছি, বিয়েটা করা উচিত ছিল।

কোনো কোনো বন্ধু এই কথা শুনে নাখোশ হয়—কী যে বলো তুমি! দিব্যি আছ।

তাদের আশঙ্কা, এ বাড়িতে বউ এলে, এই যে তারা খালি বাড়ি পেয়ে প্রেমিকা নিয়ে আসছে, প্রেমিকা বানাতে পারলে আসছে, উত্সাহী মেয়ে পেলে আসছে—সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। তার এখন পর্যন্ত তেমন প্রয়োজন পড়েনি। পড়েনি, ঠিক আছে, পড়বে না—তানজিলার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে তার মনে হচ্ছে—পড়বে না, এ হলফ করে বলা যায় না। হয়তো তানজিলাই একদিন এমন বলবে—আমি বুঝি সবসময়ই রাস্তায় রাস্তায় ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে ঘুরে বেড়াব তোমার সঙ্গে?

— অন্য কারো সঙ্গে ঘুরতে চাও? সে নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করবে।

— এমন মার খাবে, কেঁদেও কূল পাবে না।

— তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদব? হাসিমুখে কথাটা বলেই সে একটু চমকাল। তানজিলা, এ কথাটা তুমি অন্যভাবে নিও না। কিন্তু এ কথাটা ঠিক, তোমাকে জড়িয়ে ধরে আমার মাঝে মাঝে খুব কাঁদতে ইচ্ছা করে।

— ওমা, এটা কী কথা!

— মনে হয় তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে আমি অনেক অনেক হালকা হয়ে যাব।

— বলছ? ভালো লাগবে তোমার?

— আমি যদি এভাবে জানতে চাই—আমার কান্না শুষে নিতে ভালো লাগবে না তোমার?

— লাগবে লাগবে।… কিন্তু তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে কোথায় কাঁদবে সোনা?

— আছে…। এক বন্ধুর বাসা। খালিই পড়ে থাকে।… যাবে?

— কেউ থাকে না? কোনো অসুবিধা নেই?

— কিসের অসুবিধা! বন্ধু একাই থাকে। কিন্তু আমরা যখন যাব, ও থাকবে না।

— যাব।… আমার অনেকদিনের ইচ্ছা তোমাকে রান্না করে খাওয়াব।

— সত্যি! দারুণ হবে কিন্তু।

— আমার রান্না যদিও খুবই পচা, তবে আমি রান্না করেছি, তুমি খাচ্ছ, আমি তোমার পাশে বসে বা দাঁড়িয়ে আছি, এটা-ওটা তুলে দিচ্ছি, এটাই হচ্ছে ব্যাপার।

— দারুণ দৃশ্য।… তানজিলা, আমরা কিন্তু সারাদিন থাকব।

— সারাদিন? … আচ্ছা। আমার অসুবিধা নেই।

— আরেকটা কথা।

— বলো।

— তুমি কিন্তু আমার ওপর রাগ করতে পারবে না।

— আমি কেন তোমার ওপর রাগ করব। বলো।

— আমি কিন্তু তোমাকে আদর করব।

— আচ্ছা! ফাঁকাবাড়ির রহস্য একটু একটু করে উদ্ঘাটিত হচ্ছে।

— তানজিলা…।

— ইশ, ছেলের অভিমান হয়েছে।… শোনো, কেন তুমি আমাকে আদর করতে পারবে না!

পরিষ্কার বুঝবে না সে, সে তাকিয়ে থাকবে তানজিলার দিকে।

— তুমি যদি আমাকে আদর না করো, আমার ভালো লাগবে?

তার মুখ হাসিতে ভরে যাবে।

— তবে শর্ত আছে একটা।

— শর্ত… কী শর্ত…!

— আমাকে এলোমেলো করে দেবে তুমি।… বলো, আদরে আদরে তুমি আমাকে এলোমেলো করে দিতে পারবে না?

বাড়ি ফিরে লিখতে বসাটা খুব জরুরি ছিল। সেই কবে সে ইমদাদকে বলে রেখেছে—গল্প দেবে। শুরুও করেছে, শেষ করতে পারছে না। সে যখন বাড়ি ফেরার পথে, ইমদাদ ফোন করেছিল। ইমদাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আন্তরিক, কিছু ঠাট্টা-ইয়ার্কিও চলে, তাই ইমদাদ সহজেই বলতে পারল—গল্প লিখতে এতদিন লাগে, তা জানতাম না।

— এই এখন জানছ। এটাও জানবে যে, গল্প লিখতে আরো বেশিদিন লাগতেও পারে।

— তা পারে। কিন্তু আমার বিশেষ সংখ্যা বের হওয়ার জন্য ছটফট করছে।

— একটা কথা আছে না—জুত? ঠিক জুত করতে পারছি না।

— ফসকে ফসকে যাচ্ছে?

— ফসকে ফসকে যাচ্ছে।

— ভাই, ছাই নিয়ে বসেন। বললে আমি কিছু পাঠাই।

— লাভ হবে না… এরমধ্যে আবার নতুন ঝামেলা…।

— কী হয়েছে?

— মেহের…। তুমি বুঝবে না। যা-ই হোক, গল্প দিচ্ছি। আর কয়েকটা দিন।

— এত সময় যে কেন লাগছে!… মেয়েটা কি আর ফোন করছে না?

— কোন মেয়ে?

— ওই যে, বলেছিলেন না—একটা মেয়ে, পাঠক, ফোন করছে লেখককে। লেখক মনে করছেন, মেয়েটি তার চেনা, পরিচিত, কিন্তু সে চিনতে পারছে না। বারবার লেখক ভাবছে— কে, কে…।

— হুঁ হুঁ, আর বলতে হবে না। সে হাসল। আইডিয়াটা খারাপ ছিল না।

— আমারও বেশ পছন্দ হয়েছিল।

—ফোন আসছে মেয়েটির, চেনাচেনা মনে হচ্ছে, পরিচিত মনে হচ্ছে, কিন্তু চিনতে পারছে না। লেখক প্রতিবারই ভাবছে—ঠিকই চিনবে সে, তখন তার মনে হবে—আচ্ছা! তাহলে এ!… ইমদাদ, তুমি ভেবো না। লিখে ফেলব।

মেহের ফোন করেছিল দুপুরের দিকে। সে তখন ইমদাদের কথা ভেবেই লেখার টেবিলে। সে মেহেরকে বলল—তোমার কি জরুরি কিছু? আমি লিখছি।

— তানজিলা নায়িকা?

— তুমি পেয়েছ এক তানজিলা।

— বুঝি।

— পরে ফোন করবে?

— না।… সন্ধ্যায় দেখা হবে?

— আজ? … লিখতে চাচ্ছিলাম।

— কাল রাতে আমার ফ্লাইট।

— কোথায় যাচ্ছ?

— যেখানে থাকি।… দেখা হলে বলব। … আমার আসল গল্পও এখনো বলা হয়নি।

— বললে তো… তোমার আর শাফিনের বিয়ে হয়েছে।

— ওটা একটা লাইন মাত্র—আমার আর শাফিনের বিয়ে হয়েছে। একটা ঘটনা। এই ঘটনার সঙ্গে আরো কিছু আছে।

— থাকবেই। কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন বা একক না।

— সেটুকু শুনবেন না? লেখক হিসেবে আপনার কৌতূহল হচ্ছে না?

— নাহ।

— নাহ?

— জীবনের সব গল্পই আমার শুনতে হবে? জীবনের সব গল্পই কি কৌতূহলের? তোমার আর শাফিনের কাছে হয়তো তোমাদের গল্প ইউনিক, বাকি অনেকের, বা কারো কাছেই হয়তো সেকরম না।

— কিন্তু এই গল্প আপনিই শুরু করেছিলেন।

— শেষও করেছি। বাকি অংশ তোমাদের।

— সেটুকুই শুনুন। একটা শেষ হয়ে যাওয়া গল্পের বাকি অংশ।

তাদের দেখা হয়েছে এক রেস্তোরাঁয়। এটা মেহেরের ইচ্ছা। সে বলেছে, সে একসঙ্গে লাঞ্চ করবে। আবার কবে দেখা হবে, তার ঠিক নেই, দেখা যে হবেই, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। মেহের বলেছে—আমরা চা খেতে খেতে আড্ডা দিই, শাফিন চলে আসবে।

— তার জানা ছিল না, সে জিজ্ঞেস করেছে—শাফিন ঢাকায়?

— ঢাকায়।… ব্যস্ত মানুষ। আজ অবশ্য ও গেছে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে।

— তুমি যাওনি?

— আমাকে বড়খালা বটি নিয়ে তাড়া করুক, এটা আপনি চান?

— না। সে হাসল। ছবি আঁকছ কেমন?

— ছবি?

— হ্যাঁ, ছবি। এখনো লালরঙ বেশি ব্যবহার করো?

— হলো কী জানেন? আমি কিন্তু সত্যিই শাফিনকে ওই কথা বললাম। …ওই যে, ভেবেছিলাম, না, শাফিনকে বলব—আমার যে তোমার মুখ থেকে শুনতে খুব ইচ্ছা করছিল?

— সে সামান্য হাসল—সত্যিই বলেছিলে? তা, শাফিন কী বলল?

— বলল, আমার সঙ্গে এক হয়ে থাকতে ইচ্ছা হয় না তোমার?

— আর, তুমি আটকে গেলে এই কথায়। তা-ই না?

— বুঝলেন কী করে! মেহের একটু চমকাল। তারপরই হেসে ফেলল—বোঝারই কথা, আপনি লেখক।… আরো কিছু বুঝতে পারেন? কেমন চলছে আমাদের সংসার?

— সংসার নানা রকম হতে পারে। এটা আন্দাজ করা মুশকিল।

— ঠিক। … আমরা জানতাম আমাদের বিয়েতে কেউ রাজি হবে না, তাই আমরা পালালাম।

সে হাসতে আরম্ভ করল।

— হাসবেন না—ভেবে দেখুন, আর কি কোনো উপায় ছিল?

একটু ভাবল সে, দু’পাশে মাথা নাড়ল—না। … তবে বেশ নাটক করেছ দেখছি।

— শাফিনের বুদ্ধি, গুছিয়ে নিল সবকিছু। মজার এক ব্যাপার ঘটল—এরমধ্যে হঠাত্ বাবা চলে এল ২-৩ দিনের জন্য। বাবার আসার কথা না, আবার না আসার কথাও না। এমন তো না—বাবা আসেই না। বাবা ওভাবেই আসে, খুব হঠাত্ হঠাত্। তা, বাবা এল, আমি আর শাফিন বাবাকে বললাম। বললাম—এখন আমাদের কী করা উচিত? বাবা কী বললেন, জানেন?

— তোমাদের মন যা চায়, তা-ই করতে বললেন?

— অনেকটা অমনই। বললেন—তোমাদের জীবন, তোমরাই ঠিক করবে কী করা উচিত।… একটা কথা স্যার, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, উচিত বলে কোনো কথা নেই।

— হতে পারে। উচিত বলে কথা নেই।

— শুধু উচিত বলে নয়, অনুচিত বলেও কোনো কথা নেই।

— দুটোই ঠিক।

— স্যার, আমরা আসলে জানি না কোনটা কখন ঠিক।

— তবু মানুষ ঠিক করে, যেকোনো সময়ে।

— আমি আর শাফিন যেমন ঠিক করলাম। বাবাও বললেন, আমাদের জীবন, আমাদেরই ঠিক করা উচিত।… আমরা পালালাম। আমরা এখন ভ্যাঙ্কুভারে থাকি।

— জায়গাটা খুব সুন্দর?

— খুব। আমরা মাঝখানে অন্য শহরে গিয়েছিলাম। বেশিদিন ভালো লাগেনি। আমরা আবার ভ্যাঙ্কুভারে ফিরে এসেছি।

— এখন নিশ্চয় ল্যান্ডস্কেপ ভালো পাও।… রঙ, তুলি, ক্যানভাস কিনতেও অসুবিধা নেই।

— মেহের হাসল—শাফিন আমাকে অনেক পয়সা দেয়। আমার লাগে না, তা-ও দেয়।… স্যার, আমি আর ছবি আঁকি না।

— কী বলছ!

— যা শুনেছেন স্যার, সেটাই। আমি আর ছবি আঁকি না।

— কিন্তু কেন!

— ইচ্ছা করে না।

— ইচ্ছা করে না মানে?

— ইচ্ছা করে না মানে ইচ্ছা করে না।

— শাফিন কিছু বলে না?

মেহেরের মুখে সামান্য হাসি দেখা দিলো—কী বলবে?

— ছবি আঁকতে বলবে।

— নাহ। ও আমার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়।

— আমি কিন্তু—ও তোমার ছবি দেখতে এসেছে, এভাবেই গল্পটা আরম্ভ করেছিলাম…।

— মনে আছে। … গল্পকার লিখে দেয়। কিন্তু গল্প আর জীবন এক নয়।

— আলাদাও কিছু নয়।

— মেহের সামান্য মাথা ঝাঁকাল—না, তা-ও না। একও না আলাদাও না।

— তুমি এতটা নিরাশ ছিলে না আগে।

— আপনি ভালো জানবেন। … আচ্ছা স্যার, এরপর কি আপনি এমন কোনো প্রশ্ন করবেন—আমি আর শাফিন সুখী কি না?

— জিজ্ঞেস করাই উচিত। তোমার কথা শুনে কেমন কেমন মনে হচ্ছে।

— আমি আর শাফিন খুবই সুখী, স্যার।

— সত্যি বলছ?

— সত্যি বলছি। আমরা এত সুখী যে মাঝে মাঝে জীবন অর্থহীন মনে হয়।

সে স্থির চোখে তাকাল মেহেরের দিকে।

— অবশ্য শাফিনের কথা আমার বলা উচিত না। শাফিনের কাছে জীবন হয়তো খুবই অর্থপূর্ণ। কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।… আমি আমার কথা বলছি।

সে তাকিয়ে থাকল মেহেরের দিকে।

— মাঝেমাঝে মনে হয় বিয়েটা না হলেই ভালো হতো।

— কিংবা হলে ঐ অঙ্কের মাস্টারের সঙ্গে…।

— হয়তো।… নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না।

— না, তা যায় না।

— আপনি গল্পটা এমনভাবে তৈরি করেছিলেন, পাঠক ভাববে—আহারে, এরা কী চমত্কার জুটি, এই যে বিয়ে পার হলো না এদের, কী গভীর হাহাকার নিয়ে এদের জীবন পার হবে!

— গল্পের কী দোষ!

— গল্প, স্যার, একটা প্রলোভন।… সত্যি কথা হলো, গভীর হাহাকারে এখনো জীবন পার করছি।

— সুখের হাহাকার?

— তা সে যা-ই হোক।… হয়তো ব্যাপারটা এরকম—ধরাবাঁধা সুখ ধরাবাঁধা হাহাকার।

— তোমাদের বিয়ের জন্য আমি দায়ী নই।

— আমি দোষ দিচ্ছি না। আমি বলছি।… স্যার…।

‘স্যার’ বলে মেহের কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। মেহেরের দেখাদেখি সে-ও। একটুপর সে-ই জিজ্ঞেস করল—কিছু বলবে?

— একটা কথা জিজ্ঞেস করব।

— করো।

— একদম সত্যি একটা উত্তর দিতে হবে।

— দেবো।

— তানজিলাকে নিয়ে না কিন্তু।

— আহা, আবার তানজিলা।… কী জিজ্ঞেস করবে!

— এর উত্তরে অবশ্য এখন আর কিছুই এসে যাবে না।… হয়তো যাবে।… বাইরে বাইরে যাবে না।

—… স্যার, পরে বলব, শাফিন চলে এসেছে।

শাফিনকে রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে। তার চেহারায় যদিও ক্লান্তির ছাপ, সেই ছাপ ভেদ করে তার ঔজ্জ্বল্য ফুটে বেরোচ্ছে। শাফিন এসে তাকে জড়িয়ে ধরল—স্যার, এভাবে জড়িয়ে ধরলে কি আপনি রাগ করবেন?

— না না, রাগ করার কী আছে!

— তাহলে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখি। আপনি না থাকলে আমি মেহেরকে পেতাম না।

মেহেরের মুখে মুচকি হাসি দেখা গেল। আর, সে বলল—আমি আর কী করেছি! আমি গল্প থামিয়ে দিয়েছি। তোমাদের বাকি কাজগুলো তোমরাই করেছ।

— এভাবে বললে হবে না, স্যার। সূচনা আপনার হাতে।

— বাদ দাও। বলো, তুমি কেমন আছ?

— আমি ভালো আছি স্যার, আপনার দোয়া। আমি খুবই ভালো আছি। মেহের, তুমি বলোনি?

— কী!

— আমাদের ভালো থাকার কথা।

— বলেছি।

— হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেছে ও।

— স্যার। শাফিন অবশ্য ‘স্যার’ বলে তাকাল মেহেরের দিকে। তার মুখে মুচকি হাসি। মুখ সে ফেরাল—স্যার, মেহেরকে রাজি করাতে আমার কী যে পরিশ্রম করতে হয়েছিল…।

মেহের হাসিমুখে বলল—মায়ের কাছে মাসির গল্প হচ্ছে?

— ওর প্রতিবারই ওই এক কথা—এ হয় না, এ হয় না!

— না হলেই ভালো ছিল।

— হ্যাঁ, দুজন গভীর অতৃপ্তি নিয়ে জীবন পার করে দিতে পারতাম। শাফিন হাসতে হাসতে বলল। স্যার, আপনি একবার ভ্যাঙ্কুভার আসবেন না?

— ভ্যাঙ্কুভার?

— আপনি বললেই আমরা টিকিট পাঠিয়ে দেবো। খুব ভালো লাগবে আপনার।

— একটা না, দুটো টিকিট পাঠাতে হবে।

— হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভাবির জন্যও।

— না, ভাবি না। সায়রা আমাদের এই গল্পের কেউ না। তানজিলার জন্য।

— তানজিলা কে?

— সায়রাকে পরে সম্ভব হলে আমি একবার নিয়ে যাব। তখন আবার তোমরা থাকবে না।

— কিন্তু, স্যার, তানজিলা কে?

সে হঠাত্ এলোমেলো বোধ করল। তার মনে হলো তানজিলা কে—এটা সে শাফিনকে কী করে বোঝায়! সে চুপ করে থাকল। আর মেহের, নিবিষ্টচিত্তে হাতের নোখ দেখতে আরম্ভ করল।

— এই, মেহের…। শাফিন মেহেরের হাত ধরে নাড়াল।

— বলো, ধাক্কাতে হবে না।

— তানজিলা কে?

— এটা আরেকটা গল্প। না বোঝার কী হলো, শাফিন!

শাফিন বলল—ওহ, তা-ই বলো।… স্যার, যা বলছিলাম, ভ্যাঙ্কুভারে এলে আপনার ভালো লাগবে।

সময়টা ভালো কাটল তার। তার দ্বিধা ছিল, সে ভেবেছিল সময়টা বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে, তার এরকম মনে হতে পারে—কেন যে আমি এলাম! এরকম কিছু ঘটল না, বরং সে দেখল, সে মন ও মুখ খুলে হাসছে, সময়টা তার কাছে উপভোগ্য মনে হচ্ছে। তার মনে হলো, লেখা একটু পেছাল বটে, তবে সময়টা ভালো কাটল। এ কথাই সে বলল মেহের ও শাফিনকে, যখন তারা জিজ্ঞেস করল।

— বেশ কাটল। বেশ কাটল সময়টা।

— কিন্তু আপনি স্যার, কম কথা বলেন। কথা তো সব আমরাই বললাম।

— জমজমাট একটা আড্ডা হলো। সে বলল। এটাই কথা।

— তা ঠিক তা ঠিক। মেহের তোমার কেমন লেগেছে। বলতে বলতে শাফিন উঠল—আমি একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি।

শাফিন চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত মেহের সেদিকে তাকিয়ে থাকল। তারপরই সে ফিরল—স্যার, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে নিয়েছিলাম…।

— হুঁ। কী যেন…।

— উত্তরটা আমার জন্য জরুরি স্যার। সত্যি উত্তরটা দেবেন তো?

— একটা উত্তরের কমপক্ষে দুটো দিক থাকে। আমি উত্তরের যে অংশেই থাকি না কেন, সেটা তোমার জন্য জরুরি?

— জি স্যার, যা-ই শুনি না কেন, সেটাই।

— বলো।

— আপনি আমাকে পছন্দ করতেন?

— আমি? তোমাকে?

— আপনি আমাকে পছন্দ করতে পারেন না।

— তুমি আমাকে পছন্দ করতে?

— অনেক।

কিন্তু তুমিই বলেছ—লেখকরা বুদ্ধিমান না। লেখকরা যতটা বোঝে মনে করে, আসলে ততটা তারা বোঝে না।

— তাতে কী? এসব সত্যি বলে আমি আপনাকে পছন্দ করতে পারব না?

— সে তুমি জানবে।… কিংবা, জানো।

— আমি আপনাকে খুবই পছন্দ করি, স্যার। আপনার গল্প পর্যন্ত আমি খুবই খুশি আপনার ওপর। তার পরের যে জীবন আমার, তার জন্য আমি আপনাকে দায়ী করতে পারি না।

সে সামান্য মাথা ঝাঁকাল।

— তবে যেটুকু আপনার হাতে—সেখানে গ্লানি ছিল, অপমান ছিল, অনিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু এসব ছাপিয়ে আরো কী যেন ছিল… আপনি আমার খুব প্রিয় মানুষ।

সে সামান্য হাসল—তোমার সঙ্গে আবার হয়তো কখনো দেখা হয়ে যাবে।

— কিন্তু আমার উত্তরটা স্যার, মেহের ব্যাকুল গলায় বলল। ওটা জানা আমার জন্য খুবই জরুরি।

সে মেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকল।

— বলুন স্যার।

— আমি তোমাকে খুবই পছন্দ করতাম। তোমাকে নিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি আমার ভেতর কাজ করত। মাঝে মাঝে মনে হতো, তোমার মতো কারো সঙ্গে যদি দেখা হতো! আবার কখনো মনে হতো, তোমার মতো কাউকে আমি দেখেছি। হয়তো কল্পনায়, ভাবনায়, কিন্তু দেখেছি।

মেহেরের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল, সে হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরল, ধরে রাখল, ছেড়ে দিল। হাত সরিয়ে নিয়ে সে দু’চোখ মুছে নিল।

— খুশি?

— খুব খুশি স্যার, খুব খুশি। মেহেরের মুখে তারপর ফিচকে হাসি দেখা দিলো—এখন স্যার, তানজিলার কথা।

— আবার তানজিলা!

— আহা, বলেন না স্যার, শুনি।

— দেখো, তানজিলা হয়তো কোনো গল্পের চরিত্র মাত্র।

— সে আমি জানি, স্যার।

— ব্যাপার এই এটুকুই।

— জানি স্যার।

— তাহলে বারবার কেন জিজ্ঞেস করছ!

— এমনি। … স্যার, আমার হিংসা হচ্ছে না।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে সে তানজিলাকে ফোন করল। এমনিই করা। সে ভেবেছিল, তানজিলার ফোন বন্ধ পাবে। কিন্তু দু’বার রিং হওয়ার পরই তানজিলা ফোন ধরল। বলল—আমি জানতাম তুমি ফোন করবে।

— আমাদের দেখা হবে কবে?

— হবে।

— কবে?

— আহা, দেখা তো হবেই।

— কবে?

— কী আশ্চর্য! আমি বলছি না—হবে।

— আমি জানতে চাচ্ছি—কবে।

— এক কাজ করো। তুমি চলে আসো।

— কোথায়?

— আমার কাছে।

— তুমি তোমার ঠিকানাই দাওনি!

— তোমাকে আমার ঠিকানা দিতে হবে! তানজিলা অবাক গলায় বলল।

— ঠিকানা ছাড়া…।

— ঠিকানা দেওয়ার দায়িত্ব আমার! বলো, আমার? তুমি নিজে আমার ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারবে না!

— পারব… মানে… ।

— তাহলে সে চেষ্টাই করো, আমার ঠিকানা তুমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করো।

সে ভেবেছিল সকালে ইমদাদকে ফোন করে লেখা নিয়ে যেতে বলবে। এখন ক্লান্ত লাগছে তার, তবে কিছু আনন্দও আছে, গল্পটা সে শেষ করতে পেরেছে। সে ঠিক করল, এখন সে লারেলাপ্পা টাইপ একটা সিনেমা দেখবে। তবে তার আগেই ইমদাদের ফোন এল—লোক এখন পাঠাব? না, কাল সকালে?

— কেন?

— বারে, গল্পটা আনাব না!

