কেয়া আমি এবং জার্মান মেজর

আমি তখন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করছিলাম। হঠাৎ ক্রিং ক্রিং শব্দে টেলিফোন বাজল। শব্দটা যেন সন্ধ্যার ধূপের ধোঁয়া। কিছুক্ষণের জন্য আচ্ছন্ন করল আমার চোখে দেখার এবং চিন্তা করার ক্ষমতা। এই পনেরো দিন যন্ত্রটা ছিল মৃত। রিসিভার তুলেও কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যেত না। হঠাৎ সেই মৃত যন্ত্রটা (না জন্তুটা) পুনর্জীবন পেতেই অদৃশ্য প্রেতের মতো মনে হলো শব্দটাকে। ধোঁয়া থেকে যেন শরীর ধারণ করছে। একটা হিম হিম ভৌতিক পরিবেশ ঘরটায়। উত্তরের জানালাটা খোলা। লাইটপোস্টের সঙ্গে একটা ফেস্টুন তখনও ঝুলছে। এপ্রিলের বাতাসে এখনো শীতের ছোঁয়া। হঠাৎ মেঘ গর্জালো। মুনসুনও বুঝি এবার আগেই শুরু হবে।
টেলিফোন তখনো বাজছে। মেঘের শব্দে দেখার এবং চিন্তা করার ক্ষমতাটা ফিরে এলো। কেয়া বাইরের ঘরে আলো জ্বালতে দেবে না। শাড়ির খসখসানি শুনে বুঝলাম কাছেই আছে। মাথার চুলে সুগন্ধী তেলের ঘ্রাণ। এক মাস আগে ওর এক বান্ধবী কলকাতা থেকে ফিরে এসে উপহার দিয়েছিল। আজ পনের দিন পরে চুল ধুয়েছে কেয়া। মাথায় তেল মেখেছে। অন্ধকারেও মনে হলো ওকে এখন কিছুটা স্বাভাবিক ও সহনীয় দেখাচ্ছে।
‘রিসিভার তুলে আগেই সাড়া দিয়ো না। দ্যাখো কে ডাকছে? ফ্রেন্ড অর ফো।’ ও বলল।
অনেকটা ভূতে পাওয়ার মতোই এগিয়ে গেলাম। এমন হয় না আমার। টেলিফোন বাজলেই ছুটে যাওয়া আমার অভ্যেস। এই নিয়ে কেয়ার সঙ্গে আমার প্রতিযোগিতা। কে আগে টেলিফোন ছোঁবে। এ যেন অনেকটা বুড়ি ছুঁয়ে কানামাছি খেলার মতো। খেলায় কেয়াই জিতত। কেয়ার শরীর স্লিম। দুটো বাচ্চা হওয়ার পর মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে। তবুও মেদ জমেনি শরীরে। ক্ষিপ্রতায় হরিণী না হোক খরগোশ তো বটেই। সেই তুলনায় আমি একটু মুটিয়ে গেছি। বেশ নাতিপোয়া ভুঁড়িটা পাঞ্জাবির উপরেও দৃশ্যমান। কেয়া মাঝেমধ্যে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দেয়। আবার এ কথাও বলে, ‘এবার ওটাকে সামলাও। হাঁটো, না হয় ডায়েট করো। নইলে আর কিছুদিন পর আমার অ্যাডভানসড স্টেজের অবস্থা হবে।’ উপমাটার শ্লীলতাবোধ নিয়ে অনেক দিন তর্ক করেছি। এখন করি না। করার প্রয়োজন নেই। দিন দুই আগে কেয়া হঠাৎ সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছে আমার নাতিপোয়া ভুঁড়িটা অপস্রিয়মাণ। জামার অগ্রভাগ-যা এই কিছুদিন আগেও পেটের ওপর ফুরফুর করছিল নৌকার মাস্তুলে বাঁধা কাপড়ের মতো, এখন সেটাও পেটের সঙ্গে বেশ শান্ত হয়ে লেপটে আছে। ডায়েট নয়, হাঁটাহাঁটি নয়, কেবল উদ্বেগ-পনেরো দিনের নিদারুণ উদ্বেগেই শরীরের ফ্যাট সব শুকিয়ে গেছে। এখন আমি অনেকটা কৃশতনু কেয়ার মতোই। এই দুর্বিষহ মুহূর্তে এটাই একমাত্র সহনীয় চিন্তা মনে হয়।
রিসিভার তুলে মাউথ পিসের ওপর হাত চাপা দিলাম। রুদ্ধ নিঃশ্বাস দাঁড়িয়ে অপর প্রান্তের গলা শোনার অপেক্ষা করলাম।
মনে হলো ঝড় বইছে। অথবা টেলিফোন নামক সেই মৃত জন্তুটাই পুনর্জীবন পেয়ে হাঁপাচ্ছে। বাইরে একটা কর্কশ বোমা ফাটার শব্দ হলো। কেয়া চকিতে আমার জামার খুঁট ধরে টান দিল, ‘রিসিভারটা রাখো।’ বললাম, ‘কোনো মিলিটারি ট্রাক। ব্যাক ফায়ারের শব্দ। ভয় পেয়ো না_’ কেয়া বলল, ‘তা হোক’ সে আমার ঘনিষ্ঠ হলো আরো। বললাম, ‘ভয় পেয়েছো, আলোটা জ্বালব?’
‘না, না।’ একটা শব্দের নহর বয়ে গেল আমার শরীরে। অন্ধকারেই মনে হলো সে বুকের আরো কাছে সেঁধিয়ে এসেছে। আমার বাঁ হাতের মুঠোয় যেন বন্দুকের বাঁট। ডান হাতের আড়ালে আহত হরিণী। ঢাকা থেকে একবার খুলনা হয়ে সুন্দরবনে গিয়েছিলাম হরিণ শিকারে। মনে পড়ল সেই কথা। সেই মানুষখেকো বাঘের দেশে যে ভয় পাইনি, তার চেয়েও বেশি ভয়ে এখন কাঁপছি মধ্য ঢাকার এক ফ্ল্যাট বাড়ির ড্রয়িংরুমে টেলিফোনের রিসিভার হাতে।
সেই ঝড়ের শব্দটা থেমে গেল। থেমে গেল সেই অস্পষ্ট যান্ত্রিক গোঙানি। ঝড়ের পরে শান্ত হওয়া, স্নিগ্ধ সুরভিত হাওয়া। সেই ঘ্রাণের স্বাদে ইন্দ্রিয় লোভী হয়ে ওঠে। ভয়ের শিহর থেকে জীবনের শিহরণ। তার আগেই কেয়ার তেলমাখা মাথাটা আমার বুকের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরে গেল। কেয়া সরে গিয়ে চেয়ারের হাতলের ওপর হাত রাখে। অন্ধকারে অনৈসর্গিক হয়ে উঠল ওর শরীর। টেলিফোনের অদর্শন কণ্ঠের মতো গলা, ‘বুঝতে পারছো কে কথা বলছে?’
কেউ কথা বলেনি। আমি রিসিভারটা নামিয়ে রাখতে গেলাম।
‘তাহলে টেলিফোনটা বাজল কেন?’ কেয়ার গলায় আবার ভয়ের শিহর।
‘হয়তো বন্ধুবান্ধবদের কেউ খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করছে।’ আমি থেমে থেমে বলি। যেন চোখের সামনে থেকে অন্ধকার তাড়িয়ে বলছি। অন্ধকার তো মশা নয়, মাছি নয় যে তাড়ালেই যাবে। যতই প্রখর হোক না চোখের দৃষ্টি, অন্ধকার যেন আরো বেশি প্রাখর্য নিয়ে চোখের সামনে কালো পর্দার দেয়াল তুলে দাঁড়ায়। কেয়ার কণ্ঠ সেই নিরেট দেয়ালেই যেন বারবার আঘাত করে। সারা ঘরে তার প্রতিধ্বনি রমরম করে।
‘একটু আস্তে কথা বলো।’ আমি বলি।
‘আমি তো ফিসফিসিয়ে কথা বলছি!’ কেয়া চেয়ার ছেড়ে কাছে এগোয়।
‘টেলিফোন লাইন ওরা রেসটোর করেছে মনে হয়। এদ্দিন পরে এখন বাজল তাই ভয় হচ্ছে।’
‘ভয়টা কিসের?’
