আবদুল মান্নান সৈয়দ

আব্দুল মান্নান সৈয়দ

জন্মঃ৩রা আগস্ট, ১৯৪৩ – মৃত্যুঃ ৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১০) বাংলাদেশের একজন অগ্রগণ্য আধুনিক কবি, সাহিত্যিক, গবেষক  ও সাহিত্য-সম্পাদক। পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময় ধ’রে বাংলা সাহিত্যকে নানান দিকে দিয়ে ঋদ্ধ করেছেন। তবে ঊনিশ শতকের ষাট দশকে আবির্ভূত অন্যতম কবি হিসেবে তিনি সচরাচর অভিহিত। কবিতা ছাড়াও তিনি গল্প, উপন্যাস, সমালোচনা, নাটক ইত্যাদি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সুপ্রসার ও সুগভীর অবদান রেখেছেন। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অনন্যসাধারণ শিল্পী।রবীন্দ্রোত্তর কালে বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে তাঁর অবদান তুলনারহিত। কবি জীবনানন্দ দাশ এবং কবি কাজী নজরুল ইসলামের ওপর তাঁর গবেষণা প্রবাদপ্রতীম। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দেড় শতাধিক।জন্মসূত্রে তাঁর নাম সৈয়দ আবদুল মান্নান। বাংলাদেশের সাহিত্যমহলে তিনি ‘মান্নান সৈয়দ’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পোয়েট ইন রেসিডেন্স”।

জন্ম, শিক্ষা, জীবিকা

তাঁর জন্ম হয়েছিল অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের পশ্চিম বঙ্গে – ইছামতি নদী থেকে অনতিদূরে জালালপুর নামক গ্রামে। সেটা ১৯৪৩ খৃস্টাব্দ ; দুর্ভিক্ষের কাল। জন্মের কয়েক বছরের মধ্যে, ১৯৪৬-এ, কলকাতায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয় এবং পরের বছর ১৯৪৭-এ বৃটিশ শাসিত ঔপনিবেশিক ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ১৯৫০-এ ভয়াবহ আরেকটি দাঙ্গা হয় পশ্চিম বঙ্গে। তখন তার পিতা নৌকোয় করে পালিয়ে সপরিবার পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসেন। এইভাবে তিনি মূল ভূখণ্ড চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেন। অনিবার্য এই অভিবাসন মেনে নিলেও আমৃত্যু তিনি বাস্তুহারার বেদনা তীব্রভাবে অনুভব করেছেন।

ঢাকায় এসে তারা গোপীবাগে বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে গ্রীন রোডে জমি কিনে তাঁর পিতা স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন। সে সময় গ্রীন রোডের নাম ছিল “কুলি রোড”। ৫১ গ্রীন রোডই ছিল তাঁর আমৃত্যু ঠিকানা।

১৯৫৮ খৃস্টাব্দে ঢাকার নবাবপুর সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলা বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬০ খৃস্টাব্দে। অত:পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং ১৯৬৩-তে স্নাতক সম্মান এবং ১৯৬৪-তে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। সাহিত্যজীবনের প্রস্তুতিপর্ব সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “আমার জীবনে লেটো পিরিয়ড আছে। নজরুলের মতো। পিরিয়ডটা হলো আমার ক্লাস সেভেন-এইট থেকে এমএ পাস পর্যন্ত। আমি বিরামহীন লেখালেখি করতাম আর ছবি আঁকতাম। কিন্তু আব্বা আমার লেখা প্রকাশিত হতে দিতেন না। ওই পিরিয়ডে আমি নিজেকে ক্রমাগত শিক্ষিত ও সংস্কৃত করার চেষ্টা করেছি। আমার কঠোর আব্বা, কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন ; চাচাও মেধাবী ছাত্র ; আমাকে পড়ালেখায় বাধ্য করেছেন যেন আমি এমএ পাস করি। এ জন্য ১৯৬৫ সালকে আমি ধরি আমার আত্মপ্রকাশের বছর”।

