একটি বহুশ্রুত প্রবাদ- ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। আমাদের দেশে এই প্রবাদটি এখন আর প্রবাদ হিসেবে নেই, যত্রতত্র এর যথেষ্ট ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন ধরুন হেলপার যখন কোনো গাড়ি চালানায় হেল্প করার বদলে সেলফ্ ড্রাইভিংয়ে নিয়োজিত হয় এবং ড্রাইভিংয়ের সেন্স না থাকলেও অনেক ড্রাইভার লাইসেন্স পেয়ে যায় তখন স্বভাবতই যাত্রীদের সেন্স থাকার কথা নয়। তবুও মানুষ গাড়িতে চড়ে, দুর্ঘটনায় পড়ে, তারপর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে তখন এই প্রবাদটি মনে পড়ে ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’। এই বৃদ্ধির কারণে টনক নড়ায় সংশ্লিষ্ট সবাই বেশ নড়েচড়ে উঠেন এবং বেশ কিছুদিন এই নড়াচড়া থাকে। তারপর আবার সেই পূর্বাবস্থা- অর্থাৎ ‘যেই লাউ সেই কদু’। আর আমাদের এ ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এই প্রবাদটিরও বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যে কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে, প্রাণহানি বাড়ছে। শুধু ঢাকার বাইরেই নয়- ঢাকা শহরেও দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে বহুগুণ। যানজট যে শুধু যানবাহনের কারণেই ঘটে তা নয়, অনিয়ম যান চলাচল, নিজের জীবন বাঁচানো এবং জন সচেতনতার অভাবেও এমনটি ঘটে। রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও চলমান যানবাহনের (বাস, কার, ট্রাকের) মধ্য দিয়ে দৌড়ে, থেমে, ছুটে, হেঁটে, কখনও লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে রাস্তা পারাপার হতে দেখা যায় অনেককে। এই পারাপার করতে গিয়ে পরপারে যাওয়ার আশংকাও যেন তাদের কাছে কিছু নয়। এ জন্যে শুধু চালকই নয়-পথচারীরাও দায়ী। যদিও জ্যাম নগরী এই ঢাকা শহরে ইচ্ছে করলেও কেউ অতি গতিবেগে গাড়ি চালাতে পারে না। কারণ এখানে আমাদের নিত্যসঙ্গী যানজট। খাঁচায় বন্দি পাখিকে ছেড়ে দিলে সে যেমন কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা উড়ে চলে যায়, তেমনি রাস্তার যানজট ছাড়লেই কিছু কিছু চালক বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে শুরু করেন। যেন যান চলাচল প্রতিযোগিতায় তাকে প্রথম হতে হবে। আর এই বেপরোয়া গাড়ি চালানোর ফলে অনেক সময় ঘটে যায় মারাত্মক দুর্ঘটনা। আজকাল প্রায়ই ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় দেখা যায় কিছু অসতর্ক পথচারী মাঝ রাস্তা দিয়ে নিশ্চিন্তে হেঁটে যাচ্ছেন এবং নিজেই ট্রাফিক হয়ে হাত উঁচিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। দূরে বেগবান গাড়ি অথচ নির্বিকার পথচারী। তার এই নিশ্চিত হাঁটার কারণ বোধকরি সে নিশ্চিত- তাকে কেউ মারবে না। মেনে নিলাম কোনো বোধবুদ্ধিসম্পন্ন চালক ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটাবে না কিন্তু ইঞ্জিন যদি বিগড়ে যায়- গাড়ির ব্রেক যদি কাজ না করে? ইঞ্জিনেরতো কোনো বোধবুদ্ধি নেই- তাই চালক ইচ্ছে করলেও অসতর্ক পথচারীকে বাঁচাতে পারবে না। কেউ একবারও ভাবছেন না যে কোনো সময় এই ইঞ্জিন চালিত গাড়িটি চালকের কথা নাও শুনতে পারে। চালক এবং গাড়ি দুটোই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যেতে পারে। ফলে একজন পথচারীই শুধু নয় এতে মুত্যৃশংকা থাকে অনেক বাসযাত্রী এবং পথচারীর। আমরা পত্রিকার পাতায় প্রায়ই দেখি ব্রেক ফেল করায় চালক নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। সুতরাং পথচারীরা তাদের নির্ধারিত জায়গা দিয়ে পথ চললে