এমনিতেই কয়েকদিন হল এক চাপা টেনশনে ভুগছি। মুন্নির হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবে দিন দশেকের মধ্যে। আগেও বেরুতে পারে। সবই তো তাঁদের মর্জির উপরে নির্ভরশীল। তার উপরে যতীনের চিন্তা।
কাল রাতে শুতে গেছিলাম বড়োই চিন্তিত মনে। যতীনটা পি জি হাসপাতালে পড়ে আছে সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে। প্যারালিসিস হয়ে গেছে সারা শরীর। অথচ মাথাটা কাজ করছে।
আমি অফিসের কাজে বারাউনি গেছিলাম। ফিরে এসে, খবর শুনে, যখন দেখতে গেলাম, তখন ওর কথা বন্ধ হয়ে গেছে।
জানি না, ওর সঙ্গে আর কথা হবে কি না!
যতীনের গালে হাত ছুঁইয়ে বললাম, তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠ যতীন। আমরা আবার এবারে নন্দাদেবী এক্সপিডিশান করছি। মন্টুদা বলেছেন, অন্যদিক দিয়ে উঠব, যেদিক দিয়ে কেউই ওঠেনি।
যতীনের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তারপরই জলে ভরে এল।
মনে হল, ও বুঝি তুষার-শুভ্র নন্দাদেবী আর কলুষহীন নীল আকাশ দেখতে পেল হাসপাতালের রৌরবের মধ্যে শুয়ে।
কথা বন্ধ হয়ে গেছে। মাথাটা এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। কিছুই বলতে পারল না।
আমি আর সেখানে মিছিমিছি দাঁড়ালাম না। মনটা ভীষণই খারাপ হয়ে গেল। গত চল্লিশ বছরের বন্ধুত্ব। কলেজের বন্ধু আমরা। কত সুখ, কত দুঃখ, মান-অভিমানঞ্জ, কত অনুষঙ্গর স্মৃতি।
রাত তখন প্রায় দুটো। ফোনটা বাজছিল বসার ঘরে। মুন্নি দড়াম করে দরজা খুলে দৌড়ে গিয়ে। ফোন ধরল। তারপর আমাদের ঘরের দিকে এল। রিমা ততক্ষণে দরজা খুলে ওদিকেই যাচ্ছিল।
গভীর রাতের ফোনের আওয়াজে সকলেরই আতঙ্ক হয়!
মুন্নি বলল, নুটুদা। যতীনকাকুর ছেলে।
আমি দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলাম। বললাম, কী রে! কী খবর?
আমি জ্যোতির্ময়, মণিকাকু।
গলা শুনেই বুঝলাম নুটুনুটু। যতীন তার একমাত্র ছেলের নানান নাম দিয়েছিল ভালোবেসে।
খুব ছেলেবেলাতে ডাকত নুটুনুটু বলে। তারপর ডাকত হাবলা বলে। যতীনের স্ত্রী নীপা এখনও সেই নামেই ডাকে। তারও পর নুটুবাবু। এবং ইদানীং বলত নেটকু।
বল রে। আমি বললাম। কিন্তু রাত তিনটেতে ও কী বলতে পারে, তা বুঝতেই পেলাম।
রোজই সকালে ওদের বাড়িতে ফোন করে ওর সঙ্গে এবং নীপার সঙ্গে কথা বলতাম, যতীনের খবর নিতাম। করবার বিশেষ কিছু তো ছিল না। দেখা করাও বারণ ছিল! যতীনের তিন ভাই, শ্বশুরবাড়ির সবাই, ক্লাবের ছেলেরা, ওর সহকর্মীরা সকলেই নিয়মিত যেতেন।
আমার এবং যতীনের অন্য একাধিক বন্ধুদেরও এতদিন বয়স অনুপাতে নুটুনুটুকে একটু ইমম্যাচিওরড বলেই মনে হত। সচ্ছল বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। একটু বেশি বয়সের সন্তান। আদরে আদরেই হয়তো ওরকম হয়েছে।
কিন্তু আজ হঠাৎ এ কার গলা শুনলাম? স্মার্ট, ভাবাবেগহীন, কাটা কাটা উচ্চারণে নুটুনুটু বলল, শোনো, মণিকাকা, তোমার শরীর এখন কেমন আছে?
ভালো ভালো। তোর বাবা কেমন আছে তাই বল?
শোনো, উত্তেজিত হয়ো না, আমি জানি, তোমার শরীর ভালো নেই। বাবা রাত একটা পঞ্চাশে চলে গেল। এখন তুমি শুয়ে পড়। হাসপাতাল থেকে বাবাকে নিয়ে বাড়িতে আসতে আসতে আমাদের হয়তো এক-দেড় ঘন্টা হবে। কেওড়াতলায় বেরোতে বেরোতে বারোটা। আমরা এখন হাসপাতালেই আছি। তুমি সময়মতো উঠে, চা-জলখাবার খেয়ে টেয়ে, ধীরে সুস্থে বাড়িতেই এসো। কোনোই তাড়া কোরো না। বুঝেছো। আমি এবার ছাড়ি। অনেককে ফোন করতে হবে।
আমি কিছু বলার আগেই ও ফোন ছেড়ে দিল। ওকে আমি কী সমবেদনা জানাব? সান্ত্বনা দেব? ওই ওর ব্যক্তিত্বর সাবালকত্বে আমাকে সান্ত্বনা দিল।
খবরটাতে স্তম্ভিত এবং নুটুনুটুর হঠাৎ পরিবর্তনে যুগপৎ চমৎকৃত হয়ে রইলাম।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে বাথরুমে গেলাম। ভাবছিলাম, যতীন আমাকে নেপাল হিমালয়ে সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছিল একবার নিজের প্রাণ বিপন্ন করে। ধস আমাকে নিয়ে খাদেই ফেলে দিচ্ছিল, যদি না যতীন ধাক্কা মেরে চকিতে আমাকে শুইয়ে ফেলে আমার জ্যাকেট ধরে টেনে, পাশে সরাত।
তখনও আমার নিজের দম ছিল না একটুও।
মৃত্যু ব্যাপারটা এতদিন পুরোপুরিই পরাশ্রিত ছিল।
অমুকের দাদু মারা গেছেন, তমুকের ভাই, অন্য কারো জামাইবাবু। শুনতাম, শ্মশানেও যেতাম। কিন্তু মৃত্যু যে মানুষখেকো বাঘের মতো আমাদের নিজস্ব নিভৃত চত্বরেও এমন নিঃশব্দ পায়ে ঢুকে পড়বে কোনোদিন, আমাদেরই আপন, বড়ো কাছের কাউকে মুখে করে নিয়ে যাবে, তা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।
