মাহবুবুল আলম চৌধুরী

মাহবুবুল আলম চৌধুরী জন্ম ও শিক্ষাজীবন

মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জন্ম ১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার গহিরায় আসাদ চৌধুরী বাড়িতে।তার পিতার নাম মরহুম আহমদুর রহমান ও মাতার নাম মরহুম রওশন আরা বেগম। ১৯৩০ সালে মাত্র চার বছর বয়সে তিনি মাকে হারান।তিনি ছিলেন মায়ের একমাত্র সন্তান। তিনি কিশোরকাল অতিক্রম করার আগেই ১৯৪১ সালে তাঁর বাবা মারা যান মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে।সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।বাবা-মা’র স্নেহ ছাড়া তাঁর বেড়ে ওঠা। ১৯৪৭ সালে রাউজানের গহিরা হাই স্কুল থেকে বৃত্তিসহকারে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর আই.এ. পড়ার সময় রাজনৈতিক কারণে চট্টগ্রাম কলেজ ত্যাগ করেন।

কর্মজীবন

মাহবুব উল আলম চৌধুরী ১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগদান করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মী হিসেবে ব্রিটিশ বিরোধী ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন।১৯৪৫ সালে ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন। চট্টগ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের বীর বিপ্লবীরা কারামক্ত হলে জে.এম.সেন হলে যে সংবর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, তিনি ছিলেন এর উদ্দ্যোগী কর্মী। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামে সর্ব প্রথম নজরুল জয়ন্তী উদযাপিত, তিনি ছিলেন উদযাপন কমিটির সম্পাদক। সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবুল ফজল। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রগতিশীল মাসিক ‘সীমান্ত’ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮ সালে ‘সীমান্ত’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক বৈঠক প্রতিষ্ঠিত হয়।১৯৪৯ সালের ২২ ও ২৩ নভেম্বর কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে যে বিশ্বশান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ,তাতে তিনি যোগদান করেন। পঞ্চাশ দশকের প্রথমদিকে তাঁর সক্রিয় প্রচেষ্টায় প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে রিপোর্টে পূর্ব বাংলার স্বায়িত্তশাসনের কথা উল্লেখ ছিলনা।বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বীকৃতি ছিলনা। তিনি এই মূলনীতি বিরোধী কমিটির যুগ্ম-আহবায়ক ছিলেন।১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের সর্ব প্রথম বিশ্বশান্তি পরিষদের শাখা চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ছিলেন উক্ত পরিষদের সম্পাদক।১৯৫১ সালের মার্চ মাসের ১৬ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত চারদিনব্যাপী হরিখোলার মাঠে যে সাংস্কৃতিক স্মমেলন অনুষ্ঠিত হয়, তিনি ছিলেন এর অন্যতম উদ্যোক্তা। ১৯৫২ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন।সে বছর ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় নিহত শহীদদের স্মরনে প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ রচনা করেন।তখন তিনি জলবসন্তে আক্রান্ত হয়ে গৃহবন্দি ছিলেন।কবিতাটি পাকাস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করে জন্ম দেয় নানা ঐতিহাসিক ঘটনার।এর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়াও জারি করা হয়। ১৯৫২ সালের ১০ অক্টোবর জওশন আরা রহমানের সাথে বিয়ে হয় মাহবুব উল আলম চৌধুরীর। ১৯৫৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম কবি নাজরুল নিরাময় সমতি গঠন করেন। ১৯৫৩ সালে প্রথম অসাম্প্রদায়িক পার্টি ‘গণতন্ত্রী দল’ গঠিত হয়। তিনি এর কেন্দ্রীয় সদস্য এবং চট্টগ্রাম জেলা সমিতির সাধারন সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করার জন্য চট্টগ্রামে যে কর্মী শিবির গঠিত হয়, তিনি ছিলেন তার আহবায়ক। ১৯৫৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম শাখা যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম কৃষ্ঠি কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহন করেন।১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রামে দাঙ্গা বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন প্রতিরোধ কমিটির সম্পাদক।১৯৬৬ সালে তিনি নোবেল বিজয়ী ফাদার পিয়রের সাহায্য-সহায়তায় গ্রামের উন্নতির জন্য ‘শান্তির দ্বীপ’ নামক প্রকল্প স্থাপন করেন নিজ গ্রামে। ১৯৬৮ সালে তিনি রাউজানের গহিরা ডিগ্রী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নানা ভাবে মুক্তিযুদ্ধে জড়িত করেন।১৯৭২ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি স্থায়িভাবে ঢাকায় চলে আসেন। সেখানে নব্বইয়ের দশকে প্রায় আট বছর ‘ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর’ সভাপতি ছিলেন, পাশাপাশি দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন।

