একজিবিশন দেখে যখন বার হই, তখন বোধ হয় মিল্কী, কি নাম দেব তার, বখতিয়ার, আমাকে একটি মৃত শহরে পৌঁছে দিয়েছেন। অথচ মৃত শহরের ভয়ঙ্করতা আমার একেবারে চেনাজানা।
আমার মনে হচ্ছে তিনটা গ্রাম মিলে একটা গ্রাম হয়েছে, তিনটা নদী মিলে একটা নদী হয়েছে, তিনটা নারী মিলে একটা নারী হয়েছে: বখতিয়ার তিনটা গ্রাম মিলে একটা মৃত গ্রাম এঁকেছেন, তিনটা নদী মিলে একটা মৃত নদী এঁকেছেন, তিনটা নারী মিলে একটা মৃত নারী এঁকেছেন, সর্বত্র সবকিছু মৃত মৃত। মৃত কি শব্দ? মৃত কি লাশ? মৃত কি পচা গলিত দুর্গন্ধ?
যারা বেঁচে থাকে তারাও তো মৃত এবং গলিত এবং দুর্গন্ধ। বেঁচে থাকার বাস্তবতা ও থিওরির বাস্তবতা কি এক? আমার মাথায় এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে থাকে। এই ঘুরপাক থেকে গুঞ্জন ওঠে। গুঞ্জনটা ভ্রমরের না। অনেক বইতে পড়েছি। কোন বই তৃপ্তি দেয়নি। একটা অতৃপ্তি আমাকে ঘিরে রাখে, সর্বক্ষণ ঘিরে রাখে।
একটা বইয়ের কথা বলি। বইটা পেরুর ইন্ডিয়ান রমণীদের নিয়ে। রমণীটির বাসস্থান একটা ছোট পাহাড়ের মাথায়। সঙ্গে থাকে তার দুই সন্তান। সৈন্যরা যখন এ অঞ্চলটায় তল্লাশি চালায়, তখন তার ষাট বছরের স্বামীটি গুলি খেয়ে মারা যায়।
ঐ রমণীটির জীবন নিয়ে, জার্মান তাত্ত্বিক হাবারমাসের থিওরির আলোকে প্রক্ষেপ করেন একজন নৃবিজ্ঞানী, নাম : সুজান। তার চেপ্টা সমাজের থিওরি এই রমণীটির কাছে কতটুকু স্পষ্ট কিংবা স্বচ্ছ কিংবা সরল: তা বোঝা। আলমাটোমি জিজ্ঞেস করে, কাকে থিওরি বলে?
প্রশ্নের ধরন দেখে সুজান ঘাবড়ে যায়।
তবু সাহসের সঙ্গে বলতে থাকে, থিওরি হচ্ছে কোন কিছুর বিবরণ অথবা বর্ণনা। থিওরি তোমাকে শেখায় কোথায় ভুল আছে, ভুলটা কিভাবে শোধরানো সম্ভব।
আলমাটোমি বলে ওঠে, তাহলে সৈন্যদের মানা করো আমাদের হত্যা না করতে।
তোমাদের মাতা চিবিয়ে চিবিয়ে আলমাটোমি জিভ ও তালু কালো করে ফেলেছে।
ঠিক আছে, সুজান বলে ওঠে, কিন্তু থিওরি এর চেয়ে বেশি কিছু। থিওরির জন্য দরকার ভাল একটা যুক্তি তৈরি করা।
আলমাটোমি শুধু মাথা নাড়ে। কয়েক লহমা চুপ থাকে। পরে বলে ওঠে, বলেছি না সৈন্যদের মানা করো। আমাকে একটা নতুন স্বামী দাও। স্বামীটি আমার সঙ্গে যেন রাত কাটাতে পারে। এখানে বেজায় ঠা-া। আমার বয়স হচ্ছে। গ্রামের জোয়ান ছেলেদের আমার মতো বুড়ি পছন্দ না। তাদের চিন্তাভাবনা বদলাতে পারো। যদি পারো তাহলে আমাদের মতো বুড়িদেরও তাদের পছন্দ হবে। এই পর্যন্ত পড়ার পর, আমি বুঝি এভাবে বেঁচে থাকার থিওরি ও বেঁচে থাকার বাস্তব তৈরি হয়।
দুই.
আমি আলমাটোমি নামক একজন নিরক্ষর পেরুর মহিলার কথা ভাবি।
আমি সুজান নামক একজন পড়ালেখা জানা জার্মান মহিলা নৃবিজ্ঞানীর কথা ভাবি।
আমি বখতিয়ার নামক একজন নামকরা শিল্পীর রঙের ভুবনের কথা ভাবি।
এরা সবাই আমাকে বিভিন্ন বাস্তবের সামনে মুখোমুখি করে দিয়েছেন।
আমি ভাবি আমি নেংটো হয়ে গেছি। একটা সুতোও নেই আমার পরনে।
তিন.
একেই বোধহয় বাস্তব বলে। বাস্তবের
থিওরি বলে।
আমি বুঝি না।
আমি যত বেশি বিভ্রান্ত হই তত বেশি বুঝতে চাই।
কিন্তু কোথাও কেউ ছোট না।
পৌঁছতে চাই, পৌঁছতে পারি না। এই দ্বন্দ্বটা আমার ভেতর ভয় তৈরি করে।
আমি আলমাটোমিকে খুঁজে বেড়াই সর্বত্র।
আপন মনে বলি: দয়া করো। আমাকে দয়া করো।
আমার ভেতরতার ক্রন্দন সাত আসমানে ছড়ায়।
সাত আসমানের কল্পনা আমরা কেন করেছি। জানি না।
চার.
মানুষ তো মরে যায়। মানুষ তো আবার বেঁচেও থাকে।
আলমাটোমির চোখের ক্রোধ আমি কিছুতেই ভুলি না। আলমাটোমিরা পৃথিবীর সর্বত্র মরে গিয়েও বেঁচে থাকে। তাদের নড়ানো যায় না, সরানো যায় না। তারা তাদের ভাবনাগুলোকে এক সন্তান থেকে অন্য সন্তানকে পৌঁছে দেয়। গরিবরা এভাবেই সাহসের সঙ্গে বাঁচে।
পাঁচ.
বখতিয়ার একদিন বলে, একটা ভাল একজিবিশন চলছে। চলো তোমাকে দেখিয়ে আনি।
তার?
মুক্তির।
ছয়.
মুক্তির ‘ক্রাই’ ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে আমি ভয় পেয়ে যাই। চিৎকারে খান খান হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। কান ঢাকার পরও চিৎকারে ফেটে যাচ্ছে পরিপার্শ্ব। এই চিৎকারের কোন জবাব নেই, একটা অসম্ভব ভয় চারদিকে ঘিরে ধরেছে। এই ভয়টাকে এই রোদনটাকে এই চিৎকারটাকে আমাদের সামনে শিল্পীরা এবং আলমাটোমিরা সব সময় হাজির করে দিচ্ছেন। চিৎকারটা রোদনটা ভয়টা রং হয়ে গলে যাচ্ছে চোখ থেকে, তাই আলমাটোমিদের চোখে রক্ত এবং ক্রোধ এবং রক্তই অস্তিত্ব।
সাত.
বখতিয়ার বখতিয়ার।
কি।
আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো।
ভয় ধরেছে তোমার।
এই ভয় আমাকে গ্রাস করবে।
আট.
আমি তখন বখতিয়ারকে আলমাটোমির গল্পটা বলি।
কেন ক্রোধ শেষ হয় না। কেন ক্রোধ কখনো মরে না।
কেন ক্রোধ শেষ হয় না
রেটিং করুনঃ