অন্তরে

কাল রাতে কী হয়েছিল?

সত্যি কি কেউ ঢুকেছিল আমার রুমে! নাকি পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছিল স্বপ্নে! অবচেতন মনে!

কিন্তু স্বপ্নে এই ধরনের অনুভূতি হয় কী করে?

স্বপ্নে যদি কেউ আমার হাত ধরে, বাস্তবে কি সেই হাত ধরা টের পাব আমি!

এমন কি হয়?

তাহলে ব্যাপারটা আসলে কী?

কোনও অশরীরী ঘটনা!

কিন্তু ওসবে যে আমার একদম বিশ্বাস নেই! ভূত প্রেত আমি মানিই না। কত ভূতের গল্প পড়েছি, হরর মুভি দেখেছি, দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছি। কই কোনওদিন তো এই ধরনের অনুভূতি হয়নি!

কাল রাতের ঘটনাটা মা বাবা ভাইয়া কেউ বিশ্বাস করেনি। ইলেকট্রিসিটির ব্যাপারটা পরিষ্কার না হলে হয়তো কিছুটা বিশ্বাস করতো।

কিন্তু সুমি তার নিজের কাছে একদম পরিষ্কার। ব্যাপারটা সত্যি ঘটেছিল। প্রথমে পায়ে সুরসুরি, তারপর নাভিমূলে, গালে গলায়। সবচে’ আশ্চর্যের কথা হচ্ছে পারফিউমের গন্ধ। এবং গন্ধটা পরিচিত। ওয়ান ম্যান শো।

স্বপ্নে কি কখনও পারফিউমের গন্ধ পাওয়া যায়!

নিজের রুমের জানালার সামনে বসে এসব ভাবছে সুমি। জানালার পর্দা সরানো। এই জানালা থেকে পাশের বাড়ির গাছপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে পশ্চিমের আকাশ কিছুটা দেখা যায়। সকাল এগারটার রোদেলা আকাশ আজ অন্যরকম লাগছে।

এই আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই সুমির এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করল। নূরজাহান বুয়াকে ডাকল সে। চা দিতে বলল।

মতি বড় হয়ে গেছে তারপরও নূরজাহানকে তেমন বয়স্ক লাগে না। বাড়ির কাজের বুয়া সে ঠিকই, ছেলে নিয়ে বিধবা হয়েছে পাঁচ সাত বছর আগে তারপরও ফিগার বেশ সুন্দর নূরজাহানের, চেহারায় কমনীয়তা আছে। চাইলে এখনও বিয়েশাদি আবার করতে পারে সে। কিন্তু সেই মনোভাব নূরজাহানের একদম নেই। সে আছে এই বাড়ির কাজ নিয়ে। কাজে ফাঁকিজুকি কাকে বলে একদম বোঝে না। চলাফেরা উচ্ছল কিশোরীর মতো।

চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে নীচতলার কিচেন থেকে সুমির জন্য চা করে নিয়ে এল নূরজাহান। কিন্তু চায়ের কাপ সুমির হাতে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেরুল না, দাঁড়িয়ে রইল।

চায়ে চুমুক দিয়ে সুমি বলল, কী হলো, দাঁড়িয়ে আছ যে?

আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব।

কী কথা?

কাইল রাইতে কী হইছে?

তুমি শুনলে কার কাছে?

মতি বলল।

ও শুনলো কার কাছে?

তা আমি জানি না।

কী বলল সে?

কইলো রাইতে বলে আপনে ভয় পাইছেন?

চায়ে চুমুক দিয়ে উদাস হল সুমি। হ্যাঁ।

কিসের ভয়? ভূতের?

ব্যাপারটা ভৌতিক। কিন্তু ভূতে আমি বিশ্বাস করি না।

হইছিল কি সেইটা আমারে বলেন।

তোমাকে বলে কী হবে?

সমস্যাটা মনে হয় আমি বুঝুম।

ভুরু কুঁচকে নূরজাহানের দিকে তাকাল সুমি। আমার সমস্যা তুমি বুঝবে কী করে?