— শেষ যে হয়েছে…।

— মজা করেন, না? শেষ যে হয়েছে, জানি।

— কী বলো, ইমদাদ! কী করে জানো!

— মেহের নামের একজন ফোন করে জানালেন।

— মেহের!

— রসিক আছেন। বললেন—একটা ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যাবে না, এটা নিশ্চিত হতে স্যার গল্পটা শেষ করে ফেলেছেন। আপনি কাউকে পাঠিয়ে দিন।… পিএ রাখলেন বুঝি?

সে শুকনো হাসি হাসল।

— আমি বরং কালই লোক পাঠাই। এখন রাত হয়েছে।

— হ্যাঁ, কাল।

ইমদাদের সঙ্গে কথা শেষ করে সে বিছানায় বসল। সে টের পেল, তার অস্থির লাগছে, তার শীত-শীত লাগছে।
গুণী অভিনয়শিল্পী দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে তার মধ্যে আপনি অন্যতম। এমন একটি অবস্থানে থেকেওএই মেয়েটিই কি তানজিলা?

সে আবার তাকাল, মেয়েটিকে বুঝতে দিতে চাইল না, তবে সে তাকাল—এই মেয়েটিই?

প্রেমের যে উপন্যাস লেখার কথা সে ভাবছে, সেটা সে কিছুতেই গুছিয়ে আনতে পারছে না। অন্য কোনো সময় হলে, অন্য কোনো গল্প বা উপন্যাসের বেলায়, সে জানে, গোছানোর কাজটা বেশি সময় নিলে, সে তখনকার মতো সেটা সরিয়ে রাখত। তারপর, লেখার তাড়া থাকলে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে ভাবত, তাড়া না থাকলে—ভাবতই না। এবার সে আশ্চর্য হয়ে দেখল, সরিয়ে রাখতে গিয়ে, প্রেমের উপন্যাস লেখার ব্যাপারটা তার মাথার ভেতরে থেকেই যাচ্ছে। সে তখন এরকম ভেবে চিন্তাটা মাথা থেকে সরাতে চাইল যে—প্রেমের উপন্যাস এমন কোনো জরুরি ব্যাপার নয় যে ওটা নিয়ে পড়ে থাকতে হবে। আর, যদি জরুরিও হয়, সে কিছুদিন পড়েও লেখা যেতে পারে। আবার, এমনও সে ভাবল—এমন কোনো জরুরি নয়—এভাবে না ভেবে—আদৌ জরুরি নয়—এভাবেও ভাবা যেতে পারে। প্রেমের উপন্যাস লিখতেই হবে, সে এমন দিব্যি কোথাও কাউকে দেয়নি। একটিও প্রেমের উপন্যাস না লিখেও ঢের লেখক তাদের লেখক-জীবন পার করেছেন, এখন পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। সে বরং প্রেমের উপন্যাস লিখেছে কয়েকটি, প্রেমের উপন্যাস সে লিখতেও চায়, কারণ, প্রেম ব্যাপারটা আছে—সুতরাং, লিখেছে যখন ও লিখবেও, তখন, এই এখনই হচ্ছে না বলে অস্থির হওয়ার কিছু নেই।

এরকম ভেবে সে ঠাণ্ডা মাথায় মাথা থেকে প্রেমের উপন্যাস লেখার ব্যাপারটা সরাতে চাইল—পারল না। যখন পারল না, যখন কোনো কাহিনিই সে গুছিয়ে আনতে পারছে না, সে তার নিজের লেখা প্রেমের উপন্যাসগুলোর কথা ভাবতে আরম্ভ করল। এই যেমন মামুলী ব্যাপার, জ্যোতির্ময়ী তোমাকে বলি, দূরের গল্প ও আরো কয়েকটি, যেগুলো একটু ঘুরিয়ে হলেও প্রেমের। তার প্রেমের উপন্যাস ঘুরেফিরে বেশ কয়েকটিই, প্রেম সেখানে প্রচ্ছন্নভাবে এসেছে, ফলে অনেকের তা চোখে পড়ে না। ওসব লেখার কথা আপাতত সে না হয় বাদই দিলো, এখন সে বরং তার প্রথম উপন্যাস মামুলী ব্যাপারের কথা ভাবতে পারে, তারপর জ্যোতির্ময়ী তোমাকে বলি’র কথা।

সে সায়রাকে জিজ্ঞেস করল—তুমি মামুলী ব্যাপার পড়েছ?

সায়রা উলটো প্রশ্ন করল—মামুলী ব্যাপার পড়েছি মানে!

— আহা! আমি বহু আগে মামুলী ব্যাপার নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম না? সেটার কথা বলছি।

— বলো, আমি শুনছি।

— আশ্চর্য, আমি জানতে চেয়েছি, তুমি ওটা পড়েছ কি না।

— আমিও আশ্চর্য। পড়ব না কেন!

— পড়েছ কি না, আমি এটুকু জানতে চেয়েছি। হ্যাঁ বা না বললেই চলে।

— তুমি জিজ্ঞেস করবে কেন! তোমার কোন লেখাটা আমি পড়িনি! তা ছাড়া, মামুলী ব্যাপার নিয়েই-বা হঠাত্ কী হলো!

— মামুলী ব্যাপারের কাহিনি মনে আছে তোমার?

— কাহিনি? মনে আছে কি না?… ওটার উত্সর্গ ছিল—এই শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে, আমাদের এই ব্যাপারগুলো মামুলী ছাড়া আর কী বলো?… শোনো, উত্সর্গ যখন মনে আছে, কাহিনি মনে না থাকার কোনো কারণ নেই। পাশাপাশি দু’ ফ্ল্যাটের এক ফ্ল্যাটে খালিদ আরেক ফ্ল্যাটে জয়া। সম্পর্ক বন্ধুত্বের, সম্পর্ক খুনসুটির…।

— ওটা আমার খুব প্রিয় লেখা।

— আমারও।… সম্পর্ক বন্ধুত্বের আর খুনসুটির, কোনোদিন পরস্পরের প্রতি দুর্বলতার কথা বুঝতে পারেনি, কিংবা পারলেও প্রকাশ করেনি।… শেষে এসে মন খুব খারাপ হয়ে যায়।

লেখকের তেমন কিছু হওয়া উচিত না, তবে আমারও কেমন কেমন যেন লাগে। বলতে বলতে আমি পাশের ঘরে উঠে গেলাম। পাশের ঘরে সায়রা। খবরের কাগজে চোখ। আমার কিংবা সায়রার খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস যায়নি। আজকাল শুনি অনেকেই খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। টেলিভিশনে হরদম স্ক্রল যাচ্ছেই, মোবাইল ফোনেও নোটিফিকেশন আসছে, আর, ফেসবুক তো আছেই। ওখানে আধা-এক ঘণ্টা থাকলেই সব জানা হয়ে যায়। ফেসবুকে আমার প্রথমে একটা অ্যাকাউন্ট ছিল। দেখলাম ওখানে কিছু একটা লিখলে যে যা ইচ্ছা মন্তব্য করে। অবদমন মেটানোর ও নিজেকে বিচারকের আসনে বসিয়ে রায় দেওয়ার এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর বুঝি নেই। আমি আমার আইডিটাকে পেজ বানিয়ে নিয়েছি। লেখালেখি নিয়ে, নিজের লেখালেখি নিয়ে এটাওটা বলি, কখনো নিজের লেখা আপলোড দিই। ইনবক্সে মেয়ে সাজা কিছু ফেইক আইডির উপদ্রব এখানেও আছে। তবে সব মিলিয়ে এটা আমার কাছে উপকারীই মনে হয়। নিজেকে নিজের ইচ্ছামতো প্রমোট করার এরচেয়ে ভালো ব্যবস্থা আরো কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।

সে বলল—খবরের কাগজ পড়তে আমার ভালো লাগে না।

— আমারও না। সায়রা জানাল। পড়ি আর কি। … তুমি হঠাত্ মামুলী ব্যাপার নিয়ে পড়লে কেন!

— পড়লাম। … আমার একটা প্রেমের উপন্যাস লিখতে ইচ্ছা করছে।

সায়রা তার দিতে তাকাল। হাসল।

— হাসির কী হলো! প্রেমের উপন্যাস লিখতে পারব না?

— আমাদের পাঠক, তুমি বলো সমালোচকও, প্রেমের উপন্যাসকে যথেষ্ট পরিমাণে হালকা একটা ব্যাপার মনে করে।

— করে। কিন্তু আমি মাথামোটাদের কথা মাথায় রেখে কখনো লিখিনি, তুমি জানো।… এখন প্রেমের উপন্যাস লিখতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু কোনো কাহিনি মাথায় থিতু হচ্ছে না।

— ওই যে, তুমি একটা কাজ করলে না মাঝখানে—তোমার উপন্যাসের চরিত্ররা তোমার কাছে চলে আসে, তাদের পরিণতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে, তোমাদের নতুন করে লিখতে বলে তাদের কাহিনি, সেরকম কিছু লিখে ফেলো, সহজ হবে।

সে মাথা নাড়ল—না, সেরকম কিছু না।

সায়রা খবরের কাগজ থেকে চোখ উঠিয়ে একবার তাকাল।

— আমার মনে হয় মামুলী ব্যাপার বা জ্যোতির্ময়ী তোমাকে বলি নিয়ে ওরকম কিছু লিখলে ওই লেখাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। প্রেমের উপন্যাস তো বটে, কিন্তু যার বোঝার তারা বোঝেন ওখানে ক্লাস কনফ্লিক্ট কতটা…।

— হ্যাঁ, ওই যে, জ্যোতির্ময়ীর কথাই যদি ধরো, মেয়েটির বিয়ের ঘোষণায় ছেলেটি মর্মাহত হয়। তার অবচেতনে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল—মেয়েটার বাবা তার কথাই বলবে। কিন্তু প্রকাশ্যে সে কিছুই বলতে পারে না…।

— কষ্ট আর অভিমান নিয়ে ঘরে চলে আসে…।

— কিন্তু আশা ও অপেক্ষা করে, মেয়েটা সবাইকে লুকিয়ে তার কাছে আসবে।

— অপেক্ষা করে, কিন্তু যদি আসে মেয়েটি, তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাও তার মাথায় ঘুরপাক। সে ঠিক করে রাখে, এরকম কিছু বলবে—যাও, তুমি যাও, এ হয় না, তুমি কেন বোঝো না—এ হয় না।… দেখো, অবচেতনে সে কিন্তু তার ও মেয়েটির শ্রেণি-অবস্থান নিয়েও সচেতন। সেটা সে এড়াতে পারছে না।

— এটা অনেকেই বুঝতে পারেনি। নিছক একটা প্রেমের উপন্যাস ভেবেছে।… এসব কিছুই না—এ উপন্যাসটা নিয়ে কিছু করার আছে? ওই যে, বিয়ের রাতে, বর এসেছে, কনেকে রেখে সবাই সেদিকে, কনে সে-ফাঁকে পেছনের বারান্দায় গিয়ে সামনের বারান্দার ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে, একটি-দুটি কথা, এই যেমন—যাচ্ছি, ভালো থেকো… দেখা হবে… হয়তো। অথচ কী আশ্চর্য, এই ছেলেটি উপন্যাসে এর আগে এক সেকেন্ডের জন্যও আসেনি।

— হুমম। একবারও আসেনি।… আচ্ছা, এতবছর পর কি ওদের দেখা হয়ে যেতে পারে? কী দেখাব? দুজনই খুব সুখী?

— ভাবো। দেখো কোনটা মানানসই হয়।

সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—সায়রা…।

— শুনছি। তাড়াতাড়ি বলো। যে খবরটা পড়ছি সেটা ইন্টারেস্টিং।

— আমি একটা অদ্ভুতুড়ে প্রেমের উপন্যাস লিখতে চাই।

— অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটবে?

— বলতে পার।… অনেকটাই।

— তাহলে ফেসবুকে যাও। ওর চেয়ে অদ্ভুত আর কিছু নেই।

— তাতে প্রেমের উপন্যাস লেখা হবে?

— আহা, তুমি ইনবক্সে কত মেয়ের সঙ্গে চ্যাট করো না? খুব সুন্দর একটা মেয়ে, ন্যাকা ন্যাকা কথা বলে, তোমার খুব ভক্ত। পরে বুঝলে সে আসলে একটা ছেলে।… এরকম। চলবে না?

— আরে, না।

— তাহলে ধরো কারো সঙ্গে দেখা করতে গেলে…।

— সে বলল—তুমি খবরের কাগজ পড়ো।

সে আবারও বোঝার চেষ্টা করল, এই মেয়েটিই কি তানজিলা!

এই মেয়েটির চেহারার মধ্যে একইসঙ্গে স্নিগ্ধতা ও চটক আছে। হিসাবে মিলছে, তার ধারণা তানজিলার চেহারায় চটক, লাবণ্য, স্নিগ্ধতা সব মিলেমিশে থাকবে। ধারণা এরকম না হলে এ বয়সে সে এ মেয়েটার জন্য একঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করত না। বিশেষ করে বিকেলের দিকে এখানে এসে অপেক্ষা করাটা বেশ রিস্কি। সে বেশকিছুটা লজ্জায় আছে, এতক্ষণ অপেক্ষা করে সে কিছুটা বিরক্তও। এখানে, শাহবাগের এই বইয়ের মার্কেট আজিজে সে সাধারণত আসে না। আসে, খুব কম, পছন্দের বা প্রয়োজনীয় বই নজরে পড়লে একটা-দুটো কিনে নিয়ে যায়, আড্ডায় জড়ায় না। এখানে আড্ডা দেয় তার তুলনায় অনেক অল্পবয়সীরা, তার বয়সীরাও আছে; কিংবা তার চেয়ে বয়সে বড় যারা, তারাও। তারা আসে আড্ডা দিতেই। তরুণ লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া তাদের জন্য জরুরি। সে তেমন কোনো আড্ডায় আসে না, এটা প্রায় সবাই জানে, জানে বলে তার লজ্জা লাগছে, তার মনে হচ্ছে—তাকে এখানে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে দেখলে অনেকেই নিশ্চয় বুঝে ফেলবে সে আসলে এসেছে তানজিলা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে।

কিন্তু তানজিলা এমন জেদ ধরল—এই এখানেই সে দেখা করবে।

সে বলল—আহা…!

তানজিলা বলল—আহা তো তুমি আমাকে দেখে বলবে।

— তা-ই বুঝি? তা, কেন আহা বলব?

— আমাকে দেখলে তোমার অমন বলতে ইচ্ছে করবে।

— আচ্ছা, বলব, অনেকবারই না হয় বলব। কিন্তু তানজিলা, আজিজ বাদ দিলে হয় না?

— তোমার মাথা খারাপ!

— তোমার সঙ্গে পরিচয়ের পর মাঝে মাঝে অমন মনে হয়।

— ডাক্তার দেখিয়েছ?

— না। … তোমাকে দেখাব।

— দেখিও। এর চিকিত্সা আমি জানি।

— কিন্তু আজিজ বাদ দাও, প্লিজ।

— আবারও তাহলে বলতে হয়—তোমার মাথা খারাপ!

— ওখানে অনেক জুনিয়র…।

— লেখক?

— হুঁ।

— ওখানে আমার সঙ্গে তোমাকে কেউ দেখলে তোমার ইমেজ খারাপ হবে?

— না না, ঠিক তা নয়।

— তুমি তো লেখক, না?

— আমার অবশ্য অধিকাংশ সময়ই তেমন মনে হয় না। কী আর লিখি!

— হয়েছে। লেখক বলেই আমি তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি।

— জানি। বলেছ।… তোমার তরফ থেকে ব্যাপারটা যে এরকম, বুঝি।

— টের পাও আমাকে?

— হুঁ। খুব।

— তাহলে আমার সঙ্গে তোমাকে কেউ দেখলে দেখুক না! লজ্জা পাবে?

— আরে না, লজ্জা না। লজ্জা কীসের?

— ইমেজও নষ্ট হবে না, লজ্জাও পাবে না। তাহলে আসতে অসুবিধা কীসের?

— অসুবিধা কীসের।… সে ভাবতে গিয়ে বুঝতে পারছিল সে যুক্তিতে হেরে যাচ্ছে।

— তোমার সঙ্গে আমাকে কেউ দেখলে আমার খুবই গর্ব হবে। যদিও আমাকে কেউ চেনে না। না চিনুক। তোমার সঙ্গে থাকাটাই গর্বের।

তানজিলার সঙ্গে কথায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে আজিজে আসা। সে ঠিক করে রেখেছিল তানজিলার সঙ্গে দেখা হলে সে পাঁচ মিনিটের বেশি থাকবে না আজিজে। প্রথম দেখা, সুতরাং কয়েকটা বই সে কিনে দেবে তানজিলাকে। নিজের লেখা বই সে আনতে পারত। ভেবে, এই ইচ্ছা সে বাদ দিয়েছে, এটা কেমন কেমন যেন দেখাবে। তাছাড়া তানজিলার সঙ্গে কথা বলে তার ধারণা হয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য সব লেখাই তানজিলার পড়া। তার পড়া বই, তার কাছে আছেও নিশ্চয়, তাকে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। যদি এমন হয়, তানজিলা উত্সাহ দেখাল, বলল, তার নাম লিখে বই দিলে তার ভালো লাগবে, তবে অন্য কথা। আচ্ছা, এটা পরে দেখা যাবে। আপাতত সে যা করবে, তানজিলা এলে তাকে নিয়ে একটা চক্কর দেবে আজিজে, কেউ যদি দেখে—দেখবে, কোনো ভক্তের সঙ্গে সে হাঁটাহাঁটি করতেই পারে। চক্কর দেয়া শেষ হলে তানজিলার পছন্দমতো বই কিনবে, তারপর বলবে—চলো।

— আসলে অন্য কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। তানজিলা বরং বলে রেখেছে—এরকম—কী করব, জানো? তোমার আমার দেখা হলে?

— তুমি আর কী করবে! করব আমি।

— তুমি আবার কী করবে?

— তোমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকব।

— আচ্ছা, থেকো। কতক্ষণ পারো, দেখব।… তুমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কতদিন চা খাও না, এটা মনে আছে তোমার?

— একটুও মনে নেই।

— আজ খাবে। আমরা খাব। প্রথমে তোমাকে নিয়ে বইয়ের দোকানগুলোতে ঘুরব, তারপর চা খাব। ততক্ষণে একটু সন্ধ্যা হয়ে আসবে। তা-ই না?

— তা আসবে।

— তারপর তোমাকে নিয়ে চারুকলার সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে টিএসসির দিকে চলে যাব। তারপর আরেকটু এগিয়ে বাংলা একাডেমির দিকে। ওখানে কোথাও তোমাকে নিয়ে ফুটপাথে বসে থাকব।

সর্বনাশ হতে পারে, সে বুঝল। তাই সে ঠিক করল, আজিজে দশ-পনের মিনিট কাটিয়ে সে খুব সহজ গলায় বলবে—চলো?

— কোথায়! চা খাবে না?

— কফি। ধানমন্ডির দিকে যাই।

— তানজিলা কফি খেতে ধানমন্ডির দিকে যাবে কি যাবে না, সেটা আসলে অনেক পরের ব্যাপার। তানজিলা এখনো যে এসে পৌঁছায়নি। সে এসেছে পাঁচটায়, ঠিক পাঁচটায়। তানজিলার অবশ্য আপত্তি ছিল—এই রোদের মধ্যে…।

— আমরা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকব না।

— তবু। গরম।

— শোনো, পাঁচটায় না এলে আমরা বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। তুমি কি এসে দেখা দিয়েই চলে যেতে চাও?

— কক্ষনো না।

— তাহলে ঠিক পাঁচটায়।

এখন ছটা বাজে। কয়েকবার মোবাইল ফোনে ফোন করেছে সে, রিং হয়েছে, কিন্তু কেউ ধরেনি। সে মেসেজ পাঠিয়েছে, মেসেজের রিপ্লাই আসেনি। প্রথমটায় নানারকম চিন্তা ছিল তার, এখন চিন্তা তার মোটামুটি একইরকম—তানজিলা মেয়েটা তার সঙ্গে মজা করছে। হয়তো এসেছে এখানে, একা কিংবা বন্ধুদের নিয়ে, দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। নিজেদের মধ্যে কী বলছে তারা, মোটামুটি আন্দাজ করা যায়।

— দেখেছিস, বারবার কেমন ঘড়ি দেখছে!

— ওশান ব্লু জিন্স প্ল্যান্ট আর টি-শার্ট পরে এসেছে। বেশ লাগছে।

— যা যা, তুইই যা তাহলে।

— হ্যাঁ, জিনিস তানজিলার আর যাব আমি! আমার যেন কম পড়েছে।

— কবিতা তো লেখেন না, তা, অমন কবি কবি দেখাচ্ছে কেন।

— ওই দেখ, রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল।

— আহা, কবিদের কি ঘাম মোছা মানায়!

— এখনো অভ্যস্ত হতে পারেনি। তানজিলার প্রতি গভীর প্রেম তাকে কবি করে দিয়েছে—এখন এই স্টেজে আছে।

— ঘটনা কি এরকম? আজিজের এদিক-ওদিক হাঁটতে হাঁটতে বার-দুই এটা ভেবেছে—সে কি প্রেমে পড়েছে তানজিলার? না হলে, তানজিলা একবার বলামাত্র তার এভাবে চলে আসার মানে কী! মেয়েরা যে এসব নিয়ে মজা করে, এমন না সে জানে না। তা হলে?

মেয়েটা তাকে নিয়ে মজা করছে, এমন চিন্তা, তার মাথায় যেমন এসেছে, আবার চলেও গেছে। তবে গেছে মানে, চলে যায়নি, আছে। তার মনে হচ্ছে, সে যতদিন কথা বলেছে তানজিলার সঙ্গে, কখনো তাকে ওরকম কিছু মন হয়নি। তার তানজিলাকে অন্যরকম মনে হয়েছে। একটু দুষ্টুমির স্বভাব তার আছে যদিও, একটু মজা করার, কোনো একটা নরম কথা বলে তার প্রতিক্রিয়া দেখার, তবু, এতকিছুর পরও মেয়েটা অন্যরকম। কীরকম—এটা কেউ তাকে জিজ্ঞেস করলেই সে হরহর করে বুঝিয়ে বলতে পারবে না। সে এটুকুই শুধু বলতে পারবে—তানজিলা অন্যরকম।

তবে অন্যসব কথা বাদ দিয়ে এ মুহূর্তে কথা হচ্ছে—তানজিলা আসছে না কেন!

কোনো ঝামেলায় পড়েছে? ঝামেলায় পড়লে তাকে জানাতে পারত, কথা বলার অবস্থায় কোনো কারণে না থাকলে ছোট করে মেসেজ দিতে পারত।

এরমধ্যে পরিচিত দু’জনের মুখোমুখি হয়েছে সে। মাত্র লিখতে আরম্ভ করেছে, এমন একজন তাকে দেখে প্রায় ছুটে এলো—স্যার, আপনি….।

সে চিনতে না পেরে তাকিয়ে থাকল ছেলেটির দিকে।

— আমাকে চিনবেন না, স্যার। আমি লেখালেখির চেষ্টা করছি। আপনার সঙ্গে স্যার, আমার আগে একবার কথা হয়েছে।

সে হাসল—তা-ই? তোমার নাম?

ছেলেটা তার নাম বলল।

— হুম, মনে পড়েছে। ‘ছোটরা নদীতে যায়’ তোমার লেখা, না? ভালো লেগেছিল।

— আপনার মনে আছে! ছেলেটা হা হয়ে গেল। স্যার, আমাদের লেখা কেউ পড়তেই চান না।

সে হাসল—পড়ে। … আমি পড়ি।

এরপর ছেলেটা একটু জোঁক হতে চাইলে সে তাকে নিরুত্সাহিত করল—আমি একটু একা ঘুরব।

— নিশ্চয় নিশ্চয়, স্যার, … স্যার, আমি একদিন আপনার বাসায় যাব যদি অনুমতি দেন।

এরপর দেখা হলো সমবয়সী না হলেও ইয়ার্কি-ফাজলামো করা যায় এমন একজনের সঙ্গে—আরে, আপনি এখানে!

— আপনি এমনভাবে বলছেন, যেন এখানে আমার আসা নিষেধ।

— সে-রকম কিছুই না। দেখি না এদিকে, তাই বললাম।

— এলাম। নতুন বই কী এল, দেখব।… একজনের সঙ্গে দেখা করার কথাও আছে।

— মেয়ে ভক্ত?

সে হাসল, জিজ্ঞেস করল—আপনার খবর কী?