সবার জন্যই মঙ্গল। হঠাৎ হাত উঁচিয়ে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হওয়াই ভালো। নিয়ম জানা এবং নিয়ম মানা আজকাল দেখাই যায় না। এইতো কিছুদিন আগে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে গাবতলী বাসটার্মিনালের সামনের রাস্তায় যাতে গাড়ি দাঁড়াতে না পারে সেজন্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়ার ফলে রাস্তাটির যানজটমুক্ত অবস্থা দেখে ঢাকা টু আরিচা এবং ঘাটের ফেরি পার হয়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতকারী যাত্রীরা খুশি হয়েছেন। কারণ ঢাকা থেকে বের হতে গেলেই গাড়িটি গাবতলী এসে আটকে যেত অবৈধ বাস পার্কিংয়ের কারণে। গাড়ি সরিয়ে রাস্তাকে তার পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে নগরবাসীকে যানজটমুক্ত রাস্তা উপহার দেয়ায় নগরবাসী আনন্দিত।
শুধু তাই নয় রাস্তার পাশেই বিশাল সাইনবোর্ড ‘দাঁড়ালেই দণ্ড’। আমি নিজেও ঐ রাস্তা দিয়ে যাবার সময় ফাঁকা রাস্তা এবং সাইনবোর্ডটি দেখে খুশিই হয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পর আবার সেই প্রবাদ, ‘যেই লাউ সেই কদু’। সাইনবোর্ডগুলো যেন সবাইকে উপহাস করছে। সাইনবোর্ডের পাশেই দাঁড়ানো পুলিশ। আর পুলিশের পাশেই দণ্ডায়মান বাস। বাসের এই অবৈধ পাকিং দেখে যার দণ্ড দেবার কথা তার কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় না সাইনবোর্ডে যা লেখা আছে তা প্রয়োগ করার আদৌ কোনো ইচ্ছে তার আছে। সাইনবোর্ড থাকলেই কি আর না থাকলেইবা কি। এই ঢাকা শহরে আইন মানা নিয়ে এমনি অনেক সাইনবোর্ড আছে। সাইনবোর্ডে লেখা আইন ভাঙার ফাইনও আছে। আবার ফাইন না দিয়ে আইন ভাঙার লাইনও আছে। আসলে ঢাকা শহরে অনেক কিছুই লেখায় আছে কিন্তু দেখায় নাই। যেমন বিভিন্ন রাস্তায় আর একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে ‘এখানে বাস স্টপেজ নাই’, তারপরও আইন প্রয়োগকারী মানুষের সামনেই বাস থামছে। যাত্রী নামছে। অর্থাৎ লেখা থাকুক যাই-তারপরও আমরা থামাতে চাই এবং থামাই-যাত্রী ওঠাই-নামাই, কি লেখা আছে তা নিয়ে কেউ কি মাথা ঘামাই? কিছু রাস্তায় লেখা আছে, ‘রিকশা ভ্যান চলাচল নিষেধ’। তারপরও সেসব রাস্তায় রিকশা ভ্যান চলছে। কিন্তু পুলিশ? যাদের কিছু করার কথা তারা কি কিছু বলছে? একবার একটি রাস্তায় লেখা দেখলাম, ‘এখানে গাড়ি থামানোর চিন্তাও করবেন না’ অর্থাৎ মানুষের চিন্তাশক্তি যাতে গাড়ি থামানোর জন্য কাজ না করে সেজন্যে সর্তক বার্তা। তারপরও শুধু চিন্তাই নয়- সারি সারি গাড়ি ওখানে থেমে আছে। যারা থামাচ্ছেন তারা জানেন কেউ তাদের ধরবে না। ফলে চিন্তা করে বা না করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে যাত্রী নামিয়ে, যাত্রী ভরে চলেছে গাড়ি। কেউ কিছু মানছে না, কারো কথা শুনছে না। এ এক সাংঘাতিক রোগ। এ যেন আমার খুশি আমি চলবো, যেমন খুশি তেমন চলবো। এই জমানায় কি যে মানার, কি না মানার, কি যে জানার, কি না জানার তা বোধহয় জানা এবং মানা এখন অনেক ক্ষেত্রেই অবাস্তব। এরপর আছে যানজটের জটিল জট। এই জট শহরের অতি চেনাজানা-দেখাশোনা যানজট। এই জট কিছুতেই ছাড়ছে না বরং দিনে দিনে বাড়ছে। যেখানে আটকে গ্যালে কি হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। জটাধারীর চুলের জটের চেয়েও জটিল এই জট নিয়ে বলার গতি বাড়লেও চলার গতি বাড়েনি। তবে এইসব বলাবলিতে সাময়িক কিছু হলেও কিছুদিন পরেই আবার সেই প্রবাদ, ‘যেই লাউ সেই কদু’। জানি না এ থেকে আমরা কবে মুক্তি পাবো?
লেখক: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী