'তৃষ্ণার অগি্নতে একা'

আমরা কেউ মরি না
একটি অন্তহীন মৃত্যুহীন
বিলয়হীন সমাপ্তিহীন জীবনের
অংশ হয়ে আমরা বেঁচে থাকি
বেঁচে আছি এবং এই বেঁচে থাকার
কোনো অতীত নেই বর্তমান নেই ভবিষ্যত নেই
একটি সময়হীনতার কেন্দ্রবিন্দুতে
আমরা বেঁচে আছি সবাই…
….কবি ফজল শাহাবুদ্দীন আমার দীর্ঘদিনের একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং সুহৃদ ছিলেন। তিনি তার যৌবনের প্রারম্ভে কবিতার দিকে তার অন্তরের সমস্ত শক্তি সমর্পণ করে কাব্য রচনা করে গিয়েছেন। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে গিয়ে তাকে প্রথম দেখেছি। পরিচয়ের আগেই তার কবিতা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত দেখতাম। সেদিন শার্ট ও পায়জামা পরা কবি ফজল শাহাবুদ্দীনকে কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে সাহিত্য আসরে প্রবেশ করতে দেখলাম। ছিমছাম শীর্ণকায় শরীর। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ। মাথায় ঘন চুল। চোখে কৌতূহলী দৃষ্টি।
কবি ফজল শাহাবুদ্দীন পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিজীবনে নানা পেশায় জড়িয়ে পড়লেও তিনি মূলত কবিই ছিলেন। স্বাপি্নক মানুষ ছিলেন। একজন সফল মানুষ হিসেবে তার সময় অতিবাহিত করেছেন। আমার ঢাকায় আগমনের পর ফজলের সঙ্গে পরিচয়ের পরই তাকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম। শহীদ কাদরীও ছিলেন সেই দলে।
প্রথম সাক্ষাতে তাদের কথাবার্তায় আমি ভীত হয়ে পড়েছিলাম। পরে একটু একটু করে বুঝতে পেরেছিলাম, এরাই মস্ত শহরে আমার সুহৃদ হওয়ার মতো ব্যক্তি। প্রকৃতপক্ষে সে সময় আমি অন্য কাউকে এমন কবিতা অন্তঃপ্রাণ, বিদ্বান এবং অল্প বয়সে বেশি পাঠে প্রাজ্ঞ আর কাউকে পাইনি। আমি মুগ্ধ হয়ে তাদের কথা শুনতাম। তাদের পাঠ্য বিষয় পাঠ করতাম। তাদের মতো জামা-জুতো এবং কলম ব্যবহার করতাম। বলা যায়, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও ফজল শাহাবুদ্দীন_ এই ত্রয়ীর চুম্বকে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।
ফজল শাহাবুদ্দীন সবসময় বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। তিনি উদার এবং বন্ধুদের সঙ্গে গভীর মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে ভালোবাসতেন।
যদিও তার পেশার কারণে তাকে ব্যবসা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হতো, তবুও সবকিছুর মধ্যেই তিনি তার কবিতাশক্তিকে সজাগ রাখতে পেরেছিলেন। এটা খুব কম মানুষই পারে। তিনি ছিলেন বন্ধুবৎসল, ভোজনবিলাসী এবং সহৃদয় ব্যবহারে সবাইকে আপ্যায়ন করতেন।
ফজল শাহাবুদ্দীনের আদি বাড়ি আমাদের এলাকায়। অর্থাৎ নবীনগর থানার বাসিন্দা হলেও, তারা বহুকাল ধরে ঢাকাতেই ছিলেন। ওই সময় থাকতেন কমলাপুরে। ফজলের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রায়ই আমি চলে যেতাম তার অফিসে। তিনি তখন নবাবপুরের একটি ছোট পোস্ট অফিসে কাজ করতেন। তার একটি অভ্যাস ছিল, বন্ধুকে সহসা ছেড়ে দিতে চাইতেন না। আটকে রাখতেন ছলে-বলে! যখন অফিস থেকে বের হতেন, তখন একটি সাইকেল নিয়ে কমলাপুরের দিকে রওনা হতেন। প্রায়ই সঙ্গে থাকতাম আমি। আমাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইতেন না। একদিকে সাইকেল, একদিকে আমি। একদিকে যন্ত্র, অন্যদিকে কবিবন্ধু। দু’জনকেই ঠেলতে ঠেলতে তিনি কমলাপুর ঠাকুরপাড়ার শেষ প্রান্তে নিয়ে যেতেন। তিনি বাসায় চলে গেলে আমি একাকী দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিয়ে আসতাম নবাবপুর।
