বন্ধু স্বজন

ইছাপুরার ধীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মহাশয়ের দোতলা দালানবাড়ির নিচতলার বারান্দায় বসে গুড়-মুড়ি খাচ্ছে স্বজন। আজ সাত মাস এই বাড়িতে আছে তারা। প্রায়ই গুড়-মুড়ি খাওয়া হয় সকালবেলা। প্রথম প্রথম তেমন সুবিধার লাগেনি। গত কয়েকদিন ধরে জিনিসটা এত পছন্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে নাশতা হিসেবে গুড়-মুড়ির চে উপাদেয় কোনও খাবার পৃথিবীতে নেই। মুঠোভর্তি মুড়ি আর এক কামড় গুড় মুখে দিলে মনে হয়, এই খেয়ে জীবনটা পার করে দিতে পারলে তারচে আনন্দের আর কিছু হতো না। আউশ চালের ফোলা ফোলা লালচে মুড়ি আর খেজুড়ে গুড়, আহা, অতুলনীয়। তবে সঙ্গে থাকতে হবে সকালবেলার রোদ। তাও যেই সে রোদ না। শীত আসি আসি করার এই সময়কার রোদ। ওরকম রোদে বসে গুড়-মুড়িটা গলধকরণ করতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে তার পরিপূর্ণ স্বাদ।

রোদের কারণে এহেন গুড়-মুড়ি আজ সুবিধার লাগছে না স্বজনের। গুড়টা-মুড়িটা হাতে আছে, রোদটা নেই। রোদ জিনিসটা মনে হচ্ছে লবণের মতো। ভাত-তরকারির সঙ্গে যদি লবণই না থাকলো, তবে তো ষোলআনাই মিছে!
রোদটা যে আজ কেন উঠছে না?
সাদা চাদরের মতো পাতলা কুয়াশা চারদিকে। শিশিরে ভিজে আছে গাছপালা আর বাড়ির উঠোন-আঙিনা। কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে একটা ভাব। রোদ না উঠলে এইভাব কাটবে না। গুড়-মুড়ি হায়, বৃথা যায়!
রোদের খবর নিতে উঠোনের দিকে তাকাল স্বজন। বিশাল উঠোন ছাড়িয়ে পুবদিকে বাঁধানো ঘাটলার পুকুর। পুকুর ধারে ভাইবোনের মতো জড়াজড়ি করে আছে কিছু গাছপালা। ওপারে বাঁশবন, অচেনা ঝোপঝাড়। বকুলগাছটার মাথা যেন একটু আলোকিত মনে হচ্ছে!
খুশিতে মন ভরে গেল স্বজনের। আরে, রোদ উঠছে তো! এখনই পুব আকাশ থেকে পাখির মতো লাফ দিয়ে নামবে রোদ। ওইটুকু পাতলা কুয়াশা কোথায় উধাও হবে! সন্ধ্যা মুখার্জীর গানের মতো হয়ে উঠবে সকাল।
দেখো মিষ্টি, আহা মিষ্টি, কী মিষ্টি এ সকাল।
সোনা ঝড়ছে, ঝরে পড়ছে, কী মিষ্টি এ সকাল!
স্বজনের মন ভাল হয়ে গেল। মুঠোতে যতটা সম্ভব মুড়ি তুলে মুখে দিল, বড় এক কামড় গুড় নিল। চিবাতে চিবাতে মনে হল, আহা, কী মজা!
