জীবনের চা চক্রে

image_1362চা_ শুধু একটিমাত্র অক্ষরে তৈরি শব্দটির মূলে এক সুদীর্ঘ এবং অতিপ্রাচীন ইতিহাস বিধৃত রয়েছে। চা মূলত চীন, শ্রীলংকা এবং ভারতে উৎপাদিত হলেও চা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশও আজ আর পিছিয়ে নেই। সিলেট, চট্টগ্রাম, দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের চা-বাগানই তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন। পারস্য আরবে চাই, চীনে কু-তু বা কু-চা, কিয়া, শেহ্, চুয়েন। ইতালিতে টে, ফ্রান্সে থি, জার্মানিতে দি আর জাপানে স্যা_ এই শব্দগুলো আমাদের দেশে অতি পরিচিত ‘চা’। বিভিন্ন দেশে এই চা বিচিত্র সব নামে পরিচিত; বিচিত্র তার আয়োজন আর অভিজ্ঞতা। কত জীবনের কত সুখ-দুঃখ জড়িয়ে আছে এই চায়ের কাপে তার ইয়ত্তা নেই। আজ আমাদের দেশেও এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে চা নেই। হাটে-ঘাটে, মাঠে-বন্দরে, গলির মোড়ে, স্টেশনে, অজপাড়াগাঁয়ে_ সর্বত্রই এর সমাদর। চা ছাড়া যেন জমে ওঠে না দিন, জমে না আড্ডা।
আমাদের দেশে সর্বস্তরে এত ব্যাপকভাবে চা পানের আয়োজন দেখা গেলেও এর উৎপত্তিস্থল চীন-জাপানে চা পানের যে আনুষ্ঠানিক আয়োজন দেখতে পাওয়া যায়, তা নিতান্তই একটা শিল্প। তাদের চায়ের জন্য আলাদা চা-ঘর থাকে। যেখান থেকে আনুষ্ঠানিক ও শিল্পসম্মতভাবে চা সরবরাহ করা হয়। তার জন্য যে ঘরগুলো নির্ধারিত হয়, সেগুলোর নামকরণও কাব্যিক সুষমামণ্ডিত। জাপানিরা প্রতিনিয়তই চা খায়। দেখতে অনেকটা বালিশের মতো ছোট চায়ের প্যাকেট আছে; সেটা গরম পানিতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে তারা সারাদিন চা খায়।
বাংলাদেশেও চা পানের নানারকম রীতি-পদ্ধতি চালু আছে । শহরাঞ্চলে নিছক ক্লান্তি নিবারক হিসেবে চা পান একটা দৈনন্দিন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। গ্রাম-গঞ্জও এ থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই আজকাল। বাড়িতে বাড়িতে চায়ের আড্ডা বা চায়ের মজলিশ আমাদের সংস্কৃতিরই যেন অংশ হয়ে উঠেছে।
চা তৈরিতেও রয়েছে বহু আনুষঙ্গিক ব্যাপার। চা পরিবেশনের আছে বাহারি ধরন। চীনামাটির পাত্র, বারকোষ বা টি-ট্রে আর চায়ের কেটলি সবারই পরিচিত। চায়ে চামচ ব্যবহারের প্রচলনটিও তাৎপর্যপূর্ণ। মাপমতো ওষুধ সেবনে চামচের ব্যবহার আগে থেকেই ছিল। চায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কীভাবে যেন চা-চামচ কথাটাই একটা মাপের একক হয়ে গেছে।
আমাদের মতো অনুন্নত দেশে চায়ের সূত্রপাত এবং প্রচলন ঘটে ঔপনিবেশিক আমলে। সে আমলে চায়ের প্রসারে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাও চালানো হয়েছিল। চাকে জনপ্রিয় করার কাজটি করা হতো টি-বোর্ড থেকে। পত্র-পত্রিকায় চায়ের বিজ্ঞাপন তো থাকতই, এখানে-ওখানে বিনামূল্যে চা খাওয়ানোর ক্যাম্পেইনও চালানো হতো এই বোর্ড থেকে। চা খাওয়ার উপকারিতা, কীভাবে খেতে হয় ইত্যাদি বলে বেড়াত। সেই সুবাদে চা এখন আমাদের জীবনের এক নিত্য অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। চায়ের রয়েছে নানান রকমফের। ঔষধি বা রোগমুক্তির সহায়ক হিসেবেও চায়ের গ্রহণযোগ্যতা আছে। সর্দি-কাশিতে এর যেন তুলনাই হয় না। এমনকি পানীয় হিসেবে চায়ের ঔষধিগুণ বাড়াতে এর সঙ্গে তুলসী, পুদিনা বা মিন্টের ব্যবহারও বেশ জনপ্রিয়। আর আদা-চা নামে এক প্রকার চা তো সুপ্রতিষ্ঠিত। সর্দি নিবারণ বা কণ্ঠ পরিষ্কারক হিসেবে চায়ের সঙ্গে আদাটা বেশ জমে ওঠে। হালকা ঠাণ্ডা-কাশি হলেই আমাদের মা-মাসিরা এখনও আদা চা করে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর রঙ-চা নামের যে চা আছে, শীত-গ্রীষ্মে সমানভাবে সে পারদর্শী আমাদের মন ও শরীরকে রাঙিয়ে তুলতে।
চা নিয়ে বিড়ম্বনাও আছে অনেক। একবার সুনীল দার সঙ্গে এক বাড়িতে গেছি বেড়াতে। সেখানে চা আর নারকেলের নাড়ূ দেওয়া হয়েছে আমাদের। কিন্তু সমস্যা হয়েছে নাক টিপে দু’জনে চা’টা না হয় কোনোমতে খেয়ে নিয়েছি, নাড়ূ তো মুখ দিয়ে ঢুকছে না। কেমন একটা গন্ধের কারণে সেই নাড়ূ আমরা কিছুতেই খেতে পারছিলাম না। সুনীল দা দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বললেন, এটা ফেলে দিলে তোর কোনো অসুবিধা আছে? উপায় না দেখে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সত্যিই টুপ করে নাড়ূ ফেলে দিলাম দোতলার জানলা দিয়ে নিচে। সে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় শুনলাম নিচতলায় এক বৃদ্ধ বলছিলেন, ছেলেপুলেগুলো কী যে দুষ্ট হয়েছে_ দেখো, নাড়ূগুলো নিচে ফেলেছে! আমরা তো প্রায় পালাতে পারলে বাঁচি!
২. একসময় ঢাকায় চায়ের দোকানে দোকানে কেটে যেত আমাদের দিন। নামকরা সব চায়ের দোকানও ছিল। দিন-রাত যখনই যেতাম কাউকে না কাউকে সেখানে পাওয়া যেতই। পাকিস্তান আমলে নওয়াবপুর রেলগেটের কাছে ক্যাপিটাল নামে একটা চায়ের দোকান ছিল। চায়ের জন্যই বিখ্যাত ছিল ক্যাপিটাল। ক্যাপিটালের চা আর টোস্ট খেতে আমরা সেখানে জড়ো হতাম। নওয়াবপুর রোডে ঢুকতে প্রথম দোকানটাই ছিল এটি। তার উল্টোদিকে ছিল টিপটপ টি ট্রেডার্স নামে একটা চা পাতার দোকান। শহীদ কাদরি, শামসুর রাহমান, মুর্তজা বশীর_ কে না যেত ক্যাপিটালে! তখনকার ঢাকা শহর তো আর এত বড় ছিল না। আজকের এই গুলিস্তান পার হলে ঢাকার শুরু। নওয়াবপুর হয়ে রাস্তা গেছে সদরঘাটের দিকে। অপরদিকে ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন। এখন নওয়াবপুর রোডের চেহারাই তো আমূল পাল্টে গেছে। বংশাল রোডের দু’পাশেও ছিল কিছু চায়ের দোকান। চবি্বশ ঘণ্টাই চলত এগুলো।
চা খাওয়ার ঢাকাইয়া কিছু চলও ছিল। যেমন ডাণ্ডা চা_ চায়ের কাপে এমন পরিমাণ চিনি দেওয়া হবে যাতে একটা চামচ রাখলে চামচ দণ্ডের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। মালাই চা ছিল, তাতে কাপ ভরে দুধের মালাই দেওয়া হতো। আর ছিল হাফ কাপ চা। মানে অর্ধেক দামে অর্ধেক কাপ চা। এ রকম ছোট-ছোট চায়ের দোকান সারাদিনই জমে থাকত।
ক্যাপিটাল থেকে আমরা চলে যেতাম বিউটি বোর্ডিং-এ। বিউটি বোর্ডিং তো চায়েরই দুনিয়া। বিউটি বোর্ডিং থেকে বাংলাবাজারের দিকে যেতে আরেকটা চায়ের আড্ডা ছিল_ গোবিন্দের চায়ের দোকান। গোবিন্দের চায়ের দোকানকে ঘিরেও আছে কত না স্মৃতি! বিখ্যাত সাঁতারু ব্রজেন দাস প্রতিদিন মুরগি খেতেন এই গোবিন্দের দোকানে। ব্রজেন দা ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেবেন। সাঁতার অনুশীলন করছেন। বাড়তি শক্তির জন্য প্রতিদিন মুরগি খেতেন। উনার জন্য গোবিন্দের দোকানে প্রতিদিন একটা মুরগি রান্না করা হতো। উনি এসে খেতেন।
তখন তো আর এখনকার মতো মোবাইল ফোন ছিল না। এসব চায়ের দোকান কিংবা অন্য সব চায়ের আড্ডাতেই আমরা খুঁজে পেতাম আমাদেরকে।
গেণ্ডারিয়ায় যেতাম। সেখানে সকাল সকাল পুরি পাওয়া যেত। আর ছিল গন্ধেশ্বরী নামে একটা মিষ্টির দোকান। কথিত ছিল, এই গন্ধেশ্বরীর ব্যাটা জীবনেও ঢাকার এই দিকটা অর্থাৎ ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তানের দিকটায় আসেনি। ও ব্যাটা গেণ্ডারিয়াতেই থাকত আর মিষ্টি বিক্রি করত। তার মিষ্টি আর সোনা মিয়ার দই খুব নামকরা ছিল তখন।
তখনকার দিনে যখন যেখানে যেতাম, চায়ের আড্ডাই জমে উঠত সবখানে। কলকাতায় অবশ্য কফি হাউজ ছিল। ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের মাধ্যমে সেখানে কফি শপগুলো চলত। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজে যেতাম। প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনের দোতলা কফি হাউজটা এখনও আছে। চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে আপার হাউজ, লোয়ার হাউজ_ এ দু’ভাগে কফি হাউজ চলত। সেই আপার হাউজে বসতেন সত্যজিৎ রায়ের মতো লোকরা। তার লাগোয়া ছোট্ট ঘরটাতে ফিল্ম আন্দোলন; মৃণাল সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়_ কে না আসতেন! এমনকি বাংলা চলচ্চিত্র জগতের যে বড় পরিবর্তনটা এসেছিল, তার অনেকটাই হয়েছে এখানে। এরা এলে অবশ্য তরুণদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। নানা রকম লোকের আড্ডা বসত সেখানে। আস্তে আস্তে আড্ডার চেহারা বদলাতে থাকে মাস্তান-টাস্তানরা ঢোকার পর থেকে। তারপর নকশালবাড়ী আন্দোলনের বিপ্লবীরা আসতে শুরু করে। এভাবে ধীরে ধীরে বদলে যায় চায়ের আড্ডার অতীত জীবন। তবু জীবনের খাতা খুললে বোধ হয় চা হাতে নিয়ে তুমুল কথার তুবড়ি ছোটানো সময় নেহাত কম হবে না। ধূমায়িত চা সামনে নিয়ে বসে থাকা দিনগুলো ধোঁয়ার মতোই মিলিয়ে গেল_ চা কিন্তু মিলিয়ে যায়নি। দিন দিন তার বৈচিত্র্য আর জেল্লাই বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে এর ভক্তকুল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এর বাইরে ছিলেন না। তিনি শান্তিনিকেতনে চা-চক্র প্রবর্তন করেছিলেন। সে উপলক্ষে লিখেছিলেন :