এখন সে এসে দাঁড়িয়েছে বাইরের দিকে। তার সামনে ব্যস্ত রাস্তা। যত গাড়ি, ট্যাক্সি, স্কুটার, রিকশা এসে থামছে, সে খুঁটিয়ে লক্ষ করছে। দূর থেকে কেউ তাকে নজরে রেখেছে কি না, এটাও সে খেয়ালে রেখেছে। কিন্তু কিছুই তার মনমতো কাজ করছে না।

সে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবল—চলে যাবে। এক ঘণ্টার বেশি হয়েছে। এখন তার বোঝা উচিত, তানজিলা আসবে না। এই যে সে দাঁড়িয়ে আছে, ক্যাবলার মতো—তার ধারণা, এর কোনো মানে হয় না। এদিকে আকাশও একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে। বৃষ্টি নামতে পারে। নামলে যা হবে, আশপাশের অনেক লোক বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে এখানে উঠে আসবে। ধাক্কাধাক্কি, গুঁতোগুঁতি ছাড়াও অনেক মানুষের ঘামের গন্ধ তাকে বিরক্ত করবে। সে-বিবেচনায় এখনই উপযুক্ত সময় সরে পড়ার। কিন্তু তানজিলা যদি এসে পড়ে তার চলে যাওয়ার পরপরই, পরে যদি তাকে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে—ঝামেলা কতরকম থাকতে পারে, তা-ই না? তুমি আরো কিছুটা সময় আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারলে না!

— আরো কিছুটা সময়! এক ঘণ্টার বেশি সময়কে তুমি আরো কিছুটা সময় বলবে?

— তুমি… আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?

— করছিলাম।… এক ঘণ্টার বেশি করেছি, তানজিলা। তুমি অনন্তকাল আমাকে অপেক্ষায় রাখতে পার না।

— কে বলল! পারি।

তানজিলা এভাবে ‘পারি’ বললে অসুবিধা হয়ে যাবে। সে না পারবে পক্ষে বলতে, না পারবে বিপক্ষে। শেষপর্যন্ত তাকে হয়তো পক্ষেই বলতে হবে—হ্যাঁ, পার। কিন্তু তাই বলে…!

— তাই বলে কী?

— নিজেই বুঝতে পারছ।

— জীবনে অপেক্ষা একটা বড় ব্যাপার, না?

— ও কথা আমিই তোমাকে বলেছিলাম।

— হ্যাঁ, তুমিই বলেছিলে, তোমার কাছ থেকে শুনেছি। তারপর ব্যাপারটা আমার ভেতর থেকে গেছে। আমি ভাবতে ভাবতে বুঝেছি—জীবনে অপেক্ষা একটা বড় ব্যাপার।… আর, এদিকে, তোমার অপেক্ষার মেয়াদ এক ঘণ্টা।

— ঠিক না।

— ঠিক। তুমি কি জানো, তুমি চলে যাওয়ার পরপরই আমি এসেছিলাম?

— তা-ই কি?

— হ্যাঁ, আমি যখন রিকশা থেকে নামছি, দেখলাম তুমি তখন গাড়িতে উঠছ। তখন আর তোমাকে থামানোর উপায় নেই।

— তুমি সেদিন আমাকে কল করতে পারতে।

— আমি ইচ্ছে করে তোমাকে কল করিনি।

— এটা কেমন কথা!

— তোমাকে বুঝতে হবে তুমি চলে যাচ্ছিলে।

— তো?

— চলেই যখন যাচ্ছিলে, কল করব কেন!

— তোমার ফোনও কিন্তু বন্ধ ছিল।

— এখন নানা মিথ্যা বলতে পারি। যেমন, বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ফোন খুঁজে পাচ্ছিলাম না, হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিংবা, রিকশায় ওঠার সময় ফোন ছিনতাই হয়ে গেল। কিন্তু আমি ওসব কিছু বলব না। ফোন আমিই বন্ধ করেছিলাম। ঠিক করেছিলাম, একদম তোমার কাছে পৌঁছে ফোন অন করব।… তুমি আমার দিকে অমনভাবে তাকিয়ে আছ কেন! আমি কিন্তু সত্যি কথা বলছি।

— আমি কি একবারও বলেছি, তুমি মিথ্যা বলছ?

— না, বলোনি। কিন্তু তোমার তাকানোর ভঙ্গি ওরকম।

— ভেবে বলছ?

— শোনো, আমি মিথ্যুক না।

তানজিলা মিথ্যুক কি-না, এটা তাকে কিছুটা হলেও চিন্তায় ফেলেছে। তানজিলার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম কয়েকটা দিন তার সন্দেহ ছিল, সে সন্দেহ চলে গেছে, আজ বিকাল পর্যন্তও সেটা আর ফিরে আসেনি, এলে সে আজিজে এসে দাঁড়িয়ে থাকত না। তবে, এখন তার একটু একটু সন্দেহ হচ্ছে—কেউ বোকা বানাল কি?

সে একটু গুছিয়ে ভাবতে চাইল—কে, কে কে তাকে বোকা বানাতে পারে। সে একটা নামও খুঁজে বের করতে পারল না। ভাবল, বোকা তাকে অনেকেই বানাতে পারে। একটু মজা করল তার সঙ্গে, পরে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে হাসাহাসি করবে, হয়তো এক মুখ থেকে আরেক মুখ—এভাবে ছড়িয়েও পড়বে…। তাকে পছন্দ করে না, এমন লোকের সংখ্যা কম নয়, তারা কেউ বা কয়েকজন মিলে এমন মজা করতেই পারে। আবার, তার ঘনিষ্ঠ কেউ হতে পারে। পরে হয়তো বলবে—দোস্ত, ফেসবুকে আলাপ, একটু না হয় খুনসুটিও, তারপর তোকে ফোন করল, আর তুই চলে গেলি! উচিত হয়নি।

— সমস্যা হচ্ছে, এরকম মাঝেমাঝে ভাবছে বটে সে, এরকম ভাবনায় সে স্থির হতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে না তানজিলা মিথ্যা। তার মনে হচ্ছে না তানজিলা নামে কেউ নেই, তার মনে হচ্ছে না তানজিলাকে কেউ বানিয়ে তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাহলে তানজিলা কি সত্যি?

— সত্য। সে বলল।

— তা হলে কোথায় সে?

— আছে।

তানজিলাও তাকে একদিন এই কথা বলেছিল—কখনো ভেবো না আমি নেই।

— ভাবব না। কেন আমি ওরকম ভাবতে যাব!

— ভাবতে পার।… মানুষ অনেককিছু ভাবে।

— আমি তোমাকে নিয়ে ওরকম কিছু ভাবছি না।

— ভাববে না। দেখা হবে আমাদের।… খুব শিগগির।

— দেখা কিন্তু আমরা আরো শিগগির করতে পারি।

— দেখা করার কথা আমিই বলেছি। না?

— তুমিই বলেছ।

— আমি সময় নিচ্ছি একটু। একদিন কথা হলো, পরদিন দেখা হলো—এমন হলে আমাকে তুমি অনুভব করতে পারবে না। কিছুদিন যাক।

— যাক তাহলে। তুমি যখন বলছ।

— আরেকটু থিতু হই আমরা।

— তুমি এলোমেলো?

— বেশ।… তুমি?

— দেখলে বুঝবে, লেখকরা এমনিই এলোমেলো।

— আমি কখনো এলোমেলো ছিলাম না। আমি হলাম।

— আমি করতে চাইনি। স্যরি স্যরি।

— স্যরি কেন!

— আমি ধরেই নিয়েছি আমি তোমাকে এলোমেলো করেছি।

— আর কে!

— আমি?

— চুপ! … আমাকে নিয়ে লিখবে?

— জানি না। মাঝেমাঝে মনে হয় কিছু কিছু বিষয় ব্যক্তিগত থেকে যাক।

— হুম।… এই প্রশ্নটা আমি আবার তোমাকে করব। কিছুদিন পর।

— কোন প্রশ্ন?

— এই যে, আমাকে নিয়ে লিখবে কি না। তখন কী উত্তর দাও দেখব।

সে ছোট করে আড়মোড়া ভাঙল। মাঝেমাঝে তার খুব বড় করে আড়মোড়া ভাঙতে ইচ্ছে করে। খুব বড় আর শব্দ করে। বাসায় থাকলে কখনো অমন করেও সে। এখন অমন একটা শব্দ আর আড়মোড়ার খুব ইচ্ছা জেগেছে তার। শব্দে সবাই যদি ফিরে তাকায়, তাকাবে, সে মিস্টার বিনের মতো একটা হাসি দেবে, সবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়বে। তা, এখন তাহলে ভাঙবে অমন একটা আড়মোড়া? তানজিলা তার ভেতর এক অবসাদ তৈরি করেছে। তানজিলা করেছে, কিংবা, তানজিলার জন্য তার এই যে অপেক্ষা, অবসাদ সে কারণে। দেখা হলে তানজিলাকে বলতে হবে—কোথায় তুমি আমার অবসাদ দূর করবে…!

— দূর করিনি?

— কোথায় তুমি আলো হয়ে থাকবে…!

— থাকিনি?

— কোথায় তুমি আমার সব অবসাদ দূর করে দেবে…!

— আহা, বললে একবার। করিনি!

— আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। তারচেয়ে বরং দেখা হওয়াটা অন্যভাবে হলে ভালো হতো।

— কী রকম?

— তুমি থাকতে কোথাও অপেক্ষায়, আমি যেতাম।

— তা-ও হতো। হতে পারত।

— আমি যেতাম আর ভাবতাম, আমি আমার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি।

— তা-ই? আমি তোমার গন্তব্য?

সে ছোট করে আরেকটা আড়মোড়া ভাঙল, পাশ ফিরল, মেয়েটিকে দেখতে পেল। তার মনে হলো—এই মেয়েটিই কি তানজিলা? তার মনে হলো—এই মেয়েটিই। সে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে, মেয়েটির মুখে সামান্য হাসি, খুব সামান্য, খুব হালকা প্রলেপের মতো। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মনে হলো, এই মেয়েটিই তানজিলা। না হলে মেয়েটির মুখে এই সূক্ষ্ম হাসি থাকত না, তাকিয়েও থাকত না তার দিকে।

সে দু-সেকেন্ডের জন্য চোখ ফিরিয়ে নিল, তারপর, যেন ওপাশে কিছু দেখল, এভাবে সে আবার মেয়েটির দিকে তাকাল। সে দেখল মেয়েটি যেন ইতস্তত করছে কোনো এক বিষয়ে। এটা তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলল। তানজিলার কি আদৌ ইতস্তত ভাব থাকার কথা? যুক্তি বলে—থাকার কথা না। তাকে তানজিলার চিনতে না পারারও কথা না। তার ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়, বইয়ের ফ্ল্যাপে থাকে, সে টেলিভিশনে যায়। ইতস্তত ভাব থাকলে, তার থাকবে—কারণ সে তানজিলাকে সেভাবে দেখেনি, ফেসবুকে তানজিলার একটা স্পষ্ট ছবিও নেই। কোনোটায় মুখ ফেরানো, কোনোটায় আকাশের দিকে তাকানো, কোনোটায় সে মুখ নিচু করে আছে, কোনোটায় সে কাঠামো ঠিক রেখে ঝাপসা। সে নিজেই বলেছে, সে অস্পষ্ট, ঝাপসা থাকতে পছন্দ করে। আর, তানজিলা না বললেও, এটুকুও সে বুঝেছে, তানজিলা চমক পছন্দ করে। চোহরায় এই যে সে একটু ইতস্তত ভাব এনেছে, তা সম্ভবত তার সঙ্গে মজা করার জন্য।

এরকম ভেবেও, সে কী করবে বুঝতে পারল না।

যদি এ মেয়েটিই জানজিলা হয়, পরে নির্ঘাত্ তাকে খেপাবে—হু, খুব বলেছিলে আমাকে দেখলেই নাকি চিনে ফেলবে।

— ফেলিনি?

— কতক্ষণ সময় নিয়েছিলে?

— তুমি ইচ্ছা করে অন্যরকম হওয়ার চেষ্টা করছিলে।

— সেটা পরীক্ষা, পরীক্ষায় তুমি ফেল।

— আমাকে পুরো বিভ্রান্ত করে আমাকে ফেলটুশ বানিয়ে দিলে।

— আমার ব্যাপারে তোমার ভেতরে কখনো কোনো বিভ্রান্তিই কাজ করবে না, সবসময়ই এরকম হওয়া উচিত।… তোমার ভেতর বিভ্রান্তি কাজ করেছে।

সে ভাবল, তানজিলা পরে যেন এরকম কিছু বলতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সে অবশ্য নিজেও চায় না তানজিলার ব্যাপারে তার ভেতর কোনো বিভ্রান্তি কাজ করুক। এর জন্য আপাতত প্রয়োজন—এই মেয়েটি তানজিলা কি তানজিলা না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া।

তা, সহজ কোনো উপায় আছে নিশ্চিত হওয়ার?

সে কি একটু হাসবে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, এমন একটা হাসি, যার অর্থ—লাভ নেই, বুঝে ফেলেছি।

মেয়েটি তানজিলা না হলে একটা সমস্যা, হাসির কী কারণ—মেয়েটি ভাববে। এমন হতে পারে মেয়েটা তাকে চেনে, অনেকেই তাকে চেনে—এটা ব্যাপার না, তবে, সেক্ষেত্রে তার হাসি মেয়েটার কাছে বেমানান ঠেকবে, উপায় নেই, একটু রিস্ক বোধহয় নিতেই হবে।… কিছু জিজ্ঞেস করবে সে?

কী জিজ্ঞেস করা সে-ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই মেয়েটি তার দিকে এগিয়ে এল—আমি কি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

— ঢঙ! সে মনে মনে বলল। এই মেয়েটি যে তানজিলা, সে নিশ্চিত, এবং এ-ও সে বুঝতে পারছে তানজিলা তার সঙ্গে মজা করার পরিকল্পনা করেছে।

—হ্যাঁ, সে বলল। নিশ্চয় বলতে পারেন।

— আমি ভুল না করলে—আপনি একজন লেখক।

সে উত্তর না দিয়ে পরের কথা শোনার অপেক্ষায় থাকল।

— অবশ্য আমার ভুল করার কথা নয়।… মানে, আপনি যে একজন লেখক এটা আমার ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।

সে ঠিক বুঝতে পারল না, তানজিলা কোন পথে এগোচ্ছে। তার কী ধরনের ভাব নেওয়া উচিত, সেটাও সে বুঝল না। সে শুধু একটু হাসল—অদ্ভুত কথা!

— কোনটা?

— এই যে বললেন—আমি লেখক, এখানে আপনার ভুল করার সুযোগ নেই।

— নেই।… আপনার অবশ্য সহজেই আমাকে চিনতে পারার কথা না। মনে করতে পারলে বুঝতেন, আমার কথায় কোনো ভুল নেই।

— শোনো, তুমি একঘণ্টা দেরি করে এসেছ। সে হিসেবে তোমাকে আমার চিনতে না পারারই কথা, তা-ই না?

মেয়েটিকে অবাক দেখাল—জি…?

মুহূর্তের মধ্যে তার মনে হলো, এই মেয়েটি তানজিলা না। কেন তার এরকম মনে হলো, তা সে বুঝল না, কিন্তু তার অমনই মনে হলো। সে বলল স্যরি, আমি আপনাকে তানজিলা ভেবেছিলাম।

এরকম বলে সে নিজেকে গর্দভ বলে গালি দিল। তানজিলার নাম উল্লেখ কি আদৌ দরকার ছিল? সে কারো নাম উল্লেখ না করেও কথাটা বলতে পারত।

মেয়েটি জিজ্ঞেস করল—তানজিলার জন্য অপেক্ষা করছেন?

সে মনে মনে বলল—এটা তোমার জানার কী দরকার!… এভাবে বলা যায় না, সে তাই সামান্য মাথা ঝাঁকাল।

মেয়েটিকে বেশ উত্সাহী দেখাল—তানজিলা আপনার কোনো গল্পে আছে?

— মানে!

— গল্পটার নাম কী?

— কোন গল্পের নাম!

— যেটায় তানজিলা আছে?

— তানজিলা আমার গল্পে আছে, এটা আপনাকে কে বলল!

— ওহ! মেয়েটি হাসল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম তানজিলা কোনো গল্পের।… স্যার, এখন কি আপনি আমাকে চিনতে পারছেন?

তার মনে হলো এ এক ঝামেলা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ থাকে এরকম, এমন ভাব—যেন চিনতেই হবে। হয়তো চার বছর আগে কোনো বিয়েবাড়িতে কেউ পরিচয় করিয়ে দিলে দু’মিনিট কথা হয়েছিল, সেই ধরে বসে আছে।… সে দু’পাশে মাথা নাড়াল, না, সে চিনতে পারছে না।

— আমার নাম মেহের। মেয়েটির মুখে সামান্য হাসি।

— হ্যাঁ, আপনি আপনার নাম বললেন মেহের, আর আমি চিনে সারা হলাম—সে মনে মনে বলল।

মেয়েটি তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল—চিনতে পারেননি, বুঝতে পারছি। আসলে এতজনের মধ্যে মনে রাখার কথাও হয়তো নয়।

— আপনার সঙ্গে আমার কোথায় দেখা হয়েছিল?

— শাফিনের কথা মনে আছে আপনার?

— শাফিন?… তার একবার মনে হলো এই মেয়েটি তার স্ত্রী সায়রার দিককার আত্মীয়। বছর দুয়েক আগে সায়রার জেদাজেদিতে ওর এক দূর-সম্পর্কের আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছিল, ছেলে আর মেয়ে তার দু’পাশে বসে ছবি তুলেছিল, এই মেয়েটি সেই মেয়েটিই হতে পারে। হতে পারে যখন, নাও হতে পারে। তাই সে মৃদু হাসল—দেখুন, আমি ঠিক চিনতে পারছি না। লজ্জাই লাগছে…।

সে বলল ও মেয়েটিকে ডিঙিয়ে সামনের দিকে তাকাল—তানজিলা চলে আসেনি তো?

তাকে অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে দেখলে তানজিলা সহজভাবে নেবে না, সে জানে তানজিলা বলেছে তাকে—একটা কথা তোমার জেনে রাখা দরকার। কখনো যদি দেখি বিনাকারণে তুমি অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েছ, আমি তোমার চোখ উপড়ে ফেলব।

— একদম উপড়েই ফেলবে?

— আমি থাকতে তোমার অন্য কারো দিকে তাকাতে হবে কেন?

— তা-ও ঠিক। তোমাকে দেখাই মানে যাবতীয় দেখা।

— মনে রাখবে। আর, খামাখা কথাও বলবে না কারো সঙ্গে। আমার সঙ্গে কথা বললে তোমার আর কিছু বলার থাকবে না।

তানজিলা কিংবা তানজিলার মতো কাউকে দেখা গেল না। সে ফিরল মেয়েটির দিকে। মেয়েটি বলল—আমাকে আর শাফিনকে নিয়ে আপনি একটা গল্প লিখেছিলেন।

— গল্প! সে অবাক হলো। আপনাকে আর শাফিনকে নিয়ে!

— অবাক হচ্ছেন কেন! আপনি গল্পই লেখেন। নাকি?

— না না, সে ঠিক আছে।

— গল্পের নাম ছিল ‘ইচ্ছা’।… আপনার কি মনে পড়েছে?

তার মনে পড়ল না। সে অবশ্য মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু মনে করতে পারল না। এমন হওয়ার কথা না। সে প্রায় সবসময়ই তার নিজের লেখা গল্পের কথা মনে করতে পারে। এখন মেয়েটা বলছে, অথচ সে মনে করতে পারছে না, এটা কি তানজিলা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বলে? সে হাসার চেষ্টা করল—এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না, কিন্তু একটু পরেই হয়তো মনে পড়বে।

— গল্পটা অনেকেই খুব পছন্দ করেছিলেন।

এই কথার পিঠে তার কিছু বলার নেই। সে শুধু হাসল।

— ওই গল্প নিয়ে আমার আর শাফিনের খুব খুনসুটি হতো।… এখনো হয়। আমি হয়তো বললাম—এই গল্প উনি আমাকে নিয়ে লিখেছেন, শাফিন সঙ্গে সঙ্গে বলবে—উঁহু, আমাকে নিয়ে।

সে আবারও একটু হাসল ও প্রাণপণ চেষ্টা চালাল গল্পটা মনে করার। এবারও সে পারল না। একটু মাথা চুলকানোর ভঙ্গি করল—গল্পটার নাম ইচ্ছা। না?

— জি। ইচ্ছা।

— গল্পটা কি আমি আপনার, বা কী যেন নাম বললেন…!

— শাফিন। শাফিন ছিল গল্পের নায়ক। ও তো বলে, ওই গল্পে ওই সব।

— একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না। গল্পটা, মানে ওই গল্পটা কি আপনার বা শাফিনের মুখ থেকে শুনেছিলাম, নাকি আপনাদের পরিচিত কারো মুখ থেকে?

প্রশ্নটা করে সে নিজের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। সে কি কখনো অন্যের মুখে কিছু শুনে গল্প লিখেছে! বরং অন্য কেউ ‘গল্প’ শোনাতে এলে সে বরাবরই নিরুত্সাহিত করেছে। হ্যাঁ, এমন হয়, কখনো কোনো গল্পে নিজের বা অন্যের কোনো ঘটনা বা কোনো পরিচিত চরিত্রের কিছুটা পরোক্ষভাবে ঢুকে পড়ে, তাই বলে—পুরো গল্প! কখনো না। তাহলে কেন সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করতে গেল—ওর বা শাফিনের মুখ থেকে শুনে সেই গল্প লেখা কি না।

মেয়েটিকেও খুব অবাক দেখাল—না স্যার, তা হবে কেন!

— তাহলে?

— তাহলে কী, স্যার?

— আমি কি চিনতাম আপনাদের?

— আমাদের? মেয়েটি একটু ভেবে নিয়ে মাথা নাড়ল—নাহ, আমাদের নিয়ে লেখার আগে নিশ্চয় আমাদের চিনতেন না।

— সে বিব্রত বোধ করল।

— তবে এমন হতে পারে, আমাদের মতো কাউকে আপনি চিনতেন, বা তাদের কথা শুনেছিলেন, সেখান থেকে গল্পটা এসেছে।

— তাহলে আপনারা কারা?

— মেয়েটি অবাক হয়ে গেল—আমরা দুজন স্যার আপনার গল্পের নায়ক-নায়িকা।… স্যার, আপনি অবাক হচ্ছেন কেন!

— আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না, মাথায় ঢুকছে না, সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, তাই অবাক হচ্ছি।

মেয়েটি হেসে ফেলল—স্যার, একবার এক সাহিত্য সম্পাদক খুব করে ধরলেন আপনাকে তার পাতায় একটা গল্প দেওয়ার জন্য।

সে মাথা ঝাঁকাল—বুঝলাম, কিন্তু এরকম লেগেই আছে।

— তার চাপে, সে আপনার প্রিয়জনও বটে, অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও আপনি একটি গল্প লিখে ফেললেন। গল্পের নাম, ইচ্ছা। আর, গল্পের যে নায়িকা, সে হচ্ছি আমি।

সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকল।

— স্যার, আমি কিন্তু সত্যি বলছি।

— সেই গল্পের নায়িকা আপনি!

— জি।

— আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন?

— জি।… তবে, এভাবে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, কখনো ভাবিনি।

সে অসহায় বোধ করল।

— কখনো কখনো মনে হয়েছে যাই আপনার কাছে, দেখা হোক। শাফিনের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা হয়েছে অনেক। আমাদের দুজনেরই কিছু কথা তো বলার আছে। কিন্তু স্যার, আপনার কাছে ইচ্ছা করলেই যাওয়া যায় না।… এখন স্যার, আমার সত্যিই খুব ভালো লাগছে।… আপনি কেমন আছেন?

