রুখতে হবে বিদেশী ভাষার আগ্রাসন

রাজনৈতিক যুদ্ধ হত্যা করে ব্যক্তিকে, সংস্কৃতিক যুদ্ধ হত্যা করে পুরো একটি জাতিকে, রাজনৈতিক যুদ্ধ চোখে দেখা যায় কিন্তু সংস্কৃতিক যুদ্ধ চোখে দেখা যায় না, এটা অদৃশ্য বিষক্রিয়ার মতো ধীরে ধীরে কাজ করে যার ফলাফল সুদূরপ্রসারী। সেই সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক যুদ্ধের ফল আমরা এখন হাতেনাতে পাচ্ছি। লক্ষণীয় যে, আমাদের রাজনৈতিক যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল সংস্কৃতিক যুদ্ধ তথা ভাষা আন্দোলন থেকে, আবার ঠিক পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে পাকিস্তানিরা শেষ আঘাতটা হানতে চেয়েছিল এ সংস্কৃতির ওপরে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানিরা যেটা পারেনি ইন্ডিয়ানরা সেটা ঠিকই পেরে গেছে। আজ এটাই বাস্তবতা পাকিস্তান ভেঙ্গে ইন্ডিয়া তার একটা নতুন রাজ্য বানাতে পারেনি ঠিকই কিন্তু একটা তাঁবেদার রাষ্ট্র ঠিকই বানিয়ে ফেলেছে। ইন্ডিয়ার অঙ্গরাজ্য সমূহের প্রচুর সংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রপ্ত করে আজ আমরা রাজনৈতিক ভাবেও পরিণত হয়েছি ইন্ডিয়ার তাঁবেদার রাষ্ট্রে। মূলত উর্দু ভাষাকে আমরা সেদিন থেকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম, যখন আমাদের ওপর সেটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। নইলে ২৫ বছরের পাকিস্তানি শাসনে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দু বহাল তবিয়তেই ছিল। সেই পঁচিশ বছরে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ছিল উর্দু, এছাড়া উর্দু সিনেমা উর্দু সঙ্গীত সাহিত্য সব কিছুই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বাংলার পাশাপাশি হাত ধরাধরি করেই চলেছিল। ১৯৪৭ সালের ২১ মার্চ সন্ধ্যায় কার্জন হলের অডিটরিয়ামে বাংলা ভাষাভাষীদের সামনে ইংরেজিতে ভাষণ দিয়ে জিন্না উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা বানাতে চেয়েছিলেন, যদিও জিন্নার নিজের মাতৃভাষা ছিল গুজরাটি। গায়ে জোর বেশি মাথায় বুদ্ধি কম পাকিস্তানিরা যেটা চাপিয়ে দিয়ে হাসিল করতে চেয়েছিল সেটাই ভেজিটেরিয়ান ইন্ডিয়ানরা গত ৪০ বছরের চেষ্টায় আজ ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে হিন্দি ভাষা দিয়ে। ভাষা আসলে নিষ্পাপ জিনিস। কিন্তু সেই নিষ্পাপ ভাষাকে যখন সৈন্যসামন্ত আর বোমারু বিমানের মতো ব্যবহার করা হয় অন্য সংস্কৃতিকে দখল করার জন্য তখন আর সেই ভাষা নিষ্পাপ থাকে না। ৪০ বছর আগে উর্দু যেমন আগ্রাসী ছিল এখন হিন্দি সেই একই আগ্রাসী ভূমিকায় নিয়োজিত। পার্থক্য শুধু আজ একজন ইন্ডিয়ান জিন্না নেই যিনি ঘোষণা করবেন হিন্দিই হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা। সেটা করা ছাড়াই আজ আগ্রাসী হিন্দি দখল করে নিচ্ছে আমাদের মন মগজ আর ভবিষ্যৎ তারুণ্য। নেপাল ভুটান সিকিমের মতো আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি দখল হয়ে গেলে সৈন্য পাঠিয়ে দেশ দখল করার আর প্রয়োজন থাকে না। ঘরে বাইরে হিন্দির আগ্রাসনে আমি আতংকিত। বিশ্বায়ন আর বাজার অর্থনীতি মানে এ নয় যে আমি তোমারটা মুঠো ভরে নেব আর আমারটা কাছা খুলে দেব। আমাদের জানালা খোলা থাকবে ঠিকই কিন্তু আমাদের দরজায় থাকবে সশস্ত্র প্রহরী। এটাই আপসোস, যে ভাষার জন্য যে জাতি জীবন দিয়েছে সেই জাতির একজন সদস্য হিসেবে আমি আবারও আমার ভাষা আমার কৃষ্টি নিয়ে শংকা প্রকাশ করছি। আমাদের রাষ্ট্রের যেন কোনো দায় নেই, আজ ৪ থেকে ১২ বছর বয়সী যে কোনো শিশু অনর্গল হিন্দিতে কথা বলতে পারে গান গাইতে পারে। ঘরে ঘরে মহিলারা আকণ্ঠ ডুবে আছে হিন্দি সিরিয়ালের আফিমে। অবস্থা খুবই ভয়াবহ, সামাজিক মূল্যবোধ শেষ হয়ে গেছে। ধর্ষণ, হত্যা, শিশু হত্যা, পিতামাতার হাতে সন্তান হত্যা, সন্তানের হাতে পিতা-মাতা হত্যার মতো পৃথিবীর ঘৃণ্যতম সব অপরাধ এ দেশ করে ফেলেছে। সংস্কৃতি হচ্ছে জাতির মগজ, সেই মগজে পচন ধরলে তার প্রতিক্রিয়া এমনই হয়। সংস্কৃতি গোল্লায় যাক, এ দেশের এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি হল যে কোনো পন্থায় ক্ষমতায় যেতে হবে অথবা ক্ষমতায় থাকতে হবে। সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে গ্রাহ্য না করে রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম অর্থহীন। হিন্দি সংস্কৃতি সবচেয়ে বড় সাফল্য এটাই- যে পর্ণ সিনেমা লুকিয়ে দেখার জিনিস সেটাকে এখন তারা সপরিবারে দেখার উপযোগে করে ফেলেছে। হিন্দি আবর্জনা গিলতে গিলতে আমরা পরিণত হচ্ছি স্থূল আর নিম্ন রুচির এক জাতিতে। হিন্দি সিনেমার নায়ক সঞ্জয় দত্তের অস্ত্র মামলার বিচারককে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনি কি হিন্দি সিনেমা দেখেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন- ‘না দেখি না, হিন্দি হচ্ছে ইতর শ্রেণীর লোকজনের ভাষা’। তবে সমাধান কী? এ গ্লোবালাইজেশনের যুগে কি সংস্কৃতি এবং তথ্য প্রবাহের গতি রোধ করা সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। যে ভাবে ড্রাগ বা অবৈধ চোরাচালান বন্ধ করা সম্ভব, ঠিক সেভাবেই সম্ভব। সেই সম্ভবের কাজটা করবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্মানজনক কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে হবে সংস্কৃতির আদান-প্রদান। যেভাবে বৈধ পণ্যের আদান-প্রদান হয়। আমি বেছে বেছে তোমার সেই সংস্কৃতিটা নেব যা আমার জন্য উপকারী। খারাপটা নেব না, তুমিও আমার খারাপটা নেবে না। এবং অবশ্যই সেটা হবে সমতার ভিত্তিতে। নেশাদ্রব্য গ্রহণ করা খারাপ এটা সবাই জানে এমনকি যে এটা গ্রহণ করে সেও একবাক্যে স্বীকার করবে এটা খারাপ। নাগালের মধ্যে থাকলে সহজলভ্য হলে যে কেউ চাইবে এটা চেখে দেখতে। চেখে দেখা থেকে আসক্তির সূত্রপাত, গত ৪০ বছর ধরে চেখে দেখতে দেখতে আজ সেই হিন্দি আবর্জনা আমাদের নেশায় পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের কাজ হল দেশ এবং জনগণের স্বার্থে সেই নেশার উৎপাদন বিপণন এবং সঞ্চালন রোধ করা। ঠিক এভাবেই হিন্দি সংস্কৃতির আফিমকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। রক্ষা করা সম্ভব নিজের ভাষা কৃষ্টি সংস্কৃতি। এজন্য রাষ্ট্রকে শক্তিশালী হতে হবে, শক্তিশালী হতে হবে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক বুনিয়াদ। আমি হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে নই, আমি ‘আগ্রাসী হিন্দি ভাষা এবং সংস্কৃতির’ বিরুদ্ধে, যেমন আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ‘আগ্রাসী উর্দুর’ বিরুদ্ধে ছিলেন। আমাদের আবার একটা ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়ার সময় এসে গেছে, হয়তো সেই ভাষা আন্দোলন থেকে আবারও এক স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা হবে। নেপাল এবং শ্রীলংকা যদি ইন্ডিয়ান তাঁবেদারি থেকে মুক্ত হতে পারে তবে আমরাও পারব। আমাদের ইতিহাস শিক্ষা দেয় সংস্কৃতিক যুদ্ধ সূচনা করে রাজনৈতিক যুদ্ধের। ইতিহাস চাকার মতো, এটা কখন যে কোনো দিকে ঘোরে বোঝা মুশকিল।