নদী লুণ্ঠন এবং অর্থমন্ত্রীর স্বপ্ন

ঢাকার পার্শ্ববর্তী তুরাগ নদের একটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে ৩ ফেব্রুয়ারির সমকালে। তাতে বলা হয়েছে, “মিরপুর থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত প্রায় ১৮ কিলোমিটারের মাঝে মধ্যে তুরাগের বুকে পানির দেখা মিললেও বেশিরভাগ অংশ বালু জমে নদীর পিঠ বেরিয়ে এসেছে। দখল-ভরাট আর দূষণে ‘নিখোঁজ’ হতে চলেছে তুরাগ। বেড়িবাঁধ ধরে উত্তর দিকে কিছুদূর এগিয়ে চটবাড়ি এলাকায় পেঁৗছলেই দেখা যায়, নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে লেদারল্যান্ড পার্ক। বেশ বড় একটি এলাকা বালু দিয়ে ভরাট করা হয়েছে; ভেতরে লাগানো হয়েছে গাছপালা। দুটি অবকাঠামোও গড়ে তোলা হয়েছে। নদীর সীমানা পিলারও পড়েছে ওই পার্কের ভেতর। এরই পাশ দিয়ে কোনো রকমে বয়ে যাচ্ছে মৃতপ্রায় তুরাগ।”

ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যার ওপর এ ধরনের রিপোর্ট নতুন নয়। অনেক বছর ধরে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার, প্রথম আলোসহ অন্যান্য পত্রিকায় অসংখ্যবার এ ধরনের রিপোর্ট ইতিপূর্বে প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে বোঝার কোনো অসুবিধা হয় না, কীভাবে এই নদীগুলো ভূমিদস্যুদের দ্বারা দখল হতে হতে এগুলোর অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হতে বসেছে। এগুলোর পানি দূষিত হয়ে মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবন প্রায় ধ্বংস করেছে এবং এগুলোর ওপর নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে উঠে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়েছে। এভাবে দখল চলতে থাকলে অল্পদিনের মধ্যেই নদীগুলোর নাম-নিশানাও আর দেখা যাবে না।

দেশে তো একটা সরকার আছে। এর আগেও একের পর এক সরকার এসেছে, অথচ কয়েক দশক ধরে নদী দখলের এই প্রক্রিয়া অবাধে এগিয়ে চলেছে। এর থেকে এটাও বোঝার অসুবিধা নেই যে, এই সমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রে সরকার থেকেও নেই। এটা কীভাবে সম্ভব? যেসব সরকার নিজেদের দেশপ্রেমিক বলে ঢেঁড়ি পেটায়; নদীগুলোর ওপর ভূমিদস্যুদের এই হামলা চলতে থাকা সত্ত্বেও তারা কীভাবে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে? তারা নিজেরা তো এ বিষয়টি নজরে আনেই না, উপরন্তু বিভিন্ন পত্রিকা এবং সংস্থা এদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সরকার কোনো নজর দেয় না। একেবারে নজর দেয় না বলা ঠিক হবে না। কারণ এ নিয়ে কোনো কোনো সময় খুব বেশি আলোচনা ও হৈচৈ হতে থাকলে তারা নদীর ওপর সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে নির্মিত কিছু স্থাপনা ভেঙে দেয়। কিন্তু তার কয়েকদিন পরই আবার দেখা যায়, সেখানে সেগুলো নতুন করে নির্মিত হয়ে আগের মতোই কারবার করছে! এভাবে নতুন করে স্থাপনাগুলো নির্মাণ করা সত্ত্বেও ভূমিদস্যুদের গায়ে সরকার হাত দেয় না। তাদেরকে কোনো জরিমানা করে না, তাদের কাউকে গ্রেফতার করে না, তাদের নামে কোনো মামলা হয় না। তাদের কোনো শাস্তি হয় না! এই অপরাধের কোনো শাস্তি না হওয়ায় অপরাধীরা বেপরোয়াভাবে নদীর নতুন নতুন এলাকা দখল করতেই থাকে।

শুধু ঢাকার পার্শ্ববর্তী এই চারটি নদীই নয়, বাংলাদেশের প্রায় সব নদীই এভাবে এখন ভূমিদস্যুদের দ্বারা দখল হচ্ছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ধলেশ্বরী নদী দখল ও দূষণমুক্ত ছিল। কিন্তু এখন ধলেশ্বরী নদী দখল ও দূষিত হওয়ার সংবাদও কোনো কোনো পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। এ অবস্থা দেখে মনে হয়, দস্যুদের এই অপরাধ থেকে বিরত রাখা এবং অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার মতো কোনো শক্তি দেশে নেই। এ ক্ষেত্রে সরকারের যে হস্তক্ষেপ দরকার, তা নেই। মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে এ কাজকে সরকার কোনো অপরাধ বলে গণ্যই করে না!