শিক্ষা-জীবন শেষে তিনি সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। সারা জীবন প্রধানত: অধ্যাপনা ক’রে তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন।কর্মজীবনে তিনি ফরিদপুর শেখ বোরহানুদ্দীন কলেজ, সিলেটের এম. সি. কলেজে, এবং ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ারে।ঢাকার জগন্নাথ কলেজে দীর্ঘ কাল অধ্যাপনা করার পর ২০০২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত মেয়াদের জন্য তিনি নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত হন।

পিতা সৈয়দ এ. এম. বদরুদ্দোজা (১৯১০-৮৯) ছিলেন সরকারী চাকুরে ; সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী। যৌবনে উর্দ্দুতে কবিতা লিখতেন। মান্নান সৈয়দের লেখালেখির জন্য গ্রীন রোডের বাসায় উঠানের একপাশে আলাদা দোচালা ঘর তুলে দিয়েছিলেন। মাতা কাজী আনোয়ারা মজিদও সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। তাঁরা ছয় ভাই, চার বোন। বিয়ে করেছিলেন চাচাতো বোন সায়রা সৈয়দ রানুকে। একমাত্র কন্যার নাম জিনান সৈয়দ শম্পা।

সাহিত্যচর্চা

তাঁকে বলা হয়েছে সব্যসাচী লেখক। বাংলা সাহিত্যের যে শাখায়ই তিনি চর্চা করেছেন, সাফল্য ও কীর্তি ধরা দিয়েছে অবলীলায়।বলা হয়েছে এদেশে তাঁর মতো পরিশ্রমী লেখক নেই। যে কোন লেখার মধ্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। প্রচণ্ড তোলপাড় করা শক্তি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। বাংলা কবিতায় কবিতায় তিনি যুক্ত করেছিলেন পরাবাস্তববাদী দিগন্ত। তাঁর উদ্ভাবনী শক্তি ও ব্যঞ্জনা সৃষ্টি তাঁর ভাষাকে করে তুলেছে ব্যতিক্রমী। মহাসমর পরর্তীকালে দুই বাংলাতেই তাঁর মতো সাহিত্যসমালোচক খুঁজে পাওয়া যায় দুষ্কর। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে ছিল তাঁর অগাধ ধারণা। সমসাময়িককালে তাঁর মতো বড় মাপের লেখক দেখা যায় না। কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও কবিতায় তাঁর সৃজনশীলতা অসাধারণ।সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় প্রচৃর কাজ করলেও ভগ্নস্বাস্থ্য উপেক্ষা করে তিনি আরো কাজ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “মাইকেল সম্পর্কে, বঙ্কিমের উপন্যাস সম্পর্কে আমার লেখার ইচ্ছা আছে। ফররুখ আহমেদ একজন বিরাট লেখক। আমার একটা আক্ষেপে, এত বড় কবি জসীমউদ্দীন, তাঁর ওপর আমি কোনো কাজ করিনি। জীবনানন্দকে নিয়ে আমি যে কাজটা করেছি, মানিক বন্দোপাধ্যায়কে নিয়েও সে রকম কাজ করা আমার উচিত ছিল।”তাঁর আত্মজৈবনিক লেখার মধ্যে বিষাদের সুর পরিলক্ষিত হয়। যে তুলনারহিত সৃজনশক্তির স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন তার মূল্য জীবদ্দশায় যথাযথভাবে স্বীকৃত হয় নি। স্বীয় বিশ্বাসে রাজনৈতিক ঔদার্য়ের কারণে তাঁকে প্রায়শ: রাষ্ট্রীয় উপেক্ষার শিকার হতে হয়েছে।

মান্নান সৈয়দ ছিলে বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম “পোয়েট ইন রেসিডেন্স”। তাঁকে স্কলার-ইন-রেসিডেন্স পদমর্যাদায় নিয়োগ করে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগ্রামী জীবনকে গ্রোথিত করে পূর্ণাঙ্গ নজরুলজীবনী রচনার দায়িত্ব দেয়া হয়।