কাফেলা অফিসে চাকরি করছি যখন, তখন একদিন অফিসে এসে হাজির হলেন কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। এসেই বললেন, শুধু কবিতা দিয়ে এবং কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ দিয়ে কাফেলার একটা সংখ্যা বের করো না কেন? প্রস্তাবটা খুবই চমৎকার লাগল আমার কাছে। তার কথায় আমি কাফেলায় কবিতা সংখ্যার পরিকল্পনা করলাম এবং পত্রিকায় ঘোষণা দিয়েছিলাম। সম্ভবত এটাই ছিল তৎকালীন ঢাকায় কবিতা ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধাদি নিয়ে একটি সংখ্যা প্রকাশের স্বতন্ত্র প্রয়াস। অনেক আলোচিত হয়েছিল কাফেলার সেই সংখ্যাটি।
ফজল শাহাবুদ্দীনের সাংবাদিক এবং লেখালেখির জীবন শুরু হয় দৈনিক বাংলায়। তিনি প্রকৃত কবির জীবনযাপন করেছেন। স্বাপি্নক মানুষ হিসেবে তার জীবন-যৌবন অতিবাহিত করেছেন। নানা কারণে তার জীবনের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। তাকে দেখেছি, তিনি দৈনিক বাংলার কাজ ছেড়ে দিয়ে হারুন এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। যদিও এটি একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, তবুও ফজল শাহাবুদ্দীন তার নানাবিধ দক্ষতা ও কর্মতৎপরতার গুণে এখানেও তার জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পেরেছিলেন। ফজল ব্যক্তিজীবনে সামান্য অবস্থা থেকে অনেক উচ্চে নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলন। এ সাফল্যকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হয়।
১৭ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের প্রথম কবিতা ‘এবং তুমি’। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তৃষ্ণার অগি্নতে একা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। পরবর্তীতে একে একে প্রকাশিত হয় তার আরও ২৭টি কাব্যগ্রন্থ। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘অকাঙ্ক্ষিত অসুন্দর’, ‘আততায়ী সূর্যাস্ত’, ‘অন্তরীক্ষে অরণ্য’, ‘সানি্নধ্যের আর্তনাদ’, ‘আলোহীন অন্ধকারহীন’, ‘সনেটগুচ্ছ’, ‘অবিনশ্বর দরোজায়’,’ ‘আমার নির্বাচিত কবিতা’, ‘হে নীল সমুদ্র হে বৃক্ষ সবুজ’, ‘লংফেলোর নির্বাচিত কবিতা’, ‘দিকচিহ্নহীন’, ‘ছিন্নভিন্ন কয়েকজন’, ‘যখন জখম নাগমা’, ‘বাতাসের কাছে’, ছায়া ক্রমাগত’, ‘নিসর্গের সংলাপ’, ‘পৃথিবী আমার পৃথিবী’, ‘ ক্রন্দনধ্বনি’, ‘ ক্রমাগত হাহাকার’। ফজল শাহাবুদ্দীনের সর্বশেষ কবিতার বই ‘একজন কবি একাকি’ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন গল্প এবং প্রবন্ধও। ইংরেজীসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার কবিতা। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৮৮ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক অজর্ন করেন।
প্রায় ছয় দশক তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে কবিতার চর্চা করে গেছেন। বাংলা কবিতার আধুনিক ধারায় তিনি অন্যতম প্রধান । তিনি ছিলেন ফজল শাহাবুদ্দীন ছিলেন সত্তর দশকের সাড়া জাগানো সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র প্রাণপুরুষ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন তিনি শামসুর রাহমানের সঙ্গে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন দেশের ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য পত্রিকা ‘কবিকণ্ঠ’। ত্রৈমাসিক পত্রিকাটি শুরুতে দু’জনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলেও পরে ফজল শাহাবুদ্দীনের একক সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ।
