কাক ও রসগোল্লা

kakOrosogolla
এই কাকটা বেশি চালাক। বাজারের পাশের জামগাছে থাকে। আরাম-আয়েশেই দিন কাটে। মাছবাজারের ওদিকটায় আস্তাকুঁড়। সেখানে বিস্তর খাবার। মুদি-মনিহারি দোকানগুলোর পেছন দিকটায় পড়ে থাকে নানা রকম বাসি-পচা বিস্কুট, পাউরুটি ইত্যাদি। ইঁদুরের উৎপাত আছে দোকানপাটে। ইঁদুর ধরার কল বসিয়ে সেগুলো ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলে দেওয়া হয়। খাদ্য হিসেবে ধাড়ি ইঁদুর খারাপ না। মাংসের দোকানগুলোর ওদিকে গরু-ছাগলের নাড়িভুঁড়ি বা মানুষ যা মুখে দেয় না ওসব জমা থাকে। অন্যান্য কাকের সঙ্গে এই কাকটাও সেখানে যায়। বেদম খেয়ে পেট-গলা ঢোল করে ফেলে।

ফাঁকে ফাঁকে চুরিচামারিও করে। মাছবাজারে গিয়ে জেলেদের ঝাঁপিতে হঠাৎ করে একটা ঝাঁপ দেয় বা তক্কে তক্কে থাকে কখন জেলে একটু অন্যমনস্ক হবে আর সেই ফাঁকে সে বহন করতে পারে এমন একটা তাজা মাছ নিয়ে উড়াল দেবে। জামগাছে নিজের সংসারে গিয়ে বউ-বাচ্চাদের নিয়ে খাবে।

কখনো মুদিদোকানগুলোর ওদিকে গিয়ে চরে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে কোন জিনিসটায় ছো দেওয়া যায় বা দোকানি কাকের খাওয়ার মতো কিছু ফেলল কি না, ওই নিয়ে উড়াল দেয়। দোকানে কেউ না থাকলে কোন জিনিসটা চুরি করা যায় সেই তালেও থাকে। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের হাত থেকে মজাদার কোনো কোনো খাবার ছো মেরেও নেয়।

সব মিলিয়ে সে আছে বেশ। তবে বড় একটা দুঃখও আছে তার। মিষ্টির দোকানটার ওদিকে গিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারে না। ময়রা লোকটার নাম হরিরাম ঘোষ। যেমন কালো, তেমন মোটা। শীতকাল, গরমকাল সব সময়ই খালি গা, সব সময়ই ঘামছে। পরনে খাটো ধুতি। তবে তার রসগোল্লার সুনাম অনেক। হরিরামের রসগোল্লা বলতে পাগল দশ গ্রামের লোক। দূরদূরান্ত থেকে লোক আসে রসগোল্লা নিতে। তার রসগোল্লা অতুলনীয়। একবার খেলে জীবনভর স্বাদ লেগে থাকবে মুখে। খেলে শুধু খেতেই ইচ্ছা করবে। এত নরম, এত মোলায়েম, মুখে দিলে কোন ফাঁকে পেটে চলে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। বিশ-তিরিশটা খেলেও পেট ভরতে চায় না, খেতেই ইচ্ছা করে। এ জন্য হরিরামের দোকানে খদ্দের লেগেই থাকে।

একজন কর্মচারী আছে দোকানে। তার নাম ভোলা। খদ্দেরদের মিষ্টি মেপেজুকে প্যাকেট করে দেয়। হরিরামের বসার অতিকায় একটা আসন আছে। সেখানে ভুঁড়ি ভাসিয়ে বসে থাকে। মিষ্টি বানাতে বসে দুপুরের পর। তা-ও খুব বেশি বানায় না। তিনটা বিশাল কড়াই আছে। কড়াইগুলো চুলায় বসানোই থাকে। দুপুরের পর ভোলা চুলা জ্বালায়। চিনির সিরা যখন টগবগ করে ফুটতে থাকে, তখন হরিরাম আর ভোলা মাখনের গোল্লা পাকিয়ে ফুটন্ত সিরায় ছাড়ে। তৈরি হয় রসগোল্লা।