নূরজাহান হাসল। আমিও তো মাইয়া মানুষ!

মেয়েমানুষের সঙ্গে ভৌতিক ব্যাপারের কী সম্পর্ক?

সম্পর্ক আছে। আপনি আমারে বলেন।

তোমার এখন কোনও কাজ নেই?

না। সব কাজ শেষ। দুপুরের রান্না হইয়া গেছে। নিজের গোসলটা খালি বাকি আছে আমার। সেইটা পরে করুম।

নূরজাহানের কথা বলার ভঙ্গিটা সব সময়ই ভাল লাগে সুমির। এখনও লাগল।

চা শেষ করে কাপটা নূরজাহানের হাতে দিয়ে বলল, বস।

সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে বসল নূরজাহান।

পুরো ঘটনাটা নূরজাহানকে বলল সুমি।

শুনে তীক্ষ্মচোখে সুমির মুখের দিকে তাকাল নূরজাহান। এইটা তো বড় আজব কাণ্ড। এই বাড়ির আশেপাশে তো খারাপ জিনিস কিছু নাই।

সুমি অবাক হলো। খারাপ জিনিস মানে?

যুবতী মেয়েদের সঙ্গে এই ধরনের কাণ্ড করে বদজীনে।

বদজীন কথাটা শুনে সুমি একটু নড়েচড়ে বসল। বদজীন ব্যাপারটা কী?

খারাপ জীন। জীন হইল দুই রকম। ভাল জীন আর খারাপ জীন। খারাপ জীনগুলিরে বলে বদজীন। মানুষের মধ্যে যেমুন ভাল মানুষ আর খারাপ মানুষ আছে, জীনের মধ্যেও তেমন আছে। ভাল জীনরা মানুষের উপকার করে আর বদজীনগুলি অনিষ্ট করে।

একটা একটা করে বল। ভাল জীনরা কী ধরনের উপকার করে মানুষের?

বহুত রকমের উপকার করে। তারা থাকেন পরহেজগার মানুষের লগে। কামেল দরবেশ পীর ফকিরের লগে। ভাল জীন দিয়া মানুষের অসুখ বিসুখ সারায়া দেন পীর ফকিররা। ধন সম্পত্তি টেকা পয়সাও জোগাড় কইরা দেয় ভাল জীনে। পথের ফকিররে রাজা বাদশা বানাইয়া দেয়। বহুত ঘটনা আছে এই রকম। ভাল জীন যদি কোনও মানুষের উপরে আছড় করে, তারে তারা আর দেশ গেরামে রাখে না। নিজেগ দেশে লইয়া যায়।

জীনদের দেশ কোথায়?

পরিস্থানে।

পরিস্থান তো শুনেছি পরিদের দেশ।

নূরজাহান হাসল। জ্বীন আর পরি তো একই। পুরুষরা হইল জীন, মেয়েরা হইল পরি। ভূত আর পেত্নির মতন। পুরুষ ভূতগুলি ভূত, মেয়েগুলি পেত্নি।

এসব আমি জানি।

জানোনের তো কথাই। এইসব কথা কে না জানে! ভাল জীনরা যে তাগ পছন্দের মানুষরে দেশ গেরামে রাখে না এমুন একটা ঘটনা আমগ গেরামে ঘটছিল।

সুমি অবাক হলো। তাই নাকি?

হ। বলুম ঘটনাটা?

বলো।

আমাগ গেরামে একজন দরবেশ আছিল। খালেক দরবেশ। দরবেশ সাবে যখন ছোট, একদিন দুপুরবেলা ঘরে ঘুমাইয়া রইছে, পাকের ঘরে তার মায় রানতে বইছে, হঠাৎ কইরা মার মনডা কেমুন কইরা উঠল। পোলার মুখটা দেখনের লেইগা পাগল হইয়া গেল। পোলা যেই ঘরে শুইয়া রইছে দৌড়াইয়া সেই ঘরে চইলা আসলো। আইসা দেখে ঘুমন্ত অবস্থায় পোলা তার শূন্যে ভাইসা রইছে। ভাইসা ভাইসা আস্তে আস্তে দরজার দিকে যাইতাছে। এই অবস্থা দেইখা মায় তো একেবারে পাগল হইয়া গেছে। দুইহাতে পোলারে জড়াইয়া ধরছে। বাজান, কই যাস তুই? এই অবস্থায় তুই কই যাস? তখন গায়েবি আওয়াজ হইল, দুনিয়া বড় বদ জায়গা। খালেকরে এখানে রাখুম না। এই আওয়াজ শুইনা মায় দুইহাতে বুকে জড়াইয়া ধরল শূন্যে ভাইসা থাকা পোলা। কইলো, না না,