রিমা বলল, এত রাতে কোথায় যাবে? ট্যাক্সিও তো পাবে না। শরীরও তো ভালো নেই। যতুদা তো আর নেই! এখন তাড়া করে কী লাভ? আমার নিজের হাত-পা ছেড়ে যাচ্ছে। ভাবতেও পারছি যে যতুদা নেই! তুমি আমার কাছেই থাকো।
তুমি মুন্নির সঙ্গে শুয়ে থাকো ওঘরে গিয়ে। আমাকে যেতেই হবে। এই খবর না জানলে, অন্য কথা ছিল। নুটুনুটু একা। না গেলে চলে।
বলেই, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
ট্যাক্সি নেই। কলকাতা বম্বে নয় যে, সারা রাত সারা দিন ট্যাক্সি পাওয়া যাবে। সার্কুলার রোড। আর আমাদের পথের মোড়ে এসে পৌঁছোলাম হাঁটতে হাঁটতে। দেখি, পুলিশের একটি ঝকঝকে ভ্যান মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট্ট ভ্যান। তাতে সুবেশ সুদর্শন একজন অফিসার এবং তাঁর পাশে ড্রাইভার।
গাড়িতে অন্য কোনো পুলিশ নেই।
পুলিশ অফিসার আমার স্পর্ধা দেখে একটু অবাক চোখে তাকালেন। তারপর নৈর্ব্যক্তিক গলাতে বললেন, দেখছেন না, আমরা ডিউটিতে আছি? ওঃ। আমি বললাম। বিলেত-ফেরত ভন্টুদার কাছে শোনা লন্ডনের পুলিশদের সৌজন্য ও কর্তব্যজ্ঞানের কথা মনে পড়ে গেল আমার।
মোড়েই দাঁড়িয়ে রইলাম, যদি শেয়ালদার দিক থেকে কোনো ট্যাক্সি আসে, সেই অপেক্ষাতে। ট্রাম-বাস চলার সময় হয়নি এখনও।
একটু পরেই একটি ট্রাক এল। পুলিশ অফিসার দরজা খুলে লাফিয়ে নামলেন। ট্রাকটি গতি কম করল, কিন্তু দাঁড়াল না। ড্রাইভারের বাঁ-পাশে বসা লোকটি তার হাত বের করল জানালা দিয়ে। তারপরই চলে গেল ট্রাকটি। পরক্ষণেই শিক্ষিত, সুদর্শন, কর্তব্যপরায়ণ ভদ্রলোকের পুলিশ। ছেলে, নীচু হয়ে, পথ থেকে সর্দারজির অবজ্ঞা-অবহেলা এবং ঘৃণাতে ছুঁড়ে দেওয়া দশ টাকার নোটটি তুলে নিয়ে পকেটে রেখে সামনের সিটে উঠে বসলেন। ডানদিকের সিটে।
ভ্যানটা লেফট-হ্যান্ড ড্রাইভ ছিল।
আমি স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইলাম। কিন্তু অফিসারের কোনো ভাবান্তর হল না। লজ্জা, মান, ভয়, তিন থাকতে নয়। বীরের মতো ঘুষ নিলেন অফিসার।
ট্যাক্সি এল না। কিন্তু একটু পরে ওইরকমই আরেকটি ভ্যান এল। তাতেও ওইরকমই দু-জনে বসা। সঙ্গে আর কেউই নেই। ওই ভ্যানটি আসতেই আগের ভ্যানটি সামনে এগিয়ে গেল অন্য জায়গাতে কর্তব্য করতে। পরের ভ্যানটি আগের ভ্যানের জায়গাতে এসে দাঁড়াল।
নির্লজ্জ, মান-অপমান বোধহীন কলকাতাবাসী আমি আবারও ওই ভ্যানের অফিসারকে অনুরোধ করলাম। একই অনুরোধ। আমার ছেলেবেলার এক বন্ধু মারা গেছেন একটু আগে। আপনারা কি পি জি হাসপাতালের দিকে যাবেন? গেলে, একটু এগিয়ে যেতাম।
একই উত্তর পেলাম। তবে এবারে নৈর্ব্যক্তিকতার সঙ্গে নয়, বিরক্তির সঙ্গে।
অফিসার বললেন, আমরা এখানে ডিউটি করতে এসেছি। আপনি কি মনে করেন যে পুলিশের। কাজ মাঝরাতে আলতু-ফালতু লোককে লিফট দেওয়া? ভিখিরিদের মতো বন্ধু-ফন্ধু মরে যাওয়ার গল্প, ওরকম সকলেই বানিয়ে বলে।
না, না, আমি লিফট তো চাইনি। আপনারা যদি ওইদিকে যেতেন তাহলে একটু এগিয়ে যেতে পারতাম। আপনাদের ভ্যানও তো দেখছি ফাঁকাই। তাই…
আমরা ডিউটি করছি।
ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। ঠিক করলাম, হেঁটেই এগোই। সামনে গিয়ে যদি কোথাও ট্যাক্সি পাই তো ভালো, নইলে হেঁটেই যাব। আর কী করার!
যতীনের সঙ্গে পাশাপাশি পর্বতে-উপত্যকায় বনে-জঙ্গলে দিনে রাতে কত বছর কত হেঁটেছি! ওই চলে গেল! ওর কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছোবার জন্যে না-হয় মাইল তিনেক হাঁটলামই!
ঠিক এমন সময়ে দূরে একটা হেডলাইট দেখা গেল। ট্যাক্সি? না, ট্রাক। ট্রাক দেখেই অফিসার লাফিয়ে নামলেন। ইনিও সুদর্শন। তবে গায়ের রং কালো। চমৎকার ছাঁট-এর চমৎকার ইস্ত্রি করা পশ্চিমবঙ্গর পুলিশি জামা-কাপড়। এই ট্রাকটিও গতি কমাল, নোট ছুঁড়ে দিল শিক্ষিত, ভদ্রলোক, কর্তব্যপালনকারী সম্রান্ত সরকারি কর্মচারী ভিখিরির দিকে। ট্রাকটি চলে গেলে, অফিসার ভ্যানে উঠে পড়ে, সার্কুলার রোড ধরে পি জি র দিকেই এগিয়ে গেলেন। নতুন জলায় মাছ ধরতে।
দশটাকার নোটগুলো যেখানে ফেলেছিল, ঋজু, মেহনত-করে-খাওয়া, কম-কথা-বলা সর্দারজিরা এবং যেখান থেকে বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোক শিক্ষিত বাঙালি পুলিশ অফিসারেরা সেই অসম্মানের নোট কুড়িয়ে নিয়েছিলেন, সেখানে পিচিক করে থুথু ফেলে, আমি হাঁটা দিলাম পি জি হসপিটালের দিকে, অন্ধকার, তিলোত্তমা, কল্লোলিনী কলকাতা শহরের নিশুতি রাতে।
মনে মনে বললাম, যতীন, আমি আসছি, আমি আসছি। দেরিটা ক্ষমা করে দিস। আমি আসছি। আমরা আসছি যতীন, আমরা আসছি।
২.