বাবার বন্ধু ধীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে স্বজনরা ডাকে ধীরেনকাকু। পদবি তাদের মতোই। এই কারণেই জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। ইছাপুরার প্রভাবশালী লোক। প্রায় জমিদার। মাঠে বিস্তর ধানের জমি, বাজারে বিস্তর দোকানপাট। বাড়িখানা পুরনো আমলের জমিদার বাড়িই। বাড়ি পুকুর আর বাঁশবন মিলিয়ে তিরিশ-বত্রিশ বিঘার কম হবে না। নকশা করা দোতলা বিল্ডিংখানা দেখার মতো। একতলা-দোতলা মিলে রুম হবে সতেরো-আঠারোটা। সবই প্রায় খালি পড়ে ছিল। ধীরেনকাকু, তাঁর স্ত্রী সরদাকাকীর সঙ্গে থাকতো জনা চার-পাঁচেক কাজের লোক। এতবড় বাড়িতে এই কজন মাত্র লোক! মনে হতো বাড়িতে আসলে লোকজনই নেই। বাড়ি পড়ে থাকতো নির্জনে। গাছপালায় পাখি ডাকতো সারা দিন, পুকুর ধারের ঝোপঝাড়ে দিনেরবেলায়ও ডাকতো ঝিঁঝিঁপোকা। বাঁশবনে শন শন করতো হাওয়া। সেই নির্জনতা ভেঙে গেল এপ্রিল মাসের শুরুতে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে দলে দলে আসতে লাগল ধীরেনকাকুর আত্মীয়-স্বজন, সারদাকাকীর আত্মীয়-স্বজন। সপরিবারে কাকুর বন্ধু এলেন একজনই, বাদল চক্রাবর্তী, স্বজনের বাবা। পাকিস্তানীদের হাত থেকে বাঁচার আশায় মানুষগুলো আশ্রয় নিল এই বাড়িতে। পাকিস্তানীদের সবচাইতে বেশি আক্রোশ ছাত্রদের ওপর, হিন্দুদের ওপর। হাতের কাছে পেলে আর রক্ষা নেই। হয় তখনই গুলি করে মারবে, নয় ধরে নিয়ে যাবে। সেই নেওয়াই শেষ নেওয়া। যাকে নেবে সে আর ফিরে আসবে না।
ধীরেনকাকুর বাড়িতে এখন এগারোটা হিন্দু পরিবার। সত্তর-আশিজন লোক। বাড়ি গমগম করছে মানুষের সংসার কর্মে। সন্ধ্যাবেলায় সবাই একত্র হয়ে রেডিও খুলে বসেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছে। মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় কোন ব্রিজ উড়ালো, কোথায় কতজন মিলিটারি মারলো, রাজাকারদের নাস্তানাবুদ করলো কোথায় কোথায়, এই সব খবরে কী উল্লসিত একেকজন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। পাকিস্তানীদের ধ্বংস অনিবার্য। চরমপত্র নামে যে অনুষ্ঠানটা হয়, সেই অনুষ্ঠানের কোনও তুলনা নেই। ঢাকাইয়া ভাষায় এমন রসালো বর্ণনা দেওয়া হয় মিলিটারি আর রাজাকার নিধনের, শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা শুনতে শুনতে রক্তে দোলা লাগে। আর ওই যে ওই গানগুলো, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিবরে, অথবা শোনো একটি মজিবরের থেকে লক্ষ মজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ প্রচার করা হয় দু-তিনবার। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আর আছে সেই প্রিয় স্লোগান, জয়বাংলা। জয়বাংলা তো বাঙালি জাতির জীবনমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বজন তো জয়বাংলা ছাড়া কথাই বলে না।
স্বজনের বয়স ষোল বছর। দেখলে মনে হয় বারো-তেরো। সাইজে এত ছোট আর এত রোগা, মনেই হয় না এই ছেলের এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। পাকিস্তানীরা অবশ্য পরীক্ষা একটা নিয়েছে, সেই পরীক্ষা দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরা তো দূরের কথা, মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীদেরও বেশিরভাগই দেয়নি। স্বজনের প্রিয়বন্ধু মামুনও দেয়নি।