 কবিতা

বাংলা ভাষায় তিনি সেই একজন কবি যিনি ষাটের দশকে সমকালীন কাব্যরুচিকে বদলে দেয়ার অভিপ্রায়ে পরাবাস্তবতার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এভাবেই তিনি স্বীয় কবিকণ্ঠস্বরকে অনন্যসাধারণ করে উপস্থাপন করেছিলেন। ১৯৫৯ খৃস্টাব্দে তৎকালীন ইত্তেফাক পত্রিকার সাহিত্যবিভাগে “সোনার হরিণ” শিরোনামে একটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার জগতে তাঁর অন্নপ্রাশন হয়েছিল।১৯৬৭ খৃস্টাব্দে জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ শিরোনামীয় কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতায় আবদুল মান্নান সৈয়দের অনির্বচনীয় আসনের শিলান্যাস হয়েছিল। জীবদ্দশায় তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ২১। ষাটের দশকের আধুনিকতাবাদী কবিদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ অন্যতম। তাঁর কাব্যশৈলীর বড় বৈশিষ্ট্য আধুনিকতা ও নন্দনতত্ত্বের বহুমাত্রিক প্রয়োগ। স্যুররিয়ালিস্ট বা পরাবাস্তবতার কবি হিসেবে তিনি খ্যাতিমান ছিলেন। বলা হয়েছে, “তিনি প্রচণ্ড তোলপাড় করা শক্তি নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কবিতায় তিনি এনেছেন পরাবাস্তববাদী অনন্য বৈভব।”নতুনতর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে গতানুগতিকতাকে তিনি বরাবরই চ্যালেঞ্জ করেছেন। নিজের রচনায় নিরন্তর তিনি নিরীক্ষা চালিয়েছেন। ফলত: প্রায় পাঁচ দশকের কবি জীবনে তিনি বহু বার বাঁকবদল করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “কবিতায় আমি ভ্রাম্যমাণ। ফলে বছর পঞ্চাশ ধরে কবিতা যে লিখে গেছি, তার মধ্যে যে রূপান্তর তাকে আমি বাধা দিইনি। জোর করে কখনো কবিতা লিখিনি। আজো না। কবিতা আমি তখনই লিখি যখন কবিতা নিজে এসে আমার ওষ্ঠ চুম্বন করে।”প্রতীক-পরাবাস্তব থেকে সহজ-সাধারণ ধর্মীয় কবিতা; অক্ষরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত থেকে সনেট ও টানাগদ্য – প্রায় সর্ববিধ আঙ্গিকে তিনি নিরীক্ষাধর্মীতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে সর্ব্বদাই যে প্রণোদনা তাঁর কবিসত্তায় অন্তর্নিহিত ছিল তা’ হলো ১৯৩০ দশকের কবিদের প্রভাব মুক্ত হয়ে বাংলা আধুনিক কবিতায় নতুন একটি দিগন্ত সৃষ্টি করা।বহুলপ্রজ এই কবির কবিজীবনে সবচেয়ে ফলপ্রসূ সময় আশীর দশক। এই কালপরিধিতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ৬টি কাব্যগ্রন্থ। শৈলী ও বিষয়বস্তুর বৈচিত্রে এই কাব্যগ্রন্থগুলো ভাস্বর, বহুবর্ণিল। নির্বাচিত কবিতা (২০০১) শিরোনামীয় সংকলনগ্রন্থে তাঁর কবিসত্তার সামগ্রিক পরিচয় পাওয়া যায়।