যতীনের কাজও হয়ে গেল গতকাল। এখন শুধু স্মৃতিটা আছে। এখনই মুশকিল। চলতে-ফিরতে, একা থাকতে, বাসের জানলায় বসে, অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবলই যতীনের কথাই। মনে পড়ে। ওর হাসি, রসিকতা, ওর রাগ, সব কিছুর কথাই।
ভড় সাহেব ডেকে বললেন, বারাউনি যেতে হবে পরশুই। এবারে মাস-খানেকের জন্যে।
রিমা বারবার করে বলেছিল যে, মুন্নির রেজাল্ট বেরুবে আগস্টের গোড়াতেই। সেই সময়ে যেন কলকাতার বাইরে না থাকি। মার্কশিট আনতে হবে স্কুল থেকে। প্রত্যেক কলেজে কলেজে। ইন্টারভিউ দিতে হবে। মার্কশিট দেখালে, তবে ফর্ম দেবে। নইলে কোনো কলেজই দেবে না। প্রেসিডেন্সি, সেন্ট জেভিয়ার্স, লরেটো, লেডি ব্রেবোর্ন, স্কটিশচার্চ সব কলেজেই ইন্টারভিউ দিয়ে রাখতে হবে। কোথায় পাওয়া যাবে কে জানে! জয়েন্ট-এন্ট্রান্স-এর ফর্ম পেতেও মার্কশিট লাগবে। মার্কশিট হাতে পেয়েই জেরক্স করতে হবে গণ্ডা গণ্ডা। তারপর শুরু হবে দৌড়োদৌড়ি। তারও পর কোথাও ভরতি হতে পারলে তারপর বই কেনা, অ্যাডমিশন ফি, ইত্যাদি ইত্যাদি। মুন্নির স্বাস্থ্য একটু দুর্বল। ও একা এত ধকল সইতে পারবে না।
ভড় সাহেবকে একথা বলতেই উনি বললেন, সবসময়ই আপনাদের অজুহাত। অফিসারদেরও এরকম মেন্টালিটি আনথিংকেবল। কাজ করতে চান না একটুও। আপনাদের মতো ইনএফিসিয়েন্ট আনউইলিং বাঙালিদের জন্যেই কলকাতা শহরটা, পুরো পশ্চিমবঙ্গটাই অন্যদের দখলে চলে গেল। উদ শুড বি অ্যাশেমড অব ইওরসেলভস।
আমার গা জ্বলে উঠল। ভড় সাহেবের কাজ এবং কুকাজের সব খবরই আমি রাখি। অত বক্তৃতা ভালো লাগে না।
বললাম, স্যার আমার একটিই সন্তান। এবং তার পুরো ভবিষ্যতের প্রশ্ন এটা। ভালো কলেজে, নিজের বিষয় নিয়ে ভর্তি হতেই যদি না পারে, তাহলে ভবিষ্যৎটাই যে নষ্ট হয়ে যাবে। আজকাল কী ছেলে, কী মেয়ে, স্বাবলম্বী না হলে তো তাকে না খেয়েই থাকতে হবে। রোজগেরে মেয়ে ছাড়া তো কেউ বিয়েও করতে চায় না আজকাল। আপনি যদি আগস্টের প্রথম দুটি সপ্তাহ আমাকে। কলকাতায় থাকতে না দেন, তবে স্যার আমি ছুটির দরখাস্তই করে দিচ্ছি।
বড়োসাহেব পান চিবুতে চিবুতে বললেন, দরখাস্ত করা মানেই যে ছুটি মঞ্জুর হয়ে গেল, তা তো নয়। ছুটিই যদি দিতে পারতাম আপনাকে, তাহলে এত কথা কীসের ছিল? আপনি ছাড়া আর। কেউ তো নেই মিস্টার রায়! এদিকে অডিটরেরা অ্যাকাউন্টস ফাইনালাইজ করবেন। দিল্লিতে যাবেন আগস্টের ন-দশ তারিখ, এমনই কথা আছে।
তারপরই বললেন, আপনার বাবার এবং শ্বশুরবাড়ির ফ্যামিলিতে ভ্যাগাবন্ড লোকের কি কোনো অভাব আছে? পশ্চিমবঙ্গে চাকরি বা কাজ আছে কটা লোকের মশাই? এইটেই তো একটা মস্ত অ্যাডভান্টেজ। তাদের কাউকে ফিট করে দিয়ে চলে যান।
তেমন কেউই যে নেই।
আমি মিনমিন করে বললাম।
বলেন কি মিস্টার রায়? আপনি তোদারুণ লাকি মশায়! বাঙালির বাড়িতে ভ্যাগাবন্ড নেই, সকলেরই কাজ আছেঞ্জ, এ তো অভাবনীয় ব্যাপার। সাংবাদিকদের বলতে হবে, আপনাকে ইন্টারভিউ করে কাগজে রিপোর্ট করতে হবে।
চুপ করে রইলাম। ভাবছিলাম যে, ভ্যাগাবন্ড কেউ নেই এও যেমন সত্যি তেমন যৌথ পরিবারের নিরাপত্তা, অদৃশ্য কিন্তু দৃঢ়মূল বিমা, জনবল এসবও তো নেই! নেই অনেক কিছুই। ভালোবাসা নেই, বিশ্রাম নেইঞ্জ, মমত্ববোধ নেই।
না মিস্টার রায়। আই অ্যাম সরি। এ নিয়ে আমাকে আর কোনোরকম পীড়াপীড়িই করবেন না। বেশি চাপাচাপি করলে আপনার ফ্যামিলিতে আপনাকেই ভ্যাগাবন্ড হয়ে যেতে হবে। এই বয়সে, এই কোয়ালিফিকেশনেঞ্জ, আপনি এই চাকরিটি খোয়ালে আর কোথাওই কি চাকরি পাবেন?
কী? চুপ করে রইলেন কেন? বলুন? পাবেন কি?
মাথা নাড়লাম।
ভাবলাম, আমার চাকরি অবশ্যই খেতে পারেন কিন্তু একজন ক্লাস-ফোরের চাকরি খান দেখি? সেদিনই তো শালা-বাঞ্চোত বলে গেল ঘেরাও করে। কি করতে পারেন তাদের?
ভাবলাম, কিন্তু বলতে পারলাম না।
আমি পারব না যে, সেকথা ভড় সাহেব জানেন বলেই তো এমন অমানুষের মতো ব্যবহার করতে পারেন। এত করেও তো কোটি কোটি টাকা লস। স্টেট গভর্নমেন্টেরই তো কোম্পানি! আর। লসটা যে কেন হয়, কী করে হয়ঞ্জ, তাও তো আমরা জানি। অথচ দোষ হয়
আমাদেরই। এই ছাতার পেটি অফিসারদের! বাড়িতে এসে কথাটা রিমাকে বলতেই, সে তো হাউমাউ করে উঠল।
মুন্নি গম্ভীর হয়ে গেল।
মুন্নি, স্কুল ফাইনালেও তিনটে লেটার পেয়েছিল। এগ্রিগেটে বিরাশী পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিল। আমি নিজে স্কুল ফাইনালে ফটি-টু পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিলাম। অ্যাডিশনাল ম্যাথস-এ। পেয়েছিলাম পনেরো। এক নম্বরও যোগ হয়নি এগ্রিগেটে। আমার মেয়ে যে এমন ভালো হয়েছে। পড়াশুনোয় তার সব কৃতিত্ব তার এবং রিমারই। মেয়েই রিমার জীবন-স। জীবনঞ্জ, জীবনী। মেয়েই তার বর্তমান, মেয়েই ভবিষ্যৎ। গত পনেরো বছর দাম্পত্য বলে কিছুমাত্রই ছিল না আমাদের এই ছোট্ট সংসারে। তার স্থান নিয়েছিল অপত্য। ঘোর অপত্য।
মা ও মেয়ের মুড দেখে আমি বললাম, চাকরিটা চলে গেলে খাব কী বল? অফিসের নগেনকে বলে যাব। ওকে নিয়ে তুমিই মুন্নিকে সঙ্গে করে, না হয় ট্যাক্সি করেই যেও সব জায়গাতে। যেতে যদি হয়ই আমাকে, বেশি টাকা দিয়ে যাব ব্যাঙ্ক থেকে তুলে।
তুমি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পরও এক কণা সাহায্য করোনি। মেয়েটা জন্ডিস থেকে এই সেদিন উঠল। মুন্নির বিলিরুবিন কত হয়েছিল গত মাসে তা কি তুমি জান না? তুমি তো নিজের শরীর নিয়েই ব্যতিব্যস্ত সবসময়ে। মেয়ে-বউ-এর কথা জানার বা শোনার সময় কোথায় তোমার?
আমি হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে বললাম, আমাকে একটা ফোন করে দিলেই আমি পালিয়ে আসব। বারাউনি থেকে। ওভারনাইট জার্নি। তাতে, চাকরি গেলে যাবে। রেজাল্ট তো আগে বেরোক। মার্কশিটটা তো জোগাড় করো। করে, জেরক্স করে ফেলল। সেই সময়ে চাকরি গেলে, যাবে। ব্যানার্জিদার ফাঁকা গ্যারাজটা ভাড়া নিয়ে ওখানে আলুর চপ আর ঘুগনির দোকান দেব। এই ছাতার চাকরির চেয়ে স্বাধীন ব্যবসা অনেক ভালো। বাণিজ্যে বসতেঃ লক্ষ্মী। হ্যাঁ! ভারি তো। মাইনে তার আবার এত কথা আর এত হ্যাপা।
যা খুশি তাই করতে পার। করবার মুরোদ থাকলে আগেই করতে পারতে। এর চেয়ে খারাপ থাকা তো যায়ই না! তবে আর ভয় দেখাচ্ছ কী? নতুন করে ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই। টেলিফোনটাই শুধু খুলে নিয়ে যাবে, অফিসের ফোন বলে। আর বেশি অসুবিধে কীসের? তিনটি পায়রার খোপের মতো ঘর। নিজেরা তো এই করেই কাটিয়ে দিলাম জীবনটা। মেয়েটা যেন মানুষের মতো বাঁচতে পারে, ভালো থাকে, ভালো খায়, ভালো ছেলেকে বিয়ে করে এ ছাড়া আমার আর চাইবার কী আছে? ভগবানকে সবসময়েই বলি, মেয়েটা পায়ে দাঁড়িয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন মরে যাই। তোমার সাত-শো টাকা পেনশানে তো দু-জনের চলবেও না। সঞ্চয়ও তো অনেকই করেছ! আর যা বাজারের অবস্থা! তুমি যখন রিটায়ার করবে, তখন টাকা তো কাগজই হয়ে যাবে। ঠোঙার কাগজ।
আমি কিছু বললাম না। বললেই, প্রেসার উঠে যায়। অবশ্য, না বললেও যায়।
যেসব কথা ভুলে থাকতে চাই, ভুলে যেতে চাই সেই সব কথাই যে কেন রিমা বার বার তোলে।
৩.