নদী দখলের ক্ষেত্রে সরকারের এই ঔদাসীন্যের কারণ বোঝা কঠিন ব্যাপার নয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে যেখানে ব্যাপকভাবে লোকজনকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাদের নামে মামলা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে এভাবে দেশের সম্পদ লুটপাট হওয়া চোখের সামনে দেখেও সরকারের চোখ বুজে থাকার কারণ, যারা এ কাজ করছে তারা সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত, নানা গাঁটছড়ায় বাঁধা। এ জন্য সরকার তাদের অপরাধের প্রতি উদাসীন থাকে এবং দলীয় স্বার্থে দেশের ক্ষতিকে তারা বিবেচনার বিষয় মনে করে না। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। কারণ সরকার যদি চায় তাহলে এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা কঠিন তো নয়ই, বরং খুব সহজ ব্যাপার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সরকারের পক্ষে এ ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ কঠিন ব্যাপার এ জন্য যে, যারা এভাবে দস্যুতা করছে সরকার নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের ওপর নির্ভরশীল। এ ধরনের অপরাধীরা শুধু নদী দখলই করছে না। তারা ছড়িয়ে আছে সমাজের সর্বত্র। কাজেই সমাজে আজ ব্যাপকভাবে যে লুটতরাজ, দুর্নীতি, দখলদারির রাজত্ব চলছে, তার থেকে নদী দখলের এই প্রক্রিয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় যে, নদী দখল নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন, নদীকে দখলমুক্ত রেখে তার প্রবাহ অবাধ রাখতে যারা আগ্রহী, পানি দূষণমুক্ত রাখার কথা যারা বলে থাকেন, তারা সমস্যাটির এদিক নিয়ে কোনো কথা বলেন না। নদী দখলের সমস্যা সম্পর্কে তারা বলেন, কিন্তু এ সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব এ বিষয়ে তারা নিশ্চুপ। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতা ও নিষ্ক্রিয়তা তাদের কোনো সমালোচনার বিষয় নয়। সরকারের ওপর এ ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগের কথাও তারা চিন্তা করেন না। কাজেই পত্রপত্রিকায় নদী দখল ও নদী দূষণের ওপর যতই রিপোর্ট প্রকাশিত হোক, এ সমস্যা নিয়ে যতই লেখালেখি হোক, এদিক দিয়ে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয় না।

আগে বলা হয়েছে যে, দেশে সরকার একেবারে নেই, এমন নয়। যেসব ক্ষেত্রে সরকার আছে সেগুলো চিহ্নিত করারও অসুবিধা নেই। সরকার কী চায় ও কী চায় না, এটা বোঝারও কোনো অসুবিধা নেই। সরকার কোন ক্ষেত্রে কতটুকু চায় ও কতখানি উপস্থিত সেটাও পরিষ্কার। যেমন দেশে চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকার নেই_ এটা বলা যাবে না। কিন্তু সরকার চিকিৎসা ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে নীতি ও কার্যক্রম অনুসরণ করে, তার থেকে সরকারের লক্ষ্যের সীমাবদ্ধতা বোঝা সহজ ব্যাপার। চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকার কোনোমতে চালিয়ে যায়। এমনভাবে চালিয়ে যায় যাতে দেশের সব মানুষ চিকিৎসা ও শিক্ষার অধিকার সমানভাবে না পাওয়ায় একটা বড় রকম বৈষম্য বিরাজ করে। কোটি কোটি ছাত্র প্রকৃত শিক্ষা পায় না, কোটি কোটি অসুস্থ মানুষ উপযুক্ত চিকিৎসা পায় না। শুধু সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশই এ ক্ষেত্রে ঠিকমতো সুযোগ পেয়ে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে। সরকারি কর্তৃত্ব ও দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা এ ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার কোনো স্বপ্ন দেখেন না।