ওই সময় দোকানে বেচাবিক্রি বন্ধ।

অবশ্য খদ্দেররা দুপুরের পর আসেও না। সবাই জানে বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে গেলে গরমাগরম রসগোল্লা পাওয়া যাবে। এ জন্য তখন হরিরামের দোকানে ভিড় বেশি। ভোলা মিষ্টি মেপে আর প্যাকেট করে কূল পায় না।

অন্য সময়ে ভোলার কাজ কম। হাতে একটা তালপাখা নিয়ে হরিরামকে বাতাস করে। মিষ্টির আলমারির কাছে, কড়াইগুলোর কাছে মাছি ভন ভন করে। ভোলা সেই মাছিও তাড়ায়।

হরিরামের দোকানের উল্টো দিকে চায়ের দোকান। কাকটা সময়-সুযোগ পেলেই সেই চালায় এসে বসে। লোভী চোখে হরিরামের দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকে।

আহা! একটা রসগোল্লা যদি কোনো দিন খাওয়া যেত!

হরিরামের দোকানে রসগোল্লার অবশিষ্ট বলে কিছু থাকে না। লোকে একেবারে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যায়। কড়াইতে থাকে শুধু চিনির সিরা। আলমারিতে শুধু অন্য দু-চার পদের মিষ্টি। যেমন কালোজাম, বালুশাই, লালমোহন, আমিত্তি ইত্যাদি। ওগুলোর বিক্রি কম। তা-ও হরিরাম বানায়। যদি কেউ চায়!

চায়। ওসব মিষ্টি বিয়ে-শাদির বাড়িতে চলে। দই চলে। এ জন্য দইও বানায় হরিরাম, কিন্তু জনপ্রিয় হচ্ছে তার রসগোল্লা। রসগোল্লা বিক্রির টাকায় সে এখন বড়লোক। দিন যত যাচ্ছে, তত টাকা হচ্ছে তার, তত মোটা হচ্ছে সে। এখন জলহস্তীর সাইজ হয়েছে, কিছুদিন পর স্থলহস্তী হয়ে উঠবে।

হরিরাম একদিন কাকটাকে খেয়াল করল। প্রায়ই এসে ওই চালায় বসে তার দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকে। চায় কী?

খোশমেজাজে থাকলে পশুপাখির সঙ্গে একটু কথা বলে সে। যেমন বাজারের নেড়ি কুত্তাগুলোকে আদর করে ডাকে। কী রে, খবর কী তোদের? আছিস কেমন? খাওয়াদাওয়া হয় ঠিকমতো? এই যে দুটো আমিত্তি দিলাম, খা।

সত্যি সত্যি দুটো আমিত্তি কুকুরগুলোর সামনে ছুড়ে দিল হরিরাম। কুকুরগুলো মনের আনন্দে খেয়ে, দু-একটা ঘেউ দিয়ে চলে গেল।

কয়েকটা মোটাতাজা বিড়াল আছে বাজারে। সেগুলোর সঙ্গেও আহ্লাদ দেখায়। বিড়ালকে সে ডাকে ‘বিলাই’। কী রে বিলাই, খাবি নাকি দুখানা বালুশাই? নে, খা।

দুটো বালুশাই দিল বিড়ালদের। বিড়ালেরা মনের আনন্দে ওখানে বসেই খেল আর নয়তো মুখে নিয়ে আড়াল দেখে দৌড় দিল।

কয়েক দিন কাকটাকে লক্ষ করে একদিন তার সঙ্গেও কথা বলল হরিরাম। কাককে সে ডাকে ‘কাউয়া’। হাতের ইশারায় আদর করে কাকটাকে ডাকল। এদিকে আয় রে কাউয়া। ওখানটায় বসে থাকিস, তাকিয়ে থাকিস আমার দিকে, মতলব কী? চাস কী?

কাক কী বোঝে কে জানে, দুবার কা কা করল।

হরিরাম যেন আর্তিটা বুঝল। মিষ্টি খেতে চাস নাকি?

কাক আবার কা কা করল।

বুঝেছি বুঝেছি, মিষ্টি খেতেই চাচ্ছিস। তা কোনটা খাবি বল?

কা কা।

রসগোল্লা? রসগোল্লা খেতে চাচ্ছিস?

কা কা।

বুঝেছি বুঝেছি। আর বলতে হবে না!