সাহিত্য-সমালোচনা

আবদুল মান্নান সৈয়দ কবিতা বা কথাসাহিত্যের চেয়েও সাহিত্য-সমালোচক হিসেবে অধিকতর খ্যাতিমান। পঞ্চাশ বছর তিনি সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে কাজ করে বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যকে একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর সমালোচনা নিবিড় গবেষণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সমালোচনার জন্য তিনি আবিষ্কার করেছেন একটি নিজস্ব ভাষা যা প্রায়শ: দুর্জ্ঞেয়-দুরতিক্রম্য। সাহিত্য প্রবন্ধে তিনি বিশুদ্ধ শিল্পলোক-বিচরণে প্রতিশ্রতিবদ্ধ ছিলেন। তিনি সমালোচনায় নিমোর্হ এবং বিবেকী। শুদ্ধতম কবি , করতলে মহাদেশ, দশ দিগন্তের দ্রষ্টা প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধ ষাটের কাব্য-লক্ষণ গদ্যভাষার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। বলা হয়েছে, সুগভীর শিল্প-এষণা, নন্দনতাত্ত্বিক ব্যুৎপন্ন এবং সাহিত্যচর্চায় প্রশ্নাতীত নিষ্ঠা ও সততা ষাটের প্রাবন্ধিকদের মধ্যে তাঁকে স্বতন্ত্র অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রবন্ধের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি মূলত নন্দনতত্ত্বের বিভিন্ন শাখায় স্বচ্ছন্দ হলেও কবি ও কবিতা এবং কাব্য-আঙ্গিক তাঁর অভিনিবেশের ঐকান্তিক ক্ষেত্র। অনেক ক্ষেত্রে তাঁর প্রবন্ধে যুক্তি-জ্ঞান-অভিজ্ঞতার চেয়ে কবি-কল্পনাই প্রাধান্য পেয়েছে।তাঁর প্রথম প্রবন্ধ মুদ্রিত হয়েছিল সাম্প্রতিক পত্রিকায়, ১৯৬৩ খৃস্টাব্দে, শিরোনাম “কথাসাহিত্য প্রাসঙ্গিক”। প্রথম গ্রন্থালোচনা প্রকাশ করেছিলসমকাল পত্রিকায়।

জীবনানন্দ চর্চ্চা

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ এবং প্রধানতম কবি জীবনানন্দ দাশের ওপর আলোচনার জন্য সুবিখ্যাত। তাঁর শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা গ্রন্থ। তিনি জীবনানন্দ দাশের কবিতা, গল্প, পত্রাবলী ইত্যাদি সংগ্রন্থিত ক’রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর জীবনানন্দ পাঠ সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিবেচিত।

নজরুল চর্চ্চা

নজরুল চর্চ্চায় তিনি কবি মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ এবং প্রাবন্ধিক শাহাবুদ্দিন আহমদের গবেষণা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।তাঁর নজরুল ইসলাম – কবি ও কবিতা একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ।

কথাসাহিত্য

সব্যসাচী লেখক মান্নান সৈয়দ কথাসাহিত্যেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে গেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলী হলো সত্যের মত বদমাস, চল যাই পরোক্ষে এবং মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা। এর মধ্যে সত্যের মত বদমাশ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ খৃস্টাব্দে। অশ্লীতার অভিযোগে তৎকালীন সরকার কর্তৃক এ গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয়। তাঁর বহুল আলোচিত দুটি উপন্যাস হলো পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী, অ-তে অজগর। তাঁর গল্প-উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রাধ্যন্য পেযেছে। বলা হয়েছে, “ষাটের গল্পকারদের মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ সবচেয়ে বেশি প্রাতিস্বিকতাবিলাসী শিল্পী। আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার গল্পভাষ্য নির্মাণে তিনি সিদ্ধহস্ত। বিষয়াংশ এবং প্রকরণের অভিনবত্বে তাঁর গল্পসাহিত্য বিশিষ্টতার দাবিদার। তবে, প্রথম পর্বের গল্পে, কনটেন্ট ও ফর্মে, আরোপিত উপাদান গল্পের মূলস্রোতের সঙ্গে জৈবসমগ্রতায় একাত্ম হতে পারেনি। বিচ্ছিন্নতা ও নির্বেদের যন্ত্রণায় তাঁর অধিকাংশ নায়ক পীড়িত ও পর্যুদস্ত। প্রতীকী এবং পরাবাস-ববাদী পরিচর্যা আবদুল মান্নান সৈয়দের ছোটগল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রথম পর্বের গল্পের ভাষারীতিতে আরোপিত আধুনিকতা দ্বিতীয় পর্বে পরিত্যক্ত হয়েছে; ফলে, গল্পস্রোত হয়েছে অনেক বেশি সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ।”[২৩]