দুই

বাড়ি ফিরে সে গল্পটা খুঁজে বের করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বাড়ি অবশ্য সে তখনই ফেরেনি। স্যার, আপনার অসুবিধা না থাকলে খুব তাড়াতাড়ি আমাদের দেখা হবে—এই বলে মেহের বিদায় নেওয়ার পর সে অনেকক্ষণ ওই ওখানেই দাঁড়িয়েই ছিল। তানজিলা আসবে কি আসবে না—এই চিন্তাটা তার মাথায় ছিল না। তানজিলার কথা তার মনে হয়নি, এমনও অবশ্য নয়। একবার সামান্য সময়ের জন্য এমনও তার মনে হয়েছে—সম্ভবত তানজিলাই অমন অভিনয় করে গেল। মজা আর কি। পরে তাকে খোঁচাবে—দেখেছ, আমার ক্ষমতা দেখেছ! তুমি কিছুই বুঝতে পারলে না।

তানজিলার সঙ্গে তার পরিচয় ফেসবুকে। তার নিজের নামে পেজ আছে। সেখানে সে তার বইয়ের খবরাখবর দেয়, লেখালেখির কথা বলে। কে তার কোন বইয়ের কোন লেখার কী প্রতিক্রিয়া জানাল—তার অপেক্ষায় থাকে। ওখানে ইনবক্স আছে। অনেকেই মেসেজ পাঠায়। অধিকাংশই জানতে চায়, সে নতুন কী লিখছে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, অমুক বইটি কোন প্রকাশনীর, সামনের মেলায় নতুন কী আসবে, অনেকদিন কেন তার গল্প দেখা যাচ্ছে না, এসব।

এই ইনবক্সে একদিন তানজিলার মেসেজ এলো—স্যার…।

এই মেসেজের কি কোনো উত্তর হয়! কী বলবে সে। কিছুই জানতে চায়নি মেয়েটি। আর, মেয়ে কি না, সে ব্যাপারেও নিঃসন্দেহ হওয়া যাচ্ছে না, নাম মেয়ের, সঙ্গে ছবি যেটা, সেটাও মেয়ের, তবে পাশ থেকে এমনভাবে তোলা, শুধু কাঠামো বোঝা যাচ্ছে তার, চেহারার কিছুই না। সে মেয়েটির প্রোফাইলে গেল, তেমন কিছুই নেই। কিছু কিছু কবিতার লাইন, কখনো কিছু গদ্যাংশ, কবিতার লাইন বা গদ্যাংশ সবই বিখ্যাত লেখকদের। হোক, সে তানজিলা নামের মেয়েটির মেসেজ সিন করে রেখে দিলো।

পরদিন আবার মেয়েটির মেসেজ এল—স্যার…।

সে তখন তার পেজেই, এবার উত্তর দিলো—জি, বলুন।

— আপনার লেখা ভালো লাগে।

— আচ্ছা, (হাসির ইমো) ধন্যবাদ।

— একটু বেশিই ভালো লাগে।

— আবারও ধন্যবাদ। (এবার হাসির দুটো ইমো।)

— সব পড়েছি, এমন বলব না, তবে অধিকাংশই পড়েছি।

— শুনে ভালো লাগছে।

— একটা কথা বললে রাগ করবেন?

— শুনি।

— বুঝতেই পারছেন, আমি আপনার ভক্ত। আমি যদি মাঝে মাঝে এখানে আপনার সঙ্গে কথা বলি, বিরক্ত হবেন?

— না, না, তা কেন হব! তবে এখানে আমি খুব একটা আসি না।

— মাঝে মাঝে আসেন। সে সময়ে যদি কথা বলি, মানে মেসেজ…।

— না, বিরক্ত হব না।

— অনেক ধন্যবাদ।

— জানতে পারি, আপনি কে?

— আপনার ভক্ত।

— সেটা পরিচয় হতে পারে না।

— আমি তানজিলা।

— এ নামটা দেখতে পারছি। তবে তানজিলা যে কেউ হতে পারে।

— তা পারে। … আমি ঢাকা শহরেই থাকি। পড়াশোনা শেষ হয়নি। প্রচুর বই পড়ি।

— এটুকু?

— আপাতত।… আপনার অনুমতি নিলাম না—মাঝে মাঝে কথা হওয়ার—তখন সবই জানা যাবে।… আপনার ধারাবাহিক ‘অপার’ শেষ হবে কবে? মনে হচ্ছে, অনেক বড় ক্যানভাস।

— হ্যাঁ, সম্ভবত বেশ বড় হবে।… আরেকটা কথা…।

— জি?

— আপনার সবগুলো ছবিই অমন কেন, স্পষ্ট করে কোনোটাতেই কেন আপনার চেহারা বোঝার উপায় নেই?

— এটা হয়তো খেয়াল আমার। কিংবা হয়তো কোনো কারণ আছে।… বলব।

মাঝখানে সে নির্ভেজাল প্রেমের উপন্যাস লেখার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। এই নিয়ে সায়রার সঙ্গে তার কথা হয়েছিল। সায়রা, সে যখন বলেছিল—সে অদ্ভুতুড়ে এক প্রেমের উপন্যাস লিখতে চায়, উত্তরে বলেছিল—তাহলে ফেসবুকে যাও, ফেসবুকের চেয়ে অদ্ভুত আর কিছু নেই।

এই তানজিলার সঙ্গে সপ্তাহ দুয়েক কথা বলার পর মনে হলো—ফেসবুকের চেয়ে অদ্ভুত জায়গা সত্যিই আর কিছু নেই। নইলে, যে তানজিলা সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না, তার সঙ্গে এত অল্পসময়ে এমন এক নৈকট্য তৈরি হয় কীভাবে! সে ইনবক্সে তানজিলাকে জিজ্ঞেস করল—ব্যাপারটা খুব অবাক করা না?

পাল্টা প্রশ্ন এল—কীরকম?

— এই যে কোথায় ছিলাম আমি…!

— আহা! তুমি তো ছিলেই…।

সে সময়ের কিছুদিন আগেই তারা পরস্পরকে ‘তুমি’ সম্বোধন শুরু করেছে। প্রস্তাবটা তানজিলার, ইচ্ছাটা তার। দু-চারদিন কথা বলার পর তার মনে হলো, মেয়েটির বয়স কম, তার প্রতি ভক্তিও অগাধ বলেই মনে হয়, তো, একে আপনি আপনি করে বলার কী দরকার! তবে প্রস্তাবটা সরাসরি দিতে তার লজ্জা লাগল। এভাবে কি সরাসরি বলা যায়—তোমাকে তুমি করে বলব, হ্যাঁ?—তার মনে হলো—না। অবশ্য কিছুই না করে তুমি তুমি করে লিখতে শুরু করে দেওয়া যায়। তবে সে সে-পথেও হাঁটল না। সে একদিন ইচ্ছে করে দু’বার ‘তুমি’ করে লিখল, তার পরপরই লিখল—‘স্যরি, আপনি’। তৃতীয়বারের বার তানজিলা বলল—বলি, তুমি করে বলতে নিষেধ করেছে কে!

— না না, নিষেধ করবে কে!

— তা হলে অত কাটাকাটির কী দরকার!

— এমনিতে ধরো, অসুবিধার কিছু নেই। তবে আমাদের পরিচয় বেশিদিনের নয়।

— অনন্তকালের।

সে মুচকি হাসির ইমো পাঠাল।

— সুতরাং আপনি আমাকে তুমি করে বলতেই পারেন।

— পারি, মনে হচ্ছে।

— দ্বিধা থাকলে বলি—আপনার কাছ থেকে তুমি সম্বোধন আমি ডিজার্ভ করি।

— তা-ই? (সঙ্গে ভুরু কোঁচকানো ইমো)।

— হ্যাঁ, সুতরাং তুমি করে।

— বেশ, তুমি করে।

পরদিন তানজিলা বলল—আমার একটা কথা ছিল।

— অপেক্ষা করছি।

— আমিও তোমাকে তুমি করে বলব।

একটুস সময় নিল সে—এ তো ভালো কথা…।

— তুমি যদি ভাবো আমি বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাচ্ছি…।

— আমি মোটেও সেরকম কিছু ভাবছি না।

— কথা শেষ করতে দাও। তুমি যদি ভাবো আমি বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চাচ্ছি, তবে তোমার ভাবনা ভুল।

— আমি কিছুই ভাবিনি, আমি খুশি হয়েছি।

— আমি বয়সে ছোট। বেশ ছোট। তা হলে কেন তোমাকে তুমি করে বলব?

— আমরা বন্ধু বলে।

— উঁহু। তোমাকে তুমি করে বলব সম্মানের জায়গা থেকে। একজন যখন অনেক বেশি সম্মান অর্জন করে ফেলে, তখন তাকে সম্মান জানিয়েও তুমি করে বলতে পারি।

— বেশি বেশি বলছ। আমি মোটেও অতটা নই। আমরা বরং বন্ধু…।

— অবশ্যই আমরা বন্ধু। তবে তারও আগে আমার ওই কথা।

— বেশ, সে তোমার ব্যাপার। আমি কিছু বলব না।

এরপর সে একদিন বলল—ব্যাপারটা খুব অবাক করা না—আর, তানজিলা প্রশ্ন করল—কীরকম? সে বলল—এই যে কোথায় ছিলাম আমি… উত্তরে জানজিলা বলল—আহা, তুমি তো ছিলেই। সে তখন বলল—আমার কথা কিন্তু শেষ হয়নি।

— কোথায় ছিলে তুমি আর কোথায় ছিলাম আমি, এই তো বলবে ভেবেছিলে।

— বুঝে ফেলেছ!

— অবাক হচ্ছ! এটা বোঝার জন্য বেশি বুদ্ধিমান হতে হয়?

— না, এটা বোঝার জন্য অল্প বুদ্ধি দরকার।… তোমার বুদ্ধি অনেক।

— অনেক না, আবার কমও না।

— এটা আমার খুব ভালো লাগে।

— কোনটা?

— তোমার বুদ্ধির ব্যাপারটা।

— আচ্ছা, বুঝলাম। এখন বলো কী বলছিলে…।

— পুরনো কথা। পুরনো কথাই আবার বলছিলাম—আমরা দুজন কে কোথায় ছিলাম…।

— আমার সেরকম লাগে না…।

— কেন! তার ভুরু কুঁচকে ছিল।

— কেন, জানি না। তবে আমার কাছে স্বাভাবিক লাগে। যেন এমনই হওয়ার কথা ছিল।

— আমার রূপকথা রূপকথা লাগে…।

তানজিলা হাসতে আরম্ভ করেছিল।

— হাসি পাওয়ার মতো কিছু কি বলেছি আমি?

— মনে হচ্ছে যখন, একটা রূপকথা লিখো। একালের রূপকথা।

— লিখব।… রূপকথা কেন বলি, জানো? আরো বলি এ কারণে যে—তুমি দেখতে কেমন, সে সম্পর্কে আমার ধারণা নেই।

— আমি দেখতে একদম আমার মতো।

— খুবই আশ্চর্যের কথা!

— খুবই…। শোনো, আমার নাক খাড়া…।

— হুমম…।

— ঠোঁট পাতলা…।

— আহা তানজিলা, একটা ছবি দিলে কী হয়!

— অনেক ছবি আছে প্রোফাইলে।

— একটাও স্পষ্ট নয়। আবার কোনোটা মুখ ফেরানো…।

— তুমি লেখক, তুমি স্পষ্ট করে নাও না…।

— সে তো নিয়েছিই কিছুটা। তবু…।

— এক কাজ করি বরং। আমার ফোন নাম্বার তোমাকে দেই। এই মেসেঞ্জারেই অবশ্য কথা বলা যায়। কিন্তু ব্যবস্থাটি আমার পছন্দ নয়। আমি সেল নাম্বার দিচ্ছি। তুমি যখন ইচ্ছে আমাকে ফোন করতে পারবে, আমার অসুবিধা নেই। দেখা যাক, কথা বলে তোমার সুবিধা হয় কি না।

— সুবিধা হয় কি না! কী ধরনের সুবিধার কথা তুমি বলছ?

— ধরো, আমার সঙ্গে কথা বলে তুমি আমার চেহারা সম্পর্কে কোনো ধারণা করতে পার কি না।

— পারা যাবে?

— সেটা নির্ভর করছে তোমার ওপর। দেখো চেষ্টা করে।

সে বলল—দেখি।

তারা কথা বলল বেশ কয়েকবার। ওটা একটা বড় সুবিধা—তানজিলাকে যেকোনো সময়ই ফোন করা যায়। সে হয়তো রাত বারোটায় ফোন করল—হ্যালো।

— এত রাতে কী হলো!

— কিছু না। শুধু একটু হ্যালো বলার ইচ্ছা হলো।

— কথা বলে যা হলো, তানজিলা সম্পর্কে তার জানার পরিধি বাড়ল। তার মনে হলো মেয়েটাকে সে ইনবক্সের চেয়ে অনেক বেশি বুঝতে পারছে। তবে সবসময় ফোনে কথা বলা তার পক্ষেই সম্ভব না, সুতরাং সে ইনবক্সে তানজিলাকে বলল—ফোনে কথা বলার একটা বড় সুবিধা কী, জানো?

— নাহ, জানা হয়ে ওঠেনি।

— কথা বললে আরো বেশি অনুভব করা যায়।

— আচ্ছা! তাহলে তুমি আমাকে আগের চেয়ে বেশি অনুভব করছ?

— আমার তেমনই মনে হচ্ছে।

— আমার সম্পর্কে দু-চারটে মতামত দাও দেখি।

— এই যেমন তুমি বুদ্ধিমান।

— এ তুমি আগেই বলেছ।

— তোমার গলা একটু ভাঙা ভাঙা।

— এ কথা বললে যে কেউ মনে করবে।

— হুমম। তুমি একইসঙ্গে স্থির ও চঞ্চল।

— তা-ই? এটা নিয়ে ভাবতে হবে।

— তোমার রসবোধ দারুণ…।

— আর?… দাঁড়াও। আরো বলার দরকার নেই। বরং মূল ব্যাপারটি বলো। আমার চেহারা সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছ?

— না।

— একটুও না?

— না।

— তুমি দেখছি ডাহা ফেল।

— এটা খুব কনফিউজিং।

— কনফিউজিং? … কী রকম?

— একেকবার একেকরকম মনে হয়।

— আমি কথা কিন্তু বিভিন্নভাবে বলি না।

— তা বলো না। কিন্তু আমি স্পষ্ট ছবি তৈরি করতে পারছি না।

— তোমার লেখা পড়ে কিন্তু মনে হয় তোমার কল্পনাশক্তি অসীম।

— আমিও সে-রকমই জানতাম। (সে একটা মন খারাপের ইমো বসাল)।

— আরও কিছুদিন চেষ্টা করবে?

— তাতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।

— তাহলে কী আর করা, আমি অস্পষ্টই থাকি তোমার কাছে।

— নাহ।

— তুমি স্পষ্ট করতে পারছ না।

— অন্য একটা উপায় আছে।

— স্পষ্ট ছবি কিন্তু আমি দেবো না।

— আমি ছবির কথা বলছি না। অন্য উপায়।

— বলো, শুনি।

— তুমি আন্দাজ করতে পারছ না?

— পারছি।… পারার কথা, তা-ই না?

— তাহলে আমার বলার দরকার নেই, না?

— ভুল। দরকার আছে।

— কেন?

— আমি তোমার মুখ থেকে শুনব।

সায়রা জিজ্ঞেস করল—তোমার নতুন উপন্যাস কি শুরু করেছ? ওই যে, বলছিলে না—এবার একটা প্রেমের উপন্যাস লিখবে।

সে মাথা নাড়াল—নাহ, কোনো ডেভলপমেন্ট নেই।

— গোছাতে পারছ না?

— কাহিনিই ঠিক করতে পারলাম না।

— কেন, মেয়েটা কি যথেষ্ট সহযোগিতা করছে না?

— কোন মেয়ে?

— আচ্ছা, তুমি তালগাছ থেকে পড়লে কেন?

— তালগাছ থেকে কেন পড়ব!

— কোন মেয়ে তুমি সেটা বুঝতে পারছ না?

— নির্দিষ্ট করে না বললে…।

— যে মেয়ের সঙ্গে তুমি ইনবক্সে ব্যস্ত। তোমাকে মাঝে মাঝে উদাসীন দেখায়।

— মোটেও আমাকে উদাসীন দেখায় না।

— বেশ, তোমাকে চটপটে দেখায়। এখন বলো, মেয়েটা কি কাঠখোট্টা টাইপের? তোমার মধ্যে প্রেমভাব জাগাতে পারছে না?

— তুমি আমার ইনবক্স দেখেছ?

— আমার দায় পড়েছে…।

— এমনভাবে বলছ যেন কত কী জেনে বসে আছ। শোনো, ইনবক্স বলো বা আউটবক্স, কোথাও কোনো মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই।

— না, মানে বলছিলাম কি, এমন নিমগ্ন হয়ে চ্যাট করো…।

— কী আশ্চর্য, তুমিই-না আমাকে ফেসবুকে ঠেলে পাঠালে!

— গল্পের যেন একটা প্লট পাও, সেজন্য পাঠিয়েছি। না?

— হুঁ। সেজন্যে।

— কিন্তু তোমার প্লট আসছে না, প্রেম চলে আসছে…।

— আহা, সায়রা…!

— নাম কী মেয়ের?

— তানজিলা।

— বাহ! চেহারা কেমন?

— ধারণা নেই। প্রোফাইলে যতগুলো ছবি আছে, সবগুলো আড়াল করা বা ঝাপসা।

— সায়রা হাসতে আরম্ভ করল।

— হাসির কিছু হয়নি। কারো কারো এরকম বাতিক থাকতে পারে।

— হাসছি, কারণ আমি নিশ্চিত তুমি কোনো ফেইকের পাল্লায় পড়েছ।… সাবধান।

সে পরদিন তানজিলাকে ইনবক্স করল—ব্যস্ত?

— তুমি নক করলে, আর, আমি ব্যস্ত! কক্ষনো না।

— একটা কথা বলব।

— যে কথাটা আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।

সে বলল—হুমম, সে কথাই। দেখা করার কথা।

বাড়ি ফিরে সে গল্পটা খুঁজে বের করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লে সায়রা জিজ্ঞেস করল—কী খোঁজো? তারপর বলল—এই যে বুকসেলফ থেকে এত কাগজ নামিয়েছ, সব কিন্তু গুছিয়ে তোমাকেই ওঠাতে হবে। আমার কোমরে ব্যথা, আমি পারব না।

— তোমার কী মনে আছে? সে জিজ্ঞস করল।

— নেই। সায়রা বলল। সংসারের চাপে আজকাল অনেক কিছুই মনে থাকে না। তবে তানজিলার কথা মনে আছে।

— তানজিলা না, মেহের।… আমার কি ‘ইচ্ছা’ নামে কোনো গল্প আছে?

— মেহের আবার কে!… জানি না। তোমার ইচ্ছার কথা তুমি জানবে।

— আহা, বলোই না। আছে?

— আছে। মেয়েটার জন্য আমার খুব খারাপ লেগেছিল।

— কোথায়?

— কোথায় মানে! খারাপ লাগলে মনে লাগবে।

— না না, গল্পটা কোথায়?

— আচ্ছা, সেটাও কি আমার জানার কথা!

— গল্পটা দরকার। খুব।

— খোঁজো, থাকলে এখানেই আছে।

— আচ্ছা, ওই গল্পের নায়িকার নাম কি মেহের?

— নাম মনে নেই। গেলাম। একটু পর হয়তো জিজ্ঞেস করবে—মেয়েটা কি সবুজ শাড়ি পরত?

— ধ্যাত্। এই তো। পেয়েছি।

— চোখের সামনে রেখে খুঁজে বেড়াচ্ছ, সমস্যা কী?

— গল্পটা পড়তে হবে।

— এটাকে সমস্যা মনে হচ্ছে না।

— আছে, পরে বলব।

— কোনো সুন্দরী পাঠিকা কিছু বলেছে। তার জীবনের সঙ্গে মিলের কথা?

সে হাসল—অনেকটাই।… এখন এককাপ কফি করে দাও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।

একটু ইতস্তত করল সায়রা—দিচ্ছি।… আমার একটা সবুজ শাড়ি লাগবে।

সায়রা চলে গেল, সে গল্পটা পড়তে আরম্ভ করল।

— ওটা ওয়াটার কালার। জলরঙ। একটু পেছন থেকে না দেখলে ছবিটা তোমার ভালো লাগবে না?

শাফিন দেওয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে এগোচ্ছিল। মেহেরের কথা শুনে সে থমকে দাঁড়াল। মেঝেতে তার ছায়া পড়েছে। নিজের ছায়ার দিকে সে তাকিয়ে থাকল কিছুটা সময়। ছায়া থেকে চোখ সরিয়ে সে তাকাল তার সামনে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে। মেহের বারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু সে বুঝতে পারছে না—যেমন সামনে এগোচ্ছিল তেমন এগোবে, না পিছিয়ে আসবে। সামনে এগোলে, তার মনে হচ্ছে, ছবিটা কাছ থেকে ভালোভাবে দেখা যাবে। পেছনে গেলে কি সেটা সম্ভব? ব্যাপারটা বুঝতে পারল না শাফিন, সে যখন বুঝতে পারে না, তার মুখে একধরনের হাসি ফোটে, তার মুখে সেই হাসিটা ফুটল। সে বলল—পিছিয়ে গিয়ে দেখলেই ছবিটা ভালো লাগবে।

মেহের মাথা নাড়ল—নিশ্চয়তা নেই।… তবে ছবিতে নাক লাগিয়ে দেখলেই ছবিটা ভালো লাগবে, তা কখনো নয়। এই নিশ্চয়তা দিতে পারি।

শাফিন হাসিমুখে মেহেরের দিকে ফিরল—ছবির আসলে আমি কিছুই বুঝি না।

মেহের হাসল—জানি।

— কীভাবে জানো?

— এমনি এমনি জানি। তবে দেখতে যখন এসেছ…।

— নিয়ম মানতে হবে?

— হ্যাঁ, সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। ছবি দেখারও। সেটা তোমাকে মানতে হবে।

— বেশ। ওয়াটার কালার কি পেছন থেকে দেখতে হয়?

— সব ছবিই একটু দূর থেকে দেখতে হয়।

— কারণটা জানা যাবে?

— যাবে।… তুমি তাজমহল দেখতে গেছ?

— যাইনি। তবে যাব।

— তোমাকে তাজমহলের গায়ের সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া হলো। তুমি তাজমহলের বুঝবে কিছু? ছবিও তেমনি। সৌন্দর্যটুকু নেয়ার জন্য একেক দূরত্বে দাঁড়াতে হয়।

— একটু পিছিয়ে যাব তাহলে?

— কয়েক পা পেছনে আসো।… হ্যাঁ, আরেকটু… আরেকটু। দাঁড়াও।… শোনো, অত শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে না। শক্ত হয়ে না দাঁড়িয়েও ছবি দেখা যায়। … আহা, তোমাকে দেখে কী মনে হচ্ছে, জানো?

অদ্ভুত একটা কিছু বলবে মেহের, শাফিন বুঝতে পারল। এড়াবার উপায় নেই, সে জিজ্ঞেস করল—কী মনে হচ্ছে?

— তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। তুমি ছবিটা দেখো। ছবি দেখার জন্য কিন্তু তুমিই জোরাজুরি করেছ। এখন তুমি যদি ঠিকমতো ছবি না দেখো, আমার মেজাজ গরম হবে।

— প্রায়ই হয়?

— কী?

— মেজাজ গরম।

— হুম, প্রায়ই হয়।

শাফিন হাসল—তোমার আবার মেজাজ…। শাফিন ছবিটার দিকে তাকাল। সামান্য সময় পরই সে বুঝতে পারল মেহের ঠিকই বলেছে। ছবিটার কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে নিলে ছবিটা এভাবে সে দেখতে পেত না। এখন, যেটা হয়েছে, পুরো ছবিটা সে দেখতে পাচ্ছে।

আরো কিছুটা সময় নিয়ে ছবিটা দেখল সে। মেহেরের দিকে তাকাল—আগুনের রঙ সবুজ রেখেছ কেন? আগুনের রঙ কি সবুজ হয়?

— হয়। এমনভাবে ‘হয়’ বলল মেহের, যেন শাফিনের প্রশ্নটাকে সে এতটুকু গুরুত্ব দিল না।

— কীভাবে হয়? কোথায় হয়? আমাকে একটু বোঝাবে?

— এখানে কেন সবুজ, সেটা তোমাকে বলব না। তবে আমি অন্য একটা উদাহরণ দিতে পারি।

— অলরাইট, সেটাই শুনি। আফটার অল, শিল্পীর ব্যাখ্যা।

— আগুনের আসলে কী রঙ? মূলত?

— লাল।

— ধরো কোথাও আগুন লেগেছে। খুব বাজে ধরনের আগুন। আমি যদি তখন আগুনের লালকে বেশ কিছুটা কালো করে ফেলি, অসুবিধা আছে?

তোমার ব্যাখ্যা পছন্দ হয়েছে—এরকম কিছু বলতে যাচ্ছিল শাফিন। তার আগে ঘরের বাইরের দিকের দরজায় লুবনাকে দেখা গেল। তার মুখে হাসি। সে বলল—যে ছবি দেখে কিছু বোঝা যায় না, সে ছবি দেখা বন্ধ। সে তাকাল শাফিনের দিকে, ইয়ার্কির ভঙ্গিতে বলল—ফোন এসেছে ফ্রম হার রয়াল হাইনেস, শাফিন ভাইয়াজান, আপনি কি দ্রুত, অর্থাত্ পঙ্খিরাজের মতো উড়ে গিয়ে ফোনটা ধরবেন?