আমার বুকের ধন আপনেরা নিতে পারবেন না। তারপর খালেক দরবেশরে তারা। রাইখা যায়। তয় যেই জীনে তারে নিতে চাইছিল সেই জীনটা সারাজীবনই দরবেশ সাবের লগে আছিল।

ঘটনাটা যে খুব আলোড়িত করল সুমিকে তেমন নয়। তবু সে বলল, তার মানে এরা হচ্ছে ভাল জীন?

হ।

এবার তাহলে একটা বদজীনের ঘটনাও বল।

তার আগে খালেক দরবেশের ঘটনাটা শেষ করি।

করো।

তারপর হঠাৎ করেই যেন বাড়ির পরিস্থিতিটা বুঝতে চাইল সুমি। তুমি যে এখানে, নীচতলায় কে?

মতি আছে।

মার চেম্বার লক করা তো?

হ। নীচের ঘরদুয়ার বেবাকই বন্ধ।

বাবা বেরিয়েছে কখন?

আম্মার লগেই গেছে। আম্মারে কোটে নামাইয়া দিয়া সিটি করপোরেশান না কই বলে যাইব।

বুঝেছি, বাড়ির ট্যাক্সের ব্যাপারে কী ঝামেলা হয়েছে। ভাইয়া কি আগে বেরিয়েছে?

না। সে বাইর হইছে পরে।

নীচে মতি আছে তো? চোর টোর ঢুকে যাবে না তো?

না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।

সুমি জানালার দিকে তাকাল। পাশের বাড়ি পেয়ারা গাছে দুটো শালিক বসে আছে। এত চুপচাপ শালিক সাধারণত থাকে না। কিন্তু এই শালিক দুটো আছে।

পাখি দুটোর দিকে তাকিয়ে বেশ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল সুমির।

নূরজাহান বলল, খালেক দরবেশের ঘটনাটা শেষ করুম?

নূরজাহানের দিকে তাকাল না সুমি। বলল, হ্যাঁ।

দরবেশ সাব সারাজীবন নীল রংয়ের একখান কাপড় পরতেন। মাইয়া লোকের শাড়ির মতন কাপড়। ওই এক কাপড়ে পুরা শইল ঢাইকা রাখতেন। নীল কাপড় ছাড়া পরতেন না। খালি সিগ্রেট খাইতেন। তেমুন কথাবার্তা মানুষের লগে বলতেন না। রাস্তা দিয়া হাঁটতে হাঁটতে বিড় বিড় কইরা কথা কইতেন, হাসতেন। তাগ বাড়ি থিকা পদ্ম আছিল কাছে। জোসনা রাইতে পদ্মার তীরে গিয়া বইসা থাকতেন, একলা একলা কথা কইতেন। আসলে তো একলা কথা কইতেন না! কইতেন তো জীনগ লগে!

শীতকালেও কি ওই একই কাপড় পরে থাকতেন?

হ। শীত গরম আছিল না তার।

বিয়ে শাদি করেননি?

একথা শুনে উফুল্ল হলো নূরজাহান। এই ঘটনাটাই আপনেরে কইতে চাইতাছি।

বলো।

বয়েসকালে বিয়া ঠিক হইল দরবেশ সাবের। বিয়ার আগের দিন বউরে সাপে কাটল।

মানে? মারা গেলেন মহিলা?