নাটক

শুধু কবিতা-কথাসাহিত্য নয়, তিনি লিখেছেন, কাব্যনাট্যপ্রহসন, একাঙ্ক, শ্রুতিনাট্য, পূর্ণাঙ্গ নাটক, অনুবাদ নাটক, ইত্যাদি। ১৯৯২ খৃস্টাব্দে বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত হয় তাঁর নাট্যগুচ্ছ। ২০০৯-এ প্রকাশিত হয় নাট্যধর্মী সকল লেখার সঙ্কলন নাট্যসমগ্র। তিনি ছোটগল্পের নাট্যরূপ দিয়েছেন। তাঁর কয়েকটি কাব্য নাট্যের নাম বিশ্বাসের তরু, জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা, ঈশ্বরপ্রাপ্তির ছোট্ট গাঁথা, চাকা, কবি ও অন্যেরা এবং আটতলার ওপরে

 সম্পাদনা

বিভিন্ন লেখক-সাহিত্যিকের রচনাসমগ্র সংকলন ও সম্পাদনায় মান্নান সৈয়দ অতুলনীয় ধৈর্য্য ও পরিশ্রমের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এ সবের মধ্যে কয়েকটি হলো: জীবনানন্দ দাশের কবিতা, ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ফররুখ রচনাবলী (প্রথম খন্ড), বাংলাদেশের কবিতা, বাংলাদেশের ছড়া, সমরসেনের নির্বাচিত কবিতা, মোহিতলাল মজুমদারের নির্বাচিত কবিতা, বুদ্ধদেব বসুর সুনির্বাচিত কবিতা প্রভৃতি। এছাড়া তাঁর ব্যতিক্রমী কাজের মধ্যে রয়েছে কবি শাহাদাত হোসেনের ইসলামী কবিতা এবং কমরেড মোজাফফর আহমদের পত্রাবলী সম্পাদনা ও সংগ্রন্থনা।

 শিল্পতরু

কবি আবিদ আজাদ সম্পাদিত সাহিত্যসাময়িকী শিল্পতরু’র উপদেষ্টা সম্পাদক হিসাবে মান্নান সৈয়দ দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় তিনি নবীন-প্রবীন সকল কবি-সাহিত্যিকের রচনা সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। তাঁর সম্পাদনার মাধ্যমে শিল্পতরু আশীর দশকের শেষভাগে একটি মর্যাদাবান সাহিত্যপত্রে পরিণত হয়েছিল।

 চিত্রকলা

ছোটবেলা থেকেই তিনি আকিয়েঁ। ষাটের দশকে বেশ একেঁছেন। অশোক সৈয়দ ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন তখন। কিন্তু দীর্ঘকাল তাঁর আঁকিয়ে পরিচয়টি লুপ্ত ছিল। খেয়া সাময়িকীর ২৫তম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় (আগস্ট ২০০৮) দীর্ঘ তিন-চার যুগের ব্যবধানে তাঁর আঁকা ছবি মুদ্রিত হলে চিত্রকর পরিচয়টি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।

গদ্য ভাষা

মান্নান সৈয়দ তাঁর প্রকাশ রীতির জন্য একটি বিশেষ গদ্য ভাষা আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর বাক্যে পদসংস্থাপনার ক্রম ছিল অভিনব এবং সমাসবদ্ধ শব্দন্ধের ব্যবহার ছিল অকাতর। ফলে ভাষা ছিল কিছুটা জটিল ও দুবোর্ধ্য। তবে সার্বিকভাবে এ ভাষা ছিল প্রকাশ ক্ষমতায় ঋদ্ধ। জীবনের শেষভাগে তিনি সাদা-মাটা ভাষায় লিখতে শুরু করেন। তিনি প্রচুর সমাসবদ্ধ শব্দ সৃষ্টি করে ব্যবহার করেছেন।