বারাউনিতে এলে এমনিতে ভালো লাগে। গেস্ট-হাউসটা নিরিবিলি জায়গাতে। বাগান-টাগানও আছে। খাওয়া-দাওয়াও মন্দ নয়। তবে বাইরে থাকার জন্যে যদি একটা এ্যালাউন্স থাকত। তবে আরও ভালো হত। কোম্পানির ড্রাইভাররাও আউট-স্টেশন অ্যালাউন্স পায়।
নামেই আমি অফিসার। ওভারটাইম আর এই সব নিয়ে একজন বেয়ারা বা ড্রাইভারও আমার চেয়ে বেশি রোজগার করে। কে ভাবে আমাদের কথা! মধ্যবিত্তদের আর কটা ভোট! আমরা না। খেয়ে মরলেই বা কী যায় আসে!
সকালে উঠে, কাগজ খুলেই চোখ কপালে উঠল। হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট আগামীকাল বেরুবে। মানে, স্কুল খুলে যাবে। মাত্র চল্লিশ পার্সেন্ট পাশ করেছে। বারো হাজার ন-শো ছেলে
মেয়ের রেজাল্ট ইনকমপ্লিট। পরশু জানতে পাবে রেজাল্ট, ছেলে-মেয়েরাঞ্জ, যার যার স্কুল থেকে।
খবরটা পড়ার পর থেকেই টেনশান বাড়তে থাকল ভিতরে ভিতরে।
মুন্নি আমার মেয়ে খুবই ভালো। শুধু ভালো যে তাই নয়, অত্যন্তই সিরিয়াস। পাশ করবে এবং ফার্স্ট ডিভিশানও পাবে। কিন্তু কটা লেটার পাবে? এগ্রিগেটে কত পাবে? সেইটেই দেখার।
তারপর ইন্টারভিউ কেমন হয়? কোন কলেজে? কী কম্বিনেশান পায়? চিন্তা তো আছে! শুনি নাকি যে, প্রেসিডেন্সির অধ্যাপকমণ্ডলী খুব ভালো। এমনকী সেখানের অফিসের কর্মচারীদের ব্যবহারও চমৎকার। এরকমটি নাকি দেখা যায় না আজকাল কোথাওই।
এসব খোঁজ-খবর এনেছে মুন্নিই।
রিমার দিদির মেয়ে ঝুমা, প্রেসিডেন্সিতে পড়ত। তাই মুন্নিরও শখ। প্রেসিডেন্সির একটা আলাদা গ্ল্যামার আছে। ও বলে। আছে কি? কে জানে!
পোলিটিকাল সায়ন্স-এর অধ্যাপক প্রশান্ত রায় (পি. আর.) নাকি এক লিভিং লেজেন্ড। হবেন হয়তো। কিন্তু আমি ভাবতাম, প্রেসিডেন্সি, বাড়ি থেকে অনেক দূরেও হবে, তদুপরি সে অঞ্চলে,
তো হাঙ্গামা লেগে থাকে প্রায় রোজই আজকাল। আমারও ইচ্ছে, মুন্নি অন্য কলেজে পড়ুক। ভাবলাম, আজকে অফিসে রাত দশটা অবধি থাকব। আগামীকালও। কাজ যতদূর পারি এগিয়ে রাখতে হবে। পরশু বিকেলের দিকেই ফোন করব বাড়িতে। পরশু বিকেলের আগে স্কুলে রেজাল্ট আসবেও না। কিন্তু বারো হাজার ন-শো ছেলে-মেয়ের রেজাল্ট ইনকমপ্লিট? কমপ্লিট না করে রেজাল্ট ওরা বের করলেনই বা কেন? কে জবাব দেবে? প্রশ্নই বা করবে কে? কাকে করবে? এই অচলায়তনে?
দাকিং ক্যান ডু নো রং।
এখন তো সরকারই রাজা!
৪.
ফোন করব করব ভাবছি। ভেবেছিলাম চারটেতে করব। আমার পক্ষে পার্সোনাল কল করতে এখান থেকে কোনোই অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি ফোন করার আগেই কলকাতা থেকে ফোন এসে গেল।
নিশ্চয়ই ডেসপারেট হয়ে করেছে রিমা। আমার বাড়ির ফোনে এস-টি-ডি ফেসিলিটিই নেই। অফিসের দেওয়া ফোন তো! অন্য কোথাও থেকে করেছে নিশ্চয়ই।
হ্যালো।
আমি বলছি।
রিমা বলল।
বলো। কী হয়েছে? কোথা থেকে বলছ?
টাবলুর বাড়ি থেকে। মুন্নির রেজাল্ট ইনকমপ্লিট।
ইনকমপ্লিট?
ঠিক এই আশঙ্কাই করছিলাম পরশু থেকে আর মনে মনে উইশফুল থিংকিং করে যাচ্ছিলাম যে, ওই বারো হাজার ন-শোর মধ্যে আমার মেয়ে থাকবে না।
আমরা প্রত্যেকেই স্বার্থপর। নিজের পায়ে জুতোর চাপ না পড়লে আমাদের যায় আসে না। কিছুই। মুন্নির রেজাল্টটা কমপ্লিট থাকলে যেত-আসত না কিছু আমারও। আমি যে বাঙালি! বুদ্ধিজীবী।
কবে পাবে?
মানে, কমপ্লিট রেজাল্ট কবে পাবে?
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম।
স্কুল থেকে হেডমিস্ট্রেস বললেন, পরশুর মধ্যে।
তবে আর কী? পরশু আমিই ফোন করব বিকেলে। চিন্তা কোরো না।
চিন্তা করব না? মার্কশিট না পেলে যে, কোনো কলেজ ফর্মই দেবে না।
আরে মার্কশিট তো পেয়েই যাবে পরশু। চিন্তা করছ কেন? মিছে চিন্তা কোরো না। মার্কশিটের জন্যে অ্যাপ্লাই করেছে মুন্নি?
হ্যাঁ। তা তোকরেছেই। স্কুল থেকেই সব করে দিয়েছে।
তবে তো ঠিকই আছে। পরশু ফোন করব আমি। ছাড়ছি। তোমার প্রেসার কেমন আছে?
খুবই বেড়ে গেছে। ডঃ মিত্রকে ডাকতে হয়েছিল। দু-শো ষাট হয়ে গেছে প্রেসার।
চমৎকার! শুয়ে থাকো। উত্তেজিত হোয়ো না। সময়মতো ওষুধ খেও।
ফোনটা ছেড়ে দেবার পরই আমার মাথা দপদপ করতে লাগল। কী করব? করার কী আছে? কোথায় যেন পড়েছিলাম, There is no point in trying to do something when there is nothing to be done.
মুন্নিকে নিয়ে আমাদের দুজনের কতই-না জল্পনাকল্পনা! আই এ এস হবে, না, চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট? অধ্যাপনা করবে, না ব্যাঙ্কের চাকরি করবে? বিদেশে পড়তে যাবে কি? মুন্নির নিজের ইচ্ছা গ্র্যাজুয়েশন-এর পর G.R.E ও TOEFEL দিয়ে আমেরিকার কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়বে। এ.ট্ট.থ্ব.-এ বসে হায়ার সেকেন্ডারির পরই বাইরে যাবার ওর কোনোই ইচ্ছে নেই।
রিমা বলে, তোকে যেতে দিতে পারি মুন্নি, যদি ফিরে আসবি বলে কথা দিয়ে যাস।
মুন্নি হাসতে হাসতে বলে, ফিরব না কেন? স্বদেশের মতো কি আর বিদেশ? সকলেই যদি ভালো থাকা, ভালো-পরা, বড়ো-গাড়ি চড়ার জন্যে বিদেশে চলে যায় তবে দেশের কী হবে? আমরা সকলে মিলে যদি দেশে থেকে, দেশের অবস্থা ফেরাবার চেষ্টা না করি তবে দেশের অবস্থার উন্নতি কি কোনোদিনই হবে?