হ। তারপর সারাজীবন দরবেশ সাব আর বিয়া করেন নাই। মানুষে কয় তার লগের জীনেই বলে সাপের রূপ ধইরা তার বউরে কাটছে।

কেন?

দরবেশ সাবে বিয়া করুক, সংসার ধর্ম করুক এইটা জীনেরা চায় নাই।

কারণটা কী?

আল্লায়ই জানে। মনে হয় তারা এই দুনিয়াতে দরবেশ সাবরে বেশিদিন রাখতে চায় নাই। দরবেশ সাবে যদি বিয়াশাদি কইরা সংসার ধর্ম করে, যদি তার বউ পোলাপান থাকে তয় দুনিয়ার মায়া বাইড়া যাইব, বোধহয় এইসব চিন্তা করছে জীনে।

তাহলে তিনি কি কম বয়সে মারা যান?

খুব কম বয়সে না। তয় এসব কামেল দরবেশরা তো মরেন না। তারা শরিল বদলান।

শরীর বদলানো মানে?

এক শরিল ছাইড়া আরেক শরিল নেন। সেই শরিল নিয়া পরিস্থানে চইলা যান। দরবেশ সাবের জীনরাও তারে পরিস্থানে নিয়া গেছে।

ঘটনাগুলো শুনতে ভালই লাগল সুমির। কালরাত থেকে অন্যরকম হয়ে থাকা মন কেমন যেন বদলালো। হালকা হয়ে গেল।

নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে সুমি বলল, এবার বদজীনের কথা বল। যুবতী মেয়েদের সঙ্গে বদজীনের কী সম্পর্ক, বল।

নূরজাহান একটু নড়েচড়ে বসল। বদজীনগুলি যুবতী মাইয়াগ খুব জ্বালায়। দেশ গেরামে শোনেন না, অমুকের বউরে ভূতে ধরছে, তমুকের যুবতী মাইয়ারে ভূতে ধরছে, অল্প বয়সে বিধবা হইয়া আছে কেউ, তারে ধরছে।

ভূত আর বদজীন কী এক নাকি?

একই। কেউ বলে ভূত, কেউ বলে বদজীন। আসলে সব খারাপ জিনিসই ভূত। শোনেন না, খারাপ মানুষরে অনেকে বলে ভূত। খারাপ মেয়েরে বলে পেত্নি।

সুমি হাসল। বুঝেছি।

সুমিকে হাসতে দেখে নূরজাহানও হাসল। এইবার আপনেরে একটা বদজীনের ঘটনা কই। আমগ গেরামে শিরিন নামে একটা মাইয়া আছিল। পাড়া বেড়াইনা মাইয়া। নিজেগ বাড়িতে থাকেই না। এই বাড়িত যায়, ওই বাড়িত যায়। দিন দোফর মানে না, রাইত বিরাইত মানে না। যখন যেখানে মন চায় চইলা যায়। বয়স হইয়া গেছে কিন্তু গরিব মা বাপে বিয়া দিতে পারে না। শিরিনের শরিল স্বাস্থ্য খুব ভাল। এই ধরনের মাইয়াগ পুরুষ পোলারা খুব পছন্দ করে। কিন্তু শিরিনের স্বভাব চরিত্র খারাপ না। নষ্ট মাইয়া না সে। শিরিনের সই আছিল কাজল নামে আর একটা মাইয়া। কাজলের বিয়া হইয়া গেছে। শ্বশুরবাড়ি থাকে সে। যখন নিজেগ গেরামে আসতো, কাজলরে শিরিন নিজের দুঃখের কথা কইতো।

কী দুঃখ?

বিয়া না হওনের দুঃখ।

বলেই মুখ টিপে হাসল নূরজাহান।

তার হাসি খেয়াল করল সুমি। বলল, হাসছ কেন?

