এবারে কোথাওই বৃষ্টি নেই। শান্তিনিকেতনেও নয়। শান্তিনিকেতনের বসন্ত ও শীতের মতো। বর্ষাকালটাও সমান উপভোগ্য। এখানে আমার এই পর্ণকুটির বানাবার পর থেকে প্রায় গত বছর দশেক পুজোর লেখালেখি এখানে বর্ষাকালে এসেই সারি। বি এস এন এল এর সার্ভিসের যা অবস্থা হয়েছে ফোন থাকা-না-থাকা একই কথা। তাই ফোনও তুলে নিয়েছি। মালিকে একটি। মোবাইল কিনে দিয়েছি। তাতেই সে কলকাতাতে ফোন করে। আমরাও কলকাতা থেকে করি। তাতে অনেক সাশ্রয়ও হয়। বছরের অধিকাংশ সময়ই ফোন খারাপ থাকে, একটু ঝড় বৃষ্টিতেই তার ছিঁড়ে যায়, বি এস এন এল এর কর্মীরা কথায় কথায় চক্ষুলজ্জাহীনের মতো টাকা চান। অধিকাংশ কর্মী অফিসের বাইরের গাছতলার চাতালে বসে আড্ডা মারেন। কর্ম-সংস্কৃতি বলে। কিছুমাত্রই নেই। কর্মসংস্থানের কথা প্রায়ই শোনা যায় গমগমে গলাতে মাইকে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্কৃতি মরে গেছে। বলতে গেলে, জ্যোতিবাবুর আমল থেকেই।
তেমনই এক আজব প্রতিষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎপর্ষদ। এইরকম আন্দাজি অগ্রিম বিল করার রেওয়াজ পৃথিবীর অন্য কোথাওই আছে কী না জানি না কিন্তু এই রকম অযৌক্তিক পদ্ধতির পেছনে যুক্তিটা যে কী থাকতে পারে সে সম্বন্ধে কোনো সদুত্তর তো দূরস্থান কোনো উত্তরই। কোনোদিন পাওয়া যায় নি। সরকারেরও কোনো হেলদোল নেই। কিছু বলতে গেলেই স্থানীয় অফিস সিউড়ি দেখিয়ে দেন। মহাকরণে লিখলেও কোনো জবাব আসে না, যদি-বা আসে তা। অটোক্র্যাটিক। আমাদের মতো অবসরপ্রাপ্ত গরিব মানুষদের পক্ষে এই অন্যায়ের প্রতিকার। করার কোনো উপায়ও নেই। উপায় হয়তো আছে। তা হল দমদম দাওয়াই। মাওবাদীরা দিনে দিনে যে প্রভাব বাড়াচ্ছে তার কারণ বোঝা যায়। যেদিন বি এস এন এল বা বিদ্যুৎ পর্ষদের দু-একজন-এর লাশ পড়বে সেদিন হয়তো এঁদের টনক নড়বে। সবিনয়ে, মুখের কথায় অথবা চিঠি লিখে এই সব অন্যায়ের সুরাহা যদি না হয় তবে যা ভবিতব্য তাই হবে। সরকারি কর্মীরা যদি তাঁদের অদৃষ্টে কী আছে তা এখনও না বুঝতে পারেন তাহলে তাঁদের নিজেদেরই ধন্যবাদ দিতে হবে। পরে কেঁদে কোনো লাভ হবে না। বাঙালি জাতটার আত্মসম্মান জ্ঞানই লোপ পেয়ে গেছে। বিশেষ করে সরকারের ছত্রছায়ায় যাঁরা আছেন। অথচ সরকার তাঁদের মাইনে এবং অন্যান্য সুখ সুবিধা বাড়িয়েই যাচ্ছেন। বেসরকারি সংস্থাতে যাঁরা কাজ করেন, অসংগঠিত পেশাতে যেসব। কোটি কোটি মানুষ আছেন তাঁরা যেন মানুষই নন। তাদের দুঃখ কষ্ট সরকার দেখেও দেখেন না। এইরকমভাবে যে আর কতদিন চলবে তা ঈশ্বরই জানেন। একটা সময় আসবে যখন আর চলবে না। হয়তো তখনই বাবু আর সাহেবদের টনক নড়বে। আমাদের বন্ধু ছিলেন ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির এককালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর পি বি ঘোষ। তিনি যখন শান্তিনিকেতনে বাড়ি করেন