বৃদ্ধমঙ্গল

বৃদ্ধমঙ্গল

রোজ দেখি একজন বুড়ো লোক
বাঁশের মাচায় শুয়ে লিচুগাছ পাহারা দিচ্ছেন ।
গাছের তলায় এইটুকু তার নিরন্ন আবাস ।
সারাদিন মশারি টানানো ।
বুকের পাঁজরে তিনি পা দু’টো গুটিয়ে যদি হঠাৎ বসেন,
মনে হবে ঝলসানো চিংড়ি মাছ ।
আমূল গুটিয়ে আছে মায়ের জঠরে শিশুটির মতো । ঠিক যেন ভ্রুণের আদল ।
কখন জন্মাবে সেই অপেক্ষা । আঁতুরঘরে অন্তরঙ্গ সময়ে মন্থর অবসর ।
ডাল থেকে ঝুলে-পড়া পাটের দড়িতে টান দিলে
ছুটির ঘন্টার মতো টং টং টং…
মুড়ির টিনেই আজ অমূল্য স্মৃতির এক সম্পন্ন ইশকুল ফিরে ফিরে আসে ।
ফিরে যায় পাখিরা সবাই, কিছু শঙ্কিত বাদুড়
আর কাঠবিড়ালি–লিচুর দুশমন, যারা ঝুলন্ত খাদ্যের লোভে
সুষমার অমৃত কুটির ভেবে এসেছিল সারাশব্দহীন এই লিচু গাছে ।

আহা পাঠশালা পলায়ন…
সহপাঠী আজ এই পাখিরা সবাই, কিছু শঙ্কিত বাদুড়
আর কাঠবিড়ালি–লিচুর দুশমন যারা পূর্ণ স্বেচ্ছাচারে ।
না কি যমদূত ? শুধু স্বরূপ আগলে রেখে অন্য কোনোখানে
এসেছে বিফল মনোরথ যেন অমেয় মৃত্যুর ?
বাগান বিলাসী নয় এই বুড়ো; লিচু পাতা গোপন শিরায়
যতটুকু ধরে রাখে ললিত অতীত তার সবটুকু আকুল বিস্ময়
নিরূপম কেড়ে খাবে, তার মন এতটা সজাগ–
প্রফুল্ল পার্বণ ফেলে এসে জীবনের ।
সে কি মৌন মাধব একাকীত্বের ? বিষন্ন অর্গলে কেউ তাকে বেঁধে রাখে ?
কি আছে অব্যয় অধিকার আজ এই হাতের লাঠিটি ছাড়া ?
মুসার সর্পের মতো শক্তির উদ্ভাস তাই জেগে থাকে নিজের মুঠোয় ।
কোথায় অতীব চোর বুড়োর সকাশে যায় লিচু খেতে রাতের বিপ্লবে চুপিচুপি ?
নাই, এইখানে চোর নাই, নাই ফলে ফলে রসের ভাসান ।
লিচুর খোসার নিচে সুডৌল যৌবনে সাদা সাদা
যেন অণ্ডকোষ ঝুলে আছে নিস্পন্ন বুড়োর ।
কেড়ে নিচ্ছে সময়, সূর্যের কান্তি, ভোর আর গোধূলি পুচ্ছের অন্ধকার ।
……তারপর চাঁদ উঠে…
রাতের আকাশে চাঁদ এই মাত্র স্নান সেরে উঠে এল যেন ।
গায়ে ছিল ময়লা অমাবশ্যার । দিপ্তীর ফেনায় ধুয়ে-মুছে আজ বড়ো ঝকমকে ।
আকীর্ণ জোছনাভরা গন্ধের বাতাস
মৌ মৌ করছে । হে, গুপ্ত নেশা, চাপ চাপ রক্তের বিভায়
কেন তুমি খুন করো বুড়োর হৃদয় ?
মধুর হাঁড়িতে রোজ বিমোহে আটকেপড়া মাছিদের মতো
সে-যে তড়পায় মগ্ন জ্বালাতনে; যজ্ঞ করে লিচুর বাগান ।
ইচ্ছে হয় চাঁদকে দোলনা করে তারার রশিতে বেঁধে লাখো লাখো
আলোর কোটরে সে-ও ঘুম যাবে খুব, আর ঝুলবে নিস্পাপ ।
অপার নিলীমা ছুঁয়ে যেন এই প্ররোচনা যেন সেই রক্তের পল্লব
জমির আলের মতো সকল শিরায়
ফলন ! ফলন ! বলে ডেকে তোলে বুড়োকে এবার ।
বলেঃ শোনো, তাহলে জীবন হলো বসুধা সঞ্চয় । এক ফলিত গণিত মহাজগতের ।
কেবল বহন করো শস্যের গৌরব ।

জীবনের গোলাভরা সমূহ বিদ্যুৎ এই দায় ভার
মেঘের আশ্বাসে যদি ভেসে যায়…সামান্য নির্ভার হতে গিয়ে
মানুষের মাকড় জীবন টান টান উৎপীড়নে শয়ে শয়ে তারকার জালে ধরা পড়ে যদি
আর সেই মৃত্যুর উদ্ভব
নিঝুম প্রাণের কথা বলে, বলে রাতের ঝোপের মতো অশ্রুত উদ্গ্রীব ফিসফাস,
নাতী ও নাতনিদের নব্য কামকুক্ষিগত উড়ন্ত যৌবন
কেমন দেখাবে সেই দিন ? ওরা লিচু খাবে ? অঙ্গের সৌষ্ঠবে নেচে নেচে ?
এই ভেবে নিজেকে বিবর্ণ শ্যাওলার মতো নিরস্ত্র সবুজ বলে মনে হয় কেন ?
মনে হয় নিহত যৌবন ব্যাপকতা শরীরের পলে পলে
আজ শুধু বিরহ উদ্বেগ কঙ্কালের ।
শরীর তাহলে চায় অন্তত একটিবার  মর্মন্তুদ ইচ্ছার আঘাত ।
মানুষ যেমন করে মৃত্যুকরোজ্জ্বল জীবনের নামে
কামড়ে কামড়ে বলে দন্তকুশলতা, রাখে চিহ্ন অকাতর
সেই শেষ মর্মাঘাত তাহলে সন্তান হয়ে, স্রোত হয়ে নাতি ও নাতনিদের
গৌরী কাকলিতে ভরে যায় ।
শোনা যায় কন্ঠরোল, গৃহের উচ্ছাস আর জীবন্ত শৈশব ।
আহা কি শোণিত সংস্রবের লিচু গাছ  কাঠবিড়ালি সুকান্ত মেলামেশা পাখিদের
এই যে এখন রাত…ব্যাঙডাকা রাতের নিঃশ্বাসে
জোনাকি উতলা হয় যেমন নাতনি হাসে খিল খিল আলো…
নাতিরা ঘুমায় তবু মৃন্ময় হুল্লোড় শোনা যায় খুব মিটি মিটি…
বুড়োর আগুনে এই দুই ফোঁটা জল
তবে কি নিরন্ন বর্ষা ? মৌন উজ্জীবন ?