আমার খুব গর্ব আমার মেয়ে মুন্নিকে নিয়ে। কারণ, পড়াশোনাতে ভালো অনেক ছেলে-মেয়েই হয়, কিন্তু ওর মধ্যে সমকাল, স্বদেশ, স্বপরিচয়, স্ব-জাতি ইত্যাদি সম্বন্ধে এমন এক উৎসাহ ও গভীর ভাবনাচিন্তা দেখি যে, খুব কম ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই তা দেখতে পাই। আমার মেয়ে বলে বলছি না, মুন্নি একটি এক্সট্রা-অর্ডিনারি মেয়ে। তবে একটাই দোষ। সব ব্যাপারেই ওভার সিরিয়াস।
আমার তো ইচ্ছাই করে না মুন্নির বিয়ের কথা ভাবতে। একটামাত্র মেয়ে। একমাত্র সন্তান। সেও পরের ঘরে চলে গেলে, আমরা বাঁচব কী নিয়ে? মাঝে মাঝে ভাবি, কোনো ভালো, বিদ্বান ছেলেকে জামাই করব। সে এসে, আমাদের কাছেই থাকবে অথবা আমরা মেয়ে-জামাইয়ের কাছে গিয়ে। আজকাল তো এমন কতই হয়।
কে জানে। মুন্নি কী হবে জীবনে? কী করবে, কেমন জামাই হবে আমাদের? কবে হবে? বৃদ্ধ বয়সে আমার আর রিমার জীবন অনেকখানিই নির্ভর করবে মুন্নি আর মুন্নির স্বামীর উপরে। একথাটা ভাবতে লজ্জা হয়, ভয় হয়ঞ্জ, আবার ভালোও লাগে।
ওরা হয়তো অন্য অনেকের মতো হবে না।
অন্যরকম হবে।
৫.
অপারেটরকে বলতেই দু-মিনিটের মধ্যে কলকাতার লাইন পেয়ে গেলাম। মুন্নিই ধরল।
কী রে! কী খবর? পেয়েছিস মার্কশিট?
না।
কেন রে?
তুমি মায়ের সঙ্গে কথা বলো। মা আসছে। মায়ের শরীর ভালো নেই।
হ্যালো।
রিমা বলল।
বলো কী হল? তোমার কী হয়েছে?
আমার কথা পরে।
কেন?
মধুস্মিতা সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে?
সে কে?
আঃ। জয়িতার মেয়ে। চেন না যেন!
সে তো দারুণই ভালো মেয়ে! স্কুল ফাইনালে তো আটাত্তর পার্সেন্ট নম্বর পেয়েছিল না?
হ্যাঁ। তা পেলে কী হয়? খাতা কি আর দেখেছে! খাতা দেখলে কি এমন হয়? না, হতে পারে? গজেনদার ছেলে রমু, তিনটি সাবজেক্টে চল্লিশের ঘরে নম্বর পেয়েছে, সেও সেভেন্টি-ফাইভ পার্সেন্টনম্বর পেয়েছিল স্কুল-ফাইনালে। প্রেসিডেন্সিতে পড়বে বলে তৈরি হয়ে বসেছিল ছেলে।
কিন্তু মুন্নির মার্কশিট কী বলছে?
আরে পেলে তো! তাহলে আর বলছি কী? আজ স্কুল থেকে চ্যাটার্জিবাবু গেছিলেন বোর্ডের
অফিসে খোঁজ করতে। তিনি জেনে এসেছেন, যে ছাবিবশ তারিখে আবারও গিয়ে খোঁজ করতে হবে। তখন জানাবেন ওঁরা।
তার মানে?
অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে, প্রায় রিমাকেই ধমকে বললাম আমি।
মানে, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? এডুকেশন মিনিস্টারকে জিজ্ঞেস করো, এডুকেশান সেক্রেটারিকে জিজ্ঞেস করো।
আমি কি তাঁদের চিনি?
যাঁরা চেনেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করো, খুঁজে বের করো। এখানে চলে এসো আজকেই রাতের গাড়িতে। কত ছেলে-মেয়ের বাবারা কত কী করছেন আর তুমি ওখানে বসে বসে ঘুমোচ্ছ। আর মাঝে মাঝেদয়া করে ফোন করছ। আমার কিছু ভালো লাগে না-আ-আ-আ
বলেই, কেঁদে ফেলল রিমা।
মেয়েদের এই অবুঝপনা আমার সত্যিই সহ্য হয় না। অথচ সহ্য না করেও কোনো উপায় নেই।
বললাম, দ্যাখো রিমা, আজেবাজে চিন্তার একটা সীমা আছে। বোর্ডের দোষে মার্কশিট পাওয়া যাবে না সময়ে, আর সে জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছেলে-মেয়েদের ফর্ম দেবে না, তাদের কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যাবেঞ্জ, তা কি হয়? এ কি জঙ্গলের রাজত্ব নাকি? যত্ব সব নাই-চিন্তা।
তারপরে বললাম, শনিবারে ফোন করব। সতেরো তারিখে। দ্যাখো। তার মধ্যে পেয়ে যাবে মার্কশিট ঠিকই।
তুমি আসবে না।
রিমা আলটিমেটাম দিল।
এখন গিয়ে করবটা কী?
মেয়ের মতিগতি আমার কিন্তু ভালো ঠেকছেনা। দিনরাত দরজা বন্ধ করে বসে আছে ঘরে। কথা বলছে না কারো সঙ্গে। বন্ধুরা ফোন করলেও ধরছে না। ছাবিবশ তারিখের আগে
তো সব কলেজের অ্যাডমিশানই ক্লোজড হয়ে যাবে। যদি তার আগেও মার্কশিট দেয় তবুও মেয়ের যা অবস্থা! তাকে আমি একা সামলাতে পারব না। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো। কিছু একটা করে বসলে? ও যা সেনসিটিভ, ইনট্রোভার্ট। তোমার পায়ে পড়ি। তুমি বড়োই অবুঝপনা করছ রিমা। মুন্নি মার্কশিট পেলেই আমি চলে আসব।
নগেনকে জানিও। ও টেলেক্স করে দেবে আমাকে এখানে। সঙ্গে সঙ্গে দিনে রাতের যে গাড়ি পাব তাতেই চলে আসব। আমি কি এখানে শখ করতে এসেছি? অডিটরের ছেলেরা সবাই এখানে এসে বসে রয়েছে বহুদিন হল। অডিট-ফার্মের পার্টনার কাল আসছেন। আমার পক্ষে এক্ষুনি যাওয়া অসম্ভব।
মেয়ে কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে। কিছু করে না বসে! আবারও বলছি। আমার একেবারেই ভালো লাগছে না।
যেমন মা, তেমন তো মেয়ে হবে! মুন্নিকে ডাকো। আমি কথা বলব। কী করে বসবে আবার?
কে জানে! কত ভালো ছেলে-মেয়ে সুইসাইড করে বসে!
মুন্নি ফোনে এল।
কি রে? কী পাগলামি করছিস তুই? তোর দোষটা কী? তুই যে মাত্র দু-ঘন্টা ঘুমিয়েছিস পরীক্ষার আগে তা কি আর আমরা জানি না? তোর মার্কস দেখিস, খুবই ভালো হবে। দেখিস। কোনো ব্যাপারই নেই।
থমথমে গলায় মুন্নি বলল, বাবা। খাতা দেখাই হচ্ছে না বোধহয়। হলে, ময়না, চিরদীপ, শকুন্তলাদের মার্কস এরকম হত না। কিছুতেই সম্ভব নয়। ইমপসিবল।
খাতা রিভিউ করতে চেয়ে অ্যাপ্লিকেশান করতে বল ওদের।
হুঁ। তুমি তো জান না। মিতাদি–চারবছর এম এ পাশ করে চাকরি করছে, এখনও বি এর খাতা Review করে ওঠার সময় পাননি তাঁরা। হুঁ।
আরে যাই হোক, খাতাই দেখে না, তা কি হয়? কত ফ্যাকটারস আছে। তুই আমি কি ওঁদের সব খবরই জানি? কেন যে কী হয়।
কী হবে, কেন?