— এখন ফোন। শাফিন বলল, তার গলায় বিরক্তি না বিস্ময় ঠিক বোঝা গেল না। লুবনা একটু সরে দাঁড়ালে সে ‘আসছি’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। লুবনা তার পেছনে-পেছনে গেল না, সে দরজার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকল, মেহেরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল—কী করছিলে?

— তুমিই বললে যে ছবি দেখে কিছু বোঝা যায় না…।

— সে ঠিক আছে। করছিলে কী?

— শাফিন ভাই ছবি দেখতে চেয়েছিল…।

— নাকি তুমি ছবি দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছিলে?

— তুমি যা মনে করো।

— শুধু আমি কেন! মনে করলে এ বাড়ির সবাই করবে।

সামান্য হাসি মেহেরের ঠোঁটের কোণে উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল—তা-ই?

— তা-ই।

— লুবনা। মেহের বলল, তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ইচ্ছে করছে না।

— তা তো করবেই না। যখন-তখন তোমার কথা বলতে ইচ্ছা করে না। লুবনা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঘুরতে নিয়ে ফিরে দাঁড়াল—ছবি ঘরের দরজা খোলা রেখেও দেখানো যায়। ছবি দেখানোর জন্য ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিতে হয় না।

শাফিনের বিয়ে সামনের মাসে। সে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে থাকে। ছবি দেখলেই বোঝা যায় শিল্পীর আঁকা ছবির মতন একটা জায়গা। যেন পাল্লা দিয়ে সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। এই সৌন্দর্যের কথা, আড্ডায় কথা উঠলে, শাফিন কয়েকবার বলেছে।

ভ্যাঙ্কুভারে যাওয়ার পরের দিনগুলো শাফিনের খুব কষ্টের ছিল। সেটা ছিল শীতের সময়। ওতেই সে কিছুটা কাবু, সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও কম ভোগান্তির নয়। এখন সব কষ্ট সব সমস্যা সে কাটিয়ে উঠেছে। এখন ওখানে চমত্কার এক জীবন সে যাপন করে। পরিশ্রমের, তবে গোছানো ও স্বাচ্ছন্দ্যেরও। তবে সবকিছুর পরও ওখানে সে একা। সে দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য।

এই নিয়ে সমবয়সীদের মধ্যে অল্পবিস্তর রসিকতা হয়েছে—

— সে কী রে! ওই দেশে তুই মেয়ে খুঁজে পেলি না!

— নাকি ওই দেশে একটা করেছিস, এখন এ দেশেও করবি একটা?

— কাজটা কি ভালো হবে, এ দেশে বিয়ে করা? বিয়েটা ও দেশেই করতি, আমরা বলতে পারতাম আমাদের শাফিনের বিদেশি বউ!

পাত্র হিসাবে সে যথেষ্ট যোগ্য বলে, পরিচিত মহলে মেয়ে খোঁজার একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। শেষে তার বড় খালা বহু দেখেশুনে তার জন্য পাত্রী ঠিক করেছেন। অতি রূপসী সে মেয়ে। এ নিয়েও রসিকতা কিছু কম হয়নি—

— চেহারা দেখেছিস মেয়ের? এ মেয়েকে তো শাফিন কিছু করতে পারবে না।

— কেন কেন?

কারণ এ মেয়েকে বাঁধিয়ে রাখতে হবে।

বড়খালা অবশ্য মেয়ের রূপের পাশাপাশি তার উচ্চবংশের ব্যাপরটিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন। আজকাল উচ্চবংশের মেয়ে পাওয়া, তিনি বারবার বলছেন, খুবই কঠিন ও ভাগ্যের একটা ব্যাপার। মেয়ের নাম জরিনা। তাদের পরিবারে উর্দুর কিঞ্চিত চল আছে। তাদের আভিজাত্য মেয়ে দেখতে ও বাড়িতে গেলেই টের পাওয়া গেছে। এতে বড় খালার মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। সাধারণত ছেলের জন্য মেয়ে ঠিক করার ক্ষেত্রে মায়ের একটা বড় ভূমিকা থাকে। শাফিনের মা ছেলের জন্য মেয়ে ঠিক করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি। তিনি সহজ, সরল, নিরীহ টাইপের মহিলা। অপছন্দ হলেও অন্যের কথা মেনে নিতে তার অসুবিধা হয় না। জরিনাকে অবশ্য তার পছন্দ হয়নি। বরং মেয়ে দেখার আসরে তাকে মেয়ের দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছিল। মেয়ে দেখে নির্দিষ্ট কোনো কথা না দিয়ে কিছু সময় নিয়ে ফিরে আসার পর রাতে শাফিন যখন জিজ্ঞেস করল—মা, তোমার কেমন লেগেছে মেয়েকে, তুমি এখনো কিছুই বলোনি, তুমি বলো—তিনি বললেন—ভালোই তো রে, বাবা।

শুনে হা হা করে উঠলেন শাফিনের বড় খালা লুবনার মা—ভালোই তো মানে!

— ভালো না?

— তাহলে ভালোই তো বলছ কেন! এত সুন্দর মেয়ে কি আজকাল পাওয়া যায়! পাশাপাশি খানদানটাও দেখবে না?

— হ্যাঁ হ্যাঁ, তা তো বটেই। শাফিনের মা তখনই বললেন। এমনভাবে বললেন, যেন ভালোই তো বলে তিনি মহা অপরাধ করে ফেলেছেন, এখন অপরাধ খণ্ডন করার জন্য তিনি উদগ্রীব।

— বুবুকে দিয়ে হবে না। বুবুর কিছু ঠিক নেই। শাফিন, তুই বল, বড়খালা বললেন।

— ভালোই তো। শাফিন বলল।

— তুইও—ভালোই তো।

— আহা, আর কী বলব!

— বেশ, বড় খালা বললেন। তাহলে এখানেই তোর বিয়ে, আমি ওদের পাকা কথা দিয়ে দিচ্ছি।

ছবি আঁকতে মেহেরের সবসময় ইচ্ছা করে না। তবে কখনো এরকম হয়, সে ঠিক করে রাখে কোনো একটা ছবি সে অমুক সময়ের মধ্যে ঠিক করবে। তাতে ছবিটা যদি না দাঁড়ায়, না-দাঁড়াক। আবার বেল কয়েকটা ছবি আছে অসমাপ্ত। কোনোটায় সামান্য কাজ বাকি, কোনোটার কিছুটা বেশি। ওসবের মধ্য থেকে একটা ছবি সে আলাদা করে রেখেছিল। সে ঠিক করে রেখেছিল, এই যে ছবিটায় লালের প্রাধান্য বেশি, সেটা সে আগে শেষ করবে। এখন ছবিটা ধরা যায়। ঘণ্টাখানেক টানা কাজ করতে পারলে ছবিটা নামিয়ে ফেলা যাবে। সে একপাশে জড়ো করে রাখা ছবিগুলোর দিকে এগোল, যে ছবিটা শেষ করতে চায়, সেটা সে তুলে আনল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ; ছবির কোথায় কোথায় কাজ করতে হবে, তা তার মাথায় আছে। মাথায় না থাকলেও চলে, ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই হয়, আবার এমনও হয়—মাথায় যা ছিল, বিরতি নিয়ে তাকানোর পর তা বদলে যায়, কাজ শুরু করার পরও নতুন কিছু এসে যায় মাথায়। এ ছবির ক্ষেত্রেও যে ওরকম কিছু ঘটবে, সে জানে। মেহের ছবিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নামিয়ে রাখল, তার হঠাত্ মনে হলো, ছবিটা নিয়ে কাজ করতে আসলে এখন তার ইচ্ছা করবে না।

একটু আগে লুবনা তার সঙ্গে খামাখা খারাপ ব্যবহার করে গেছে, এটা তার মন খারাপ করে দিয়েছে, তবে এতটা খারাপ করে দেয়নি যে ছবির বাকি কাজ তার সারতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তার ইচ্ছা করছে না। শাফিন নিজের ইচ্ছায় ছবিগুলো দেখতে এসেছিল, আর, দরজা বন্ধ না, খোলাই ছিল, ভেজানো ছিল হয়তো, সে আসলে খেয়াল করেনি। তাছাড়া খেয়াল করলেই দরজা সে হা করে খুলে দিত, এমনও নয়। কারণ, দরজা ভেজানো বা ভেজানো না থাকলে কী, এসব তার মাথায়ই আসেনি। ওসব নিয়ে লুবনার কথায় তার মন কিছুটা খারাপ হয়েছে বইকি। অন্য সময় হলে, সে জানে, ওরকম কোনো ব্যবহার একটুও মন খারাপ হতো না তার। এদের খারাপ ব্যবহারে, খারাপ ব্যবহার যদি নাও বলে সে, তাচ্ছিল্য বলবেই, সে অনেকদিন ধরে অভ্যস্ত। কিন্তু একটু আগে শাফিন ছিল তার সঙ্গে, তার ভালো লাগছিল শাফিন তার আঁকা ছবিগুলো দেখবে বলে, এমন সময়ে লুবনার উপস্থিতি তাকে একটু হলেও বিব্রত করেছে। মেহের ভুরু কুঁচকে, লালের প্রাধান্য যে ছবিতে, সে ছবির দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল।

এর আগে শাফিন তার দু-চারটা ছবি দেখেছে। সেগুলো বারান্দায় ও করিডোরে টানানো। ছবি নিয়ে শাফিনের উত্সাহ নেই। তার মা কী কথায় তাকে বলেছেন, ছবিগুলো মেহেরের আঁকা, তারপর থেকে তার উত্সাহ—তোমার ছবি?

— আমার আঁকা ছবি।

— আহা, সে তো বুঝেছি। তুমি ছবি আঁকো?

— তোমার কী মনে হয়?

— তুমি যে ছবি আঁকো, এটা আগে বলোনি কেন?

— বলিনি কেন? মেহের উলটো প্রশ্ন করেছিল। তার আগে বলো, বললে কী হতো?

— ধরে নাও, কিছুই হতো না। আমার জানা হতো।

— তাতেই বা কী হতো!

— মেহের, শোনো, কথা একটু বেশি বলছ।

— মাঝে মাঝে বেশি কথা বলতে ইচ্ছা করে।… শাফিন ভাই, তুমি ছবি বোঝো?

— নাহ।… কয়েকজন শিল্পীর নাম অবশ্য জানি।

— তাহলে দেখে কী করবে?

— আমি অনেক কিছুই বুঝি না। যা যা বুঝি না, তার সবকিছু দেখা ও শোনা তো বন্ধ নেই।

— আচ্ছা, দেখাব।

— মা বলেছে, তুমি নাকি একটা পুরস্কারও পেয়েছ।

— ও কিছু না। একটা পুরস্কার মাত্র।

— শাফিন আরো দু’বার বলার পর মেহের তাকে ছবি দেখাতে নিয়ে এসেছিল। কাউকে ছবি দেখাতে তার ভালো লাগে না। আবার লাগেও। এ বাড়ির কাউকে দেখানো মানে অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু কথা শোনা। বড় খালা তার ছবি দেখে একবার বললেন, এইটা কী! তা, সেটা যে কী, সেটা কী করে বোঝায় মেহের! যে ছবি দেখে বলে—এইটা কী—তাকে কি ছবি বোঝানো যায়! সে অবশ্য বলতে পারত—এটা কলা। এখনো পাকেনি যদিও। এরকম বলার বেশ একটা ইচ্ছাও হয়েছিল তার। তবে সে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। বড় খালাকে এরকম কিছু বললে, ঝাল যে কতরকম হতে পারে, সেটা পরে বুঝতে হবে।

যা-ই হোক, বাসায় আসলে এরকম—এ বাড়ির কেউ একজন যেচে পড়ে তার ছবি দেখতে চেয়েছে, এটা মেহেরের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ বাড়িতে তার ছবির খোঁজখবর মাঝে মাঝে নেয় তার মা। ওটাকে অবশ্য, বিবেচনা করলে, খবর নেওয়া বলে না। মেয়ে একটা কাজ করছে, তাই সেটা সম্পর্কে হঠাত্ এরকম কোনো জিজ্ঞাসা—কীরে, ছবি আঁকছিস তো, কিংবা, আজ কি কিছু এঁকেছিস, কিংবা, আঁকা মনে হয় কমিয়ে দিয়েছিস—ব্যাপারটা আসলে এরকম, এ পর্যন্ত।

লুবনা একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিল—আচ্ছা, তুমি ছবি আঁকো কেন!

— এমনি আঁকি। মেহের উত্তর দিয়েছিল।

— বোঝাই যায়। এখানে ওখানে কিছু রঙ ঢেলে দাও শুধু। এমনি এমনি না আঁকলে আর এরকম হয়। অসুবিধা নেই অবশ্য। তোমার রঙ তোমার তুলি তোমার টাকা…।

টাকার কথা অবশ্য বড় খালাও বলেছিলেন, সরাসরি—মেহের, তোর জিনিসপত্রের দাম কি সত্যিই এত বেশি!

—জি খালা, বেশি। মেহের বেশ সংকুচিতই ছিল।

— এত এত খরচ করে এসব আঁকা! খালা বলেছিলেন।… আমার কথায় আবার কিছু মনে করিস না। জানিস তো শুধু ওটাই।

— এটা ঠিক না খালা! মেহের বলেছিল। আপনি যা ভালো মনে করেন, বলতেই পারেন।

— হ্যাঁ, পরে তো আবার মুখ কালো করে থাকবি।… যত খারাপই লাগুক, একটা কথা মনে রাখিস, তোদের তো আর সেভাবে ইনকাম নেই। বাড়িটা সবার, আর বড়, তাই থাকার জায়গার অভাব নেই, কিন্তু তোদের ভাগের টাকা যে দিন দিন কমে যাচ্ছে।

এমন হতে পারে, এজন্য তার ছবি আঁকাই বন্ধ হয়ে গেল একসময়। একদিন দেখা গেল, নানা তার মেয়েদের জন্য যে টাকা রেখে গিয়েছিলেন, সে টাকায় তাদের অংশ শেষ। অন্য দুই খালার ক্ষেত্রে এমন হওয়ার আশঙ্কা নেই। বড় খালুর ব্যবসা চলছে তরতর করে, আর, মেজো খালু যদিও নেই, তার ছেলে ভ্যাঙ্কুভারে বসে টাকা কামাচ্ছে অনেক, তার একটা বড় অংশ চলে আসছে দেশে, এদিকে তাদেরটাই শুধু ফুরোচ্ছে, জমছে না। শুধু ফুরিয়েই যখন যাচ্ছে, তখন এত টাকা দিয়ে রঙ তুলি ক্যানভাস কিনবে সে! কেনেও যদি, আর, ছবি যদি এঁকেও যায়, তাতে কী আর এমন হাতিঘোড়া হবে!

ছবিটার দিকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল মেহের। লালের এমন সুন্দর ব্যবহার সে আগে কোনো ছবিতে করতে পারনি। শেষ করতে পারলে এটা একটা অন্যরকম ছবি হবে। কিন্তু এখন না, এখন এই ছবি ধরবে না সে। মেহের তবু আরেকটু সময় নিল, তারপর দু’পাশে মাথা নাড়ল—না, এখন না। ছবিটার দিক থেকে সে চোখ সরিয়ে নিল। পরে ধরবে এটা, যখন তার ইচ্ছা করবে। কিন্তু এখন সে কী করবে, সেটা সে বুঝতে পারল না। ব্যাপার না—মেহের হাসল—না বুঝেও অনেক কিছু করা যায়, করে যেতেও হয়।

শাফিন তাকে জিজ্ঞেস করল।

মেহের জানত শাফিন তাকে জিজ্ঞেস করবে। এরমধ্যে বারকয়েক এই কথাটা উঠতে উঠতেও ওঠেনি। কিন্তু কথা হয়তো কিছুটা উঠেছে, তারপর অন্য কথার চাপে সরে গেছে। তারা ছাদে উঠেছে বিকেলের দিকে। এর আগে হঠাত্ শাফিনের ডাক—মেহের মেহের… আমাদের আর্টিস্ট কোথায় গেল! শিল্পী কোথায়?

মেহের তার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল—এভাবে চিত্কার করছ কেন গলা ফাটিয়ে!

— একটা কথা বলব।

— সেজন্য চিল্লাতে হয় না।… বলো।

— চিল্লিয়ে বলব, না এমনি বলব?

— চেরা বাঁশের শব্দ শুনতে কার ভালো লাগে! এমনি বলো।

— দু’কাপ চা বানাতে হবে। রান্নাঘরে গিয়ে কাউকে বললে হবে না। তোমার নিজের হাতে বানাতে হবে। তারপর চা নিয়ে সোজা চলে যাবে ছাদে।

— কেন? ছাদ কি চা খাবে?

— না। কারণ ছাদে আমি থাকব। এই এখনই আমি ছাদে যাচ্ছি।

চা বানাতে সময় লাগবে না। লাগত, যদি লুবনা বা তিথি থাকত বাসায় কিংবা বড় খালা যদি শুনতে পেতেন শাফিনের কথা। ও রকম কিছু নেই, তাই চা বানানো হয়ে গেল সহজে। চা নিয়ে ছাদে গেল মেহের। এক কাপ শফিনের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলল—শাফিন ভাই, তুমি একটু পাগল আছ।

শাফিন হাসল—সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে!… তোমাকে চা বানাতে বললাম, কারণ চা তুমি খুব ভালো বানাও।

মেহের হেসে ফেলল।

— হাসির কী বললাম!

— যে না এক চা, তার আবার বানানো!

— না, ব্যাপার আছে, সবাই চা বানাতে পারে না।

— বেশ, ব্যাপার আছে।

— আর, চা নিয়ে তোমাকে ছাদে আসতে বললাম, কারণ ছাদে হাঁটব আর তোমার সঙ্গে গল্প করব।

— কী গল্প?

— অনেক গল্প। ধরো, এভাবে আমাদের গল্প শুরু হতে পারে—এই যে তুমি এত ছবি আঁকো, এদিকে আমি কেন ছবির কিছুই বুঝি না!

— এটার কোনো ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। এটুকু বলি—তোমারও অনেক ব্যাপার আছে, যার কিছুই আমি বুঝি না।

— আমার কী তুমি বোঝো না?

— দেখো, এখানে ‘তুমি’ বলতে ঠিক তুমিই না…।

— বুঝেছি… আসলে, ছবি আমি কেন বুঝি না—এই গল্প করার জন্য আমি তোমাকে ডাকিওনি।… একটা কথা জিজ্ঞেস করব আমি।

—জিজ্ঞাসাবাদ! মেহের চোখ বড় করে তাকাল। জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব?

শাফিন হাসল—না, গল্পও আছে।

— ঠিক আছে। শুরু হোক।

— তুমি রাগ করতে পারবে না।

— করব না। রাগ ব্যাপারটা আমার মধ্যে তেমন নেই।

— জানি।… দেখছি তো।… মেহের, তোমার বাবা, মানে খালুর ব্যাপারে…।

মেহের স্থিরচোখে শাফিনের দিকে তাকাল—এই বিকেলে আমার বাবাকে আবার ছাদে টেনে আনা কেন?

—অবশ্য তোমার ইচ্ছা না হলে বলবে না। তোমার বলার ইচ্ছা না-ই হতে পারে।… আমি কিন্তু প্রথমেই বলেই নিয়েছি, তুমি আমার ওপর রাগ করতে পারবে না।

— রাগ করব না। আমার ভেতর ইচ্ছা-অনিচ্ছাও কাজ করছে না। বলো, কী জানতে চাও?

— খালু এরকম করলেন কেন?

মেহের কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই শাফিন তাকে থামাল—আমি কি খুব সরাসরি কথাটা জিজ্ঞেস করলাম?

— না। এই প্রশ্ন ঘুরিয়ে করার মতো নয়। ঘুরিয়ে করলেও অর্থ একই দাঁড়ায়।

— আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি কথা ঘুরিয়ে বলতে শিখিনি।… হ্যাঁ, বলো, তিনি এরকম করেছিলেন কেন?

মেহের হাসল—আমি অনেককেই দেখি, আমার বাবার ওপর আমার ওপর তাদের রাগ বেশি।

— আমার রাগ না।

— এখানেও ‘তুমি’ মানে তুমিই না।

— আমার ঠিক রাগ না।… কৌতূহল।

— কৌতূহলের মধ্যে অনেক সময়ই একটা রাগ বা বিরক্তি লুকিয়ে থাকে। যে জিজ্ঞেস করে, সে হয়তো বোঝে না, কিন্তু আমি বুঝি।

— দেখো, শুধু রাগ বা বিরক্তি, কৌতূহলের মধ্যে বিস্ময় কাজ করে না?

মেহের মাথা ঝাঁকিয়ে হাসল—হ্যাঁ, তা-ও করে।… শাফিন, বাবার ওপর আমার রাগ হয় না। বাবার ওপর আমি বিরক্তও হইনা। বরং তার জন্য আমার মন খারাপ হয়। মানুষটা জীবনে একটা বড় ভুল করেছিলেন।

— কী ভুল?

— বিয়ে করেছিলেন। বিয়ে করা বাবার উচিত হয়নি। কোনো কোনো মানুষ থাকে, সংসার তার জন্য না। বাবা অমন একজন মানুষ।

— তাই বলে তোমাদের কিছু না জানিয়ে হুট করে একদিন উধাও হয়ে যাবেন! দায়িত্ব…।

— দায়িত্ব পালন করার মতো মানুষ তিনি নন। ভুলটা তার করা উচিত হয়নি, বিয়ে করার ভুল, সংসার যে তার জন্য নয়—এটা তার বিয়ের আগেই বোঝা উচিত ছিল।

— বুঝলে কোথাও কোনো সমস্যা তৈরি হতো না। কিন্তু ভুল মানুষই করে, অন্যায় যদি বলো, সেটাও।… যে সংসার করার মানুষ না, একসময় সংসার তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠতেই পারে।

— কিন্তু তার স্ত্রী… তার মেয়ে…। খালা… তুমি…।

— যে সংসার অসহ্য হয়ে উঠেছে, তারা সেই সংসারেরই অংশ, না? দেখো, আমার ধারণা, অসহ্য হয়ে উঠেছে সংসার, তার নয়।… আর, সংসার থেকে যারা যায়, তাকে এসবের কিছুই বেঁধে রাখে না।… পথে পথে ঘুরে বেড়াতেই তার আনন্দ।

শাফিন এমনভাবে তাকিয়ে থাকল, যেন সে ব্যাপারটা মেহেরের মুখ থেকে বুঝতে চাচ্ছে।

— আরো একটা ব্যাপার আছে। মেহের বলল। ধরো, সংসার বিবাগী হওয়ার ব্যাপারটা বাবার মধ্যে সংসারী হওয়ার আগে ছিল না। কিংবা ছিল, লুকানো। তিনি বুঝতে পারেননি। সংসারী হওয়ার পর, যতই দিন যেতে লাগল, ততই হয়তো একধরনের অর্থহীনতা তার মধ্যে বিশাল হয়ে উঠতে লাগল…। ভেবো না আমি বাবার দোষ ঢাকছি, আমি এরকমই ভাবি।

চায়ের কাপে রেলিং-এর ওপর নামিয়ে রাখল শাফিন। তাকে কিছুটা চিন্তিত ও অস্থির দেখাল। সে মেহেরের দিকে ফিরল না, সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকল, বলল—তোমাকে আরেকটা কথা বলব।

— বলো।… ওটাই কি আসল কথা?

— জানি না।… মেহের, এইটা একটা কথা।

— বলো।

— খালুর কথা তুলেছি হয়তো একথাটা বলার জন্যই।

— বলো।

— আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, খালুর মতো আমিও সংসারী হতে পারব না।

— মানে? মেহের স্থির চোখে তাকাল। তুমিও যাবে?

— না। আমি যাব না। আমার যাওয়ার সাহস নেই।

— তাহলে?

— আমি সংসারেই থাকব।

মেহের জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকল।

— তুমি বুদ্ধিমান, তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কী বোঝাতে চাচ্ছি?

— তুমি সংসারে থেকেও সংসারী হবে না—এরকম কিছু?

—মেহের… হ্যাঁ, এরকম কিছু।

— তোমার এরকম মনে হচ্ছে?

শাফিন মাথা ঝাঁকাল।

— কেন তোমার এরকম মনে হচ্ছে?

শাফিন বলল—বুঝে নাও।

— কী বুঝব?… কথাবার্তা পাকা হয়ে যাওয়ার পর তোমার এখন জরিনাকে পছন্দ হচ্ছে না?

মূহূর্তেই শাফিনের চেহারা বোকা বোকা হয়ে গেল—তুমি বুঝলে কী করে? এই প্রশ্ন করেই শাফিন হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেলল—আমার অবশ্য বোকা হওয়ার দরকর নেই। আমি জানতাম তুমি বললেই বুঝবে।

মেহের সামান্য হাসল—কিন্তু এখন এমন একটা অদ্ভুত কথা বললে হবে?