স্বজনের বন্ধুদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে বুলু। এক ক্লাসে পড়লেও বুলু ওদের বছর দুয়েকের বড় হবে। ছফুটের ওপর লম্বা, দুর্দান্ত সাহসী ছেলে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই আগরতলায় চলে গেছে ট্রেনিং নিতে। ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় এসেছে। ক্র্যাকপ্লাটুন হচ্ছে বুলুদের গ্র“প। সেই গ্র“পের হয়ে গেরিলা যুদ্ধ করছে। পাকিস্তানীরা যে এসএসসি পরীক্ষা নিচ্ছে সেই পরীক্ষার দুটো কেন্দ্রে গিয়ে গ্রেনেড চার্য করে এসেছে বুলু। এই খবর ইছাপুরায় বসেই পেয়েছে স্বজন। গ্রেনেডের শব্দে পাকিস্তানীদের পিলে চমকে গেছে, ছাত্র-শিক্ষকরা কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে দিকবিদিক ছুটেছে। পরীক্ষা ভণ্ডুল হয়েছে সেদিনকার মতো।
স্বজনের সবচাইতে বড় দুঃখ তার শরীর। শরীরের কারণে সে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেনি। তবে মুক্তিযুদ্ধের খোঁজ-খবরই সে রাখছে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ শুনছে প্রতিদিন। সেখানেই পাওয়া যাচ্ছে সব খরব। আর আছে ইছাপুরা বাজার। বাজারে গেলেও খবরের অন্ত নেই। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে কত যে খবর! গুজবও ছড়াচ্ছে সমানে। গত সাত মাসে কতবার যে গ্রাম ছেড়ে পালাতে হয়েছে মিলিটারিদের ভয়ে।
ইছাপুরা হচ্ছে সিরাজদিখান থানায়। এই এলাকায় মিলিটারি আসে মে মাসের ১৯ তারিখে। তালতলা থেকে সিরাজদিখান পর্যন্ত টহল দেয় তারা, ভয় আর আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করে। সিরাজদিখান বাজারের এক বীর বাঙালি আবদুল আজিজ মিলিটারিদের সামনেই জয়বাংলা স্লোগান দেন। মিলিটারিরা তাকে ধরে নিয়ে বলে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দাও। আজিজ আবার গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেন, জয়বাংলা। মিলিটারিরা তারপর তাকে গুলি করে। শহীদ হন আবদুল আজিজ।
আবদুল আজিজের বীরত্বের কথা এখন মানুষের মুখে মুখে।
সিরাজদিখান এলাকায় রসুনিয়া সিংবাড়িতে এপ্রিল মাসেই একটি আশ্রয় শিবির গড়ে উঠেছিল। মে মাসের ২০ তারিখে এই আশ্রয় শিবির আক্রমণ করে পাকিস্তানীরা। রসুনিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক কান্তবাবু এবং বাড়ির মালিক রামসিংয়ের সঙ্গে আরও সাতজন বাঙালিকে হত্যা করে মিলিটারিরা। তারপর থেকে এলাকার ছাত্র-যুবকরা দলে দলে চলে যায় মুক্তিযুদ্ধে। ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসেছেন অনেকে। এলাকায় নানারকম ছদ্মবেশে তাদের দেখা যায়। বিক্রমপুরে আলবদর আলশামস বাহিনী গঠিত হয়নি। শান্তিবাহিনী হয়েছে। সিরাজদিখান থানায় শান্তিবাহিনীর সদস্য যারা তারা কেউ ইছাপুরার না। রাজানগর-তালতলা ওইসব গ্রামের। এ জন্য ইছাপুরায় স্বজনরা ভাল আছে। মিলিটারি নেই, রাজাকার নেই, আছে মুক্তিযোদ্ধা। এক অর্থে ইছাপুরা হচ্ছে স্বাধীন।
এই স্বাধীন গ্রামে পরাধীন হয়ে আছে স্বজন। বাড়ি আর বাজার, বিকালবেলা ইছাপুরা স্কুলের মাঠ, আশপাশের দুয়েকটি গ্রাম, এর বাইরে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। অথচ স্বজনের মন পড়ে আছে ঢাকায়। গেণ্ডারিয়া গিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছে করে তাদের বাড়িটা। বাড়ি না দেখলেও দুঃখ নেই, যদি একবার শুধু দেখে আসতে পারতো তারা বন্ধু মামুনকে! আহা কতদিন মামুনের সঙ্গে দেখা হয় না।
এত স্বাদের গুড়-মুড়ি ভুলে স্বজন মনে মনে মামুনকে বলল, কেমন আছ, বন্ধু আমার?