‘স্বপ্নের’ কথা এ ক্ষেত্রে বলার কারণ, কয়েকদিন আগেই অর্থমন্ত্রী বলেছেন তার এক স্বপ্নের কথা। স্বপ্নটি হলো, ঢাকায় একটি ১৪২ তলা ইমারত নির্মাণ, যা হবে বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম! এই প্রস্তাবিত বিল্ডিংয়ে থাকবে সাত তারকা হোটেল, বিশাল বিশাল শপিং মল, নানারকম খেলার মাঠ, সিনেমা-থিয়েটার হল, অনেক রেস্তোরাঁ, বিশালবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ইত্যাদি। বাংলাদেশ হলো বিশ্বের তৃতীয় বা চতুর্থ দরিদ্রতম দেশ। এই দেশে এ ধরনের ইমারত তৈরির বিষয়টা আসলেই এক বড় স্বপ্ন, যা বাস্তবায়ন করতে হলে তার খেসারত জনগণকেই দিতে হবে এবং দরিদ্র দেশ হিসেবে এ দেশ আরও একধাপ নেমে যাবে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশের অর্থমন্ত্রী কেন এই স্বপ্ন দেখবেন_ এ প্রশ্ন করাই যেতে পারে। কারণ এটি তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়। তার এই ব্যক্তিগত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সম্পদের জোগান তো জনগণকেই দিতে হবে, যে জনগণের জীবনের সঙ্গে এই স্বপ্নের কোনো সম্পর্ক নেই।

এই ‘স্বপ্ন’ যে কতখানি অবাস্তব সেটা সরকারি এক রিপোর্ট থেকেও দেখা যায়। স্বপ্নের এই ইমারত নির্মাণের জন্য সরকার আন্তর্জাতিক টেন্ডার কল করেছিল। কিন্তু একজনও এতে সাড়া দেয়নি। এই পরিস্থিতিতে বলা হয়েছে যে, ‘স্বপ্নের’ এই ইমারত যদি সম্ভব না হয়, তাহলে ৭১ তলাবিশিষ্ট দুটি ইমারত তৈরি করা হবে। স্বপ্নের উচ্চতা খর্ব হলেও স্বপ্ন পূরণের কর্মসূচি বাদ দেওয়া হবে না!

বাংলাদেশে এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় বড় প্রকল্পের দেশ। এসব প্রকল্পের মধ্যে ঢাকা এবং অন্য দু-একটি শহরের ফ্লাইওভার বা উড়ালপুলও আছে। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে যে, বাংলাদেশে উড়ালপুলগুলো নির্মাণের খরচ সারা দুনিয়ায় বিভিন্ন দেশে এর জন্য যে খরচ হয়, তার থেকে অনেক বেশি। চীন, ভারত, পাকিস্তানে এ খরচ অনেক কম। এমনকি যে পাকিস্তান চোর, দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারীতে ভর্তি তাদেরও এ ক্ষেত্রে খরচ বাংলাদেশের খরচের অর্ধেক! এই অতিরিক্ত খরচের অর্থ যে দুর্নীতিবাজ ও লুটপাটকারীদের পকেটে যায়, এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। উড়ালপুল ছাড়াও অনেক বড় প্রকল্প বাংলাদেশের আছে, যার তালিকা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন এখানে নেই। এই পরিস্থিতিতে হাজার হাজার বা লাখ লাখ কোটি টাকা খরচ করে ‘স্বপ্নের’ ১৪২ তলা ভবন নির্মাণের যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা যে চুরি, দুর্নীতি ও লুটপাটের ঊধর্ে্ব থাকবে_ এটা মনে করা কি যুক্তিসঙ্গত? চিকিৎসা, শিক্ষা, সাধারণ মানুষের জন্য বাসস্থান ইত্যাদি সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বাদ দিয়ে দুনিয়ার তৃতীয় উচ্চতম ইমারত তৈরির ‘স্বপ্নের’ সঙ্গে দেশপ্রেমের কী সম্পর্ক? এ ধরনের স্বাপি্নকরা দেশে কাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে? এরা কারা?

৬.২.২০১৭

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
বদরুদ্দীন উমর- র আরো পোষ্ট দেখুন