খচ্চর

আজও সেই একই জায়গা। নিথর, নিঃশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রানীটা। যদিও এক নজরে দেখলে প্রানহীন মনে হয়। চোখ দুটো বারে বারে বুজে আসে। সারা গায়ে ঘা হয়ে লোম উঠে গেছে। বৈশাখের খাঁখাঁ রোদ্দুর। নিঝুম পথ। গঞ্জের বুক চিঁরে বয়ে চলা সর্পিল নয়ানজুলির ওপর এই কাঠের সাঁকো। এপাড়ার সাথে গঞ্জের একমাত্র সংযোগ। তার ওপরেই দণ্ডায়মান নিরিহ প্রান টাকে এপাড়ার সবাই চেনে। সূর্য মাথার ওপর উঠলেই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পরে এই সাঁকোর উপর, আজও তার ব্যাতিক্রম নেই। ফুলমনি বারবার তাকে সরানোর চেষ্টা করছে।

বছর চল্লিশ এর কামাল ভাই এপাড়ার আদি বাসিন্দা। গঞ্জ থেকে নয় মাইল দূরে ঝাড়খণ্ডের পাহাড়ি এলাকা, পাথরের খাদান, পাথর ভাঙা কল, জায়গাটা ইদানিং জমজমাট। সেখানেই তার মোটর গ্যারাজ। শান্ত নিরিহ মানুষ। খুব সহজেই যে কেউ তাকে বোকা বানিয়ে দেয়। কামাল ভাই সেটা জানেন, আর ভীষণ বিনয়ের সাথে তা মেনেও নেন। এহেন কামাল ভাই হঠাৎ একদিন এই প্রানীটিকে নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত। সে তার বাপের মুখে নিজেদের গাঁয়ের অনেক কথা শুনেছিল। তার বাপের খুব ইচ্ছে ছিল একটা গরু কেনার। সে সাধ তার জীবিত দশায় অপূর্ণই থেকে যায়। পরবর্তীকালে সেই সাধ সংক্রমিত হয় কামাল ভাই এর হৃদয়ে। সেইদিন সে হঠাৎ পৌঁছে যায় গরুর হাটে। পাইকারদের সাথে দামদর করে দেখে তার পুঁজিতে কুলোচ্ছেনা। অগত্যা ফিরে আসবে বলে বেরচ্ছিল, এমন সময় পেছন থেকে তার হাত ধরে ডাক দেয় একজন পাইকার।

ঘোড়া নেবেন ভাই জান। জওয়ান ঘোড়া।

প্রথমে কামাল বুঝতেই পারেনি লোকটা কি বলতে চাইছে। তারপর নজর যায় একটু দুরেই দাঁড় করানো টাট্টু ঘোড়ার দিকে। এক মুহূর্তের ভাবনায় সে বুঝতে পারে না ঘোড়া নিয়ে তার কি প্রয়োজন। হাত ছাড়িয়ে নেয় কামাল, কিছুটা আবহেলার ছলে মাথা নাড়িয়ে না বলে। সেখান থেকে এগিয়ে যেতে নিলেই আবার ডাক। লোকটা নাছোড়বান্দা, পেছন ছাড়েনি।

ভাই জান, বহুত সস্তায় দিয়ে দেব।

আরে মু ঘোড়া লিন কি করবে?

কিনো, ঘোড়ার পিঠে চড়বেন। বাচ্চাদের চড়াইবেন।

মুর অতো শখ চরে লাই, আর মুর বাচ্চাও লাই।

কামাল কে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ কেঁদে ওঠে লোকটা। কামাল আর এগোতে পারেনা, সেখানেই দাঁড়িয়ে পরে। মনে মনে ভাবে, ‘আচ্ছা বিপদ হোল’। এই সুযোগে লোকটা আবার কামালের হাত ধরে। রুগ্ন হাতটা স্পর্শ করায় কামাল বুঝতে পারে লোকটা থর থর করে কাঁপছে। মুখের দিকে তাকাতেই তার বাপের করুন মুখটা মনে পরে যায়।
হামার দুঠো বেটা আছে ভাইজান, তিন রোজ সে উদের কুছু খোয়াতে পারি নাই। ঘোড়া গাড়ির বেওসাও আজকাল চোলে না। লিয়ে লিন ভাইজান, টাকাটা হামার বহুত দরকার আছে।

সব গুলিয়ে যাচ্ছিলো কামালের। ছোটবেলায় সে নিজেও ভীষণ দারিদ্র দেখেছে। কেমন অদ্ভুত একটা মায়া হলো লোকটার ওপর। আর কিছু ভাবার অবস্থা কামালের ছিল না। একটা হুজুগ চেপে বসল তার ঘাড়ে। অতএব সাত পাঁচ ভাবনা ছেড়ে ঘোড়াটা কিনেই ফেলল।