মুন্নি বলল।
যে ছেলে-মেয়ে প্রেসিডেন্সিতে ভরতি হয় তাদের মধ্যে অনেকে অত খারাপ রেজাল্ট করে কী করে? নিশ্চয়ই পড়াশুনো করে না। আগে যে ভালো ছিল, পরে সে খারাপ হয়ে যায়, আড্ডাবাজি করে, ইউনিয়নবাজি করে। অন্যের কথা ভাবিস না। নিজের কথা ভাব। তা ছাড়া ধর, যদি তোর রেজাল্ট খারাপও হয়, তবুও তোর কী হবে? জলে পড়বি কি? আমরা তো আছি। এ.উ.ঘৃ.-এ বসবি। সেখানে তো আর অন্যায় হবে না। চলে যাবি ত্রগ্বউত্থড্র-এ।
মুন্নি বলল, নিজের দেশে, নিজের রাজ্যে এমন করে অন্যায় ঘটবে বলে, মানুষ এমন। দায়িত্বজ্ঞানহীন, এমন ক্রিমিনাল, নেগলিজেন্ট হয়ে গেছে বলে, স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে ন্যায় খুঁজব আমি? না, তা কেন! এখানেই থাকব এবং ওই মানুষগুলোকে শিক্ষা দেব।
অধৈর্য হোস না মা। যৌবনের সহজ ধর্মই অধৈর্য হওয়া। দ্যাখ, জাত হিসেবে আমরা চিরদিনই ঢিলে-ঢালা, কাছা-খোলা, তা বলে ভুলে যাস না যে অন্যেরা বলে What Bengal thinks today India thinks to-morrow. এও ভুলে যাস না যে, আমরাও একদিন যুবক ছিলাম।
তা ভুলিনি। কিন্তু তোমরা যদি যৌবনের দায়িত্ব-কর্তব্য ঠিকভাবে পালন করতে, যদি দেশের মধ্যে সবরকম অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, তবে দেশের অবস্থা আজ এমন হত না বাবা। আমরা ছেড়ে দেব না কাউকেই। তুমি দেখো, দরকার হলে নকশাল আন্দোলনের মতো। নতুন আন্দোলন গড়ে তুলে এদের আমরা গুলি করে মারব। রক্তে স্নান করিয়ে দিয়ে দায়িত্ব কর্তব্য কাকে বলে এদের শেখাব তা নতুন করে।
মুন্নির কথা শুনে আমার হাত-পা ছেড়ে যাবার জোগাড় হল।
মুন্নি, তুই মা, ক্যালি-ফস সিক্স-এক্সটা খাচ্ছিস তো নিয়মমতো? একটা কাজ করিস। এক শিশি
টুয়েলভ-এক্সও আনিয়ে নিস মুন্নি।
আমার বুকের মধ্যেটা ধড়ফড় করছিল।
তার দরকার নেই বাবা।
ক্যালি-ফস টুয়েলভ এক্সেও ঘুম আসবে না আমার।
কোনো চিন্তা করিস না মুন্নি। তোর মায়ের কথা ভাব। তোর মায়ের কথা। এটা একটা পাসিং। ফেইজ। কত ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষা দেয়, সেকথা ভাব তো একবার। বোর্ডের ডিফিকাল্টির কথাও ভাব একবার।
ভেবেছি, আরও একটু দেরি করে রেজাল্ট বের করলেন না কেন বোর্ড? কে বারণ করেছিল? কেন ইনকমপ্লিট রেজাল্ট বের করলেন? কেন সরকার, সমস্ত কলেজে এখনও ইনস্ট্রাকশান পাঠাচ্ছেন না এই ব্যাপারে?
কীসের ইনস্ট্রাকশান?
যে, যেসব পরীক্ষার্থী মার্কশিট দেরি করে পাবে, তাদেরও ফর্ম দিতে হবে। পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে ভরতির জন্যে এবং তার আগে আসন ভরতি করা হবে না।
আরে, দেবে রে দেবে। আমার না হয় কোনোই ক্ষমতা নেই। ক্ষমতাশালী বাবা-মাও তো কম নেই পশ্চিমবঙ্গে। তাঁরা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন? দৌড়োদৌড়ি করছেন তাঁরা। তাঁদের মাধ্যমে সেক্রেটারি, মিনিস্টার, জজসাহেব, অ্যাডভোকেট জেনারেল, মায় চিফ মিনিস্টারের লেভেল পর্যন্ত তদ্বির অবশ্যই পৌঁছে গেছে। তাঁদের সকলের চেষ্টার বেনিফিট তোরাও পাবি, সকলে মানেঞ্জ, আমার মতো সাধারণ ক্ষমতাহীন বাবা-মা যেসব ছাত্র-ছাত্রীরাঞ্জ, তারাও।
ছাই পাবে। যাদের খুঁটির জোর আছে তারা পাশও করবে, অ্যাডমিশনও পাবে। সবই তো তাদেরই জন্যে।
আমি কবে যাব জানাস। মার্কশিট পেলেই নগেনকে বলিস, টেলেক্স…
ও পাশে রিসিভারটা নামিয়ে রাখার শব্দ হল। একটু শব্দ করেই।
দুঃখ পেলাম। এরকম তো ছিল না মুন্নি আগে। ভারি অসভ্য হয়েছে তো! সহবতই যদি না শিখল, তবে পড়াশুনোতে কে কত ভালো তা দিয়ে কী হবে? শিক্ষা আর পরীক্ষার রেজাল্ট তো সমার্থক নয়!
সত্যি ভারি রাগ হল মুন্নির উপরে।
আমি রিসিভার নামিয়ে রাখলাম।
৬.
পাঁড়েজি, এখানকার চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট বললেন, বড়ী দেড়তক বাতেঁ চলা। কুছ গড়বর-সড়বর হো গ্যয়ী ক্যা?
বললাম, তেমন কিছু নয়। তবে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার রেজাল্ট ইনকমপ্লিট। বারো হাজার ন-শো ছাত্র-ছাত্রী এখনও মার্কশিট হাতে পায়নি। যারা মার্কশিট পায়নি তাদের সব কলেজই ফিরিয়ে দিচ্ছে। অ্যাডমিশান টেস্টেই বসতে দিচ্ছে না। ফর্মও দিচ্ছে না। বোধহয় দু-একটি কলেজ একমাত্র ব্যতিক্রম। মার্কশিট পেতে পেতে ভরতি হবারই সময় পার হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। চাপে পড়ে এখন যা-তা নম্বর দিয়ে মার্কশিট ভরানো হবে বলে আশঙ্কা করছেন। অনেকেই। অনেক ভালো ছেলে-মেয়ের মার্কস দেখে এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে যে, খাতা দেখাতে বা ট্যাবুলেশানে হয়তো কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। অথবা খাতা হয়তো ভালোভাবে দেখাই হয়নি।
পাঁড়েজি, হাসলেন। বললেন, আপলোগোকাঁ বংগালকা হালত আভি অ্যায়সা হুয়া হ্যায়? বড়া দুখকি ত বাত। হামারা পিতাজী নে কেলকাটা উনিবার্সিটিকি স্টুডেন্ট থা। উও জমানা দুসরা থা। ক্যানাম থা!
একটু চুপ করে থেকে আমাকে চুপ দেখে বললেন, আচ্ছা নীলুবাবু, আপনাদের এই কলকাতাতেই না পাঁচ পয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়ার জন্য আন্দোলন হয়েছিল . গুলি চলেছিল, ট্রাম পুড়েছিল। আর এমন একটা সাংঘাতিক ব্যাপারে কেউ কোনো প্রতিবাদ করছেন না? বিদ্রোহী, রেভলিউশনারি বাঙালিদের কি এই অবস্থা হয়েছে এখন? যাঁরা তখন আন্দোলন করেছিলেন তাঁরা এখন কোথায়?