মৃত্যু

দীর্ঘদিন তিনি ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। ২৭ আগষ্ট ২০১০ চ্যানেল আই নামক টেলিভিশনে আয়োজিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গিয়ে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। নিকটস্থ ঢাকা মেট্রোপলিটন হাসপাতালে চিকিৎসা লাভ করেন তিনি।[ সেই থেকে বাসায়ই অবস্থান করছিলেন কবি। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ ইফতারীর কিছু আগে ঘুমের ভিতর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। বাসার অদূরে ল্যাবএইড হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে ডাক্তাররা তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করে।তাঁর মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমঘরে সংরক্ষণ করা হয়। পরদিন ৬ আগস্ট তাঁর বাসস্থানের সন্নিকট গ্রীন রাড মসজিদে তাঁর প্রথম নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাঁর লাশ বাংলা একাডেমীতে নিয়ে যাওয়া হয় ; সেখানে নজরুল মঞ্চে রাখা হয় মরদেহ। এ সময় কবি-সাহিত্যিকসহ সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে। বাংলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও এ সময় শ্রদ্ধা জানানো হয়। বেলা পৌনে ১২টায় এখানে মরহুমের দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা একাডেমীতে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সেখানে যান কবি সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, সৈয়দ আনোয়ারা হক, বেলাল চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, রবিউল হুসাইন, হাসান হাফিজ, হাবিবুল্লাহ সিরাজী, রেজাউদ্দিন স্টালিন, রামেন্দু মজুমদার, আতাউর রহমান, ম. হামিদ, আবদুল হাই শিকদার, জাতীয় কবির নাতনি খিলখিল কাজী প্রমুখ।তৃতীয় এবং সর্বশেষ নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জোহরের নামাজের অব্যবহিত পরে। সেখান থেকে তাঁর লাশ আজিমপুর গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সমাধিস্থ করা হয়। বলা হয়েছে, তাঁর মৃত্যুতে সমকালীন বাংলা সাহিত্য এক অপূরণীয় শূন্যতায় নিমজ্জিত হলো এবং এমন একটি সংকট তৈরী হলো যা দীর্ঘকাল ধ’রে অনুভূত হবে।

চারিত্র্য

জীবনানন্দকে তিনি বলেছিলেন “শুদ্ধতম কবি” ; কার্যত: নিজ জীবনেও তিনি ছিলেন “শুদ্ধতার সাধক”। দীর্ঘ শালপ্রাংশু অবয়ব, কাঁধের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া কেশগুচ্ছ, সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন রীতিমতো সুদর্শন সুপুরুষ। একদিকে তিনি পৌরুষদীপ্ত ও ব্যক্তিত্বময় ; অন্য দিকে সদালাপী, সদা হাস্যময়। অন্তরে ছিলেন তীব্র অভিমানী। কথার ফাঁকে কৌতুক করা ছিল তাঁর সুনিপূণ অভ্যাস। স্বভাবে বিজনবাসী হলেও তিনি ছিলেন আড্ডার ভক্ত তবে পড়াশুনা আর লেখালেখির ব্যাপারে এক মুহূর্ত ছাড় দেন নি। এ বিষয়ে তিনি সদা উন্নীদ্র, আমৃত্যু চঞ্চল। রাষ্ট্র ও সমাজ তার যথাযোগ্য মূল্যায়ন করতে পারেনি বলে একটি সূক্ষ্ণ অভিমান তাঁকে তাড়া ক’রে ফিরতো। দু’বার হার্ট এটাক তার জীবনী শক্তি অনেকখানি ক্ষয়ে ফেলেছিল। তাঁর অস্তিত্বে সেঁটে গিয়েছিল এক অনপনেয় বিষণ্ণতা। একটি কবিতায় তিনি মৃদু কণ্ঠে বলেছেন: “আনন্দ কাকে বলে—আজ আর মনে নেই আমার।”তবে মৃত্যুঅবধি তিনি ছিলেন একজন জীবিত মানুষ। তাই জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে জীবন দর্শনের পুনমূর্ল্যায়ন করে বলেছিলেন, “একটা বয়সে এসে বুঝতে পারছি, আমি চারপাশে তাকাইনি। দ্বিতীয়বার হৃদরোগের পরে, দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থেকে আমি আমার আশপাশে মানুষদের দেখলাম- আমার পাড়ার মানুষেরা, বাজারের লোকজন, খুব সাধারণ মানুষদের। বুঝতে পারছি, যাদের দিয়ে আমার জীবন চলছে, তাদের জন্য আমি কোনো কিছু করিনি।” মান্নান সৈয়দ ছিলেন সাহিত্যের ঘোর লাগা মানুষ। তিনি আপাদমস্তক একজন কবি, সাহিত্যকর্মী।

প্রকাশিত গ্রন্থাবলী

কবিতা

  • জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭)
  • জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা (১৯৬৯)
  • ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ (১৯৭৪)
  • কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৮২)
  • পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮৪)
  • পার্ক স্ট্রিটে এক রাত্রি (১৯৮৩)
  • মাছ সিরিজ (১৯৮৪)
  • নির্বাচিত কবিতা
  • আমার সনেট।

 উপন্যাস

  • পরিপ্রেক্ষিতের দাস-দাসী
  • অ-তে অজগর (১৯৮২),
  • কলকাতা (১৯৮০),
  • ক্ষুধা প্রেম আগুন’ (১৯৯৪)
  • কলকাতা,
  • পোড়ামাটির কাজ,
  • হে সংসার হে লতা,

ছোটগল্প

  • সত্যের মতো বদমাশ
  • চলো যাই পরোক্ষে
  • মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা
  • নেকড়ে হায়েনা
  • তিন পরী ইত্যাদি। প্রবন্ধ
  • বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা
  • দশ দিগন্তের দ্রষ্টা
  • নির্বাচিত প্রবন্ধ
  • করতলে মহাদেশ
  • আমার বিশ্বাস,
  • ছন্দ।

স্মৃতিকথা

  • ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়

গবেষণা গ্রন্থ

  • কালান্তরের যাত্রী।

শিশু সাহিত্য

 জীবনী

  • নজরুল ইসলাম: কবি ও কবিতা
  • বেগম রোকেয়া
  • সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
  • সৈয়দ মুর্তাজা আলী
  • ফররুখ আহমদ
  • শাহাদাত্ হোসেন
  • জীবনানন্দ দাশ
  • প্রবোধচন্দ্র সেন
  • আবদুল গনি হাজারী
  • সৈয়দ মুর্তাজা আলী ।

 গ্রন্থনা

  • জীবনানন্দ দাশের কবিতা
  • ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭৫)
  • ফররুখ রচনাবলী (প্রথম খন্ড ১৯৭৯)
  • ইসলামী কবিতা : শাহাদাত হোসেন (১৯৮৩)
  • বাংলাদেশের কবিতা (১৯৮৮)
  • বাংলাদেশের ছড়া (১৯৮৮)
  • মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন স্মৃতি অ্যালবাম (১৯৮৮)
  • সমরসেনের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৯)
  • মোহিতলাল মজুমদারের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৯)
  • বুদ্ধদেব বসুর সুনির্বাচিত কবিতা (১৯৯০)।

জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্থাবলী

  • শুদ্ধতম কবি (১৯৭২),
  • জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৩),
  • জীবনানন্দ (১৯৮৪),
  • জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৬),
  • জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী (১৯৮৭),
  • জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯)।

 পুরস্কার ও স্বীকৃতি

  • বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার, ১৯৮১।
  • একুশে পদক,
  • আলওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮১।
  • নজরুল পুরষ্কার, পশ্চিম বঙ্গ, ১৯৯৮।
  • নজরুল পদক, ২০০১।
  • কবি তালিম হোসেন পুরষ্কার, ২০০০।
  • লেখিকা সংঘ পুরষ্কার, ২০০০।
  • অলক্ত সাহিত্য পুরষ্কার, ২০০২।
  • সুত্রঃ উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
মিতা- র আরো পোষ্ট দেখুন