তখন তাঁর বৈদ্যুতিক লাইন কিছুতেই আসে না। তখন আমাদের আরেক বন্ধুস্থানীয় অ্যান্ড্র ইউল কোম্পানির ডিরেক্টর পি আর রয়, তাঁকে বলেন যে, পয়সা না। দিলে জীবনেও লাইন পাবে না। অতএব কোনো ফিক্সারের সাহায্যে বহুদিন ধস্তাধস্তি করে ঘোষ সাহেব লাইন পান। এ একেবারেই লজ্জা মান ভয় তিন থাকতে নয় অবস্থা। সবাই জানে, সবাই দেখে, সবাই শোনে কিন্তু করে না কেউই কিছু। অবশ্য করবার কিছু নেইও। দমদম দাওয়াই-ই একমাত্র পথ। আর শুধু নীচুতলাতেই নয়, ডালহৌসির লাল বাড়ি অবধি এই। দাওয়াই-এর প্রয়োগ করার প্রয়োজন এসেছে। পিচকুড়ির ঢাল-এ দাঁড়িয়েছিল শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। এবারে বৃষ্টি না হওয়ায় পিচকুড়ির ঢাল-এও জল নেই।
একটু পরে ট্রেন ছাড়ল। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেল শান্তিনিকেতনে। মমতা ব্যানার্জি নতুন রেলমন্ত্রী হবার পরে দু-টি এসি কোচ দিয়েছেন এই ট্রেনে। যখন কোনো অনুষ্ঠান থাকে তখন-তো খুবই উপকারে লাগে। অন্য সময়েও হাত-পা ছড়িয়ে যাওয়া যায়।
স্টেশনে আমার মালি মান্টু আসে। সঙ্গে সন্তোষ, স্যুটকেসটা নামিয়ে নিয়ে সাইকেল-রিক্সাতে তুলে দেয়। আজকাল এখানে আমার মতো গরিব এবং কিছু পুরোনো স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া সকলেই হয় নিজস্ব গাড়ি নয় প্রাইভেট ট্যাক্সি করেই যাতায়াত করেন। পুরোনো শান্ত, প্রায় নিস্তব্ধ ও নিরাপদ শান্তিনিকেতনের পরিবেশই নষ্ট করে দিয়েছে এই গাড়ির মিছিল। বড়োলোকেরা-তো চড়েনই, অনেকে আবার বড়োলোকি দেখাবার জন্যেও চড়েন।
আমাকে রিক্সাতে চড়িয়ে দিয়ে সন্তোষ নিজে পেছনে পেছনে সাইকেলে আসছিল। সাইকেলটা স্টেশনের সাইকেল রাখার জায়গাতে রেখেছিল। সচরাচর ও স্টেশনে আসে না। ও আমার পার্মানেন্ট লোকও নয়। আমি যে ক-দিন থাকি ও বাগান পরিষ্কার করার জন্যে, ফাই-ফরমাস খাটবার জন্যে এবং আমার গা হাত পা টিপে দেবার জন্যে আসে। আসলে ওকে ডাকবার। দরকার তেমন নেই কিন্তু মানুষটা ভারি ভালো এবং বড়ই গরিব। তা ছাড়া, আমি যতদিন থাকি সে ক-দিন মালি মান্টু আর তার বউ সতীর সঙ্গে ও একবেলা খায়ও। খেয়ে দেয়ে একটু জিরিয়ে, বিকেল তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ চলে যায়। সত্যি বলতে কি ওকে সাহায্য করার জন্যেই আমি এখানে এলেই ওকে ডাকতে বলি মান্টুকে। সাইকেল রিক্সা চলছে কাঁচোর-কোঁচর করে। পেছনে পেছনে সন্তোষ আসছে সাইকেলে। টুকটাক কথা বলতে বলতে আমার সঙ্গে। আমার বাড়ি স্টেশন থেকে অনেক দূরে। পূর্বপল্লী-রতনপল্লী এই সব পশ জায়গাতে বাড়ি বানাবার সামর্থ্য আমার নেই। প্রান্তিক স্টেশনের কাছে বছর দশেক আগে সস্তায় পাঁচ-কাঠা জমি কিনে ছোট্ট বাড়ি বানিয়েছিলাম। পর্ণকুটির বাড়িটি দেড় কাঠার ওপরে। বাকিটা বাগান।
গাছগুলো কেমন আছে রে সন্তোষ? আয়লাতে কি খুবই ক্ষতি হয়েছে?
