বিষণ্ণ শহরের গল্প

আসপিয়া শোবার ঘরে ঢোকার জন্য এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বুকে হাত চেপে বসে থাকা আরমান হককে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘরে ঢুকতে পারে না। পা নড়ছে না। ওর উপস্থিতি টের পায়নি আরমান হক। যে ভঙ্গিতে বসেছিল সেভাবেই বসে থাকে। আসফিয়ার মনে হয় চোখ বন্ধ করে রাখা আরমান হক যেন হাজার বছর আগের গুহাবাসী কোনো মানুষ। তার সামনে অন্ধকার পৃথিবী নিথর হয়ে আছে। এখনো সবুজ বনানী গড়ে ওঠেনি। নদীর কলস্রোত নেই। পাখিদের কিচিরমিচির নেই। পোকামাকড় নড়ছে না। আসফিয়া নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবছে, এই জীবনে এমন ছবি দেখার ভাগ্য ওর হলো কেন? কেন ও এমন দুর্ভাগ্যের শিকার হবে? তার চেয়ে চোখ খুলুক ওর প্রাণপ্রিয় মানুষটি। বলুক, অমিয় নিখোঁজ হয়ে থাকবে না। চলো, ওকে খুঁজে নিয়ে আসি। আমরা দুপুরের ভাত একসঙ্গে খাব। মহুয়া থাকবে আমাদের সঙ্গে। ভাত খেয়ে দুজনে বসে গল্প করবে ড্র্ইংরুমে বসে কিংবা গান শুনবে। আলপনা ওদের চা-নাশতা দেবে। তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ, ধ্যানী মূর্তি?

কোথাও কোনো সাড়া নেই। বেলা বেড়ে দুপুর গড়িয়েছে। পিলখানা থেকে গোলাগুলির শব্দ কমেছে। মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে দু-একটা গুলির শব্দ হয়। আর কোনো শব্দ নেই।

আরমান হক চোখ খোলে। আসফিয়া দেখতে পায় বিষণ্ন দৃষ্টিতে পুরো শহর যেন জমাট হয়ে আছে। আসফিয়ার চোখে চোখ পড়লে জিজ্ঞেস করে, কোনো খবর আছে?

—নেই। খবর কিভাবে পাব।

আরমান হক বুকের ওপর থেকে হাত সরায়। দুহাত পেছনে দিয়ে মাথা ঝাঁকায়। ঘাড় কাত করে বলে, খবরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

—চলো, টিভি দেখবে। টিভিতে অনেক কিছু দেখাচ্ছে। টিভির স্ক্রলে কাদের মারা হয়েছে সেসব নামও দেখাচ্ছে।

—নাম? আঁতকে ওঠে আরমান হক। সোজা হয়ে বসে বলে, আলপনা, মহুয়া কি টিভি দেখছে?

—দেখছে। আমিও বেশ কিছুক্ষণ দেখেছি। পরে ভাবলাম তোমাকেও ডাকি। চলো।

—না, আমি টিভি দেখতে পারব না।

—আমিও বেশিক্ষণ দেখতে পারিনি। পিলখানার চারদিকে দিনের ঝকঝকে আলো ছড়ানো আছে। সে আলোর দিকে তাকালে শুধুই অন্ধকার ভরে আছে মনে হয়।

—আমার মনে হচ্ছে রাস্তায় বের হয়ে দেখি। লোকজনকে জিজ্ঞেস করি যে তাদের কাছে কী খবর আছে।

— না, তুমি যেতে পারবে না। কোনো খবর থাকলে বাড়িতেই পাব। বরং আমিয়র অপেক্ষায় বসে থাকি। সুযোগ পেলে ও নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে।

—ঠিক বলেছ। ফ্রিজে মুরগি রান্না আছে। মনুকে বলি ভাত বসিয়ে দিতে।

—অমিয় তোমার হাতের তৈরি কাবাব ভালোবাসে।

—ঘরে তো মাংস নেই। আজ আর কাবাব বানানো হবে না।

—সবজি কি আছে? ওর জন্য পটোল ভাজি করো।

—না, ভাজি না। পটোলের দোলমা করব। আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। আমার মানিক এসে বলবে, মাগো, খিদে পেয়েছে।

মৃদু হেসে চলে যায় আসফিয়া। ছেলেটিকে নিয়ে এমন ভাবনা দুজনকেই খানিকটুকু ভারমুক্ত করে। সকাল থেকে যে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় বিধ্বস্ত হয়েছিল, তার ভার একটুখানি লাঘব হয়। আরমান হকও স্বস্তিবোধ করে। নিজেরাই নিজেকে কষ্ট দিয়েছে পরিস্থিতির সবটুকু না জেনে। এভাবে ভাবা কি উচিত হয়েছে? ছেলেটি ভালো আছে এই প্রার্থনাই তো করা উচিত ছিল। কেন মৃত্যু-চিন্তায় ওরা নিজেরা ছেলেটির…। না, আর এসব ভাববে না। বিছানার ওপর বসে আরমান হক নিজেকে ক্রোধের সাগরে ভাষায়। নিজেকে নির্বোধ বলে শাসন করে। বিছানায় বসে দুই পা মেঝেতে দাপায়। ছুটে আসে আসফিয়া। দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার?

—আমি ছেলেটিকে নিয়ে অমঙ্গল চিন্তা করেছি। গোলাগুলির শব্দ মানেই কি মৃত্যু? একতরফা গুলি করছে সেপাইরা। তার মানে এই নয় যে ওরা সবাইকে মেরে ফেলেছে। যাদের সঙ্গে ওদের বোঝাপড়া করতে হচ্ছে, তাদেরই তো মারবে ওরা। তাই না? আমাদের ছেলে তো বড় অফিসার না। আমাদের ছেলে তো কোনো অন্যায় করেনি।

—আহ! থামো। ভেতরের খবর তো আমরা কিছু জানি না। সে জন্য আমরা শুধু আমাদের ছেলেকে নিয়ে ভেবেছি। ওর কোনো খবর পাচ্ছি না বলে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে আছি।

—আমরা ছেলেটিকে নিয়ে নানা স্মৃতির কথা ভাবছি কেন?

—ভাবব না কেন? ও আমাদের সামনে থাকলেও ওর নানা স্মৃতির কথা আমরা ভাবতে পারি। ওর সঙ্গে শেয়ার করতে পারি। আমি তো ভেবে রেখেছি মহুয়ার সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমি মহুয়াকে ওর ছোটবেলার অনেক কথা বলব। বিশেষ করে ওর দুষ্টুমির কথা।

—আমরা এসব নিয়ে আর কথা বলব না, আসফিয়া।

—কেন? সমস্যা কী?

—মেয়েটা কষ্ট পাবে।

—কী বলছ তুমি? আমি তো এখন বলব না। ওদের বিয়ের পরে বলব।

—ওদের বিয়ে…। এরপর আর কথা বলতে পারে না আরমান হক। আসফিয়ার কানে তার বিষণ্ন কণ্ঠস্বর ঢোকে। গলগলিয়ে ঢোকে। বিষণ্নতার অনুভব ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছু চিন্তা করতে পারছে না আরমান হক। তাহলে কি সামনে ভয়াবহ দুঃসংবাদ আছে? দুকান ভরে শুনে জীবন উজাড় করে ফেলবে। আর কখনো ফিরে আসবে না সুসংবাদ? আসফিয়ার ভেতর তড়বরিয়ে ওঠে।

আসফিয়া মৃদুস্বরে বলে, তোমাকে চা দেব? আরমান হক মুখ ফেরায় না। বাম দিকের ঘাড়ের ওপর মাথা কাত করে রেখেছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই তার কাছ থেকে।

আসফিয়া আবার বলে, তোমাকে চা দেব? আজ তো চা-ও খাওনি। চা না খেলে তোমার মাথা ধরে।

আরমান হক মাথা সোজা করে। আগের মতো ঠিকই বিষণ্ন স্বরে বলে, অমিয়র মা, তুমি আমাকে আর কোনো দিন চা দিয়ো না। আমি ঠিক করেছি চা আর খাব না। কারণ চা না খেলে আমার মাথা আর ধরবে না। মাথা ধরা স্থায়ী হয়ে গেল আজ থেকে।

—অমিয় এসে যদি বলে, চলো আমার মেসে তোমাদের চা খাওয়াতে নিয়ে যাই। তখন কী বলবে?

—জানি না কী বলব। তুমি আমাকে আর প্রশ্ন করবে না অমিয়র মা।

আরমান হক অন্যদিকে মুখ ঘুরিযে রাখে। আসফিয়ার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে চায়। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে। যে স্মৃতি উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে, তেমন স্মৃতি ওকে পেয়ে বসেছে। কিন্তু কোথাও আনন্দ নেই। এই শব্দটি ওর সামনে এক অপরিচিত শব্দ। এর মানে আরমান হক জানে না। কখনো এই শব্দ নিয়ে ভেবেছিল কি না তাও মনে আসছে না। কেন এমন লাগছে? দুঃসংবাদ পেতে হবে—এমনই কি এই মুহূর্তের সত্য? আড়াল করা যাবে না এই সত্যকে। স্মৃতি স্মরণ করে ছেলের না থাকার সময়কে মনে করতে হবে। মাত্র দুই মাস আগে ও পিলখানায় বদলি হয়েছে। এর আগে পোস্টিং ছিল ক্যান্টনমেন্টে। আরমান হক আর আসফিয়া খাতুন একদিন পিলখানায় গিয়েছিল। অমিয় নিজেই হাসতে হাসতে বলেছিল, কোথায় আছি দেখবে না? চলো আমার মেস থেকে চা খেয়ে আসবে।

ছেলের সঙ্গে পিলখানায় বেড়াতে গিয়েছিল দুজন। চা খেয়ে অনেকক্ষণ দুজনে গাছপালার ছায়াস্নিগ্ধ, ফুলশোভিত চারদিকে ঘুরে বেরিয়েছিল। অমিয়র আরো দু-চারজন সহকর্মীও ছিল তাদের সঙ্গে। সেদিনের মনোরম সময় এখন স্মৃতি। কিছুদিন আগের স্মৃতি। দুজনের একই চিন্তা হয় যে পিলখানায় দেখে আসা মনোরম পরিবেশ এখন মৃত্যুর কালো ছায়ায় ভরে গেছে। সূর্যের আলো ঢুকতে পারছে না।

আকাশ থেকে আলো ছড়ানোর জন্য সূর্য এখন লজ্জিত। লজ্জায় মুখ ঢেকে রেখেছে। পিলখানার কালো ছায়া কখন সরে যাবে, সূর্য তা জানে না। শুধু এটুকু জানে যে মরতে তো হবেই। মানুষের হাতেই মানুষের নিয়তি বদলায়। এমন ভাবনা দুজনকে ঘায়েল করে রাখে; তার পরও আরমান বলে, পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেলে আমরা পিলখানায় যাব।

—কী দেখতে যাবে? রক্ত? পোড়া গন্ধ, নাকি মৃত মানুষ?

—আহ আসফিয়া, এভাবে বলবে না।

—ওরা যাদের মেরে ফেলল তাদের লাশের কী হবে?

ভেতরে কি কবরস্থান আছে?

—আমার জানামতে নেই।

—তাহলে কী হবে লাশের? গর্ত করে পুঁতে ফেলবে, নাকি পুড়িয়ে ফেলবে?

—এসব কথা আমরা ভাবব না।

স্তব্ধ হয়ে যায় আরমান হক। হাঁটুতে মুখ গোঁজে। আসফিয়া বুঝে যায় যে এখন আর কথা বলবে না। আসলে ওরা দুজনেই অমিয়র জন্য বড় কোনো ভাবনা মনে আনতে পারছে না। ঘুরেফিরে অন্ধকারই ঢেকে ফেলে বাকিটুকু। ওরা নিজেদের এর বাইরে নিতে পারছে না। আসফিয়া আঁচলে চোখ মুছে আরমানের পাশে এসে বসে। মনে হয় রান্না করে কী হবে, খাবে কে?

তখন আলপনা আর মহুয়া ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়।

—মা-বাবা, টেলিভিশনে দেখাচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর প্রতিমন্ত্রী পিলখানায় গেছেন। প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য। এ কথা বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে।

—এর উত্তরে বিদ্রোহীরা কিছু বলেছে?

—বিকেলে বিদ্রোহীরা কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে যাবে। বৈঠকে বসবে।

—নিঃসন্দেহে এটা একটি খবর।

—খবর দিয়ে আর কী হবে, সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়েছে!

—ওরা যাতে আর বেশি কিছু করতে না পারে, তা তো বন্ধ হলো!

—মাগো, গোলাগুলি তো বন্ধ হয়েছে।

আলপনা মায়ের কাছে এসে বসে। মহুয়াও আলপনার পেছনে মেঝেতে বসে পড়ে। ওর মুখে কথা নেই। চাঞ্চল্য নেই। পিলখানা নীরব হলে ওর কিছু এসে-যায় না, যতক্ষণ না অমিয় ফোন করে বলবে, মহুয়া, ভেবো না। আমি ঠিক আছি। চারপাশের রক্তের স্রোতে আমাকে ডুবে যেতে হয়নি। তুমি আমাকে ভালোবাসার গান শোনাও মহুয়া।

ভালোবাসার গান? কোনটা গাইব?

আলপনা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার কী হয়েছে মহুয়া আপু? শরীরে ঝাঁকুনি পেলাম।

মহুয়া কথা বলে না। বোঝে, এখন কথা বলার সময় না। কি-ই বা কথা বলবে? মৃত্যুর মুখোমুখি মানুষ কি কথা বলতে পারে? হূদয় নিংড়ে বেরিয়ে আসা কথা?

—বুঝেছি তুমি কথা বলবে না। মাকে বলি, তোমার বিয়ের শাড়িটা আমি পছন্দ করব? তোমার পছন্দের রং আমার জানা আছে।

আলপনার কথা শুনে আসফিয়া মৃদুস্বরে বলে, মহুয়ার বিয়ের শাড়ি মহুয়াই পছন্দ করবে। তোকে আমি পছন্দ করতে দেব না।

—তাহলে আমি ওর হানিমুনে পরে যাওয়ার শাড়ি পছন্দ করব। এটা হবে তো মা?

—এটাও হবে না। যে পরবে পছন্দটা সেই করবে।

—তুমি আমার কথা মানছ না কেন মা?

—তোমার বিয়ের শাড়ি তো তুমিই পছন্দ করবে মা। তোমার বেলায় যদি তোমার কথা মানি, তাহলে মহুয়া পছন্দ করবে তা মানব না কেন?

—হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। ঠিক আছে মহুয়া আপুর সঙ্গে আমিও যাব দোকানে।

—হ্যাঁ, তা যাবে। ওকে সঙ্গ দেবে। কিন্তু ওর পছন্দের ওপর জোর খাটাবে না।

আরমান হক মৃদু ধমকের স্বরে বলে, এসব কথা আলোচনা করার কি সময় এটা?

—বাবা, এখন কোনো সময়ই আমাদের না। আমরা বিয়ের কথা আলোচনা করি বা না করি তাতে কিছু এসে-যাবে না। আমি আর মহুয়া আপু নিজেদের এই সময় থেকে দূরে নিয়ে যেতে চাই। আমরা যদি পিলখানার ভেতরে যেতে পারতাম, কী ঘটেছে তা নিজেদের চোখে দেখতে পারতাম, তাহলে বলতাম আমরা এই সময়ের সাক্ষী। আমরা কী ঘটেছে, তার সব কিছু জানি। কেন ঘটেছে তার সব কিছু জানি। পিলখানার সবাই আমাদের কাছের মানুষ। আমরা বিদ্রোহীদের প্রতিবাদ বুঝতে পারতাম। প্রতিবাদের জন্য নৃশংস হতে হবে কেন, তাও আঁচ করতাম। আমরা সময়কে নিজেদের করে নিতে পারতাম বাবা। কিন্তু আমরা বুঝে গেছি এই সময়কে আমরা নিজেদের করে নিতে পারছি না। সময় আমাদের বিপরীত অবস্থানে আছে। বাবা, আমরা এই সময়ে শুধু একজন মানুষের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। তার খবর আমাদের জীবনের সবটুকু। সে তোমাদের ছেলে, আমার ভাই, মহুয়া আপুর প্রেমিক।

চলবে

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
মিতা- র আরো পোষ্ট দেখুন