কী বলব পাঁড়েজিকে?
কথাটা অপমানজনক হলেও সত্যি তো বটেই।
বললাম, জানি না পাঁড়েজি। গদির এমনই কিছু গুণ আছে, হয়তো ক্ষমতারও যেঞ্জ, তা মানুষের বিবেককে মেরে ফেলে, তার জায়গাতে ক্ষমতা, আরও ক্ষমতার লোভ ভরে দেয়। অন্ধ, কানা চলচ্ছক্তিহীন হয়ে যায় বিপ্লবী। পরম তৃপ্ত। নিজেদের কোনোরকম দোষ-ত্রুটিই আর তাদের চোখে পড়ে না।
স্টুডেন্টরা বিপ্লব করুক। প্রতিবাদ করুক। বাবা-মায়েরা সকলে মিলে পথে নামুন আপনারা সকলে মিলে! আমাদের পটনা হলে দেখতেন। বিহারও আপনাদের শেখাবে এখন।
আমি মাথা নাড়লাম। মুখে কিছু বললাম না।
মুন্নি কী নুটুনুটু, এরা সব অন্য প্রজন্মর ছেলে-মেয়ে। ওদের বুঝতে পারি বলে মনে হয় বটে আমাদের, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারি যে, আসলে আদৌ বুঝি না। ওরা অনেক চুপচাপ, কিন্তু অনেক বেশি জেদি। চলবে না, চলবে না আর গুড়িয়ে ফেলো, ভেঙে ফেলো দেখে দেখে আর শুনে শুনে ওরা ক্লান্ত। কৃত্রিম কণ্ঠস্বরে ক্লান্ত। মুখোশে ক্লান্ত। ওরা অন্য কিছু করতে চায়, যা ভান বা ভড়ং নয়ঞ্জ, যা সৎ, যা সত্য, যা প্রবলঞ্জ, এমন কিছু। মুখোশগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিতে চায় ওরা।
৭.
বোর্ডের অফিসে শ্রীকল্যাণ দাশগুপ্ত আমাদের সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করলেন। তবে তিনি যতই করুন, কম্পিউটারই তো সব গোলমালের মূলে। এরকম অব্যবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি কি দেওয়া যায় না? ছেলে-মেয়েদের মা-বাবাদের কী অবস্থা! কত ছেলে মেয়ে কলেজে ঢুকতেই পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ইনস্ট্রাকশন দেওয়া কেন হচ্ছে না বাবা?
আরও তিনটি দিন কেটে গেল। কোনো ফোন নেই। নগেনের টেলেক্সও এল না। আজ সপ্তম দিন। আজ সকাল থেকেই মনটা বড়ো উচাটন হয়েছিল। অফিসে এসেই পাঁড়েজিকে বললামও। সবই বললাম খুলে। উনি বললেন, আমি ম্যানেজ করে নেব এদিকটা। একমাত্র সন্তানের মামলা, না গিয়ে কী করবেন? আপনি কলকাতাতে পৌঁছেই একটি ছুটির দরখাস্ত দেবেন ওখানে। মেডিক্যাল সার্টিফিকেট আমি এখান থেকেই করিয়ে দেব। ডাক্তারের নির্দেশেই আপনাকে চলে যেতে হয়েছে এমন কথাই বলব, আমার কাছে জানতে চাইলে।
খুবই ছোটো লাগল নিজেকে। এমন তঞ্চকতা করিনি কখনো আগে। এও তো এক ধরনের নীচতা, শঠতাঞ্জ, মিথ্যাচার, কর্তব্যহীনতা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের, সিসটেম-এর বিবেকহীনতাই যে এর মূলে? আমি ন্যায্য কারণে ছুটি চাইলে এবং তা দিলে আমার তো মিথ্যাচার করতে হত। না।
ভাবছিলাম, নিজেদের জীবনের অনেক এবং অনেকরকম সমস্যারই সমাধান করা যায় না কিন্তু সন্তানদের সমস্যার সমাধান না করতে পারলে মা-বাবা হিসেবে বড়োই অসহায় বোধ করতে হয়। যেখানে ওদের কিছুমাত্রই দোষ নেই অথচ মুষ্টিমেয় মানুষের অভাবনীয় দায়িত্বজ্ঞানহীনতাতে এমন ক্যালাস ঘটনা ঘটতে পারে এবং শুধু ঘটতে পারে যে তাই নয়, তার পরেও তাদের নির্লজ্জ could not careless attitude সত্যিই জ্বালা ধরিয়ে দেয় মনে।
জানি না আর ভাবতে পারি না। যেসব ছেলেমেয়ের ফল অসম্পূর্ণ আছে তাদের বাবা-মায়েরাই শুধু জানবেন আজ আমার মনের মধ্যে কী আছে। অসহায়, খুঁটির জোর না-থাকা, সাধারণ বাবা মায়েদের কথা শুধুমাত্র তাঁরাই জানেন, জানবেন।
৮.
আজ নবম দিন। ফোন করেছি রোজই। রোজই খারাপ খবর। মুন্নির ফোন আসছে না। রিমার প্রেসার আরও বেড়ে গেছে। ডঃ মিত্র একেবারে শয্যাশায়ী থাকতে বলেছেন।
অথচ এসবের কিছুর জন্যেই আমাদের কারোই অপরাধ নেই। কোর্টে কেস করে দেওয়া উচিত প্রচণ্ড ক্ষতিপূরণ চেয়ে, ইনজাংশান চেয়ে। সমস্ত ছেলে-মেয়েদের মার্কশিট তাদের হাতে না-আসা অবধি সব কলেজ ভরতি বন্ধ রাখবে, এই দাবিতে। কিন্তু কেস কে করবে? প্রতিটি কাগজে সংসদ আর বিধানসভায় জুতো ছোঁড়াছুঁড়ির খবর। কিন্তু মুন্নিদের ব্যাপারটা একটা খবরই নয়।
ধন্য নব্য সাংবাদিকতা! ধন্য খবরের কাগজের মালিক আর সম্পাদকেরা! ধন্য! ধন্য! ধন্য!
৯.
ট্রেনটা, ফর-আ-চেঞ্জ, সকালে সময়মতোই পৌঁছল হাওড়াতে। আমার বগিটা ছিল প্ল্যাটফর্মের পেছনের দিকে। ট্যাক্সির যা লম্বা লাইন দেখলাম, তাতে বুঝলাম একঘন্টা কম করেও লাগবে। বেশিও লাগতে পারে। প্রাইভেট ট্যাক্সি এবং পুলিশকে টাকা-দেওয়া হলুদ-কালো ট্যাক্সিও সামনেই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু যে টাকা তারা চায়, তা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই।
পুলিশ সবই জানে। দমদম এয়ারপোর্টে, হাওড়া স্টেশনে রোজই এই ছবি। আমরাও সব জানি। বছরের পর বছর ধরে এই চলেছে। কিন্তু গন্ডারের চামড়ার আমরা একদিনও এক মুহূর্তের জন্যেও সমবেত হয়ে পুলিশদের কলার ধরে বলতে পারিনি যে, ওহে জনগণের সেবক, শুনুন। আমাদেরই পয়সায় মাইনে পান, আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বেই বহাল আছেন আপনারা। সেবা যাকে বলে, তাই করুন। বলতে পারি না, ওহে এম এল এ এখন কিছু করুন। পয়সা তো অনেকই বানালেন এবারে কিছু কাজ করুন।
কিন্তু কে করবে? কে বলবে? অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।আমাদের যে সময়ই নেই! আমরাও যে অন্য নানাবিধ ধান্দাতে নিজেদের পকেট ভারী করার মতলবে সদাই ঘুরি। আজ আমার সত্যিই সময় নেই। আমি এও জানি যে, পরের বার যখন হাওড়া স্টেশনে এসে নামব তখনও আমার সময় থাকবে না। অন্য কারোই থাকে না। প্রতিকার করবেটা কে? বা কারা? আমরা যে কুকুর-বেড়াল হয়ে গেছি। মুন্নি আর তার বন্ধুরা হয়তো করতে পারে। কিন্তু কবে? কী করে? এই দেশ, এই রাজ্য তো এদেরই মতো আমাদেরও। আমাদেরও কি করণীয় নেই কিছুমাত্র?