— তুমি এটা বুঝলে কী করে, মেহের!

— তুমিই না বললে—তুমি বললেই আমি বুঝব।

— হুঁ, বলেছি বটে।

— তোমার আরেকটু সময় নেয়া উচিত ছিল।

— বড় খালা আমার হয়ে সব কথা দিলেন যে!

— বড় খালা সংসার করবেন, না তুমি?

— না না, আমিই করব…।

— মেয়েটকে আমার কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছে।

— তো? মেয়েটার সঙ্গে সংসার কি তুমি করবে?

— নাহ, আমি কিছুুদিনের মধ্যে আমার নিজের সংসারে চলে যাব।

শাফিন বোকার মতো তাকাল—মানে?

—মানে আবার কী! এটা কি না-বোঝার কিছু?

— তোমার বিয়ে!

— শোনোনি কিছু? কেউ কিছু বলেনি?

শাফিন দু’পাশে মাথা নাড়ল।

— বড় চাচা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। ঠিক মানে, পুরো ঠিক না, প্রায় ঠিক। ছেলে মফস্বলের এক কলেজে অঙ্কের মাস্টার।

শাফিনকে বোকা বোকা দেখাল।

— মফস্বল ছোটবেলায় আমার খুব ভালো লাগত। এখনো লাগবে বলেই মনে হয়।

— কবে বিয়ে?

— তবে অঙ্ক আমার একেবারেই ভালো লাগে না।

— বিয়ে কবে?

— আমার কেন যেন মনে হচ্ছে—এই অঙ্কের মানুষটা খুব নিরস হবে। বিষয় অঙ্ক, সেজন্য নয়। অঙ্ক অনেক ইন্টারেস্টিং হতে পারে, জানি। মানুষটা নিরস হবে অঙ্কের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই। আমাকে ছবি আঁকতে দেখে বলবে—আরে, লাল নীল সুবজ হলুদ, এসব কী, বলো তো আমাকে—এসব কী!… শাফিন ভাই, তোমার কী মনে হয়? এরকম কিছু বলবে?

— জানি না। শাফিন মৃদুগলায় বলল। সে তাকিয়ে থাকল মেহেরের দিকে।

— সমস্যা হচ্ছে, ছবি না-এঁকে আমি থাকতে পারব না। এছাড়া অন্য কোনো সমস্যা নেই।

— হুঁ… আর কী সমস্যা…?

— হুঁ… শুধু ছবিটাই।

— এই ছবি ব্যাপারটা আমিও বুঝি না। শাফিন বলল। ছোটবেলায় স্কুলে ড্রয়িংক্লাসে ছবি আঁকতাম—ঘর নদী নৌকা ফসলের খেত। ঘরের পেছনেই নদী। নদীতে নৌকা। সেই নৌকা আবার সামনের ঘরের চেয়ে আকারে বড়…।

— খুবই ক্রিয়েটিভ ছিলে দেখছি! মেহেরের মুখে চাপা হাসি।

— আমার একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

— মানুষের কত কী জানতে ইচ্ছা করে…।

— আমার জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি ছবি আঁকো কেন?

— বলে লাভ নেই। ছবি যখন বোঝো না, ছবি কেন আঁকি—সেটাও বুঝবে না।

— তবু…। শুনি একটু।

— এই ধরো—ছবি আঁকতে আঁকতে একটু একটু করে নিজেকে মুক্ত করে আনি।… কিছু বুঝলে?

— নাহ।… কঠিন কথা।

— জানতাম, তোমার কাছে কঠিনই লাগবে।

— ভুল জানতে। শাফিন মুচকি হাসল। আমি বুঝেছি।… তবে কী বুঝেছি, সেটা আবার জিজ্ঞেস কোরো না।

একসময় সে টের পেল, সে গল্প যথেষ্ঠই মনোযোগের সঙ্গে পড়ছে যদিও, মাঝে মাঝেই মোবাইল ফোনের দিকেও তাকাচ্ছে। তাকানোর অবশ্য দরকার নেই, ফোন বা মেসেজ এলে শব্দ হবে। তবে মাঝে মাঝে তাকানো সে বন্ধ করতে পারছে না। সে অবশ্য মনে মনে বলছে—দরকার নেই, দরকার নেই তানজিলার আমাকে ফোন করার বা মেসেজ পাঠানোর। তবে এ-ও ঠিক, তানজিলা তাকে কিছু না জানিয়ে নিশ্চুপ—এটাও সে মেনে নিতে পারছে না।

তার অভিমান হচ্ছে। সে পড়ায় মন দিলো।

ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে, মেহেরের ধারণা ছিল না।

ছুটির সকালে ছবি আঁকা ছাড়া তার আর কীইবা করার আছে। যদিও লালের প্রাধান্য যে ছবিটায়, সেটা সে এবারও ধরেনি। সে আরম্ভ করেছে নতুন এক ছবি। রঙ বসানো ও ওঠানোর জন্য সে তুলির পাশাপাশি আরো কিছু জিনিস ব্যবহার করছিল। যেমন টিস্যু পেপার, সুতি কাপড়, স্পঞ্জ। তার ধারণা হয়েছিল, এ ছবির প্রাথমিক কাজটুকু সে সহজেই শেষ করে ফেলতে পারবে। তার আগেই তার ঘরে এলেন শাফিনের মা।

মেহের খালার দিকে তাকাল না। এ সময় খালা আসায় সে বিরক্ত। ছবিটা একটানে সম্ভব এগিয়ে নিতে না পারলে পরে অসুবিধা হতে পারে। এ সময় খালার কী এমন দরকার পড়ল! এরকম ভাবনা ভর করলে মেহের আরো অবাক হলো এই ভেবেও—খালা এর আগে কখনো এভাবে তার ঘরে ঢোকেননি।

— ছবি আঁকছিস মা? খালা জিজ্ঞেস করল।

মেহের রেগে যেতে নিয়ে হেসে ফেলল—হ্যাঁ।

— তুই বোধ হয় ব্যস্ত…।

— তুমি কিছু বলতে এসেছ?

— একটু কথা বলতে চেয়েছিলাম রে।

— বলে ফেলো।

খালা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন—অবস্থা তো ভালো না।

— খালা, অবস্থা ভালো না—কথা কি এটাই?

— শাফিন ওই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না।

মেহের ছবির দিক থেকে চোখ সরাল, তুলি নামিয়ে রাখল, খালার দিকে তাকাল—কেন?

— আমি বলতে পারব না। আমি জানি না। আমাকে খুলেমেলে কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে, ওই মেয়েকে তার পছন্দ না।

— এ সময়? বিয়ের আর কতদিন বাকি?

খালা বড় করে শ্বাস ফেলে চুপ করে থাকলেন।

— আপনি শাফিন ভাইকে বোঝান। এসময়ে এধরনের ইয়ার্কি মারার কোনো মানে হয় না।

— আমি বলেছি। কিন্তু একবার গোঁ ধরলে ও কি কোনোদিন কারো কথা শুনেছে?

মেহের সামান্য মাথা ঝাঁকাল। তাকে অন্যমনস্ক দেখাল।

— তুই কি ওকে একটু বুঝিয়ে বলবি?

মেহের হেসে ফেলল—খালা, তুমি না মাত্র বললে ও কারো কথা শোনে না।

— তোর তো অনেক বুদ্ধি। তুই একটা বুদ্ধি দিতে পারবি আমাকে?

মেহের আবারও হাসল—খালা, কে বলেছে আমার অনেক বুদ্ধি! আমার একটুও বুদ্ধি নেই।

খালা অসহায় গলায় বললেন—তাহলে আমি এখন কী করব!

প্রায় একই কথা বললেন বড় খালা। তিনি অবশ্য মেহেরের ঘরে এলেন না। তিনি মেহেরকে ডেকে নিয়ে গেলেন। ঘরে আর কেউ ছিল না। মেহের—খালা, ডেকেছেন—বলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। খালা চোখের ইঙ্গিতে তাকে বিছানায় বসতে বললেন। মেহের বিছানায় বসল না, তবে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। খালা তার দিকে তাকালেন। সে তাকানোর মধ্যে মেহেরের মনে হলো, কিছু ভর্ত্সনা আছে, কিছু তাচ্ছিল্যও আছে, কিছু বিদ্রূপও আছে। মেহের, ভুলটা সে কোথায় করেছে, বুঝতে পারল না। সে বুঝতে পারল—এই এখনই তাকে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

খালা বললেন—তুইই বল, আমি এখন কী করব?

এটুকুতে পরিষ্কার করে কিছুই বোঝা যায় না, বরং জটিলতা বাড়ে। মেহের পরবর্তী কথা শোনার অপেক্ষায় থাকল।

— তুই এই কাজটা কেন করতে গেলি?

মেহের প্রথমে ভাবার চেষ্টা করল সে কী করেছে। ভেবে যখন কিছুই বুঝতে পারল না, জিজ্ঞেস করল—খালা, আমি কী করেছি?

— কী করেছিস!.. কেন, তুই জানিস না শাফিন এখন ওই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না?

— শুনেছি। সেজো খালা আমাকে বলেছেন।

— শুনে কি বেশ খুশি হয়েছিস?

মেহের অবাক চোখে তাকাল। কী উত্তর দেবে, বুঝতে পারল না।

— নাকি তুই আগে থেকেই জানতিস?

— খালা। মেহের মৃদু গলায় বলল, আমি এসব কী করে জানব!

— হ্যাঁ তা বটে, তুই এসব কী করে জানবি!

মেহের চুপ করে থাকল।

— শাফিনের দুই গালে দুইটা চড় বসাতে পারলে শান্তি পেতাম। এসব কি ইয়ার্কি নাকি?

— আপনি বোঝান তাকে। আপনার কথা শাফিন ভাই শুনবে।

খালা কঠিন চোখে তাকালেন—ও কী শুনবে কী শুনবে না, তা আমি জানি।

মেহেরের কিছু বলার ইচ্ছা হলো না।

— সব দোষ আমি ওকে দিচ্ছি না। খালা মেহেরের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে বললেন। বলতে বলতে তার মুখ কঠিন হয়ে গেল—কিন্তু তুই কেন ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খেলি, বলবি?

— আমি! মেহেরের মুখ হাঁ হয়ে গেল। সে টের পেল। কিন্তু সে মুখ বন্ধ করতে পারল না।

—চিবানোর জন্য আর কোনো মাথা খুঁজে পেলি না?

— খালা, আপনি এসব কী বলছেন!

— কী বলেছি শুনতেই পেয়েছিস । ঠিক বলেছি।

— আমি শাফিন ভাইয়ের মাথা চিবিয়ে খেয়েছি?

— তুই চিবিয়ে খেয়েছিস।

মেহের টের পেল তার কান্না পাচ্ছে। তার সহজে কান্না পায় না। কিন্তু এখন তার কান্না পাচ্ছে। কান্না লুকানোর জন্য সে হেসে ফেলল।

— হাসবি না। খবরদার, হাসবি না।

— আপনি এমন একটা কথা বলেছেন…।

— এমন একটা কাথা মানে! তুই কি ভেবেছিস আমি কিছু বুঝি না?

মেহের কান্না চাপল—খালা, আপনি কিছুই বোঝেন না।

খালার মুখে হাসি দেখা গেল। তিনি আপাদমস্তক মেহেরকে দেখলেন। বললেন—তাহলে তুই বলছিস আমি কিছুই বুঝি না?

মেহের চুপ করে থাকল।

— ছবি দেখানোর নামে করে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া, ছাদে গিয়ে আর নামার নাম না করা, বারান্দায় এসে ফিসফাস…।

— খালা…!

— এসব কিছুই না, না? এসব তো আমার বোঝার কথা না, না?

গভীর হতাশায় দু’পাশে মাথা নাড়ল মেহের। কিছু বলল না সে, চুপ করে থাকল।

খালা ধমকে উঠলেন—এখন চুপ করে থাকলে হবে।

— কী বলব!

— তুই নিজে কোথায় আছিস, সেটা বুঝিস না?

— বুঝি।

— বুঝিস?

— আমার চেয়ে ভালো সেটা কেউ বোঝে না।

— তাহলে বামন হয়ে চাঁদের দিকে কেন হাত বাড়াস?

কান্নাটুকু সামলে নিয়েছে মেহের। সে খালার দিকে তাকাল। গোছানো, শান্ত গলায় বলল—আমি খুব ভালো করেই জানি আমি কোনোদিকে হাত বাড়াইনি। আমাকে আপনার এতসব বলার দরকার নেই।

গল্পের এ পর্যন্ত এসছে সে, তার মোবাইল ফোন বাজতে আরম্ভ করল। সে খুবই বিরক্ত বোধ করল। এখন কারো সঙ্গে কথা বলতে তার ইচ্ছা করছে না। এমন না, এই গল্পে সে মোহিত হয়ে আছে, কিন্তু গল্পে কী হয়েছিল মেহেরের, মনে নেই, মনেও পড়ছে না। জানতে ইচ্ছা করছে তার। সে পাশে রাখা ফোন একবার তুলে দেখল। আচেনা নাম্বার। অচেনা নাম্বারের সুবিধা অসুবিধা দুটোই আছে। অসুবিধা হলো—অনেকে সময় নাছোড়বান্দা ভক্ত হয়, সে সকালে শেভ করেছে কি না, এটাও জিজ্ঞেস করে বসে, কখনো হয় অপছন্দের প্রকাশ করা, কখনো অন্য নাম্বার থেকে ফোন করা সাহিত্য সম্পাদকরা। আবার, সে দেখেছে—অনেক সময় অচেনা নাম্বার থেকে জরুরি ফোন আসে। এ ফোনটা সেরকম হতে পারে। আবার, চকিতে তার এমনও মনে পড়ল—ফোনটা আবার তানজিলার হতে পারে। সে এবার মজা করার জন্য অচেনা নাম্বার থেকে ফোন করেছে। বেশ, দেখা যাক কী মজা করে। সে কল রিসিভ করল—হ্যালো।

ওপাশে নারীকণ্ঠ বলল—অনেকক্ষণ ধরে ভাবছি ফোন করব…।

— তানজিলা? গলার স্বর বদলিয়েই সে চুপ করে থাকল।

— কিন্তু সাহস পাচ্ছি না, বিরক্ত হন কি না…।

— না, বলুন আপনি।… একটু তাড়াতাড়ি।

— স্যার, আপানি কি এখন তানজিলাকে নিয়ে গল্পটা লিখছেন?

— তানজিলাকে নিয়ে গল্প!… ওহ, আপনি।

— জি স্যার, আমি মেহের।… স্যার, ঐ গল্পটা কি আপনি পেয়েছেন?

— পেয়েছি। পড়ছি।

— এখন পড়ছেন, স্যার?

— হ্যাঁ, এই তো, লেখাটা হাতেই।

— কোন পর্যন্ত এসেছেন, স্যার?

— ওই যে, বড় খালা মেহেরকে বললেন—বামন হয়ে কেন চাঁদের দিকে হাত বাড়াস।…

— লেখকরা বড় নিষ্ঠুর হয়।

— কেন! সে হঠাত্ই একটু বিরক্ত বোধ করল।

— অমন একটা কথা আপনি বড় খালাকে দিয়ে আমাকে শুনিয়েছিলেন।

— পরিস্থিতি ও বড়খালার চরিত্রবিচারে ও কথাটা বড়খালার মুখে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল, না বেমানান?

— বেমানান না, স্যার। বড় খালার তখন অমন কথাই বলার কথা।

— তাহলে আর, লেখাকরা নিষ্ঠুর—এ কথা বলছেন কেন!

— এমনি স্যার, এমনি বলে ফেলছি।… আমি হয়তো খুব ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে গিয়ে, মানে ঠিক ওই ঘটনার কথা মনে পড়ল, তার আবেগতাড়িত হয়ে গেলাম।

— হুমম। তবে ওই কথাই—লেখকরা বোকা না, তারা সেরকম হওয়া দরকার, সেরকম।

— জি, স্যার… তবে, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, লেখকরা সবসময় বুদ্ধিমান না, লেখকরা মাঝে মাঝে বেশ বোকা।

— লেখকরা বোকা!

— এটা অবশ্য স্যার, কোনো লেখকই স্বীকার করবেন না।

— একটা অযৌক্তিক, অবাস্তব কথা কেন স্বীকার করবে!

— হয়তো… হয়তো স্যার লেখকরা বুদ্ধিমান… ধরে নিই বেশ বুদ্ধিমান। কিন্তু আপনি এটা কি মানবেন, লেখকদের দেখার পরও আরো কিছু থাকে?

একটু ভাবল সে—এটা হয়তো মানা যায়।

— এ বিষয়ে স্যার, আমি আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব।

— এ বিয়য়ে আরো কথা বলতে হবে?

— আপনার ফোন নাম্বার যখন নিতে পেরেছি, মাঝে মাঝে ফোন তো করবই।… বেশি করব না। আপনি খুব বিরক্ত হবেন, এতটা না।… আপনি কি ফোন বন্ধ রাখেন?

— না, সে বলল। তার মনে হলো মাঝে মাঝে ফোন বন্ধ রাখা উচিত।

— একটা কথা। আমি যেভাবে কথা বলছি, তার সঙ্গে গল্পের মেহেরের কথা বলার ধরন মিলছে না। তা-ই না?

— গল্পের মেহের একটু অন্যরকম তো বটেই। নরম, লাজুক, চাপা।

— আমি ওরকমই ছিলাম স্যার, মানে যে পর্যন্ত আপনি লিখেছিলেন, সে পর্যন্ত আমি ওরকমই ছিলাম। তারপর…। স্যার, একথাটা অন্যদিন বলব।… এখন অন্যরকম কথা বলি স্যার। এই যে আপনি গল্পটা পড়ছেন, মেহেরের জন্য কি আপনার খারাপ লাগছে?

— কিছুটা।… কিংবা হয়তো লাগছে না।… আসলে আাামার এখানে কী করার আছে…!

— কিন্তু স্যার, আমার ওই সময়ের কথা যখন ভাবছি, খারাপ লাগছে, নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে।

— ওই সময় আমি খুব চাপের মধ্যে থাকতাম… মানে, আপনি রাখতেন।

— আমি? সে হাসল। আমি কি রাখি?

— আপনি যেভাবে লিখতেন, মানে, যা লিখতেন… ওটাই রাখা।

— বেশ।… এখন গল্পটা পড়ে শেষ করি?

— জি স্যার, পড়ুন। আমি কাল ফোন করব।… স্যার, একটা কথা।…

— হ্যাঁ।

— তানজিলা কে স্যার?

— কেউ না।

— কেউ তো বটেই।

— সত্যিই কেউ না।

— ঠিক আছে। পড়ুন স্যার। কাল কথা হবে।

সে ফোন একপাশে রেখে গল্পে চোখ নামাল। তখন কফি খেয়ে ভালো লাগেনি তার। এখন চা খেতে ইচ্ছা করছে। কে বানাবে? বললে সায়রা ঠিকই বানিয়ে দেবে। কিন্তু তার বলতে ইচ্ছা করল না। সে পড়তে আরম্ভ করল।

এমন একটা প্রশ্নের উত্তর এমন হতে পারে, মেহেরের এতটুকু ধারণা ছিল না। তার অনুমানশক্তি ভালো। প্রশ্ন-উত্তর পর্বেও সে সহজে হেরে যাওয়ার নয়। কিন্তু শাফিনের এমন উত্তর তার আন্দাজের মধ্যেও ছিল না।

সে শাফিনের দিকে তাকাল। বিকালের শেষ আলোর কিছুটা এসে পড়েছে শাফিনের মুখের ওপর। শাফিনের মুখে মৃদু হাসি। বিকেলের আলো আর তার হাসি—এই দুই মিলে মনে হচ্ছে সে খুব কাছের, আবার খুব দূরেরও। মেহের একটু যেন থমকে গেল। তার মনে হলো—আচ্ছা, ব্যাপারটা কি এরকম। আমি শাফিনের কাছ থেকে এমন উত্তরই চাচ্ছিলাম।

তারা ছাদে এসেছে বিকেলে। মেজো খালা বলেছেন—মা, তুই পারবি। তুই ওকে একটু বোঝা। আর, মেহেরের মা বলেছেন—এসব কীরে মেহের, এসব কী শুনি! শাফিন এমন কেন করছে! তোর বড় ভাই ও…। মেহের বলেছে—আমি দেখব, মা।

যদিও কী দেখবে সে, তার নিজেরই ঠিকঠাক জানা নেই। তার নিজের অজান্তেই সে যখন জড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু কিছু তো তাকে দেখতেই হয়। সেজন্যই শাফিন যখন ছাদে যাওয়ার কথা বলল, সে রাজি হয়ে গেল, ও ছাদে এসে একটু পর যখন ওই কথা উঠল, মেহের বলল—তুমি যে এই বিয়েতে এখন রাজি হচ্ছে না, তুমি কি জানো, বড় খালা আমাকে কী বলেছেন!

— সম্ভবত এরকম কিছু বলেছেন—তুমি যেন আমাকে ভালো করে বোঝাও।

— এটাও বলেছেন বইকি, তবে এটা তিনি বলতেই পারেন। যেটা পারেন না, সেটাও বলেছেন।

— কী সেটা?

— বলেছেন, আমি তোমার মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছি।

— খালা কেন এটা বলতে পারেন না?

— কেন বলবেন! কী আশ্চর্য!

— খালা ভুল কিছু বলেছেন বলে আমার মনে হচ্ছে না।

— মানে! কী বলো এসব!

— কথা সত্যি। তুমি সত্যিই আমার মাথা চিবিয়ে খেয়েছ।

মেহের তাকাল শাফিনের দিকে। শাফিনের মুখে তখনো রোদ ও হাসি মিলেমিশে খেলা করছে। মেহেরের প্রথম মনে হলো, এমন উত্তর সে কখনো আশা করেনি। একটু পর সে অবশ্য অন্যরকম ভাবতে আরম্ভ করল। তার মনে হলো, আসলে এরকম কিছুই সে শুনতে চেয়েছিল। সে হাসল, তারপর বড় করে শ্বাস ফেলে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে-নাড়তে বলল, শাফিন ভাই, তুমি কিছু ইয়ার্কি মারতে পারোও বটে।

শাফিন শান্ত গলায় জবাব দিল—এটা ইয়ার্কি না।

— তা-ই? এটা ইয়ার্কি না?

শাফিনের মুখে একটা হাসি হাসি ছাপ ছিল, সেটা মিলিয়ে গেল। সে বলল—তোমাকে কে বলেছে, এটা ইয়ার্কি!

— সবাই বলেছে। যারা নতুন করে শুনবে, তারাও বলবে।

— আশ্চর্য! কথাটা বলেছি আমি, আমি জানি না আমি কী বলেছি!

— দেখো… বড়খালা আমাকে আর কী বলেছেন, জানো?

— জানি না। … তুমি এত বড়খালা বড়খালা করো কেন!

— বড়খালা বলেছেন, বামন হয়ে যেন চাঁদের দিকে হাত না বাড়াই।

— কে বামন কে চাঁদ—বড়খালা সব জেনে বসে আছেন!

— শোনো শাফিন ভাই, মা আর মেজোখালাও খুব করে বলেছেন—আমি যেন তোমাকে বোঝাই। যেন হঠাত্ করে আরম্ভ করা তোমার এই পাগলামো তুমি বন্ধ করে দাও।… বুঝতেই পারছ, আমি এখন তোমাকে বোঝাব।

— তার আগে আমার কিছু কথা আছে।

— কী কথা? তুমি জারিনাকে বিয়ে করতে রাজি আছ? নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ?

— আমাকে আমার কথাগুলো বলতে দাও।

— আগে আমি তোমাকে বুঝিয়ে নিই, তারপর বলো।

— না, আগে আমার কথা শুনতে হবে।

— ঠিক আছে, বলো।

— তোমার কি সত্যিই ঐ অঙ্কের মাস্টারের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে?

— অনেকটাই।

— কিন্তু তিনি ছবির কিছুই বুঝবেন না, তুমিই বলেছ।

— তো?

— তুমি বলোনি?

— বলেছি। কিন্তু উলটোটাও হতে পারে। হয়তো আমার আঁকা ছবি দেখে সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাবে। বলবে—কী সুন্দর, মেহের, কী সুন্দর! হয়তো আমাকে বলবে—শোনো, সামনে জ্যোত্স্না। জ্যোত্স্নায় তুমি পুকুরপাড়ে বসে ছবি আঁকবে, আমি পাশে বসে দেখব।… জীবনে রহস্যের শেষ নেই। এরকম ভাবতে দোষ নেই।

— দোষ আছে। শাফিনের গলা কঠিন শোনাল। কারণ, সে সত্যিই ছবি বুঝবে না।

— সেটা তুমি কী করে জানো?

— আমি জানি। শাফিনের গলা একইসঙ্গে কঠিন ও শীতল।

মেহের হাসল—ভালো।

— তোমাকে একটা কথা বলব আমি।… এখন বলব?

— এখনই বলো।

— এটা অন্য কথাও। এটা তোমাকে আমার বলতেই হবে। তুমি শুনবে না?

— শুনব। বলো।

— তুমি কি আমাকে পছন্দ করো?

— করি।

— কতটা?

— অনেক।

— এখন তোমাকে আরেকটা প্রশ্ন করব।… করব?

— করো। আমি অবশ্য আন্দাজ করতে পারছি তুমি কী প্রশ্ন করবে।

— তুমি আমাকে বিয়ে করবে?

— না।

মেহের ভেবেছিল রাতটা সে পার করে দেবে ছবি এঁকে এঁকে। ছবি সে আঁকতেও আরম্ভ করেছিল। কিন্তু সে দেখল, কোনো ছবিই তার এগোচ্ছে না। বরং কিছু হ্যান্ডমেড পেপার নষ্ট হলো তার, কিছু ক্যানভাস। অসমাপ্ত ছবির দু-তিনটাও যেরকম হওয়ার কথা ছিল, সেরকম না হয়ে অন্যরকম হয়ে গেল। মেহের তখন ছবি ছেড়ে উঠল।

সে ছবি ছেড়ে উঠল বটে, কিন্তু কিছু করারও নেই তার। আজ, যত চেষ্টাই করুক, তার ঘুম হবে না, সে জানে। ঘুম যখন হবে না, বিছানায় যেতে তার ইচ্ছা করল না। তাহলে কী করবে? পর্দা একটু সরিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে? কিন্তু জানালার বাইরে সামনের বাড়ির কিছু অংশ ছাড়া আর কিছুই নেই দেখার। হাঁটবে তাহলে, সারা ঘরে, ঘুরে ঘুরে? নাকি ছাদে যাবে?

ছাদে গেলে সমস্যা আছে। আছে, বা হতে পারে। দেখা গেল শাফিনও হাঁটছে ছাদে। তাকে দেখে ছুটে এসে বলল—আমার মন বলছিল তুমি আসবে। কিংবা, সে যাবে ছাদে, দেখবে, কেউ নেই, কিন্তু একটু পর উঠে আসবে ছাদে—আমি জানতাম।

তাহলে কি ছাদেই যাবে সে?… মেহের দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না, সে ছাদে যাবে না। এখন, সে বরং অন্য একটা কাজ করতে পারে। শাফিনকে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। সেই উত্তর সে এখন ঠিক করতে পারে।

শাফিন জিজ্ঞেস করেছিল—কেন?

সে বলেছিল—এ হয় না।

— কেন হয় না! শাফিন চেঁচিয়ে উঠেছিল। তুমিই বললে তুমি আমাকে পছন্দ করো।

— করি। তো? বিয়ে করতে হবে?

— হ্যাঁ হবে।

মেহের হেসেছিল—যা হয় না, যা হওয়ার নয়, যে প্রশ্নের উত্তর ‘না’ হিসেবেই নির্ধারিত হয়ে আছে, আমি সে প্রশ্নের উত্তরে কী করে ‘হ্যাঁ’ বলব?

— আশ্চর্য!

— এখানে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সবাইকে সবার অবস্থানটা বুঝতে হয়।

শাফিন রেগে গিয়েছিল—তাহলে কেন, কেন তুমি আমাকে কথাটা বলতে দিয়েছিলে?

এই প্রশ্নের উত্তরটা দেওয়া হয়নি—কেন সে শাফিনকে কথাটা বলতে দিলো।

শাফিন বারবার চেঁচাচ্ছিল—বলো বলো বলো, বলো তুমি।

— কী বলব?

— কী বলবে মানে! শাফিন আরো রেগে গিয়েছিল। তুমিই-না বললে আমি কী বলব, সেটা তুমি আন্দাজ করতে পারছ।

— বলেছি।… ভুল বলিনি। আন্দাজ করতে পারছিলাম।

— উত্তর যদি তোমার ‘না’ই হবে, তবে তুমি কেন আমার কথাটা শুনলে! কেন তুমি আমি বলার আগেই বললে না, তুমি কথাটা শুনতে চাও না?

শাফিনের এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়নি।

দেওয়া যায়। এখন এই প্রশ্নের উত্তর মেহেরের কাছে আছে। আগে অস্পষ্ট ছিল উত্তরটা, একটু একটু করে সেটা এখন অনেক স্পষ্ট।

নাকি, কে জানে, স্পষ্ট হয়ে অনেক আগেই ছিল, সে স্বীকার করেনি?

সে যা-ই হোক, শাফিন যদি তাকে জিজ্ঞেস করে আবার, কিংবা জিজ্ঞেস না-ই করুক শাফিন, সে নিজেই বলতে পারে শাফিনকে—বলব? কেন আমি তোমাকে কথাটা বলতে বাধা দেইনি?

শাফিন হয়তো অবাক হয়ে যাবে—বলবে? কিংবা সে হয়তো অবাক হবে না, তবে কৌতূহলী হবে অবশ্যই—উত্তরটা আছে তোমার কাছে?

— আছে। তুমি শুনতে চাইলে বলতে পারি।

— বলো।

সে তখন মৃদুগলায়, শোনা যায় কি যায় না, এমনভাবে বলবে—শাফিন ভাই, আমার যে তোমার মুখ থেকে শুনতে বড় ইচ্ছা করছিল।

— স্যার, শেষটা নিশ্চয় আরে নানারকম হতে পারত? মেহের এই কথা জিজ্ঞেস করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

সে নিজের আগ্রহ থেকে আজ মেহেরের সঙ্গে দেখা করেছে। গতরাতে গল্পটা শেষ করার পরই তার মেহেরকে ফোন করার ইচ্ছা হয়েছিল, ঠিক নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে নয়, এমনিই তার কথা বলতে ইচ্ছা করছিল—মেহের, গল্পটার কথা আমি আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম।… এইমাত্র শেষ করলাম।

— বেশ আগের গল্প কিন্তু, স্যার।

— হ্যাঁ, তা-ই তো দেখছি।

— কেমন লাগল আপনার?

— নিজের লেখা খারাপ বলতে ইচ্ছা করে না।… তবে অবশ্যই গল্পটা এমন কিছু নয়, তবে, আবার, ফেলে দেওয়াও যায় না।

— কিন্তু যাদের নিয়ে লেখা, তাদের জন্য ইমপর্ট্যান্ট। তা-ই না, স্যার?

— হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই।

— মানুষের জীবনে এরকম অনেক গল্প…।

— হ্যাঁ, অনেক। কতরকম…।

— লেখকদের একটা বড় সুবিধা কি জানেন?

— লেখকদের আসলে বিশেষ কোনো সুবিধা নেই।

— আছে। তারা যেখান থেকে ইচ্ছা গল্প শুরু করতে পারেন, আবার যেখানে ইচ্ছা শেষ করে দিতে পারেন। পাঠককে শুধু এই ভাবনাটা দিতে হয়—হ্যাঁ, এখানে বা এভাবে শেষ হতেই পারে। পাঠক মেনে নেয়। ভাবে—হ্যাঁ, এই তো, এরকমই।

— অসুবিধা কী?

— তারপর লেখকের আর কোনো দায় নেই। এই হলো অসুবিধা।

কাল রাতে গল্পটা শেষ করার পর যা হয়েছে, মেহেরের সঙ্গে সেই বিকেলে দেখা।

হয়েছিল বলেই ভাবনাটা মাথায় এসেছে, এটা বোঝাই যায়, তার মনে হলো—আচ্ছা, শেষ হলো এক জায়গায়, গল্প এভাবেই শেষ হয়, কিন্তু তারপর কী হলো? কী খবর এখন মেহেরর? কাল রাতে ফোন করার ইচ্ছাটা আসলে এ কারণেই হয়েছিল। তবে সে নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছিল। নিজের চরিত্রকে লেখক তার উতলা হওয়া বুঝতে দিতে পারে না।

তার ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে পড়ার অভ্যাস। ঘুমোতে-ঘুমোতে রাত একটা-দেড়টার মতো হয়ে যায়, উঠতে উঠতে সাড়ে পাঁচ-ছয়। আরো কিছুক্ষণ ঘুম দরকার, ইদানীং সে বুঝতে পারছে—হ্যাঁ, কিছু বয়স তো হলো।

সে ঘুম থেকে ওঠার কিছুক্ষণ পর এক মগ কালো কফি হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। কখনো বসে, কখনো ছোট বারান্দায় কফিতে চুমুক দিতে দিতে এদিক-ওদিক করে। আজও ওরকম। বসল কিছুক্ষণ, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। সকালে তার মেহেরের কথা যত না মনে পড়ল, তার চেয়ে বেশি মনে হলো তানজিলার কথা।

রাতে তানজিলাকে সে ফোন করেছিল। সে আর সায়রা টিভি দেখছিল। সাউন্ডটা কমিয়ে দাও—বলে সায়রা ঘুমিয়ে পড়ল, আর, সে টিভি দেখে গেল ও মাঝে মাঝে ফোন করল তানজিলাকে। সে বুঝতে পারছিল, তানজিলার ফোন সে আজই পাবে। কিন্তু তার হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করছিল না। তাছাড়া, এরকমও তার মনে হচ্ছিল—হঠাত্ দেখা যাবে তানজিলার ফোন খোলা। তার ফোন চলে যাবে তানজিলার ফোনে, সে বলবে—এসবের মানে কী! বলো আমাকে, এসবের মানে কী!

— ওহ, তুমি! আমি ভাবলাম এত রাতে কে না কে!

— অন্য কাউকে আশা করছিলে?

— অন্য কাকে আশা করব!

— সে তুমি জানো।

— আজেবাজে ছাড়া তোমার আর কোনো কথা নেই?

— আছে। একটাই।… কাল আসোনি কেন?

— এমন কি হতে পারে না, খুব বড় ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলাম?

— তানজিলা, সেটাই আমি জানতে চাচ্ছি।

— বলব।… আমি কি তোমাকে সব বলি না?

— বলো! তুমি কি সব বলো?

— তুমিই বরং বলো না। আমি আশা করেছিলাম, তোমার সবকিছু বলবে আমাকে।

— বলি।… বলতে চাই।… তানজিলা, আমি আসলেই বলতে চাই।

— বলবে। আমি আছি শোনার জন্য।

— হুঁ। … কাল আসোনি কেন?

— তোমার কি আর কোনো কথা নেই?

— আছে। তবে এটাও আমার জানা দরকার কাল কেন আসোনি।

— কাল যাইনি বলে কখনো যাব না, কথা নিশ্চয় এমন নয়।

— কী কথার কী উত্তর! কাল কেন আসোনি, এটুকু বলো।

— বলব।… খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে।

— সে তুমি জানো।… আমি অপেক্ষা করতে করতে…!

— মানুষটার অভিমান হলো বুঝি!

— অভিমান হলে খুব কি অন্যায় হয়ে যাবে?

— শেনো, তোমার সবুজ রঙ পছন্দ?

— খুব।

— জানি। আমি সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরব। কপালে সবুজ টিপ। লিপস্টিক দেবো না। কাচের চুড়ি থাকবে হাতে, পায়ে পাতলা স্যান্ডেল, কানে লম্বাটে দুল—আমি এভাবে যাব তোমার কাছে।

— সত্যি? বলো, কবে?

— আমি তোমার হাত ধরব, তুমিও আমার হাত ধরবে। আমরা দুজন দুজনের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে যাব।

— তানজিলা, আমি আজ অপেক্ষা করে ছিলাম,… আমি অপেক্ষা করে থাকি…। তুমি বোঝো না?

— আমি আরেকদিন তোমার কাছে যাব জিন্সের প্যান্ট আর ফতুয়া পরে। ওভাবেও আমাকে দারুণ লাগে, জানো? সেদিন তোমাকে একটু কামড়াব।

— কামড়াবে?

— হ্যাঁ। কারণ, আমাদের মধ্যে এমন কথা প্রচলিত আছে জিন্স-ফতুয়া পরা মেয়েরা একটু অ্যাগ্রেসিভ হয়।… তবে আলতো করে কামড়াব।… তুমি জোরে বললে জোরে।

— আমি বুঝি ছেড়ে দেবো?

— দিও না।… ঘুমাও এখন, রাত হয়েছে। আমাদের কথা বলার জন্য বহুবহু দিন পড়ে আছে।

মেহেরের সঙ্গে তার কথা হলো সকালে। সে কফির মগ হাতে বারান্দায় এসে বসেছে। নতুন একটা গল্প তার মাথায় ঘুরতে আরম্ভ করেছে। এ সময় মেহেরের ফোন। নতুন গল্প নিয়ে ভাবার সময় কারো ফোন এলে সে খুব বিরক্ত হয়। মেহেরের ফোন তাকে বিরক্ত করল না, সে বলল—আমি জানতাম তুমি ফোন করবে।

— এটা স্যার, জানা খুব সহজ।… এখন লিখতে বসবেন?

— না। কিছুটা সময় আছে হাতে।

— আমার কথাও বেশি না, স্যার।… আসলে আপনাকে আমার কিছু কথা বলার আছে।

— এখন নিশ্চয় বলবে না?

— এখন না, স্যার, এখন না।… মুখোমুখি বলব। কিছু সময় দেবেন?

— হ্যাঁ, দেবো। কখন?

— বিকেলে, স্যার। ওই জায়গায়ই পাঁচটার দিকে?

সে রাজি হয়ে গেল। ফোন ছাড়ার পর সে একটা ব্যাপার অবাক হয়ে ভাবল—মেহের একবার বলতেই সে রাজি হয়ে গেল, অথচ, তানজিলা যখন আজিজে দেখা করতে চেয়েছিল, সে ইতস্তত ও বিব্রতবোধ করছিল, মেহেরের সঙ্গে ওখানে দেখা করতে তার ওসব কিছুই হচ্ছে না।

বিকেলে যখন দেখা হলো মেহেরের সঙ্গে, চারপাশে আরো অনেক লোক, তাদের অনেকেই তার চেনা, কিন্তু সে সহজ থাকল। মেহের যখন ভিড় কাটিয়ে তার সামনে এসে থামল, হাসল, সে-ও হাসল—তুমি সেই আগের মতোই স্নিগ্ধ।

— কিন্তু আপনি আমার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। আমাকে চিনতেই পারছিলেন না।

— আমি গতরাতে তারিখটা দেখলাম। গল্পটা বেশ আগের।

— তা ঠিক। সময় কম পার হয়নি। তবু আমার কী মনে হতো, জানেন? মনে হতো আপনি আমাকে দেখলেই চিনতে পারবেন।

— তোমাকে কিন্তু আমার চেনা চেনা লাগছিল।

— আমার ধারণা, আপনি আমাকে অন্য কেউ ভেবেছিলেন।

সে একটু হাসল।

— তার কথা আমাকে বলবেন?

— তার কথা পড়ে। তোমার কথা শুনি।

— স্যার, খেয়াল করেছেন, আমি লাল শাড়ি পরেছি…।

— হুমম।… তোমার একটা ছবিতে লালের প্রাধান্য ছিল।

— সেজন্যই।… বসি কোথাও?

— হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো।

— একটা কথা, স্যার।… আপনার হাতটা একটু ধরব।… মানে আপনার হাত ধরে হেঁটে যাব।

— ধরো। সে হাত কিছুটা বাড়িয়ে দিলো। মেহের হাত বাড়িয়েই রেখেছিল। তারা এগোতে আরম্ভ করল।

সে ভেবেছিল, একটু অস্বস্তি তার লাগতেও পারে। তেমন কিছু হলো না। যেন মেহেরের হাত ধরে এভাবে হেঁটে যাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই।

কিছু নেই?… কিছু দূর এগিয়েই তার ভয় করতে শুরু করল। সে তানজিলার কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। এখন তার মনে পড়ছে, এখন সে ভয় পাচ্ছে। এখন যদি তানজিলা তাকে দেখে, সে থাকতেই পারে এখানে, আর, তাকে দেখতেও পারে, কী হবে!

— একটা সত্যি কথা বলবে তুমি? প্লিজ, শুধু একটা সত্যি কথা।

— বলব না কেন! তোমাকে না বলার কিছু নেই আমার।

— মেয়েটা কে ছিল?

— কোন মেয়ে?

— ভুলে গেছ? এখন কিছুই মনে পড়ছে না!

— বুঝেছি। মেহের। তুমি মেহেরের কথা বলছ।

— তুমি মেহের বললে, আর আমি চিনে গেলাম!

— ওকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম। লিখেছিলাম মানে, ও ছিল ওই গল্পে।

— গল্পে ছিল, শুধু এটুকুতেই হতো! হাত ধরা!

— না, না, মানে ও নায়িকা হিসেবেই ছিল।

— গল্পের নায়িকা। তোমার না।

— আহা, হাত ধরা এমন কী ব্যাপার! সহজভাবে নিলেই হয়।

— সম্ভব না।… আমার মনোভাব পরিষ্কারভাবে জানিয়ে রাখতে চাই।

— তুমি একটু বেশি রিঅ্যাক্ট করছ…।

— চুপ। একদম চুপ। আর কোনোদিন যদি দেখি তুমি কোনো মেয়ের হাত ধরেছ, তাহলে আমি কী করব, তুমি তার কিছুই জানো না।

— আমি কি মেয়েদের হাত ধরেই থাকি? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে মেয়েদের হাত ধরাই আমার পেশা।

— আমি ছাড়া আর কারো হাত তুমি ধরবে না। ভুলেও না।… ধরলে আমি থাকব না।

— কোথায় যাবে?

— তোমার কাছে থাকব না, এটাই কথা।

— তুমি আমাকে ছেড়ে থামতে পারবে?

— হাহ্!

মেহের তাকে বলল—স্যার, শেষটা নিশ্চয় আরো নানারকম হতে পারত।

সে মাথা ঝাঁকাল—অন্যরকম হওয়ার একটা ব্যাপার সবসময়ই থেকে যায়।

— কিন্তু তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যায় অন্য গল্প। তা-ই না, স্যার?

— হ্যাঁ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা নতুন গল্প।… তুমি দেখি অনেক বোঝো!

মেহের একটুক্ষণ চুপ করে থাকল—না, এটা ঠিক কথা না। আমি অনেক বুঝি না। যদিও আমার নিজেরও একসময় তেমনই ধারণা ছিল। কিন্তু পরে দেখেছি আমার ধারণা ভুল।

মেহেরের কথা কানে বাজল তার। সে মেহেরের মুখের দিকে তাকাল, তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। সে বলল—এভাবে বলছ!… কী হয়েছে?

— আছে স্যার।… বলব আপনাকে।… আচ্ছা স্যার, এমন কি হতে পারত, আমি গল্পটার কথা বলছি—ওখানে আমার বিয়ে প্রায় ঠিক, কিন্তু এমন কি হতে পারত—আমার বিয়ে পুরোই ঠিক ওই অঙ্কের মাস্টারের সঙ্গে।

— সে সামান্য মাথা ঝাঁকাল, মৃদু হাসল—তারপর?

— আর সবকিছু ঠিক থাকবে।

— বেশ। তারপর?

— তারপর শাফিন আমাকে তার দুর্বলতার কথা বলবে।… আপনি এভাবে লিখতে পারতেন।

— সেটা অন্য গল্প হতো। আর, এখন, আমি কীভাবে পারতাম সেটা কথা না। তুমি কী বলতে চাও, সেটাই কথা।

— আমি, যা বলতে চাই। মেহেরকে ভাবতে হলো না। আমি চাই শাফিন দুর্বল হলো ও একপর্যায়ে এসে আমাকে গভীর ক্রোধ ও ক্ষোভের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল—তুমি জানো! তুমি জানো এ বিয়েতে তুমি সুখী হবে না, তাও, তাও কেন তুমি এ বিয়েতে রাজি হয়েছিলে?

— আচ্ছা! সে দেখল সে বেশ কৌতূহল বোধ করছে। তারপর?

— আমাকে তখন একটা উত্তর দিতে হতো। হতো না?

— হতো। গল্প শেষ করতে হবে। অবশ্য উত্তর না দিয়েও গল্প শেষ করা যায়।

— যায় হয়তো। কিন্তু আমি উত্তর দিতে চাই।

— তোমার উত্তর তাহলে শোনা যাক।

— শাফিন ওই প্রশ্ন করলে আমি ভাবব। অনেক ভাবব। ভাবতে ভাবতে আমি একটা উত্তর তৈরি করব। উত্তরটা হবে এরকম— শাফিন তো জানতে চাইবে—কেন, কেন ওই বিয়েতে আমি রাজি হয়েছিলাম, আমি এর উত্তরে, এর উত্তরে আমি বলব—আমি কি জানতাম, আমি কি জানতাম তুমি আসবে!

— সুন্দর! তার মুখে হাসি দেখা গেল।

সেই হাসি কিছুটা ছড়াল মেহেরের মুখে—সত্যি?

— হ্যাঁ, সত্যি।… কিন্তু মেহের, এটা প্রায় একই ব্যাপার। এভাবে শেষ করলে বাড়তি কী লাভ?

— আছে। বিয়ের ব্যাপারটা থাকছে না।

— কিন্তু তুমি বিয়ের ব্যাপারেই বলছ!

— তা বলছি। পার্থক্য হলো, আমার এখানে বিয়ের ব্যাপারটা ফাইনাল। সেজন্যই আমি বলব, আমি কি জানতাম শাফিন আসবে।

— একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। বিয়ের ব্যাপার থাকলে সমস্যা কী।

— আছে।

— আছে যখন, বুঝতে দাও। শুনি।

— তাহলে বিয়েটা হতো না।

— কিন্তু তোমার অতদূর যাওয়ার দরকার কী!

— আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না, না?

— কী বুঝব, সেটাই বুঝতে পারছি না।

— চলুন, উঠি। একটু হাঁটব আপনার সঙ্গে।

— ব্যাপারটা কী, সেটা বলো।

— হাঁটতে হাঁটতে বলব। তবে আপনি প্রিয় তানজিলাকে দূরে রাখবেন।

— তুমি এর মধ্যে তানজিলাকে পেলে কোথায়!

— একটা কথা বলেই ফেলি, তানজিলাকে আমার পছন্দ না।

— কেন কেন! তোমার সমস্যা কী?

— সে আপনি বুঝবেন না। লেখকরা সব বুঝতে পারে, এ আমি কখনো বিশ্বাস করি না।

— সেটা কোনো লেখক দাবিও করে না।

— দাবি করে না, কিন্তু ভাবটা নেয়।… স্যার, আপনার হাতটা দিন।

— আমার হাত দিয়ে কী করবে?

— ধরব। ধরে হাঁটব। এই সুযোগ আদৌ আর পাব কি না, জানি না।

সে অনিচ্ছায় হাতটা বাড়াল। তার এই অনিচ্ছা মেহের টের পেল। সে অবশ্য হাত ছাড়ল না। তবে সে হাসল—হাসলাম কেন, জানেন?

— ভাবছিলাম, জিজ্ঞেস করব, কেন?

— পরে বলব। এখন অন্য একটা কথা বলি। এটাও জরুরি।

সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

মেহের হাসল—শোনার ইচ্ছা কতটা?

— অনেক।

— আমার আর শাফিনের বিয়ে হয়েছে।

বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করল না তার। সে গেল এক বন্ধুর বাসায়। বন্ধুটি অবিবাহিত, অবশ্য ইদানীং সে হঠাত্ হঠাত্ বিয়ের কথা বলে—বয়স হচ্ছে। যতই বয়স হচ্ছে, বুঝতে পারছি, বিয়েটা করা উচিত ছিল।

কোনো কোনো বন্ধু এই কথা শুনে নাখোশ হয়—কী যে বলো তুমি! দিব্যি আছ।

তাদের আশঙ্কা, এ বাড়িতে বউ এলে, এই যে তারা খালি বাড়ি পেয়ে প্রেমিকা নিয়ে আসছে, প্রেমিকা বানাতে পারলে আসছে, উত্সাহী মেয়ে পেলে আসছে—সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। তার এখন পর্যন্ত তেমন প্রয়োজন পড়েনি। পড়েনি, ঠিক আছে, পড়বে না—তানজিলার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে তার মনে হচ্ছে—পড়বে না, এ হলফ করে বলা যায় না। হয়তো তানজিলাই একদিন এমন বলবে—আমি বুঝি সবসময়ই রাস্তায় রাস্তায় ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে ঘুরে বেড়াব তোমার সঙ্গে?

