মুক্তচিন্তা ও শুধু ধর্মবিরোধিতা এক জিনিস নয়

ধর্ম সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকায় বুর্জোয়া বিকাশের প্রথম যুগে ধর্মের শৃঙ্খল থেকে বুদ্ধিগত মুক্তি ছিল বুর্জোয়া চিন্তাভাবনা ও দর্শনের অন্যতম লক্ষ্য। ইউরোপীয় দর্শনের আধুনিক যুগের প্রারম্ভে লক, হিউস, দেকার্ত, স্পিলেজা, লাইবনিত্জ প্রভৃতি বিখ্যাত দার্শনিক নিজেদের দর্শনচিন্তা সেভাবেই করেছিলেন। শুধু তাই নয়, পোপের নেতৃত্বে রোমান ক্যাথলিকরা যেভাবে রাষ্ট্রের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রাখত, তার থেকে বাইরে এসে মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে প্রটেস্ট্যান্টরা খ্রিস্টধর্মকে যেভাবে নতুন করে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন, সেটা বুর্জোয়া ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও ধর্মের পৃথককরণে খুব বিশিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেক্যুলারিজম বলতে যা বোঝায় আধুনিক চিন্তায় তার উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল। এদিক থেকে বিচার করলে সেক্যুলারিজম এবং বাংলা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। কারণ আধুনিক দার্শনিক চিন্তায় সব ধর্মকে নিরপেক্ষভাবে দেখার বা বিবেচনা করার প্রশ্ন ছিল না। তারা ছিলেন সাধারণভাবে ইহজাগতিক এবং ধর্মীয় চিন্তা থেকে মুক্তির চেষ্টাই ছিল তাদের দার্শনিক চিন্তার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। মধ্যযুগীয় চিন্তার কাঠামো ভেঙে বেরিয়ে আসার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এটাই। কাজেই তারা ধর্মকে নিরপেক্ষভাবে না দেখে চিন্তাকে ধর্ম থেকে বিযুক্ত করার চেষ্টাই করেছিলেন। এদিক দিয়ে সেক্যুলারিজমের প্রকৃত অর্থ ছিল ধর্মবিযুক্ততা। এ কারণে সেক্যুলারিজমের বাংলা প্রথম থেকেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হিসেবে প্রচলিত হওয়ায় এখানে চিন্তার ক্ষেত্রে অনেক বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছে এবং যে বিড়ম্বনা থেকে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা এখনও মুক্ত হয়নি।

সমাজে সামন্ততন্ত্রের অবশেষের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে ধর্মবিষয়ক চিন্তা গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্ব অবহেলার বিষয় নয়। কিন্তু তার থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা একেবারেই ঠিক নয় যে, মুক্তচিন্তার লক্ষ্য শুধু ধর্মবিরোধিতা। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, ইতিহাসে শোষক শ্রেণীর স্বার্থে দাস ও সামন্ত যুগে ধর্মকে বড় আকারে ব্যবহার করা হয়েছিল সামন্ততন্ত্রের অবশেষকে রক্ষার জন্য কৌশলের সঙ্গে এখনও বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী বিশ্বজুড়ে ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে। সেটা না হলে পুঁজিবাদের বিশ্ব আধিপতের যুগেও ইউরোপ-আমেরিকায় ধর্মকে যেভাবে এখনও ব্যবহার করা হয় সেটা হতো না। এ বিষয়ে স্বতন্ত্রভাবে দীর্ঘ আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু আপাতত ধর্ম বিষয়ে যে চিন্তাভাবনা প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তা ক্ষেত্রে হচ্ছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তচিন্তা বলে বুদ্ধিবৃত্তির যে চর্চা এখন হচ্ছে, তার সীমাবদ্ধতার দিকটি লক্ষ্য করা দরকার।

এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে রাখা দরকার, যে শ্রেণীশাসন রক্ষা ও মসৃণভাবে চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মকে ঐতিহাসিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা ধর্মের প্রভাব কমে আসা সত্ত্বেও বিশ্বজুড়ে এখনও প্রবলভাবে শক্তিশালী। যেহেতু শোষক শ্রেণীর শাসন রক্ষা করা ও মসৃণ রাখার জন্য ধর্মকে যুগে যুগে ব্যবহার করে আসা হয়েছে, সে কারণে শ্রেণীর বিষয়টি তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে বর্তমান যুগে মুক্তচিন্তা বলতে শুধু ধর্মীয় চিন্তা কাঠামো থেকে মুক্তিই বোঝায় না। এখনকার মুক্তচিন্তা মূলত হলো, বুর্জোয়া শোষক-শাসক শ্রেণীর চিন্তা-কাঠামো থেকে বাইরে বের হয়ে সামগ্রিকভাবে সমাজের দিকে তাকানো। এই সমাজে সর্বস্তরের শ্রমজীবী জনগণ যেভাবে শোষক-শাসক শ্রেণীর হাজারো শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে বিপর্যস্ত জীবনযাপন করছেন, তার থেকে তাদের মুক্ত করার চিন্তা মুক্তচিন্তার এক অপরিহার্য দিক। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে যারা সাধারণভাবে ব্লগার বলে পরিচিত, তাদের চিন্তার মধ্যে এ বিষয়টি প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। এটা অবশ্যই তাদের ‘মুক্তচিন্তার’ এক বড় সীমাবদ্ধতা।