মনে মনে আমি বলি, করবে করবে। মুন্নিরা আর ওদের বন্ধুরাই করবে। চলবে না এই নৈরাজ্য আর বেশিদিন। তোমাদের বধিবে যারা, গোকুলে বাড়িছে তারা। বাসেই উঠে বসলাম, হেঁটে এসে। ছোট্ট একটি ওভারনাইটার ছিল সঙ্গে। মোড়ে নেমে বাড়ির কাছাকাছি এসে দূর থেকে দেখি, গলিতে চার-পাঁচটি প্রাইভেট গাড়ি। মনটা আনন্দে ভরে গেল। নিশ্চয়ই মার্কশিট পেয়েছে মুন্নি। হয়তো দারুণ ভালো ফল হয়েছে।
ওই গাড়িটা কার? ভড় সাহেবের না? তাই তো। ওই গাড়িটা দেখেই আমার সন্দেহ হল। উনি কেন? মুন্নির মার্কশিট পাওয়ার আনন্দে, তার দুর্দান্ত ফল করার আনন্দের উৎসবে তো তাঁর। আসার কথা নয়! তিনি কোনোদিনও আসেননি আমার এইদীনাবাসে। তাছাড়া,
আমি এখন ঢুকবই-বা কী করে? উনি যতক্ষণ আছেন, ঢুকতেও যে পারব না। মেডিক্যাল সার্টিফিকেট তো নিয়ে নিয়েছেন পাঁড়েজি। এখন পাঠাতেই যা দেরি।
আসলে, ভড়সাহেব মানুষটিকে যতখানি খারাপ ভাবি, ততখানি খারাপ হয়তো নন।
আমি আসতে পারিনি, ওঁরই জন্যে, তাই হয়তো মেক-আপ করার জন্যে এসেছেন।
বাঃ। ইটস ভেরি নাইস অফ হিম।
এত জনে এসে পড়েছেন আমার পাখির-বাসায় আর শুভদিনে খালি হাতে বাড়ি ঢুকব? যখনই ঢুকি না কেন। ময়রার দোকানে ফিরে গেলাম। পকেটে একটিই এক-শো টাকার নোট ছিল।
বললাম, মতি, ভালো সন্দেশদাও, একেবারে ভোর রাতে বানানো।
মেয়ের গর্বে আমি যে গর্বিত এই কথাটা আমার মুখে-চোখে চাপা ছিল না।
মতি আমার মুখের দিকে তাকাল একবার তারপর আমার বাড়ির দিকেও তাকাল।
তাকিয়েই বলল, মুখ নীচু করেঞ্জ, সকালে এত মিষ্টি নিচ্ছেন যে নীলুদা?
আরে মুন্নি, তাকে তো তুমি চেনোই না আমার মেয়ে গো! তার যে আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে। খবর। পেয়ে এসেছেন সবাই। মিষ্টিমুখ তো করাতেই হয়!
মতি আমার দু-চোখে তার দু-চোখের মণি ফেলে চেয়ে রইল ফ্যাল ফ্যাল করে।
তারপর, একটু গলা খাঁকরে বলল, নীলুদা, এখন ঠিক তেমন ভালো মিষ্টি নেই। মানে, কারখানা থেকে আসেনি। তবে এসে যাবে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। আপনি টাকাটা এখন রাখুন বরং। মিষ্টি এলেই আমি ফটকেকে দিয়েই আপনার ওখানে পাঠিয়ে দিচ্ছি। মুন্নি তো আমাদেরও কেউ হয়, না কি? আজকেরটা না হয়…এমনিই। টাকা দেবেন না। আমিই…
আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। শুধু আমি, একাইনই, আমাদের পাড়ার লোকও যে মুন্নিকে নিয়ে এতখানি গর্বিত, তা আগে জানিনি। আবেগে আমার গলার কাছে দলা পাকিয়ে। এল।
একগাল হেসে বললাম, ঠিক আছে। পাঠিয়েই দিও। থ্যাঙ্ক ট্য।
সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, একদিন ঘনিষ্ঠদের ডেকে ডাল-ভাত খাওয়াব মতি। সেদিন তোমাকেও বলব। ফটকেকেও। আসতে হবে কিন্তু। কোনো কথাই শুনব না। মতি সেইরকমই কাঠ-কাঠ গলাতে বলল, নিশ্চয়ই দাদা। বলবেন, অবশ্যই আসব।
আমি ওর দোকান থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে এগোলাম। এবারে দেখলাম, বাড়ির সামনে যেন একটা জটলা মতোও হয়েছে। এক জন দু-জন করে লোক ফোঁটা ফোঁটা ঘামেরই মতো সেখানে জমছে, জমছেই…আমাকে দেখেই ওরা এদিকেই, মানে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল।
১০.
দোকান ফাঁকা হতেই, মতি নীচু গলাতে বলল, ফটকে মদনাকে এই টাকাটা দিয়ে আসিস। সাদা পদ্ম আর রজনিগন্ধা রেডি করে রাখবে। লাশকাটা ঘর থেকে বডি বাড়িতে ফিরে এলেই…
লাশকাটা ঘর?
ফটকে বলল।
আপনি পাগল হয়েছেন বাবু! গেছেন কখনো সেখানে? উঃ বাবা! সেখানে একবার ঢুকলে ক-দিন পর ফেরত যাবে বডি তা কে জানে! ফুলে-ফেঁপে ঢোল হয়ে কাটা-ছেড়া শরীরটা যখন ফেরত। পাওয়া যায় তখন আর বাড়িতে তাকে আনাই যায় না!–বাবা দেখবে ওই দশা! ফুলের মতো মেয়ের? সোজাই শ্মশানে নেওয়া ভালো। হ্যাঁ। তবে যদি কেউ জানাশোনা থাকে পুলিশে, রাইটার্সে, সেক্রেটারি, মন্ত্রীঞ্জ, তাড়াতাড়ি হতেও পারে। নইলে, কোনো চান্সই নেই,
নীলুদা বোধহয় যখন ট্রেনে চেপেছে খবর গেছে তার পরে নিশ্চয়ই। বেচারা জানেন না কিছুই। হায় ভগবান!
মতি স্বগতোক্তি করল।
মেয়েটা এসবের কিছু তো জানত না! মানে যে, তাকে কাটাকুটি করা হবে। মরেও যে মুক্তি নেই এখানে, শান্তি নেই, শ্মশানেও যে কত নোংরা, কী জঘন্য পরিবেশ, ভিখিরি, মস্তান, শ্মশানের বাবুদের, পুরুতের ধমকানি, তা ও বেচারা জানবে কী করে! গত মাসেই তো কাকাকে পোড়ালাম।
বাবু? সেসব জানলি, ও মেয়ে মরতেই চাইত না। তাছাড়া মরলি মরলি, তো শিরা কেটে! ইস! কী বিভৎস!
মতি বলল, হয়তো মার্কশিটও পাবে, হয়তো ছাবিবশ তারিখের আগেই পাবে কিন্তু আর কী হবে? সব তো শেষই হয়ে গেল। চিন্তায় চিন্তায় মেয়েটা শেষ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় কী জানেন বাবু?
মতি বলল, কী?
রসগোল্লার জালের জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ একখানা বের করে নে গিয়ে যারা ইজন্যে দায়ী, সি শালাদের মুখের মধ্যে পুরে দিই।
চুপ কর। কথা ভালো লাগছে না এখন।
মতি অন্যমনস্কভাবে বলল।
তারপর মনে মনেই বলল, ক-জনের মুখে জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ ঢোকাবি রে তুই ফটকে?