ওই যে বিয়া না হওনের দুঃখ কথাটা কইলাম, কইয়া নিজেরই হাসি পাইল। আপনে তো যুবতী মাইয়া, বিয়া না হওনের দুঃখ আপনে বোঝবেন।

কথাটা আসলে বুঝল না সুমি। অবাক চোখে নূরজাহানের মুখের দিকে তাকাল। আমি কিন্তু বুঝিনি।

না বুঝলে ঘটনাটা শোনেন, পরে বুঝবেন।

ঠিক আছে। বল।

সইর লগে বিয়া না হওনের দুঃখের কথা কয় শিরিন, শুইনা সইয়ে কয়, হ লো সই, বিয়া হওনের পর, স্বামীর লগে থাকনের পর আমি চিন্তাই করতে পারি না স্বামী ছাড়া যুবতি মাইয়ারা থাকে কেমনে! সইয়ের এই কথাটা তারপর থিকা খালি মাথায় ঘোরতো শিরিনের। রাইতে ঘুমাইতে পারতো না। এই সময় একদিন বদজীনে ধরল শিরিনরে।

কোথায় ধরল, কীভাবে?

আগে শোনেন না ঘটনা। একদিন সন্ধ্যা বইসা যাওয়ার পর বাড়িত আইসা পাগলামী শুরু করল শিরিন। উল্টাপাল্টা কথা কয়, কাপড় চোপড় খুইলা ফালায়। বাড়ির মুরব্বিরা কইলো, শিরিনরে ভূতে ধরছে। ভূত ছাড়ান লাগবো। ভূত না। ছাড়াইলে এই মাইয়া ভাল হইব না। আমগ পাশের গেরামে বদর নামে একজন ফকির আছে। তার কাম হইল ভূত ছাড়ান। পাঁচ টেকা নিয়া, দুইতিন দিন চেষ্টা কইরা সে ভূত ছাড়ায়। বদররে খবর দেওয়া হইল। পরদিন সন্ধ্যায় বদর আইলো শিরিনের ভূত ছাড়াইতে। বদর ফকিরমানুষ হইলে কী হইব, দেখতে তাগড়া জুয়ান। বদররে দেইখাই পাগলামি শুরু করল শিরিন। কাপড় চোপড় খুইলা ফালাইতে চাইল। শিরিনের চোখের দিকে চাইয়া বদর কইল, তরে আমি চিনা ফালাইছি। পুব পাড়ার বাঁশঝাড়ে থাকছ তুই। তর মতন বদজীন আমি অনেক ছাড়াইছি। খাড়া আইজই তর খবর লইতাছি। তারপর শিরিনের মারে বদর কইল, ঘর আন্ধার করেন। তারবাদে আপনেরা বেবাকতে বাইরে যান। শিরিনের। বদজীন আমি ছাড়াইতাছি। যেই কথা সেই কাজ। সবাই ঘর থিকা বাইর হইয়া গেল। ভিতর থিকা দরজার খিল লাগাইয়া দিল বদর ফকির। বাড়ির উঠানে লোকজন সব খাড়াইয়া রইছে আর বন্ধ ঘরে শিরিনের বদজীন ছাড়াইতাছে ফকিরে। মাঝে মাঝে শুনা যায় বদজীনরে গালিগালাজ করতাছে ফকিরে আর শিরিন গোঙাইতাছে। এইভাবে ঘণ্টাখানেক। তারপর দেখা গেল শিরিন বেহুশের মতো ঘুমাইতাছে। সেই রাইতে পাগলামি আর করল না। ফকির বইলা গেল এইভাবে তিন সন্ধ্যা ছাড়াইতে হইব নাইলে শিরিনরে পুরাপুরি ছাইড়া যাইব না বদজীনে। তারপর দিন সারাদিন ভাল রইল শিরিন, বিকালের দিকে একটু একটু পাগলামি শুরু করল। বদর ফকির আসলো সন্ধ্যাবেলা। আবার আন্ধার ঘরে ভূত ছাড়াইল। তিনদিন পর পুরাপুরি ভাল শিরিন।

সুমির খুবই অবাক লাগছিল। বলল, সত্যি?

নূরজাহান হাসল। আসল ঘটনাটা আগে শোনেন।

আসল ঘটনা আবার কী? সব তো বলেই ফেললে!

বলি নাই। শোনেন। দেড় দুই মাসের মাথায় শিরিন একদিন বমি করতে লাগল।

শুনে চমকাল সুমি। কী?

হ। বেদম বমি।

কেন?

বোঝেন নাই আপনে?

না।

শিরিন পোয়াতি হইয়া গেছে।

তাই নাকি? কীভাবে?

নূরজাহান আবার হাসল। আপনে অহনও অনেক কিছু বোঝেন না। এইডা তো খুব সোজা ব্যাপার। আন্ধার ঘরে তাগড়া জুয়ান বদর ফকির শিরিনের বদজীন ছাড়াইছে কেমনে? পর পর তিনদিন?

সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝে গেল সুমি। শরীরের ভেতর কেমন একটা অনুভূতি হলো তার। একেবারেই অচেনা এক অনুভূতি। ফ্যাল ফ্যাল করে নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে।

নূরজাহান বলল, এইবার আপনেরে আসল কথাটা কই। দুনিয়াতে বদজীন ভূত পেত্নি পরি এইসব আছে কি নাই কেউ জানে না। তবে মাইয়া মানুষের শরিলে আর মনে যে একটা কইরা বদজীন আছে এইডা বেবাক মাইয়া মাইনষেই জানে। যুবতী হইয়া উঠনের পরই বদজীনটা বিরক্ত শুরু করে। সেই বদজীনরে কেউ কেউ দমাইয়া রাখতে পারে, কেউ কেউ পারে না। যারা না পারে তাগ নানান পদের অসুবিধা দেখা দেয়। তয় বিয়া হইয়া গেলে, স্বামীর লগে থাকতে শুরু করলে বদজীনে আর বিরক্ত করে না।

নূরজাহানের কথার অর্থ পরিষ্কার বুঝল সুমি।

কিন্তু তার সমস্যাটা কি ওরকম?

নূরজাহান বলল, আমার মনে হয় মনের বদজীনে আপনেরে বিরক্ত করতে শুরু করছে।

এখন তাহলে কী করা উচিত আমার?

বলব?

হ্যাঁ।

রাগ করবেন না তো?

না।

আপনের বিয়া হইয়া যাওন উচিত।

কিন্তু তুমি যা বলছ ওই ধরনের সমস্যা আমার নেই।

আছে। আপনে বুঝতে পারছেন না।

এবার অন্য একটা কথা মনে পড়ল সুমির। বলল, তাহলে কথা শুরুর প্রথম দিকে তুমি যে বলেছিলে এই এলাকায় নাকি বদজীন নেই, থাকলে তুমি টের পেতে না কী যেন! সেই কথাটার অর্থ কী?

নূরজাহান আবার হাসল। ওই কথার কোনও অর্থ নাই। এমনিতেই বলছিলাম। অর্থ ছাড়াও কত কথা আমরা কই।

আমার মনে হয় তুমি মিথ্যে বলছ।

কেমুন?

আসলে আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করার জন্য, অথবা কালরাতে কী হয়েছে এসব জানার জন্য ওইসব বদজীন ইত্যাদির কথা বলে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছ।

নূরজাহান হাসল। ঠিকই বলছেন।

তারপর উঠল। যাই। অনেক কথা কইলাম আপনের লগে। তয় যা কইলাম বেবাকই সত্য। মাইয়া মানুষের শরিল আর মনেই থাকে বদজীন। এই বদজীন ছাড়ানের একমাত্র পথ হইল বিয়া।

কিন্তু তুমি তো বলেছ বিবাহিত মেয়েদেরকেও বদজীনে ধরে!

হ ধরে! কখন ধরে জানেন?

কখন?

যখন নতুন নতুন বিয়া হয় মেয়েগ, দুই চাইরদিন স্বামীর লগে থাকে। তারপর দেখা গেল বউ রাইখা স্বামী চইলা গেছে দূরে। দুই চাইর ছয়মাস একবছর স্বামী ফিরে না, এই পদের মেয়েগও বদজীনে ধরে।

বলে নূরজাহান আর দাঁড়াল না।

নূরজাহান চলে যাওয়ার পর শুধুই জয়ের কথা মনে পড়তে লাগল সুমির।