মায়ের লাগানো কাঞ্চন গাছটা তো একেবারে উপড়ে গেছে। ছায়াটাই নড়ে গেছে বাড়ির সামনেটা থেকে।
আরেকটা কী লাগানো হয়েছে?
কী করে হবে? আপনি বা মা কেউই তো আসেননি তার পরে। আপনি এসেছেন। এবারে লাগাবে মান্টু নার্সারি থেকে এনে কাঞ্চন। যদি বর্ষা হয় তবে জল পেয়ে তরতরিয়ে বেড়ে যাবে। আর কী লাগিয়েছে?
আর কী? গতবারে সেই বনবিভাগের সাহেবের কাছ থেকে চেয়ে এনে জারুলের চারা লাগিয়েছিল একটি। সেটা ছিলই প্রায় কোমরসমান, এক জলেতেই বুক সমান উঁচু হয়ে গেছে। আর বাসন্তী গাছদুটোর একটা যে আয়লাতে ভেঙে গেছিল, সেটা আবার মাথা উঁচিয়ে উঠছে। মনে হয়, পুরোপুরি দাঁড়িয়ে যাবে গাছটা। মান্টু বলেছিল ফুরুশ গাছ আর পাতাবাহার আমার লেখার টেবলের সামনে লাগাবে। লাগিয়েছে?
হ্যাঁ। আর সমীরবাবুকে গরমের সময়ে পাখিদের চান করার আর জল খাবার জন্যে যে সিমেন্টের গামলা করে তা বাঁশঝাড়ের পায়ের কাছে পুঁতে দিতে বলেছিলেন, তিনি তাও করে দিয়েছেন। পাখি আসে?
আসবে না? যে গরমটাই পড়েছিল এ বছরে। পাখিরা মনের সুখে চান করেছে আর গান গেয়েছে। আর জলও খেয়েছে, ইচ্ছে মতো ডানায় ডানায় জল ছিটিয়েছে।
বাঃ। এটা একটা পুণ্যর কাজ করেছেন সমীরবাবু।
ভগবান ওঁর ভালো করবেন।
ভগবান!
হ্যাঁ।
ভগবান আছেন না কি?
ভগবান নেই? নিশ্চয়ই আছেন।
কত ডাকছি বাবু আয়লার পর থেকে। সাড়াই তো দেন না। ওঁর কোনো মোবাইল নম্বর আছে কি? থাকতে পারে। তবে আমার জানা নেই। তারপর বললাম, আয়লার সঙ্গে শান্তিনিকেতনের কী? এখানে তো তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। হয়নি কী বাবু। কত গাছ পড়ে গেল। আমার বাড়িটাও তো। পড়ে গেল। মাটির বাড়ি–একেবারে কোপাই-এর পাশে। একটু হলে বাড়িতেও জল উঠত। নদীর জল যে খুবই বেড়ে গেছিল। এখন নীচে ইটের গাঁথুনী দিয়ে বাড়িটাকে মেরামত না করতে পারলে বউ-বাচ্চা নিয়ে একেবারে বাস্তুহারা হব।
কত খরচ হবে?
এখন ইঁটের যা দাম। পাঁচ হাজার টাকা তো ইঁটেরই দাম।
অত টাকা তো আমার কাছে নেই রে সন্তোষ। পুজোর আগে একবার আসব। পুজোর লেখার টাকা যদি পাই কিছু পুজোর আগে, তাহলে তোকে দেব।
যদি দেন তাহলে মাকে বলবেন না বাবু।
কেন?
ও হিংসা করে। ওর বোনের বিয়েতে যে বাউটি বানিয়ে দিলেন দশ হাজার টাকা দিয়ে তা ওর বউ সতী আমাকে বলেছে কিন্তু ও চেপে গেছে।
তাকে কী হয়েছে? তোর চিকিৎসার জন্যে যে কতটাকা দিয়েছিলাম।
তোর অপারেশনের সময়ে তুই সাইকেলটা পুরো দামে বাঁধা রেখেছিলি, তাও যে ছাড়িয়ে দিলাম এসব কথাও তো তুই ওকে বলিসনি।
আপনি কি ওকে বলে দিয়েছেন বাবু?