ওয়াকিবহাল মহলের সকলেরই জানা যে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদ চরম শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে গেলেও তা প্রতিরোধের জন্য সেখানে কোনো শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন না থাকায় ধর্মকে অবলম্বন করেই সেখানে ভ্রান্ত ও বিকৃতভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক ধরনের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে, আফগানিস্তানে সোভিয়েত আধিপত্য অবসানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল কায়দার মতো ধর্মীয় সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তুলতে সহায়তা করে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ বলে এখন যা পরিচিত তার সূচনা করে। এভাবে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীরা যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিল সেই বৃক্ষই এখন বিশাল আকার ধারণ করে পত্রপল্লব বিস্তার করেছে। ধর্মের নামে এখন আল কায়দা, ইসলামিক স্টেট, বোকো হারাম ইত্যাদি যেসব জঙ্গি সংগঠন নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে, তার সঙ্গে ধর্মের কোনো প্রকৃত সম্পর্ক নেই। ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মান্ধতা এক জিনিস নয়। ধর্মবিশ্বাস নয়, ধর্মান্ধতা থেকেই এভাবে জঙ্গি সংগঠনগুলো দেশে দেশে এমন নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। এর ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গুরুতরভাবে আঘাতগ্রস্ত না হলেও সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা তাদের এই তৎপরতার ফলে এখন ব্যাপকভাবে হুমকির মুখে।

শ্রেণী-প্রশ্ন বাদ দিয়ে যদি এ ক্ষেত্রে শুধু ধর্মীয় চিন্তাকেই দায়ী করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই মুক্তচিন্তার মর্মবস্তু মনে করা হয়, তাহলে মারাত্মক ভুল করা হবে। ব্লগার নামে পরিচিত মুক্তচিন্তাকারীরা যতই সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হোন, এদিক দিয়ে তারা এক বিভ্রান্তির জালেই আটকা পড়েছেন। তারা সমাজ থেকে একভাবে বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়ছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজ তাদের নিরাপত্তার জন্য দাঁড়াবে, এমন অবস্থা নেই। এজন্য সাম্রাজ্যবাদীরা এখন ব্লগারদের নিজেদের দেশে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলছে। কোনো কোনো ব্লগারকে তারা আশ্রয়ও দিয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায়, ব্লগাররা যেভাবে মুক্তচিন্তা করছেন তার প্রভাব জনগণের ওপর সামান্য বা নেই বললেই চলে। এ পরিস্থিতির হাত থেকে ব্লগারদের মুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন মুক্তচিন্তাকারী হিসেবে নিজেদের যুক্তিতর্ক, লেখালেখি ও প্রচার শুধু ধর্মীয় বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজে জনগণ যে শোষণ-নির্যাতনের মধ্যে আজ জীবনযাপন করছেন তার দিকে তাকানো। এই শোষণ-নির্যাতন থেকে জনগণকে মুক্ত করার জন্য তাদের ওপর শোষক শ্রেণীর যে শাসন বলবৎ আছে, সে শাসন অবসানের ক্ষেত্রেও অবদান রাখা।

যারা ব্লগার হিসেবে মুক্তচিন্তা করছেন তারা শুধু ইসলাম, হিন্দুধর্ম, খ্রিস্ট বা বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে নিজেদের চিন্তাভাবনা সীমাবদ্ধ না রেখে শ্রেণী শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে অর্থাৎ বিদ্যমান সমাজের শ্রেণী কাঠামো চূর্ণ করার জন্য কাজ না করলে তাদের প্রতি জনগণের যে সহানুভূতি প্রয়োজন, সেটা তারা লাভ করতে সক্ষম হবেন না। তাদের মুক্তচিন্তার দ্বারা দেশে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাও সমৃদ্ধ হবে না। শ্রেণী শোষণ-শাসন উচ্ছেদ হলে সে অবস্থায় ধর্মীয় নির্যাতনের সম্ভাবনাও শেষ হবে। কারণ ধর্মের থেকে শ্রেণী অনেক মৌলিক ব্যাপার। এই মৌলিক বিষয়টির প্রতি উদাসীন থাকলে ‘মুক্তচিন্তা’ বিশ্বের ও বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রগতিশীলতা, সামাজিক অগ্রগতি এবং সমাজে বিদ্যমান চিন্তার শৃঙ্ঘল ভাঙার ক্ষেত্রে কোনো প্রকৃত অবদান রাখবে, এমন কোনো সম্ভাবনা নেই।

১৬.৫.২০১৬

সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
বদরুদ্দীন উমর- র আরো পোষ্ট দেখুন