ভোলা নেই। দোকান ফাঁকা দেখে বাজারের দিকে চক্কর খেতে গেছে। সে থাকলে হরিরামের নড়াচড়ার দরকার হয় না। এখন সে একটু নড়ল। গতকালের একটা কোনা ভাঙা রসগোল্লা রয়ে গেছে কড়াইতে। সেটা তুলে দোকানের সামনে রাখল। সঙ্গে সঙ্গে কাক লাফ দিয়ে এল, রসগোল্লা নিয়ে আগের জায়গায় বসে খেতে লাগল। এক ফাঁকে দুবার কা কা করল। হরিরামকে ধন্যবাদ দিল।

ওই এক রসগোল্লা খেয়ে কাক গেল পাগল হয়ে। আরে সর্বনাশ! রসগোল্লা জিনিসটা এত মজার! এত স্বাদের! আ হা হা হা, রোজ যদি একটা-দুটো রসগোল্লা খাওয়া যেত, তাহলে কাকজীবনটা ধন্য হতো।

কাক তারপর রোজ যখন-তখন হরিরামের দোকানের দিকটায় আসে। চায়ের দোকানের চালায় বসে বুভুক্ষুর মতো তাকিয়ে থাকে দোকানের দিকে। কখনো কখনো হরিরামের দোকানের সামনে এসে হাঁটাহাঁটি করে। তার পায়ের কাছেও চলে আসে।

হরিরাম তাকে আরও দু-একবার রসগোল্লা দিল। তাতে কাকের লোভ আরও বাড়ল।

হরিরাম মোটা হলে কী হবে, তার বুদ্ধি খুবই চিকন। একদিন বুঝে গেল, না, ফাজিলটার ধরন তো ভালো না! বেজায় লোভী! লোভীটাকে শাস্তি দিতে হয়!

কী শাস্তি দেওয়া যায়?

এক বিকেলে শাস্তির ব্যবস্থা করল হরিরাম। রসগোল্লা যা বানিয়েছিল, সবই বিক্রি হয়ে গেছে। শুধু একটা রসগোল্লা সে ইচ্ছা করে সরিয়ে রেখেছে। কাস্টমাররা চলে যাওয়ার পর দোকান ফাঁকা। কাজ নেই দেখে ভোলা গেছে চক্কর খেতে। কাকটা ঘুরঘুর করছে দোকানের সামনে। হরিরামের দিকে তাকায় আর কা কা করে।

সরিয়ে রাখা রসগোল্লাটা সামনের কড়াইটাতে ফেলল হরিরাম। কড়াইতে বেজায় গরম চিনির সিরা। রসগোল্লা বিক্রি হয়ে গেছে, সিরা রয়ে গেছে। আর এত গরম সিরা, ওই জিনিস সারা রাতেও ঠান্ডা হয় না।

কাকটা হরিরামের কাজকারবার খেয়াল করছিল।

রসগোল্লাটা কড়াইতে ফেলে নিজের আসনে বসে ঘুমের ভান করল হরিরাম। চোখ বুজে নাক ডাকাতে লাগল। গোঙ গোঙ…

কাক ভাবল, এই তো সুযোগ! পা টিপে টিপে যাই কড়াইটার কাছে। ঠোঁট ডুবিয়ে রসগোল্লাটা তুলে আনি।

যেই মতলব সেই কাজ। এখন আর সাবধানতার দরকার নেই। কড়াইতে ঠোঁট ডুবিয়ে রসগোল্লাটা তুলে নিলেই হলো।

কাক কড়াইয়ের কাছে গেল। দিকপাশ না তাকিয়ে ঠোঁট এমনভাবে চিনির সিরায় ডোবাল, মুহূর্তমাত্র, রসগোল্লা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারল না, কাকের অত শক্ত ঠোঁট চিনির ভয়াবহ গরম সিরায় পুড়ে বাঁকাচোরা হয়ে গেল। ত্রাহি একটা ডাক ছাড়ল সে।

হরিরাম তখন চোখ খুলেছে, নাক ডাকা বন্ধ করেছে। মুখে মিটিমিটি হাসি। কী রে কাউয়া, রসগোল্লা খাওয়ার সাধ মিটেছে?

কাক তখন আর্তচিত্কার ছাড়তে ছাড়তে জামগাছের দিকে উড়াল দিয়েছে। ঠোঁট দুমড়ে-মুচড়ে বীভত্স। তারপর থেকে ভুলেও হরিরামের দোকানের দিকে আর আসে না।