কেনার আগে যদিও বেশি কিছু ভাবেনি কামাল, কিন্তু ভাবনা তার অপেক্ষায় বসে রয়েছে বাড়িতে। ঘোড়ার গলায় ফাঁস দিয়ে দড়ি তার হাতে ধরিয়ে দিয়েছে পাইকার। দীর্ঘ পথ হেঁটে সে যখন বাড়ি পৌঁছল তাখন মাঝ্রাত গড়িয়ে গেছে। নিঝুম রাতে সে আর তার ঘোড়া বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। দাওয়ার খুঁটিতে দড়ি বেঁধে দেয়। বাড়িতে সবাই তখন ঘুমে বিভোর। অন্যদিন হলে সে কাউকে ডাকত না। ভেজানো দরজা খুলে ধুকে পড়ত ভেতরে। আজ রাতটা একটু আলাদা। নতুন একটা প্রান এসেছে এ বাড়িতে। দাওয়ায় দাঁড়িয়ে মাকে আওয়াজ দেয় কামাল। ঘুম চোখে বেরিয়ে আসে ফুলমনি। ঘরের সামনে ঘোড়া দেখেই চক্ষু চড়ক গাছ, চিৎকার করে ওঠে।

এটো কী?

ঘোড়া।

তুর মাথা, খচ্চর এনেছিস কেনে?

খচ্চর!

যদিও কখনো খচ্চর দেখেনি কামাল, কিন্তু এই শব্দটার সাথে বাল্যকাল থেকেই তার পরিচয়। স্কুলের প্রথম দিনেই পন্ডিত মাস্টার তার নাম দিয়েছিল ‘খচ্চর’। একটু বড় হয়ে সে নিজের মতো করে মানে বের করেছিল শব্দটার, দুটো ভিন্ন জাতের মিলনে যার জন্ম হয় সেই ‘খচ্চর’। সেই রাতে আর ঘুম আসেনি কামালের চোখে। অনেক রকম চিন্তা মাথার মধ্যে ভিড় করে এসেছিল।