না। আমি কেন বলতে যাব।
তারপর বললাম, দ্যাখ সন্তোষ, তুই তো আমার সবসময়ের লোক নোস–মান্টু আমার সবসময়ের মালি। ও-ই বাড়ির দেখাশোনা করে। সব ঝামেলা সামলায় আর তুই তো আমি এলে আমার খিৎমদদারি করিস একটু, তাও একবেলা। তাও বছরে আমি কতদিনই বা আসি–সব মিলিয়ে মাসখানেকও নয়।
–আপনি যে ওকে অতবড়ো টিভি কিনে দিলেন, লোডশেডিং-এর সময়ে ইনভার্টারে যে আলো জ্বলে তাও লাগিয়ে দিলেন পনেরো হাজার টাকা দিয়ে…
সে সব তো আমি আমার লেখার সুবিধের জন্যেই লাগিয়েছি। শান্তিনিকেতনের বিজলী আলো তো ইলেকট্রিকের বাবুদের দয়াতেই জ্বলে। তাঁরাই তো ভগবান। অথচ এখানে, আমার কথা বলছি না, আমি তো ফালতু। কত জ্ঞানী-গুণী মানুষরা থাকেন, কাজ করেন, কত অধ্যাপক, গায়ক-গায়িকা, চিত্রী, পৃথিবী বিখ্যাত সব মানুষ তাঁদের জন্যেও এঁদের এতটুকু ভাবনা নেই। এ এক অদ্ভুত দেশ রে সন্তোষ। তোর ভগবান-এর এখানে বাস নেই। তাঁরও কোনো ঘর থাকলে অন্যরকম হতে পারত হয়তো ঘটনাটা।
সন্তোষ বলল, গোয়ালপাড়ার আর শ্যামবাটীর অল্পবয়সি ছেলেরা বলেছে একদিন দল বেঁধে এসে ভালো করে ঠেঙিয়ে দিয়ে যাবে এদের। নকশালরাও ঘোরাঘুরি করছে। জানেন তো একটা সময়ে শান্তিনিকেতনে মাওবাদী বা নকশালদের খুবই দৌরাত্ম ছিল। আমরা তখন ছোটো। বুড়োরা বলছে, ওরা ছাড়া গতি নেই। তবে আমার কোনো লাভক্ষতি নেই। আমার তো বাড়িতে ইলেকটিরিই নেই। ইলেকটিরির কথা ছাড়ুন। কত কথা বলব। সেই যে আমার পেটের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তিনবছর ভুগলাম, প্রণব মুখার্জির রাজত্ব সিয়ানে গেলাম, এখানের ডাক্তার দেখালাম–দু-বার অপারেশন করলাম, ঘরের পাশের জমিটা বিক্রি করে দিয়ে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে–কই? তাতেও কি সুস্থ হলাম? আপনি তো চিঠিও লিখে দিলেন দু-দুবার। তাতে কী হল? ডাক্তার যত্ন করে দেখলেন বটে তবে ফিস কি কমালেন? সবই সমান। ডাক্তারেরা নামেই। সরকারি ডাক্তার সবাই পেরাইভেট প্যাকটিস করেন।
তারপরে বললাম, আমার চিঠির কী দাম! আমি তো এম এল এ বা এম পিনই। তোর বড়ো ছেলেটা তো পড়াশুনো করছিল, পড়াশুনোতে তো ভালোই ছিল, সে কোন ক্লাসে উঠল?
–কোথায় আর উঠল। দু-জায়গায় টিউশানি নিতে হত। না নিলে পাশ করাবে না। সে গুচ্ছের টাকা। আর চালাতে পারলাম না। স্কুল ছাড়িয়ে এখন আমার বড়োশালার কাছে ছুতোর মিস্ত্রির। কাজ শেখাচ্ছি। বিনি পয়সাতে থাকে খায়। এখনও রোজগার করার মতো কাজ শেখেনি। আমার শালাও তো গরিবই, তারও তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তবে আশা করছি। আর দেড় বছরের মধ্যে কাজ পুরো শিখে গেলে বাড়িতে দিতে পারবে কিছু।
এই লাগাতার অভাবের কথা, অসুবিধের কথা শুনতে ভালো লাগে না। আমি এখানে আসি প্রেমের গল্প লিখতে, ফুল দেখতে, পাখি দেখতে, সবুজ দেখতে, আপটেড হাওয়া খেতে, মেঘের খেলা দেখতে, বৃষ্টি পড়া দেখতে। কলকাতাতেও নিঃশ্বাস ফেলার সময়ই পাই না। তাই এই অবিরাম প্যানপ্যানানি কাঁহাতক ভালো লাগে। কথা ঘোরাবার জন্যে বললাম, আজকে মান্টু কি বেঁধেছে দুপুরে? খুব ভোরে উঠেছি আজ। যাব, খাব আর ঘুমাব। বিকেল থেকে লেখা-লেখি।
সন্তোষ বলল, আপনি প্রতিবারেই আসার দিন যা খান। সিদ্ধ ভাত, নানারকম সিদ্ধ ডিম সেদ্ধ, মাখন, রসুন ভাজা, উচ্ছে সেদ্ধ, কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা এই সব। আর কী।
তোদের জন্যে কী বেঁধেছে? কুচো মাছের টক, যে-ডাল আপনার জন্যে সিদ্ধ করেছে তারই একটু ডাল আর ডিম সেদ্ধ। ডিমের ঝোল করে নিল না কেন?
ও-ই। ও যা ঠিক করবে তাইতো হবে।
দেখতে দেখতে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। দূর থেকে ছাদের মাথাতে জলের ট্যাঙ্ক, সামনের দেবদারু আর পেছনের ঝাউগাছগুলোর মাথা মেঘলা আকাশের পটভূমিতে দেখা যাচ্ছে। নানারঙা। বোগেনভ্যেলিয়া, জুই আর লালরঙা ফুরুশ গাছগুলো দেখা যাচ্ছে দেওয়ালের পাশে পাশে। জায়গা অতি কম কিন্তু সেঁজুতির গাছের সখ খুব তাই ঠাসাঠাসি করে গাছ লাগিয়েছে। সবচেয়ে বড়ো সর্বনাশের কথা একটা কনকচাঁপা গাছও লাগিয়েছে। একেবারে ঘরের পাশে। কনকচাঁপা সবচেয়ে বড়ো ও উঁচু গাছ। দশবছরেই প্রচুর বড়ো হয়েছে। কবে যে বাড়ির ভিত ফাটিয়ে দেবে। যাকগে ততদিন আমি বেঁচে থাকব না। টিয়ার ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। ঘুঘু ডাকছে মন্থর দুপুরকে মন্থরতর করে। ছাতারে পাখিরা ছ্যা ছ্যা ছ্যা করে অনিয়মিত আসা গৃহস্বামীকে ভৎর্সনা করছে।
রিকশা গেটে দাঁড়ানো মাত্র মান্টু, তার দেড় বছরের ছেলে কোলে-করা স্ত্রী সীতা এবং দিঘার কাছে ওদের রামনগর গ্রাম থেকে শান্তিনিকেতনে বেড়াতে আসা মান্টুর মাধ্যমিক পাশ করা বেকার ছোটো ভাই সকলে দরজাতে আমাকে স্বাগত জানাতে দাঁড়াল এসে। সেই অর্থে ওরা। সকলেই আমার কর্মচারী নয় কিন্তু ওদের সকলের সুখে দুখে আমি জড়িয়ে গেছি ওতপ্রোতভাবে। এরা মাইনের ওপরে আমার কাছ থেকে অনেক কিছু পায়। দেয়ও অনেক কিছু।
সেঁজুতি মোবাইলে বার বার খোঁজ নেয়। কোনো দান-খয়রাতি করছি কী না। খয়রাতি–জাকাত। আমি অম্লান বদনে মিথ্যা কথা বলি। কারণ, আমি রাজা মহারাজ নই। যা-কিছুকরি আমার স্ত্রীকে, আমার নিজের সংসারকে বঞ্চিত করেই করি। তাই, একটু অপরাধ বোধেও ভুগি।
আমার অনেক প্রচণ্ড পণ্ডিত এবং তাত্ত্বিক কম্যুনিস্ট বন্ধু আছেন তাঁরা রান্না করা মেয়েকে পাঁচ-শ টাকা মাইনে দিয়ে মহৎ ভাবেন নিজেদের। কিন্তু তার একবেলার খাওয়া দিলেও ওই মাইনেতে কারো চলবে কী করে তা ভাবেন না। কথায় বলে চ্যারিটি বিগিনস এ্যাট হোম। আমার মনে হয়, কমুনিজম ক্যান অলসো বিগিন এ্যাট হোম। আবার অনেক বড়ো বড়ো কবি-সাহিত্যিক বন্ধুও আছেন তাঁদেরও কাছ থেকে দেখেছি। তাঁদের মনোভাবও নেতাদের চেয়ে আদৌ অন্যরকম। দেখিনি।
চলন্ত রিক্সাতে বসে মনে মনে ভাবছিলাম আমি যে কারোকেই ছোটো করার জন্যে এসব কথা বলছি না। মানে, ভাবছি না। আমার কথা শুনছে কে? কিন্তু শিক্ষিত, বিত্তবান, ব্যবসাদার, পেশাদার, অধ্যাপক স্কুলমাস্টারদের দেখে এবং এই মান্টু আর সন্তোষদের দেখেও আমার মনে ক্রমশ এই ধারণাই বদ্ধমূল হচ্ছে যে বড়ো বড়ো ডান বাম এবং নানা পন্থার নেতাদের বাগাড়ম্বরে যাই বলা হোক না কেন, এই দেশ দিনে দিনে, পায়ে পায়ে মাওবাদী বা নকশালবাদী হয়ে যাবে। বন্দুক, রাইফেল, পুলিশ যৌথবাহিনী বা কোবরা দিয়ে এই সমস্যার সমাধান কোনোদিনও হবে না। বন্দুক রাইফেল সাঁজোয়া গাড়ি সৈন্য বাহিনী কিছু দিয়েও ওদের দাবিয়ে রাখা যাবে না, যাবে শুধুমাত্র ভালোবাসা দিয়ে, খেতে-পরতে দিয়ে, বৈদ্যুতিক আলো এনে, পানীয় জল এনে, চাষের জল দিয়ে, মানুষকে মানুষের মর্য্যাদা দিয়ে। এতগুলো বছর মিছিমিছিই কেটে গেছে। যা সামান্য কিছু হয়েছে শহরে নগরেই। গরিব আরও গরিব হয়েছে, বড়োলোক হয়েছে আরও বড়োলোক। দেশের মানুষের কর্মসংস্কৃতি এবং আত্মসম্মানবোধও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ছাড়া কোনো দেশ সামনে এগোতে পারে না। আমরা-ওরার ভাগাভাগি তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নয়, আমরা আর মান্টু আর সন্তোষরা যতদিন, যতযুগ আমাদের থেকে আলাদা থাকবে ততদিন এই সমস্যার সমাধান হবে না। যাদের চাকরি আছে বিদ্যুৎ পর্ষদের। কর্মচারীদের মতে, সরকারি অন্যান্য বিভাগের চাকুরেদের মতো, ব্যাঙ্কের কর্মচারীদের মতো, পোস্ট অফিসের কর্মীদের মতো, তাদের বিবেকসম্পন্ন হয়ে দশটা-পাঁচটা কাজ করতে হবে।
সময়, কাজের আছিলাতে ব্যয় করলে চলবে না, যথার্থ কাজ করতে হবে, নিজের নিজের আত্মসম্মানের জন্যে।
এঁরা কত কিছু পাবেন, আর মান্টু এবং সন্তোষরা চিরদিনই আমাদের দয়াতে মনুষ্যেতর জীবন যাপন করবে, এ হতে পারে না, চলতে পারে না। এই বৈষম্য দেশের মানুষ সহ্য করবে না আর বেশিদিন।
ফিলিপিন্স-এর টুপামারো বিদ্রোহীরা একথা বিশ্বাস করে If the country does not belong to everyone, it shall belong to no-one.