তখনই দুই বন্ধুকে দেখতে পেল স্বজন। বাবা আর ধীরেনকাকু। ওই তো দুজনে গিয়ে বসলেন পুকুরঘাটে। এখন ওখানে বসে চা-সিগ্রেট খাবেন আর গল্প করবেন।
বাবা আর ধীরেনকাকুর বন্ধুত্ব হয়েছিল জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় থেকে। প্রথমে জগন্নাথ কলেজ পরে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়লেন দুইবন্ধু। দুজনেরই সাবজেক্ট বাংলা। এমএ পাস করে বাবা ঢুকে গেলেন শিক্ষকতায়, ধীরেনকাকু চলে এলেন গ্রামে। পৈতৃক সম্পত্তি দেখাশোনা করবেন আর গ্রাম উন্নয়নের কাজ করবেন। মাছ চাষ, হাস-মুড়গির খামাড়, ধানের ফলন বৃদ্ধি, বৃক্ষরোপণ অর্থাৎ গরিব মানুষকে তাদের যা কিছু আছে ওই সম্পদ ব্যবহার করে কীভাবে স্বচ্ছল হতে পারে সেই পথ দেখাবার কাজ করবেন। করলেনও তাই। ধীরে ধীরে ইছাপুরা গ্রামটিকে একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে তৈরি করলেন, বহু গরিব পরিবার দাঁড় করিয়ে দিলেন। ওদিকে স্বজনের বাবার রেজাল্ট ভাল, তিনি ঢুকলেন তাঁর প্রিয় কলেজেই। লেকচারার হিসেবে ঢুকে ধীরে ধীরে উন্নতি করতে লাগলেন। এখন এসোসিয়েট প্রফেসর। গেণ্ডারিয়াতে পৈতৃক বাড়ি। তিন ভাই, দুবোন যে যার অংশ ভাগ করে নেওয়ার পরও যেটুকু ভাগে পেয়েছেন তাতে তার জীবন তো ভালভাবে কাটবেই, দুই ছেলে স্বজন বিজনও জীবনটা ভালই কাটিয়ে যেতে পারবে। ধীরে ধীরে জমির দাম বাড়ছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশে উন্নত জীবন হবে মানুষের।
কবে স্বাধীন হবে দেশ?
বোধ হয় বেশি সময় আর লাগবে না। যেভাবে এগুচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা, যেভাবে নাস্তানাবুদ করছে পাকিস্তানীদের! কুকুরগুলো কিছুতেই কুলাতে পারবে না বীর বাঙালিদের সঙ্গে!