সেই অন্ধকার রাতের গল্প কামাল অনেকবার শুনেছে। কখনো মায়ের মুখে, কখনো বাপের মুখে। কামালের মুসলমান বাপ গফুর, গঞ্জে আসতেন রাজমিস্ত্রির জগানদারি খাটতে। তাদের হেড মিস্ত্রি উকিল মিয়াঁ খুব স্নেহ করতেন তাকে। একসময় গফুরের ওপর দায়িত্ব দেন তিনি, নিজের ও আশপাশের গাঁয়ের লোকজন জড়ো করে নিয়ে আসার। দামোদর এর তীরে ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা গ্রাম। তাদের মধ্যেই সবচেয়ে বড় গ্রাম জয়কৃষ্ণপুর। সেখানেই গফুরের বাপের ভিটে। গ্রাম এ দুটো পাড়া, একটায় তাদের জাতের বাস আর অন্যটায় আদিবাসীদের। গফুর রোজ সকালে নিজের ও আশপাশের গ্রামের লোক জড়ো করে দল বেঁধে হাঁটা দিত গঞ্জের উদ্দেশ্যে। সেখানে গোটাদিন জোগান্দারি করে বিকেলে রওনা হত বাড়ি ফেরার জন্য। বাড়ি পৌঁছতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত। আদিবাসী পাড়ার ফুলমনিও ছিল তাদের দলে। চকচকে কষ্টিপাথরের মতো গায়ের রঙ, নিটোল গোল মুখ। হাসলে সাদা দাঁত বেরিয়ে যেন বিজলি ঝলকাতো। কাজলা চোখে অদ্ভুত মায়া ছড়িয়ে দিত চারিদিকে। বাপ টাও সেই মায়া থেকে বাঁচতে পারেনি। সেদিন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছিল। বৃষ্টি যখন থামল তখন বিকেল তো দুরের কথা সন্ধ্যেও পেরিয়ে গেছে। ছেলেরা নিজেদের মতো বেরিয়ে পরলেও মেয়েদের সাহসে কুলোলনা। অগত্যা যে নতুন বাড়ি তারা তৈরি করছিল সেখানেই রাত কাটানোর ব্যবস্থা করল উকিল মিয়াঁ। গফুরকেও থাকতে হোল, মেয়েদের সুরক্ষার কথা ভেবে। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গফুর দেখে ফুলমনি নেই। একটা অজানা আশঙ্কা মনে ধরে সে বাইরে বেরিয়ে দেখে, ফুলমনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। তখন আবার বৃষ্টি নেমেছে। খোলা চুলে ফুলমনি সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল আঁজলা করে ধরছে। মায়াবি চোখ দিয়ে গোগ্রাসে গিলছে প্রকৃতির সেই তান্ডব। গফুর আগে কখনো এমন দৃশ্য দেখেনি। ফুলমনির গায়ের গন্ধ তাকে মাতাল করে তুলেছিল। ফুলমনিও সেই আমন্ত্রন এ সারা দেয়, সেই রাতেই ঘটে যায় অঘটন। এর কিছুদিন পরেই ফুলমনির ভেতর নতুন প্রানের সঞ্চার হয়। এই অবস্থায় সে ধরা পরে বাড়িতে। ফুলমনির অকাঙ্খিত পোয়াতির খবর শুনে পাড়া জুড়ে হই হই, রৈ রৈ। গোটা পাড়া তীরধনুক নিয়ে তৈরি। ‘শালা মুসলমানের বাচ্চা মুদের জাতের মেয়ে কে নোংরা করলো!’ রাত নামলেই তারা চড়াও হবে গফুরের বাড়িতে, এমনটাই পরিকল্পনা। ফুলমনি কেঁদেই অস্থির। কিছুতেই বাড়ির লোকেদের মানাতে পারেনা। বিপদ এর ঘণ্টা যে তখন বেজে গেছে। ঠিক সন্ধ্যার মুখে সুযোগ পায় ফুলমনি, লুকিয়ে বেরিয়ে পরে বাড়ি থেকে। গ্রামের বাইরে তিনরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ায়। তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য ডিমের কুসুম, ডুব দিচ্ছে দিগন্তে। এই পথেই গঞ্জ থেকে ফেরে গফুর। বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হয়নি, একটু বাদেই গফুর এসে পৌঁছায়। ফুলমনির মুখে সব কথা শুনে চিন্তার বলিরেখা ফুটে ওঠে গফুরের ললাটে। সে ভাল করেই জানে, তার বাড়িতেও জাতের বাইরের ফুলমনি কে মেনে নেবেনা। দামোদর এর তীরে পূর্বপুরুষের গ্রাম। সেখানে তাদের মাটির বাড়ি, গরু ছাগল মুরগি, সোনা ফলানো ক্ষেত, পদ্মপুকুর। সব ছেড়ে সেই এক রাতেই পালিয়ে এসেছিল তার বাপ। সঙ্গে ফুলমনি আর তার কোঁখের কামাল। সেই রাতে উকিল মিয়াঁর ঘরে আশ্রয় জোটে তাদের।

গঞ্জের প্রান্তে নয়ানজুলির ধারে চাষি জমি। সেখানেই কামালের বাপ এক ফালি জমি নিয়ে গড়ে তূলেছিলেন বাঁশ ও খলপার এই কুঁড়ে। এই কুঁড়েতেই কামালের জন্ম। তারপর আরও চার বোন এক ভাই। পাড়াটার চেহারা এখন একদম পালটে গেছে। চাষি মাঠ আর নেই। বোলতে গেলে সবই পাকা বাড়ি। গঞ্জের সাথে মিলেমিশে একাকার। কিছু ভদ্রলোক ও এখন এপাড়ায় থাকেন। কাঠের সাঁকো পাকা হওয়ার কথা চলছে। সেই সাঁকোতেই দাঁড়িয়ে থাকে কামালের সাধের খচ্চর। বেশ কিছুদিন ধরেই পারার লোকেরা কামালের কাছে নালিশ নিয়ে আসে। খচ্চরটা বড্ড অসভ্য। রোজ বাচ্চারা যখন স্কুল থেকে ফেরে, সাঁকোর ওপর পথ আঁটকে দাঁড়িয়ে থাকে খচ্চরটা। সেদিন হারান মাস্টার কামাল কে রাস্তায় ধরে ফেলে।

কামাল ভাই, খচ্চরটার কিছু ব্যবস্থা করো। রোজের ঝামেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে। মেয়েরা তো ওই সময় সাঁকোর কাছে আসতেই পারেনা।

কেনে মাস্টার?