আমাদের কলকাতার মধ্যবিত্ত পাড়াতে গলির মোড়ে একটি মুসলমান দর্জির দোকান আছে। দাঙ্গার সময়ে এই বদরুদ্দিন মিঞার দাদুকে পাড়ারই সব পরিচিত ইংরেজি জানা, কার্ল মার্কস, রবীন্দ্রনাথ পড়া হিন্দুবাবুরা টুকরো টুকরো করে কেটেছিল পরম বিক্রমে। সেই নিয়ামুদ্দিনের উলঙ্গ মৃতদেহ পথে পড়েছিল যেমন পার্কসার্কাস মৌলালিতে পড়েছিল অমল ও বিমলের মৃতদেহও।
আসলে শিক্ষা ব্যাপারটা কখনো আমাদের ভেতরে ঢোকেনি। কোরান অথবা গীতা দুই-ই বৃথা গেছে। বদরুদ্দিনের বাবা, সাহাবুদ্দিন গিয়াসুদ্দিনের মৃত্যুতে মছলন্দপুরে পালিয়ে গেছিলেন। কিন্তু বদরুদ্দিন বহুযুগ পরে কলকাতাতে ফিরে এসে তার নানান দোকান যে ঘরে ছিল, সেই ঘরেই চারখানা পা-মেশিন পেতে আবারও তার ব্যবসা পেতেছে। তার নানার খুনের বদলা নেবার জন্যে। এ এক অন্যরকম বদলা। কিন্তু ওর মধ্যে বদলা নেবার কোনো স্পৃহা নেই। বিরাদরীর বাণীই প্রচার করে তার কাজের মধ্যে দিয়ে। এ পাড়াতে দু-টি মসজিদ আগেও ছিল, পুড়িয়ে দেওয়ার পর আবারও সে দুটি প্রাণ পেয়েছে। নানা পেশার কিছু মুসলমান আবারও গুটিগুটি এসে জমেছে এই পাড়াতে অনেকই বছর হল। প্রতি জুম্মাবার, নামাজের পরে, এমনকী সারাদিনও টুপি-পরা মুসলমানেরা এসে বদরুদ্দিনের দোকানের সামনে হাত পেতে দাঁড়ায়, চায়না কিছু, যেন মাধুকরী করে। একটি কৌটোর মধ্যে মিশ্র রেজকি রেখে দেয় বদরুদ্দিন। কিছু নোটও থাকে। যেই আসুক, বদরুদ্দিন আগন্তুকের হাতে কিছু তুলে দেয়ই। প্রাপক বিড় বিড় করে নীচু গলায় বলে সালামৎ রহো। আমি একদিন ওকে জিগগেস করেছিলাম, বদরু, তুমি তো নবাব বাদশানও। তুমি এত দান ধ্যান কর কী করে?
সে বলেছিল, আমাদের শাস্ত্রে আছে গরিবকে খয়রাত-জাকাত করবে। আমি গরিব হলেও আমার চেয়েও গরিব দুনিয়াতে অনেকেই আছে। এতে অন্যের অভাব যে মিটবে না তা আমি জানি। কিন্তু এই খয়রাত-জাকাতের মধ্যে দিয়ে আমি আমির হব। যাই-ই দিইনা কেন, খোদা আমাকে তার চেয়ে অনেকেই বেশি ফেরত দেবেন। যদি নাও দেন তাহলেও বা কি? আমার অন্তর তো পূর্ণতা। পাবে। আমার মন তো ভরে উঠবে। এই ভালো অভ্যেসে প্রত্যেক মুসলমানেরই সামিল হওয়া। উচিত।
আর হিন্দুর?
বদরুদ্দিন হেসে ফেলে বলল, হিন্দুরও। তারাও তো কম দান ধ্যান করেন না। আপনি দেখেননি কি মন্দিরে মন্দিরে যাবার পথে দু-পাশে? ভিখিরিরই বেশে আপনাদের দেবতারাই তো দাঁড়িয়ে থাকেন।
তারপর বলেছিল, কোনো স্বার্থ নিয়ে দান করলে সে দানে কোনো রৌণক থাকে না। যে দানে কোনো স্বার্থ নেই, যে দানে কোনো বড়াই নেই, সেই দানই যথার্থ দান, সেই দান নিজেকে ধনী করেনা, ঋণী করে।
ঋণী? কার কাছে?