 সাহিত্যকর্ম

‘কাঁদতে আসিনি,ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ অবিস্মরণীয় কবিতার জনক সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী। রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ পরাধীন ঔপনিবেশিক দেশে জন্মগ্রহণকারী কবিদের শেষ দু’জনের জীবন কেটেছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষ, পাকিস্তান আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, এবং দেশ বিভাগজনিত চরম মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে।ওই ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে যে দু’একজন কবি প্রগতিশীল চিন্তাচেতনায় আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন, মাহবুব উল আলম তাঁদেরই প্রধান।তিনি বিশ শতকের ছয় এবং একুশ শতকের প্রথম দশক জুড়ে মেধা ও মনন এবং সৃজনশীল প্রতিভা প্রগতিশীল কর্মকান্ডে ব্যাপৃত রেখেছেন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রবাদপ্রতিম ‘সীমান্ত’ পত্রিকার সম্পাদনা, একুশের প্রথম কবিতার রচয়িতা, বিভিন্ন প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন- সংগঠনে যিনি পাকিস্তানী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অটল ছিলেন , বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরেও তিনি অবসর গ্রহন করেন নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার বিরুদ্ধে যে অবিরাম ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলেছে ,তিনি বিগত তিন দশক ধরে তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হননি।বাংলাদেশের চরম বিভ্রান্তির মধ্যেও তিনি অকুতোভয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিখা প্রজ্জ্বলিত রেখে সেই আলোতে এগিয়ে গিয়েছেন এবং সতীর্থ ও উত্তরসূরীদেরকেও সেই পথে অনুপ্রেরনা জুগিয়েছেন।

মৃত্যু

২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর মাহবুব উল আলম চৌধুরী ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলে ঢাকায় তাকে সমাহিত করা হয়।তাঁর স্ত্রী জওশন আরা দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচীর সাথে জড়িত।

উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ

আবেগধারা(১৯৪৪), ইস্পাত(১৯৪৫), অঙ্গীকার(১৯৪৬), কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি(১৯৮৮, ২০০২, ২০০৫), সূর্যাস্তের রক্তরাগ(২০০৪),সূর্যের ভোর(২০০৬)

 প্রবন্ধ সংকলন

সংস্কৃতি জাতীয় মুখশ্রী(২০০৬)

নির্বাচিত কলাম

গণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র, স্বৈরতান্ত্রিক গণতান্ত্র(২০০৬)

ছড়ার বই

ছড়ায় ছড়ায় (২০০৪)

নাটক

দারোগা(১৯৪৪), আগামীকাল(১৯৫৩)

 পুস্তিকা

মিশরের মুক্তিযুদ্ধ(১৯৫৬), বিল্পপ বাজেয়াপ্ত (১৯৪৬)

স্মৃতিকথা

স্মৃতির সন্ধানে(২০০৮)

পুরস্কার ও সম্মাননা

  • বাংলা একাডেমী ফেলোশিপ (১৯৮৬)
  • ক্রান্তি শিল্পগোষ্ঠী সংবর্ধনা(১৯৯০)
  • চট্টগ্রাম আনোমা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী সংবর্ধনা(১৯৯৭)
  • চট্টগ্রাম সঙ্গীত পরিষদ সংবর্ধনা(১৯৯৯)
  • সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সংবর্ধনা(২০০০ ও ২০০১)
  • চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব সংবর্ধনা(২০০০)
  • চট্টগ্রাম সিটি কর্পো্রেশন একুশে পদক(২০০১)
  • বাংলাদশ উদিচী শিল্প গোষ্ঠী সংবর্ধনা(২০০১)
  • পদাতিক নাট্য সংসদ সংবর্ধনা(২০০২)
  • ক্রান্তি পদক ও সংবর্ধনা (২০০২)
  • ডেমোক্রেসি ওয়াচ সংবর্ধনা(২০০২)
  • চট্টফ্রাম লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষনা কেন্দ্র সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক(২০০৩)
  • চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা’র সম্মাননাপদক(২০০৩)
  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চ সংবর্ধনা
  • একুশে পদক (২০০৯)
  • মুক্তিযুদ্ধ জাতীয় পুরস্কার(২০০৫)

 তথ্যসূত্র

  • রাউজান ক্লাবে’র বিশ বছর পূর্তি ও সংবর্ধনা স্মারক ম্যাগাজিন