কেন আবার? তোমার খচ্চর তার মস্ত লিঙ্গ বের করে দাঁড়িয়ে থাকে। লালার মতো রস ঝরে পরতে থাকে সেখান থেকে। কোনো সভ্য মেয়ের পক্ষে এটা দেখা তো ভীষণ লজ্জা জনক।

কামালের খুব লজ্জা লাগে মাস্টারের কথা শুনে। কিন্তু সেই বা কি করবে? খচ্চর টার সাথে সে নিজের মিল খুঞ্জে পায়। একটা মায়া জমে গেছে তার ওপর। এদিকে ফুলমনি পছন্দ করেনা, তাই তাকে বাড়িতে রাখতে পারেনি। বারে বারে বাপটার মুখ মনে পরে যায়।

ছোটবেলায় কামাল রোজ তার বাপ কে দেখত এই কুঁড়ের দাওয়ায় বসে কি যেন ভাবে। সেই সময় বাপের কোলে গিয়ে লেপ্টে বসতো। আধো গলায় জানতে চাইতো।

বাপ, কি হুলছে?

কিছু লয় রে বেটা।

এতো কি ভাবিস তু?

গাঁয়ের কথা।

কেনে?

উখানে জি মুদের জড় টো আছে।

সিটো কি বুটে?

সি অনেক কিছু। মুর বাপ, ভাই বহিন, মুদের গাই ছাগল মুরগি। চাষের জমিন, নদীর ধার। আরো কত।

বাপটা জন্তু জানোয়ার খুব ভালোবাসতো। বাপের সাথে সাথে কামালও স্বপ্ন দেখত সেরকমই একটা জগতের। বাপ কে বলতো।

মুকে লিয়ে জাবি বাপ তুর গাঁয়ে।

তু যাবি বেটা। হ, লিয়ে যাবো।

এরকম আরো অনেক কথা চলতে থাকতো। ফুলমনি এসে গফুরের স্মৃতিচারণ এ ভঙ্গ দিত। গরম ভাতের নিমন্ত্রন। সারাদিনে এই একবারই ভাত খেত তারা। দিনে আখেঁর গুড় আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মুড়ি তাদের রোজের খাবার। এই রাতের বেলায় একটু জুত করে খাওয়া। কচু সেদ্দ, গরম ভাত, এক টুকরো পেঁয়াজ। কোনো কোনো দিন ভুটী চচ্চড়ি ও জুটে যেত।

একটু বড় হলে উকিল মিয়াঁর হাত ধরে স্কুলে ঢোকে কামাল। বেশ ভালই লাগত তার স্কুল যেতে। চার ক্লাস এ পড়ার সময় বাপটো হঠাৎ তিন দিনের জ্বর এ মরে গেল। বাপ এর গাঁয়ে আর যাওয়া হলনা কামালের। স্কুলও বন্ধ। মায়ের একার মজুরীতে সাত সাতখানা পেট চালানো সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই কামাল কেই দায়িত্বের জোয়াল তুলে নিতে হয় কাঁধে। অসিতদার মোটর গ্যারাজে হাতে খরি হয় কামালের।

দুই কুড়ি বয়স পেরিয়ে এখন তার অবস্থা একটু ভাল। নয় মাইল দুরে পাথর ভাঙা কলের কাছে তার নিজের গ্যারাজ। ঝাড়খণ্ড লাগোয়া এই জায়গাটা ভীষণ পয়া। এই ক’বছরেই তার বেশ উন্নতি হয়েছে। কুঁড়ে ঘরের জায়গায় দুটো পাকা ঘর হয়েছে। বড় তিন বনের বিয়েও দিয়েছে ভাল মতো। ছোট ভাইটা তার সাথেই থাকে, ভালই কাজ শিখছে।

এখন মাঝে মাঝেই ছুটি নেয় কামাল। আর খাটতে পারেনা। ফুলমনিও ইদানিং খুব খিচখিচ করতে শুরু করেছে। সেদিন দুপুরে ভাতের থালা সামনে রেখেই আরম্ভ করল।

তু বিহাটো করবি কিনা বুল?

বুনটো ঘরে আছে, এখন বিহার কথা কেমনে ভাবি মাই?

উ কচি বটে। উকে লিয়ে ভাবতে হবেক লাই। তু তো বুড়াইন যেছিস।

তাই বুল্লে চলবেক? উয়ার বিহা না দিন আমি কুছু ভাবব লাই।

উর কথা মু ভেবে লিবো। তু ইবার বিহা টো কর।

মায়ের জেদ দেখে কামালের খুব হাসি পায়।

তুর বুড়া বেটার লেগে মেয়ে কই রে মাই?

কেনে? তুর কাজের উখানে কুতো মেয়ে আছে, একটো কে ধরতে পারিস লাই?