— অন্য কারো সঙ্গে ঘুরতে চাও? সে নিরীহ গলায় জিজ্ঞেস করবে।

— এমন মার খাবে, কেঁদেও কূল পাবে না।

— তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদব? হাসিমুখে কথাটা বলেই সে একটু চমকাল। তানজিলা, এ কথাটা তুমি অন্যভাবে নিও না। কিন্তু এ কথাটা ঠিক, তোমাকে জড়িয়ে ধরে আমার মাঝে মাঝে খুব কাঁদতে ইচ্ছা করে।

— ওমা, এটা কী কথা!

— মনে হয় তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে আমি অনেক অনেক হালকা হয়ে যাব।

— বলছ? ভালো লাগবে তোমার?

— আমি যদি এভাবে জানতে চাই—আমার কান্না শুষে নিতে ভালো লাগবে না তোমার?

— লাগবে লাগবে।… কিন্তু তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে কোথায় কাঁদবে সোনা?

— আছে…। এক বন্ধুর বাসা। খালিই পড়ে থাকে।… যাবে?

— কেউ থাকে না? কোনো অসুবিধা নেই?

— কিসের অসুবিধা! বন্ধু একাই থাকে। কিন্তু আমরা যখন যাব, ও থাকবে না।

— যাব।… আমার অনেকদিনের ইচ্ছা তোমাকে রান্না করে খাওয়াব।

— সত্যি! দারুণ হবে কিন্তু।

— আমার রান্না যদিও খুবই পচা, তবে আমি রান্না করেছি, তুমি খাচ্ছ, আমি তোমার পাশে বসে বা দাঁড়িয়ে আছি, এটা-ওটা তুলে দিচ্ছি, এটাই হচ্ছে ব্যাপার।

— দারুণ দৃশ্য।… তানজিলা, আমরা কিন্তু সারাদিন থাকব।

— সারাদিন? … আচ্ছা। আমার অসুবিধা নেই।

— আরেকটা কথা।

— বলো।

— তুমি কিন্তু আমার ওপর রাগ করতে পারবে না।

— আমি কেন তোমার ওপর রাগ করব। বলো।

— আমি কিন্তু তোমাকে আদর করব।

— আচ্ছা! ফাঁকাবাড়ির রহস্য একটু একটু করে উদ্ঘাটিত হচ্ছে।

— তানজিলা…।

— ইশ, ছেলের অভিমান হয়েছে।… শোনো, কেন তুমি আমাকে আদর করতে পারবে না!

পরিষ্কার বুঝবে না সে, সে তাকিয়ে থাকবে তানজিলার দিকে।

— তুমি যদি আমাকে আদর না করো, আমার ভালো লাগবে?

তার মুখ হাসিতে ভরে যাবে।

— তবে শর্ত আছে একটা।

— শর্ত… কী শর্ত…!

— আমাকে এলোমেলো করে দেবে তুমি।… বলো, আদরে আদরে তুমি আমাকে এলোমেলো করে দিতে পারবে না?

বাড়ি ফিরে লিখতে বসাটা খুব জরুরি ছিল। সেই কবে সে ইমদাদকে বলে রেখেছে—গল্প দেবে। শুরুও করেছে, শেষ করতে পারছে না। সে যখন বাড়ি ফেরার পথে, ইমদাদ ফোন করেছিল। ইমদাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আন্তরিক, কিছু ঠাট্টা-ইয়ার্কিও চলে, তাই ইমদাদ সহজেই বলতে পারল—গল্প লিখতে এতদিন লাগে, তা জানতাম না।

— এই এখন জানছ। এটাও জানবে যে, গল্প লিখতে আরো বেশিদিন লাগতেও পারে।

— তা পারে। কিন্তু আমার বিশেষ সংখ্যা বের হওয়ার জন্য ছটফট করছে।

— একটা কথা আছে না—জুত? ঠিক জুত করতে পারছি না।

— ফসকে ফসকে যাচ্ছে?

— ফসকে ফসকে যাচ্ছে।

— ভাই, ছাই নিয়ে বসেন। বললে আমি কিছু পাঠাই।

— লাভ হবে না… এরমধ্যে আবার নতুন ঝামেলা…।

— কী হয়েছে?

— মেহের…। তুমি বুঝবে না। যা-ই হোক, গল্প দিচ্ছি। আর কয়েকটা দিন।

— এত সময় যে কেন লাগছে!… মেয়েটা কি আর ফোন করছে না?

— কোন মেয়ে?

— ওই যে, বলেছিলেন না—একটা মেয়ে, পাঠক, ফোন করছে লেখককে। লেখক মনে করছেন, মেয়েটি তার চেনা, পরিচিত, কিন্তু সে চিনতে পারছে না। বারবার লেখক ভাবছে— কে, কে…।

— হুঁ হুঁ, আর বলতে হবে না। সে হাসল। আইডিয়াটা খারাপ ছিল না।

— আমারও বেশ পছন্দ হয়েছিল।

—ফোন আসছে মেয়েটির, চেনাচেনা মনে হচ্ছে, পরিচিত মনে হচ্ছে, কিন্তু চিনতে পারছে না। লেখক প্রতিবারই ভাবছে—ঠিকই চিনবে সে, তখন তার মনে হবে—আচ্ছা! তাহলে এ!… ইমদাদ, তুমি ভেবো না। লিখে ফেলব।

মেহের ফোন করেছিল দুপুরের দিকে। সে তখন ইমদাদের কথা ভেবেই লেখার টেবিলে। সে মেহেরকে বলল—তোমার কি জরুরি কিছু? আমি লিখছি।

— তানজিলা নায়িকা?

— তুমি পেয়েছ এক তানজিলা।

— বুঝি।

— পরে ফোন করবে?

— না।… সন্ধ্যায় দেখা হবে?

— আজ? … লিখতে চাচ্ছিলাম।

— কাল রাতে আমার ফ্লাইট।

— কোথায় যাচ্ছ?

— যেখানে থাকি।… দেখা হলে বলব। … আমার আসল গল্পও এখনো বলা হয়নি।

— বললে তো… তোমার আর শাফিনের বিয়ে হয়েছে।

— ওটা একটা লাইন মাত্র—আমার আর শাফিনের বিয়ে হয়েছে। একটা ঘটনা। এই ঘটনার সঙ্গে আরো কিছু আছে।

— থাকবেই। কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন বা একক না।

— সেটুকু শুনবেন না? লেখক হিসেবে আপনার কৌতূহল হচ্ছে না?

— নাহ।

— নাহ?

— জীবনের সব গল্পই আমার শুনতে হবে? জীবনের সব গল্পই কি কৌতূহলের? তোমার আর শাফিনের কাছে হয়তো তোমাদের গল্প ইউনিক, বাকি অনেকের, বা কারো কাছেই হয়তো সেকরম না।

— কিন্তু এই গল্প আপনিই শুরু করেছিলেন।

— শেষও করেছি। বাকি অংশ তোমাদের।

— সেটুকুই শুনুন। একটা শেষ হয়ে যাওয়া গল্পের বাকি অংশ।

তাদের দেখা হয়েছে এক রেস্তোরাঁয়। এটা মেহেরের ইচ্ছা। সে বলেছে, সে একসঙ্গে লাঞ্চ করবে। আবার কবে দেখা হবে, তার ঠিক নেই, দেখা যে হবেই, তা-ও নিশ্চিত করে বলা যায় না। মেহের বলেছে—আমরা চা খেতে খেতে আড্ডা দিই, শাফিন চলে আসবে।

— তার জানা ছিল না, সে জিজ্ঞেস করেছে—শাফিন ঢাকায়?

— ঢাকায়।… ব্যস্ত মানুষ। আজ অবশ্য ও গেছে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে।

— তুমি যাওনি?

— আমাকে বড়খালা বটি নিয়ে তাড়া করুক, এটা আপনি চান?

— না। সে হাসল। ছবি আঁকছ কেমন?

— ছবি?

— হ্যাঁ, ছবি। এখনো লালরঙ বেশি ব্যবহার করো?

— হলো কী জানেন? আমি কিন্তু সত্যিই শাফিনকে ওই কথা বললাম। …ওই যে, ভেবেছিলাম, না, শাফিনকে বলব—আমার যে তোমার মুখ থেকে শুনতে খুব ইচ্ছা করছিল?

— সে সামান্য হাসল—সত্যিই বলেছিলে? তা, শাফিন কী বলল?

— বলল, আমার সঙ্গে এক হয়ে থাকতে ইচ্ছা হয় না তোমার?

— আর, তুমি আটকে গেলে এই কথায়। তা-ই না?

— বুঝলেন কী করে! মেহের একটু চমকাল। তারপরই হেসে ফেলল—বোঝারই কথা, আপনি লেখক।… আরো কিছু বুঝতে পারেন? কেমন চলছে আমাদের সংসার?

— সংসার নানা রকম হতে পারে। এটা আন্দাজ করা মুশকিল।

— ঠিক। … আমরা জানতাম আমাদের বিয়েতে কেউ রাজি হবে না, তাই আমরা পালালাম।

সে হাসতে আরম্ভ করল।

— হাসবেন না—ভেবে দেখুন, আর কি কোনো উপায় ছিল?

একটু ভাবল সে, দু’পাশে মাথা নাড়ল—না। … তবে বেশ নাটক করেছ দেখছি।

— শাফিনের বুদ্ধি, গুছিয়ে নিল সবকিছু। মজার এক ব্যাপার ঘটল—এরমধ্যে হঠাত্ বাবা চলে এল ২-৩ দিনের জন্য। বাবার আসার কথা না, আবার না আসার কথাও না। এমন তো না—বাবা আসেই না। বাবা ওভাবেই আসে, খুব হঠাত্ হঠাত্। তা, বাবা এল, আমি আর শাফিন বাবাকে বললাম। বললাম—এখন আমাদের কী করা উচিত? বাবা কী বললেন, জানেন?

— তোমাদের মন যা চায়, তা-ই করতে বললেন?

— অনেকটা অমনই। বললেন—তোমাদের জীবন, তোমরাই ঠিক করবে কী করা উচিত।… একটা কথা স্যার, আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, উচিত বলে কোনো কথা নেই।

— হতে পারে। উচিত বলে কথা নেই।

— শুধু উচিত বলে নয়, অনুচিত বলেও কোনো কথা নেই।

— দুটোই ঠিক।

— স্যার, আমরা আসলে জানি না কোনটা কখন ঠিক।

— তবু মানুষ ঠিক করে, যেকোনো সময়ে।

— আমি আর শাফিন যেমন ঠিক করলাম। বাবাও বললেন, আমাদের জীবন, আমাদেরই ঠিক করা উচিত।… আমরা পালালাম। আমরা এখন ভ্যাঙ্কুভারে থাকি।

— জায়গাটা খুব সুন্দর?

— খুব। আমরা মাঝখানে অন্য শহরে গিয়েছিলাম। বেশিদিন ভালো লাগেনি। আমরা আবার ভ্যাঙ্কুভারে ফিরে এসেছি।

— এখন নিশ্চয় ল্যান্ডস্কেপ ভালো পাও।… রঙ, তুলি, ক্যানভাস কিনতেও অসুবিধা নেই।

— মেহের হাসল—শাফিন আমাকে অনেক পয়সা দেয়। আমার লাগে না, তা-ও দেয়।… স্যার, আমি আর ছবি আঁকি না।

— কী বলছ!

— যা শুনেছেন স্যার, সেটাই। আমি আর ছবি আঁকি না।

— কিন্তু কেন!

— ইচ্ছা করে না।

— ইচ্ছা করে না মানে?

— ইচ্ছা করে না মানে ইচ্ছা করে না।

— শাফিন কিছু বলে না?

মেহেরের মুখে সামান্য হাসি দেখা দিলো—কী বলবে?

— ছবি আঁকতে বলবে।

— নাহ। ও আমার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয়।

— আমি কিন্তু—ও তোমার ছবি দেখতে এসেছে, এভাবেই গল্পটা আরম্ভ করেছিলাম…।

— মনে আছে। … গল্পকার লিখে দেয়। কিন্তু গল্প আর জীবন এক নয়।

— আলাদাও কিছু নয়।

— মেহের সামান্য মাথা ঝাঁকাল—না, তা-ও না। একও না আলাদাও না।

— তুমি এতটা নিরাশ ছিলে না আগে।

— আপনি ভালো জানবেন। … আচ্ছা স্যার, এরপর কি আপনি এমন কোনো প্রশ্ন করবেন—আমি আর শাফিন সুখী কি না?

— জিজ্ঞেস করাই উচিত। তোমার কথা শুনে কেমন কেমন মনে হচ্ছে।

— আমি আর শাফিন খুবই সুখী, স্যার।

— সত্যি বলছ?

— সত্যি বলছি। আমরা এত সুখী যে মাঝে মাঝে জীবন অর্থহীন মনে হয়।

সে স্থির চোখে তাকাল মেহেরের দিকে।

— অবশ্য শাফিনের কথা আমার বলা উচিত না। শাফিনের কাছে জীবন হয়তো খুবই অর্থপূর্ণ। কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।… আমি আমার কথা বলছি।

সে তাকিয়ে থাকল মেহেরের দিকে।

— মাঝেমাঝে মনে হয় বিয়েটা না হলেই ভালো হতো।

— কিংবা হলে ঐ অঙ্কের মাস্টারের সঙ্গে…।

— হয়তো।… নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না।

— না, তা যায় না।

— আপনি গল্পটা এমনভাবে তৈরি করেছিলেন, পাঠক ভাববে—আহারে, এরা কী চমত্কার জুটি, এই যে বিয়ে পার হলো না এদের, কী গভীর হাহাকার নিয়ে এদের জীবন পার হবে!

— গল্পের কী দোষ!

— গল্প, স্যার, একটা প্রলোভন।… সত্যি কথা হলো, গভীর হাহাকারে এখনো জীবন পার করছি।

— সুখের হাহাকার?

— তা সে যা-ই হোক।… হয়তো ব্যাপারটা এরকম—ধরাবাঁধা সুখ ধরাবাঁধা হাহাকার।

— তোমাদের বিয়ের জন্য আমি দায়ী নই।

— আমি দোষ দিচ্ছি না। আমি বলছি।… স্যার…।

‘স্যার’ বলে মেহের কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। মেহেরের দেখাদেখি সে-ও। একটুপর সে-ই জিজ্ঞেস করল—কিছু বলবে?

— একটা কথা জিজ্ঞেস করব।

— করো।

— একদম সত্যি একটা উত্তর দিতে হবে।

— দেবো।

— তানজিলাকে নিয়ে না কিন্তু।

— আহা, আবার তানজিলা।… কী জিজ্ঞেস করবে!

— এর উত্তরে অবশ্য এখন আর কিছুই এসে যাবে না।… হয়তো যাবে।… বাইরে বাইরে যাবে না।

—… স্যার, পরে বলব, শাফিন চলে এসেছে।

শাফিনকে রাজপুত্রের মতো দেখাচ্ছে। তার চেহারায় যদিও ক্লান্তির ছাপ, সেই ছাপ ভেদ করে তার ঔজ্জ্বল্য ফুটে বেরোচ্ছে। শাফিন এসে তাকে জড়িয়ে ধরল—স্যার, এভাবে জড়িয়ে ধরলে কি আপনি রাগ করবেন?

— না না, রাগ করার কী আছে!

— তাহলে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখি। আপনি না থাকলে আমি মেহেরকে পেতাম না।

মেহেরের মুখে মুচকি হাসি দেখা গেল। আর, সে বলল—আমি আর কী করেছি! আমি গল্প থামিয়ে দিয়েছি। তোমাদের বাকি কাজগুলো তোমরাই করেছ।

— এভাবে বললে হবে না, স্যার। সূচনা আপনার হাতে।

— বাদ দাও। বলো, তুমি কেমন আছ?

— আমি ভালো আছি স্যার, আপনার দোয়া। আমি খুবই ভালো আছি। মেহের, তুমি বলোনি?

— কী!

— আমাদের ভালো থাকার কথা।

— বলেছি।

— হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেছে ও।

— স্যার। শাফিন অবশ্য ‘স্যার’ বলে তাকাল মেহেরের দিকে। তার মুখে মুচকি হাসি। মুখ সে ফেরাল—স্যার, মেহেরকে রাজি করাতে আমার কী যে পরিশ্রম করতে হয়েছিল…।

মেহের হাসিমুখে বলল—মায়ের কাছে মাসির গল্প হচ্ছে?

— ওর প্রতিবারই ওই এক কথা—এ হয় না, এ হয় না!

— না হলেই ভালো ছিল।

— হ্যাঁ, দুজন গভীর অতৃপ্তি নিয়ে জীবন পার করে দিতে পারতাম। শাফিন হাসতে হাসতে বলল। স্যার, আপনি একবার ভ্যাঙ্কুভার আসবেন না?

— ভ্যাঙ্কুভার?

— আপনি বললেই আমরা টিকিট পাঠিয়ে দেবো। খুব ভালো লাগবে আপনার।

— একটা না, দুটো টিকিট পাঠাতে হবে।

— হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভাবির জন্যও।

— না, ভাবি না। সায়রা আমাদের এই গল্পের কেউ না। তানজিলার জন্য।

— তানজিলা কে?

— সায়রাকে পরে সম্ভব হলে আমি একবার নিয়ে যাব। তখন আবার তোমরা থাকবে না।

— কিন্তু, স্যার, তানজিলা কে?

সে হঠাত্ এলোমেলো বোধ করল। তার মনে হলো তানজিলা কে—এটা সে শাফিনকে কী করে বোঝায়! সে চুপ করে থাকল। আর মেহের, নিবিষ্টচিত্তে হাতের নোখ দেখতে আরম্ভ করল।

— এই, মেহের…। শাফিন মেহেরের হাত ধরে নাড়াল।

— বলো, ধাক্কাতে হবে না।

— তানজিলা কে?

— এটা আরেকটা গল্প। না বোঝার কী হলো, শাফিন!

শাফিন বলল—ওহ, তা-ই বলো।… স্যার, যা বলছিলাম, ভ্যাঙ্কুভারে এলে আপনার ভালো লাগবে।

সময়টা ভালো কাটল তার। তার দ্বিধা ছিল, সে ভেবেছিল সময়টা বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে, তার এরকম মনে হতে পারে—কেন যে আমি এলাম! এরকম কিছু ঘটল না, বরং সে দেখল, সে মন ও মুখ খুলে হাসছে, সময়টা তার কাছে উপভোগ্য মনে হচ্ছে। তার মনে হলো, লেখা একটু পেছাল বটে, তবে সময়টা ভালো কাটল। এ কথাই সে বলল মেহের ও শাফিনকে, যখন তারা জিজ্ঞেস করল।

— বেশ কাটল। বেশ কাটল সময়টা।

— কিন্তু আপনি স্যার, কম কথা বলেন। কথা তো সব আমরাই বললাম।

— জমজমাট একটা আড্ডা হলো। সে বলল। এটাই কথা।

— তা ঠিক তা ঠিক। মেহের তোমার কেমন লেগেছে। বলতে বলতে শাফিন উঠল—আমি একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি।

শাফিন চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত মেহের সেদিকে তাকিয়ে থাকল। তারপরই সে ফিরল—স্যার, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে নিয়েছিলাম…।

— হুঁ। কী যেন…।

— উত্তরটা আমার জন্য জরুরি স্যার। সত্যি উত্তরটা দেবেন তো?

— একটা উত্তরের কমপক্ষে দুটো দিক থাকে। আমি উত্তরের যে অংশেই থাকি না কেন, সেটা তোমার জন্য জরুরি?

— জি স্যার, যা-ই শুনি না কেন, সেটাই।

— বলো।

— আপনি আমাকে পছন্দ করতেন?

— আমি? তোমাকে?

— আপনি আমাকে পছন্দ করতে পারেন না।

— তুমি আমাকে পছন্দ করতে?

— অনেক।

কিন্তু তুমিই বলেছ—লেখকরা বুদ্ধিমান না। লেখকরা যতটা বোঝে মনে করে, আসলে ততটা তারা বোঝে না।

— তাতে কী? এসব সত্যি বলে আমি আপনাকে পছন্দ করতে পারব না?

— সে তুমি জানবে।… কিংবা, জানো।

— আমি আপনাকে খুবই পছন্দ করি, স্যার। আপনার গল্প পর্যন্ত আমি খুবই খুশি আপনার ওপর। তার পরের যে জীবন আমার, তার জন্য আমি আপনাকে দায়ী করতে পারি না।

সে সামান্য মাথা ঝাঁকাল।

— তবে যেটুকু আপনার হাতে—সেখানে গ্লানি ছিল, অপমান ছিল, অনিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু এসব ছাপিয়ে আরো কী যেন ছিল… আপনি আমার খুব প্রিয় মানুষ।

সে সামান্য হাসল—তোমার সঙ্গে আবার হয়তো কখনো দেখা হয়ে যাবে।

— কিন্তু আমার উত্তরটা স্যার, মেহের ব্যাকুল গলায় বলল। ওটা জানা আমার জন্য খুবই জরুরি।

সে মেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকল।

— বলুন স্যার।

— আমি তোমাকে খুবই পছন্দ করতাম। তোমাকে নিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি আমার ভেতর কাজ করত। মাঝে মাঝে মনে হতো, তোমার মতো কারো সঙ্গে যদি দেখা হতো! আবার কখনো মনে হতো, তোমার মতো কাউকে আমি দেখেছি। হয়তো কল্পনায়, ভাবনায়, কিন্তু দেখেছি।

মেহেরের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল, সে হাত বাড়িয়ে তার হাত ধরল, ধরে রাখল, ছেড়ে দিল। হাত সরিয়ে নিয়ে সে দু’চোখ মুছে নিল।

— খুশি?

— খুব খুশি স্যার, খুব খুশি। মেহেরের মুখে তারপর ফিচকে হাসি দেখা দিলো—এখন স্যার, তানজিলার কথা।

— আবার তানজিলা!

— আহা, বলেন না স্যার, শুনি।

— দেখো, তানজিলা হয়তো কোনো গল্পের চরিত্র মাত্র।

— সে আমি জানি, স্যার।

— ব্যাপার এই এটুকুই।

— জানি স্যার।

— তাহলে বারবার কেন জিজ্ঞেস করছ!

— এমনি। … স্যার, আমার হিংসা হচ্ছে না।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে সে তানজিলাকে ফোন করল। এমনিই করা। সে ভেবেছিল, তানজিলার ফোন বন্ধ পাবে। কিন্তু দু’বার রিং হওয়ার পরই তানজিলা ফোন ধরল। বলল—আমি জানতাম তুমি ফোন করবে।

— আমাদের দেখা হবে কবে?

— হবে।

— কবে?

— আহা, দেখা তো হবেই।

— কবে?

— কী আশ্চর্য! আমি বলছি না—হবে।

— আমি জানতে চাচ্ছি—কবে।

— এক কাজ করো। তুমি চলে আসো।

— কোথায়?

— আমার কাছে।

— তুমি তোমার ঠিকানাই দাওনি!

— তোমাকে আমার ঠিকানা দিতে হবে! তানজিলা অবাক গলায় বলল।

— ঠিকানা ছাড়া…।

— ঠিকানা দেওয়ার দায়িত্ব আমার! বলো, আমার? তুমি নিজে আমার ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারবে না!

— পারব… মানে… ।

— তাহলে সে চেষ্টাই করো, আমার ঠিকানা তুমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করো।

সে ভেবেছিল সকালে ইমদাদকে ফোন করে লেখা নিয়ে যেতে বলবে। এখন ক্লান্ত লাগছে তার, তবে কিছু আনন্দও আছে, গল্পটা সে শেষ করতে পেরেছে। সে ঠিক করল, এখন সে লারেলাপ্পা টাইপ একটা সিনেমা দেখবে। তবে তার আগেই ইমদাদের ফোন এল—লোক এখন পাঠাব? না, কাল সকালে?

— কেন?
— বারে, গল্পটা আনাব না!
— শেষ যে হয়েছে…।
— মজা করেন, না? শেষ যে হয়েছে, জানি।
— কী বলো, ইমদাদ! কী করে জানো!
— মেহের নামের একজন ফোন করে জানালেন।
— মেহের!
— রসিক আছেন। বললেন—একটা ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যাবে না, এটা নিশ্চিত হতে স্যার গল্পটা শেষ করে ফেলেছেন। আপনি কাউকে পাঠিয়ে দিন।… পিএ রাখলেন বুঝি?
সে শুকনো হাসি হাসল।
— আমি বরং কালই লোক পাঠাই। এখন রাত হয়েছে।
— হ্যাঁ, কাল।
ইমদাদের সঙ্গে কথা শেষ করে সে বিছানায় বসল। সে টের পেল, তার অস্থির লাগছে, তার শীত-শীত লাগছে।