১৭ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের প্রথম কবিতা ‘এবং তুমি’। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘তৃষ্ণার অগি্নতে একা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। পরবর্তীতে একে একে প্রকাশিত হয় তার আরও ২৭টি কাব্যগ্রন্থ। ফজল শাহাবুদ্দীনের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘অকাঙ্ক্ষিত অসুন্দর’, ‘আততায়ী সূর্যাস্ত’, ‘অন্তরীক্ষে অরণ্য’, ‘সানি্নধ্যের আর্তনাদ’, ‘আলোহীন অন্ধকারহীন’, ‘সনেটগুচ্ছ’, ‘অবিনশ্বর দরোজায়’,’ ‘আমার নির্বাচিত কবিতা’, ‘হে নীল সমুদ্র হে বৃক্ষ সবুজ’, ‘লংফেলোর নির্বাচিত কবিতা’, ‘দিকচিহ্নহীন’, ‘ছিন্নভিন্ন কয়েকজন’, ‘যখন জখম নাগমা’, ‘ঝবষবপঃবফ চড়বসং’, ‘ঝড়ষরঃঁফব’, ‘ঞড়ধিৎফং ঃযব ঊধৎঃয’, ‘বাতাসের কাছে’, ছায়া ক্রমাগত’, ‘নিসর্গের সংলাপ’, ‘পৃথিবী আমার পৃথিবী’, ‘ ক্রন্দনধ্বনি’, ‘ ক্রমাগত হাহাকার’। ফজল শাহাবুদ্দীনের সর্বশেষ কবিতার বই ‘একজন কবি একাকি’ প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন গল্প এবং প্রবন্ধও। ইংরেজীসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার কবিতা। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার ও ১৯৮৮ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক অজর্ন করেন।
আমি ফজল শাহাবুদ্দীনকে এক নির্বিরোধ গভীর প্রেমের কবি হিসেবেই জেনে এসেছি_ এমনকি প্রকৃতির কবি হিসেবেও। এখন দেখছি তার কবিতায় আছে অন্য এক গূঢ় রহস্য যা আমাদের কবিতার জন্য একান্ত দরকার। একাকী, নিভৃতচারী, আলোচনাবিমুখ কবি ফজল শাহাবুদ্দিন শেষ বয়সে ছিলেন শুধুমাত্র কবিতা এবং নিজেকে নিয়ে। তার কবিতায় আছে এক প্রকার তৃষ্ণার রহস্যময় আগুন। সে আগুনে তিনি একা নিভৃতির গভীরে বসে জ্বলেছেন। পাঠকের মনে ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতার মায়াবি আলো।
জীবনের ‘তৃষ্ণার অগি্নতে একা’ কবি_ আমার সুদীর্ঘকালের বন্ধু-সুহৃদ ফজল শাহাবুদ্দীনকে হারিয়ে আমি স্তব্ধবাক; আমাদের বেলা-অবেলা আজ দুলে উঠছে বারবার আমাদের কবিতার চিত্রকল্পেরই মতো। বিদায়, বন্ধু।
এবং আমি জানি আমিই সৃষ্টির সকল নিম্নভূমি
সকল পাতালের একান্ত আলিঙ্গন

আমিই সকল উর্ধ আকাশ সকল স্বর্গলোকের ইন্দ্রজাল
পশ্চিম দিগন্তের সীমানাহীনতার
সকল লীলালাসা একান্ত ধ্বনি প্রতিধ্বনি
পূর্ব গগনের সবখানে প্রসারিত অশেষ এই আমি
দক্ষিণের জানালায় আমিই আসি বারংবার
উত্তরের শীতার্ত সীমানাহীনতার

আমিই ঘনিষ্ঠ ক্রন্দনধ্বনি
আসলে আমিই সব আমিই জীবন মৃত্যু আলো অন্ধকার
মহাজীবন প্রকৃতি মহাপ্রকৃতি এবং বিশ্বলোক

আদি অন্ত প্রারম্ভ সূচনা সৃষ্টি বিলয় উত্থান এবং পতন
সকল আলোহীনতা আর অন্ধকারহীনতা
দশদিক ঘেরা চিরকালের গোধূলি আমি
কবি চরকালের বেঁচে থাকি চিরকাল
সকল অশেষের শরীরে সকল সীমানাহীনতার আত্মায়
সকল অস্তিত্বের বিন্দু বিন্দু উচ্চারণে

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আল মাহমুদ- র আরো পোষ্ট দেখুন