হায় হায় হায়
দিন চলি যায়।
চা-স্পৃহ চঞ্চল
চাতকদল চল
চল চল হে!
টগবগ উচ্ছল
কাথলিতল জল
কল কল হে!

এল চীন-গগন হতে
পূর্বপবনস্রোতে
শ্যামল রসধরপুঞ্জ,
শ্রাবণবাসরে
রস ঝরঝর ঝরে
ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ
দলবল হে!

এস পুঁথিপরিচালক
তদ্ধিতকারক
তারক তুমি কা ারী,
এস গণিত-ধুরন্ধর
কাব্য-পুরন্দর
ভূবিবরণ ভাণ্ডারী।
এস বিশ্বভার-নত
শুষ্ক-রুটিনপথ
মরুপরিচারণ ক্লান্ত!
এস হিসাব’পত্তর’ত্রস্ত
তহবিল-মিল-ভুলগ্রস্ত
লোচনপ্রান্ত
ছল ছল হে!

এস গীতিবীথিচর
তম্বুরকরধর
তানতালতলমগ্ন,
এস চিত্রী চটপট
ফেলি তুলিকাপট
রেখাবর্ণবিলগ্ন।
এস কনস্টিট্যুশন
নিয়ম-বিভূষণ
তর্কে অপরিশ্রান্ত,
এস কমিটি-পলাতক
বিধান-ঘাতক
এস দিগ্ভ্রান্ত
টলমল হে।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
বেলাল চৌধুরী- র আরো পোষ্ট দেখুন