খোদার কাছে।
আমার বদরুদ্দিনের কথা শুনে সেদিন মনে পড়ে গেছিল রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটির কথা। ভিক্ষা করে ফিরিতেছিলাম তোমার পথে পথে তুমি তখন চলিতেছিলে তোমার স্বর্ণ রথে… কবিতাটির পুরোটা মনে নেই, স্বর্ণরথ থামিয়ে মহারাজ যখন ভিখারির কাছে ভিক্ষা চাইলেন তখন ভিখারি তাঁকে এক কণা চাল দিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে, ভিক্ষাপাত্র উপুড় করে ভিখারি দেখলেন। তাতে একটি সোনার চাল চিকচিক করছে। তখন ভিখারি স্বগতোক্তি করলেন, তখন কেন দিইনি তোমায় সকল শূন্য করে।
বদরুদ্দিনের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই আমি বলি, সালাম আইলেকুম মিঞা। ও বলে, আইলেকুম আস সালাম।
তারপর আমি বলি। খোদা হাফিজ।
ও-ও বলে খোদা হাফিজ।
বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে ভাবছিলাম বদরুদ্দিনের ওই খয়রাত-জাকাতএর কথা। ঈশ্বর আমাদের সামনে সর্বক্ষণই খয়রাত-জাকাত এর সুযোগ করে রেখেছেন। যে দিল, দিতে পারল, সেই ধন্য করল নিজেকে আর যে নিল সে কৃতার্থ করল দাতাকে।
খেয়ে-দেয়ে উঠে এক ঘুম লাগালাম। শান্তিনিকেতনে ঘুমিয়ে খুব আরাম। বাস মিনিবাস ট্রামের আওয়াজ নেই। আশ্রমের কাছের অন্যান্য পাড়াতে তবু কিছু আওয়াজ কানে আসে। আমাদের এই গোয়ালপাড়া প্রায় সুনসান। শুধুই পাখির ডাক আর বৃষ্টি পড়লে, বৃষ্টির শব্দ। বৃষ্টির পরে নানা পাখির ডাক। ঘুম ভাঙতেই মান্টু বলল, চা দেব বাবু?
দে। তবে একটু পরে।
চায়ের সঙ্গে কী দেব? আলুর চপ এনে দেব?
না। বাজে তেলে ভাজে। আর কী আছে?
মুড়ি আর কাঁঠালের বিচি ভাজা দেব?
কাঠালের বিচি পেলি কোথায়? আমাদের বাড়িতে তো কাঁঠাল গাছ নেই।
বাজার থেকে নিয়ে এসেছি কাঁঠাল বিচি।
বাঃ। দে তাই
তারপর বললাম সন্তোষ চলে গেছে?
হ্যাঁ। অনেকক্ষণ।
খাইয়ে দিয়েছিস তো?
হ্যাঁ বাবু। না খেয়ে কি আর যাবে।
ডিমের ঝোল করলি না কেন?
আমাদের যা অভ্যেস। কুচো মাছের টক আর ডাল দিয়ে খেয়ে গেছে। আমরাও তো ওই খেলাম।
ডিম খেলি কী করে? ভাজা?
বাবু। ডিম সেদ্ধ।
সন্তোষকে দিয়েছিস তো?
দিয়েছিলাম, কিন্তু খায়নি।
কেন?
ওর ছোটো ছেলে ডিম খেতে ভালোবাসে খুব। তাই নিজে না খেয়ে ছেলের জন্যে একটি প্লাস্টিকের প্যাকেটে সাইকেলে ঝুলিয়ে নিয়ে গেছে।
সে কী রে।
হ্যাঁ বাবু।
মান্টু চলে গেলে, আমি কল্পনা করলাম যে সন্তোষ পেটের ব্যথার জন্যে এককাত হয়ে সাইকেল চালিয়ে নিস্তব্ধ দুপুরে ওর গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। হ্যান্ডেলে ঝোলানো একটি সেদ্ধ ডিম। ভাবলাম, কালকে ওর জন্যে একডজন ডিম কিনে দেব। বাড়িসুদ্ধ সকলে ডিমের ঝোল আর ভাত খাবে সকলে মিলে পাত পেড়ে।
তাতে ওর দুঃখের লাঘব হবে না তবে আমার অপরাগতার ভার হয়তো কিছুটা হালকা হবে।