বাবার সঙ্গে ধীরেনকাকুর নানাদিক দিয়ে মিল। ধীরেনকাকুরাও তিন ভাই, দুবোন। যে যার ভাগের জায়গা-সম্পত্তি বুঝে নিয়েছে। কিন্তু এ দেশে কেউ থাকে না। সবাই কলকাতায়। এ দেশে শুধুই ধীরেনকাকু আছেন তার ভাগের জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে। অন্যরা বিক্রি করে দিয়েছেন। ধীরেনকাকু সবার বড়। স্বজনের বাবার মতোই। ভাই-বোনরা তাকে বলেছিলেন, কী হবে ওখানে পড়ে থেকে, বিক্রি করে কলকাতায় এসে বাড়ি করো, বাকি টাকা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করো, ভাল থাকতে পারবে।
ধীরেনকাকু তাদের কথা শোনেননি। তার ওই এক কথা, যে মাটিতে জন্মেছি সেই মাটি ছেড়ে যাব না।
স্বজনের বাবার সঙ্গে আরেকটা মিলও আছে ধীরেনকাকুর, তারও দুই সন্তান। তবে দুটোই মেয়ে। মজার ব্যাপার হল মেয়ে দুটো যমজ। নাম হচ্ছে সোনালি-রূপালি। তিনি পিতা হয়েছেন স্বজনের বাবার আগে। সোনালি-রূপালি ভারি সুন্দর মেয়ে। দুজনে দেখতে হুবুহু এক রকম। বাইরের মানুষ বুঝতেই পারবে না কে সোনালি, কে রূপালি। সোনালিকে রূপালি বলে ভুল করে, রূপালিকে ভুল করে সোনালি বলে। স্বজনের এই ভুল তো বহুবারই হয়েছে। যখনই এই বাড়িতে বেড়াতে এসেছে বা ওরা গেছে স্বজনদের বাড়িতে, রূপালিকে কতবার সোনালি বলে ডেকেছে সে।
সোনালি-রূপালি এসএসসি পাস করে কলকাতায় চলে গেছে পড়তে। ধীরেনকাকু চেয়েছিলেন, ঢাকায় থেকে পড়–ক। মেয়েরা রাজি হয়নি। বলেছে কাকু-পিসিদের সঙ্গে থাকবে। বছরে এক-দুবার দেশে আসবে। সারদাকাকীদের সবাই প্রায় কলকাতায়। তিনিও মেয়েদের কথায় সায় দিয়েছিলেন। বেচারা ধীরেনকাকু আর কী করেন! পাঠিয়ে দিলেন মেয়েদের। এখন এ দেশে শুধু তিনি আর সারদাকাকী।
স্বজন মনে মনে বলল, ভালই হয়েছে। যদি ধীরেনকাকুও চলে যেতেন কলকাতায়, তাহলে ওরা এসে উঠতো কোথায়? এত শান্তিতে থাকতে পারতো কার বাড়িতে?
সত্যি এই বাড়িতে খুব শান্তিতে আছে ওরা। বাবা হচ্ছেন পড়–য়া মানুষ। দু-একদিন পর পরই ইছাপুরা হাইস্কুলের লাইব্রেরি থেকে পুরনো দারুণ সব মূল্যবান বই আনছেন আর গোগ্রাসে গিলছেন। বই শেষ হলেই আবার ছুটে যাচ্ছেন লাইব্রেরিতে। বিজনের বয়স বারো বছর। সে পড়ে ক্লাস সেভেনে। স্বভাব পেয়েছে বাবার। সকাল-সন্ধ্যায় নিয়ম করে পড়তে বসছে। দুপুরবেলা বসছে অংক নিয়ে। স্কুল পড়াশুনা সব যেখানে বন্ধ সেখানে বিজন তার মতো করে চালিয়ে যাচ্ছে পড়াশুনা।
পড়াশুনায় মন বসছে না শুধু স্বজনের। তার চিন্তা একটাই, আগে দেশ স্বাধীন হোক, তারপর পড়াশোনা। তার দিন কাটে এদিক-ওদিক ঘুরে আর প্রিয়বন্ধু মামুনের কথা ভেবে। আজ সাত মাস মামুনের সঙ্গে তার দেখা নেই। পরিচয়ের পর থেকে এতদিন একজন আরেকজনকে না দেখে ওরা থাকেনি। ইস কবে যে মামুনের সঙ্গে তার দেখা হবে!
গুড়-মুড়ি শেষ করে পাজামার ওপর নীল শার্টটা পরছে স্বজন, মা জিজ্ঞেস করলেন, চললি কোথায়?
স্বজন হাসল। সব জেনে-বুঝেও রোজই এক প্রশ্ন তুমি করছো, মা? কোথায় আর যাবো? বাজারে?
তা যা। তবে সাবধান। চোখ-কান খোলা রাখবি। তালতলার ওদিকে মিলিটারি আছে, রাজাকার আছে। যখন-তখন এদিকেও আসতে পারে। আর অচেনা লোকদের সঙ্গে কথা বলবি না।
বলতে হবে না, মিলিটারি আর রাজাকারদের খবর তোমার চেয়ে আমি বেশি জানি। একটা টাকা দাও না, মা।
চারদিন আগে না একটাকা নিলি?
খরচা হয়ে গেছে।
চারদিনেই এক টাকা খরচা করে ফেললি? তার মানে প্রতিদিন চার আনা করে। এত পয়সা কিসে লাগে তোর? বিড়ি-সিগ্রেট ধরেছিস নাকি?
কী যে বলো মা! ওসব বাজে ব্যাপারে আমি নেই। তুমি তো জানোই আমার খুব মিষ্টি খাওয়ার লোভ। রোজই বাজারে গিয়ে একটা দুটো রসগোল্লা খাই। নন্দর দোকানের রসগোল্লার কোনও তুলনা নেই মা। দাও না।
আঁচলের গিঁট খুলে এক টাকার একটা কয়েন স্বজনকে দিয়েছেন মা। এই ধরনের টাকাকে বলে কাঁচা টাকা। ওই নিয়ে মহা আনন্দে বাজারে এসেছে সে। এসেই দেখা হল গেণ্ডারিয়ার রফিক ভাইর সঙ্গে। রফিক ভাইকে দেখেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল স্বজন। এই তো গেণ্ডারিয়ার লোক পাওয়া গেছে, সব খবর জানা যাবে তার কাছ থেকে।
রফিক ভাইর বয়স তেইশ-চব্বিশ বছর। পরিপূর্ণ যুবক। তারপরও মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেননি, মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি। কারণ তিনি পঙ্গু মানুষ। ছেলেবেলায় পোলিও হয়েছিল। বাঁপায়ে মাংস বলতে গেলে নেই। শুধুই হাড়। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন। লেখাপড়া তেমন করেননি। স্বজনদের বাড়ির কয়েকটা বাড়ির পর তাদের বাড়ি। বাড়ির নিচতলায় একটা স্টেশনারি দোকান আছে। চালু দোকান। সেই দোকান চালান। অবস্থা মোটামুটি।
রফিক ভাই খুবই সজ্জন মানুষ। মুখে হাসিটা লেগেই আছে। পাড়ার সবাই কম-বেশি তার পরিচিত। সবার খোঁজ-খবরই তিনি রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই দাঁড়ি রেখেছেন। পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি, মাথায় গোল টুপি। এই লেবাসের কারণে এলাকার রাজাকাররা তাকে মোটেই সন্দেহ করে না। কিন্তু সন্দেহের সব কাজই রফিক ভাই করছেন। এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এলাকার টাকা-পয়সাঅলা লোকদের কাছ থেকে টাকা তুলে পৌঁছে দিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। রাজাকারদের খবরা-খবর পৌঁছে দিচ্ছেন। গত সাত মাসে তিন-চারবার এসেছেন ইছাপুরায়। এখানে তার মামাবাড়ি। গেণ্ডারিয়ায় মিলিটারি আসার আওয়াজ পেলেই তিনি দোকান বন্ধ করে ইছাপুরায় চলে আসেন। বাড়িতে বুড়ো বাপ আর মা, দুইবোন আছে তাদের শ্বশুরবাড়িতে। বাবা পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েন। এলাকার মুসলিম লীগার, পাকিস্তান পন্থীদের সবাই তার পরিচিত। তাদের মুখ থেকে মিলিটারি আসার খবর পেয়েই ছেলেকে পাঠিয়ে দেন ইছাপুরায়। কোনও কোনও রাজাকারের কাছ থেকেও খবর পান। কয়েকদিন ইছাপুরায় কাটিয়ে, গ্রীন সিগন্যাল পেলে আবার ঢাকায় ফেরেন রফিক ভাই।
ইছাপুরা বাজারে প্রতিবারই রফিক ভাইর সঙ্গে দেখা হয়েছে স্বজনের। তার কাছ থেকে বাড়ির খবরা-খবর সবই পেয়েছে স্বজন। বাড়ি লুটপাট হয়ে গেছে, রাজা নামের এক রাজাকার দখল করে নিয়েছে বাড়ি। ফ্যামিলি নিয়ে এখন স্বজনদের বাড়িতে থাকছে সেই রাজাকারটি।
থাকুক। দেশ স্বাধীন হলে বুঝবে ঠ্যালা।
বাড়ির খবরা-খবর জানার বিশেষ আগ্রহ নেই স্বজনের। সে শুধু জানতে চায় তার বন্ধু মামুনের কথা। মামুন কেমন আছে?