রোজই প্রায় ফুলমনি একই কথা বলে চলে। কামালও শেষ অব্দি মনে মনে প্রস্তুত হতে শুরু করেছে। তার আগে সে কয়েকটা কাজ করতে চায়। আসলে বাপের কিছু অপূর্ণ ইচ্ছে তার মনে বাসা বেঁধে রয়েছে। সেইগুলি পূরণ করাই তার একমাত্র সাধ। এই বাহানায় একদিন গিয়ে পৌঁছায় বাপের গাঁয়ে। প্রান ভরে দেখে সেই গাঁয়ের রূপ। ফেরার পথে দেখতে পায় গরুর হাট বসেছে। ঢুকে পরে ভেতরে। বাপের খুব ইচ্ছে ছিল একটা গরু পোষার। আজ সেই ইচ্ছেটা কামালের মনে চাগার দিয়ে ওঠে। কাল রাতে পাওয়া কিছু টাকা তার পকেট এ এখনো আছে। ভাল একটা গাই দেখে দাম জিজ্ঞ্যেস করে। পাইকার যে দাম বলে তার অর্ধেক ও তার কাছে নেই। এগিয়ে গিয়ে আরও কিছু পাইকার এর সাথে কথা বলে। সেখানেও প্রায় একই অবস্থা। কামাল বুঝতে পারে আজ তার পকেটের টাকা দিয়ে গরু কেনা সম্ভব নয়। ফিরেই আসছিল, এমন সময় সেই লোকটার ডাক।

সেদিন সারারাত ভেবেছিল কামাল। অনেক কথা। সাঁওতালি মায়ের বাপের বাড়ির লোকেরা সেই রাতে বাপকে কেন তাড়া করছিল? দুটো জাত সেদিন মিলেছিল, জন্ম হয়েছিল তার। তাহলে কি সে…?

সকালে উঠে দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়ায়। খচ্চর টা শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে তার কাছে যায় কামাল। আলতো করে হাত দেয় তার গলায়। আদর পেয়ে প্রাণীটা ঘঁত করে একটা শব্দ করে। কামালের কি মনে হয়, গলার দড়িটা খুলে দেয়। প্রানীটা নড়ে না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে।

নয়ানজুলির ধারে লম্বা লম্বা ঘাঁস গজায়। গোটা সকালটা সেখানেই চরে বেড়ায় সে। তারপর যেই সূর্য মাথার ঠিক ওপরে আসে, তার সময় হয় সাঁকোয় এসে দাঁড়ানোর। আজও সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। রোজের মতো তার লিঙ্গ থেকে ঝরে পরছে আঁঠাল রস। ফুলমনি বারবার এসে তাকে সরানোর চেষ্টা করছে। আজ কামাল বিয়ে করতে গেছে, নতুন বউ নিয়ে এসে পৌঁছল বলে। এই সময় অসভ্যের মতো সাঁকোর ওপর পথ আঁটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে খচ্চরটা। ফুলমনির হাজার তাড়া খেয়েও হেলদল নেই তার। উপায় না দেখে ফুলমনি আশপাশে লাঠি জাতীয় কিছু খোঁজা শুরু করে। এমন সময় হঠাৎ গা ঝারা দিয়ে নড়ে ওঠে খচ্চরটা। কান খাঁড়া করে কিছু শোনে। চঞ্চল হয়ে ওঠে। ঘাড় উঁচু করে রাস্তার দিকে তাকায়। ফুলমনি খেয়াল করে প্রানীটার আকস্মিক পরিবর্তন। তার দৃষ্টি অনুসরন করে রাস্তার দিকে তাকায়। একজন পাইকার তিনটে খচ্চর নিয়ে এগিয়ে আসছে। তারা সাঁকো পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই কামালের খচ্চর তাদের পেছন নেই। ফুলমনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে তার মিলিয়ে যাওয়া। মনে ভাবে আপদ গেল।

একটু বাদেই রিক্সায় চেপে নুতন বউ নিয়ে এসে পৌঁছয় কামাল। বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে তার খচ্চরের গল্প শোনে। মনে মনে খুব হাসে। দুই খচ্চরের কপাল খুলে গেল একই দিনে।

পরেরদিন বেলা করে ঘুম ভাঙ্গে কামালের। ব্রাশ হাতে দাওয়ায় এসে দাঁড়ায়। নয়ানজুলির দিকে তাকিয়েই তার চোখ থমকে যায়। খচ্চরটা চরে বেরাচ্ছে লম্বা ঘাঁস গুলোর ভেতর। তারপর থেকে আর সে সাঁকোর ওপর দাঁড়ায় না। ঘরের সামনেই টিনের চালা করে দেওয়া হয়েছে তার জন্য। আজকাল ফুলমনিই তার দেখাশোনা করে।