মামুনের বাবা এলাকার নামকরা ডাক্তার। রশিদ ডাক্তারকে চেনে না এমন লোক গেণ্ডারিয়াতে নেই। লোহারপুলের পুবদিককার ঢালে তার ডিসপেনসারি। দুবেলা ডিসপেনসারিতে বসেন তিনি। রোগী দেখেন। রফিক ভাই তার সঙ্গে নিয়মিতই যোগাযোগ রাখেন। রফিক ভাইর মাধ্যমে তিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা পাঠাচ্ছেন। মামুনের সঙ্গে রফিক ভাইর দেখা হয় না। তবে সে যে ভাল আছে এ কথা তিনি ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে জেনেছেন। মামুন যাতে বাড়ি থেকে না বেরোতে পারে এ জন্য তাকে ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। ন্যাড়া মাথা নিয়ে মামুন এখন বাড়িতে বসে থাকে।
মামুন ন্যাড়া হয়েছে শুনে স্বজনের খুব মজা লেগেছিল। মনে মনে বলেছিল, কী রে টাককুবেল, আছিস কেমন?
রফিক ভাই আজ বসে আছেন কালুর চায়ের দোকানে। হাতে চায়ের কাপ। কিন্তু চায়ে চুমুক দিচ্ছেন না। মুখটা বিষণ্ণ। স্বজনকে দেখে বললেন, খুব খারাপ খবর আছে রে স্বজন। তিনদিন আগে বিকেলবেলা ডিসপেনসারিতে রোগী দেখছেন ডাক্তার সাহবে। মিলিটারি জিপ এল একটা। ডাক্তার সাহেবকে ধরে নিয়ে গেল। পরদিন তার লাশ পাওয়া গেল মিলব্যারাকের ওদিককার বুড়িগঙ্গায়। তিনি যে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা করেছিলেন এ কথা বোধ হয় জেনেছিল রাজাকাররা। তারাই জানিয়েছে মিলিটারিদের। এই ভয়ে আমিও এবার পালিয়ে এসেছি…
রফিক ভাইয়ের শেষ দিককার কথা আর কানে গেল না স্বজনের। মাথাটা এলোমেলো হয়ে গেল। মামুনের বাবা মারা গেছেন? ডাক্তারকাকু মারা গেছেন? মামুন তার বাবাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। বাবাকে ছেড়ে সে তাহলে আছে কেমন করে? কাঁদতে কাঁদতে নিশ্চয় অসুস্থ হয়ে গেছে। যেমন করে হোক মামুনের পাশে গিয়ে তাকে দাঁড়াতে হবে।
গেণ্ডারিয়ার রাজাকাররা তাকে ধরিয়ে দিতে পারে, মিলিটারিরা তাকে গুলি করে মারতে পারে, এ সব কিছুই ভাবল না স্বজন। আচমকা পাগলের মতো লঞ্চঘাটের দিকে দৌড় দিল। পকেটে একটা মাত্র টাকা।

One thought on “বন্ধু স্বজন”

Comments are closed.