‘ওটা ট্রাপ করার নতুন ফাঁদ হতে পারে। জাসট দেখছে আমরা কারা বাসার ভেতরে রয়েছি। ওই যে তুমি ফোনের রিসিভার তুললে, তাতেই ওরা ধরে নেবে বাসার ভেতরে কেউ না কেউ রয়েছে। লেক সার্কাসে আমাদেরই মতো কয় ঘর ফ্যামিলি বাইরে দরজায় তালা ঝুলিয়ে ঘর অন্ধকার রেখে রাত কাটাচ্ছিল। ফোন বাজতে রিসিভার তুলতেই ধরা পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা মিলিটারি লরি এসে দাঁড়িয়ে ছিল বাড়ির সামনে।
‘তারপর?’ কেয়ার গলা নয়, আমার গলাই এবার কেঁপে উঠল।
‘ওরা কাউকে মারেনি। কাউকে কিছু বলেনি। লরিতে একজন মেজর ছিল সে কেবল সোনিয়াকে নিয়ে গেছে।’
‘সোনিয়াকে। হায় আল্লাহ!’ আমি টেলিফোনের সাদা ধাতব যন্ত্রটার ওপর ভর করে শরীরের ব্যালান্স ঠিক রাখার চেষ্টা করি। কেয়ার মুখটা দেখা যায় না। কেয়া এখন অপার্থিব, অলৌকিক জগৎ থেকে যেন টেলিফোনে কথা বলছে। ওর গলায় সেই ভয়ের শিহর থির থির কাঁপছে শরীরে। ওর ভয় নেই। অন্ধকার ওর ভয়কে আবৃত করে রেখেছে।
সোনিয়াকে আমি চিনি। লেক সার্কাসের মেয়ে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েটের ছাত্রী। কেয়াই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। লেক সার্কাসের কামেলা আপার মেয়ে। সয়েল সায়েন্সে ডিগ্রি নিয়েছে। সামনের বছর স্টেটসে যাবে গবেষণার জন্য। তা ছাড়া …
আমার কনুইয়ে আলতো করে একটা চিমটি কেটেছিল কেয়া, ‘ওর হবু স্বামী জুট টেকনোলজিস্ট ডান্ডিতে আছে। কলেজে সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে ভালোবাসা। মাগো কি লম্বা চিঠি লেখে সেই পাটবিশেষজ্ঞ। তুমি দেখলেও হাসবে।’
সোনিয়া তার রং করা ঠোঁট ফাঁক করে সাদা মার্বেলের মতো ঝকঝকে দাঁতে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে বলেছিল, ‘মাঝে মাঝে আমিও বড় বেশি বোর ফিল করি।’
‘সেই সোনিয়া! সেই সোনিয়া গেল মেজরের সঙ্গে?’
‘কী করবে ও? কী করতে পারত ও?’ কেয়ার গলা এবার তীক্ষ্ন, অথচ উত্তেজনা নেই। ‘ধরো এখনই যদি ওদের কেউ এসে তোমার বুকে বন্দুক ধরে আমাকে ওদের টার্ম শোনায়। কী করতে পারি আমি?’
‘কী করতে পারি মানে?’ আমার গলা এবার টাইম বোমার মতো বিস্ফোরিত হলো। বিস্ফোরিত হয়েই থেমে গেল। আমার কথাগুলোই যেন টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ভাঙা কাচের মতো নিমিষে চূর্ণ হয়ে গেল। অনুরেণু হয়ে ধুলোয় মিশে গেল। আমার আর বলার কথা_ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়ার মতো কিছু রইল না।
অন্ধকারে কেয়ার শ্বাসপতনের শব্দ শুনলাম। চেয়ারটার ওপর গুটিয়ে বসেছে সে। নীল বুটিতোলা সবুজ পাড়ের সাদা শাড়ি তার পরনে। কুয়াশার ভোরে নদীর পারে চোখ ফেরালে যেমন দেখায়_আলো নয় অথচ অন্ধকারও নয়, ধূসরও নয়, একটা অস্পষ্ট প্রতিভাস। কেয়ার শাড়ি ঘরের অন্ধকারে সেই প্রতিভাস। আমি সেই প্রতিভাস লক্ষ করে এবার সহজ গলায় বললাম, ‘সোনিয়া আর বাড়ি ফেরেনি?’
‘ফিরেছে। রোজ সকালে ফিরে আসে। মিলিটারি জিপে। বাবাকে বলেছে, ওর বড় ভাইয়ের আর ভয় নেই। ওর বড় ভাই পলিটিঙ্ করত। এখন ফেরার। মেজর আশ্বাস দিয়েছে, ধরা পড়লে অ্যারেস্ট করবে। মারবে না।’
‘পাড়ার বাসিন্দারা কিভাবে নিয়েছে ব্যাপারটা?’
‘সহজভাবে। সহজভাবে নিতে তারা বাধ্য। কী করতে পারে ওরা? তাদের কারো ঘরে ব্যাপারটা ঘটতে পারত। ঘটেনি এ জন্য সোনিয়ার কাছে তারা কৃতজ্ঞ। ওরা জানে, সোনিয়া রোজ সন্ধ্যায় চলে যায়, সকালে ফিরে আসে।’
কোথাও মেঘ গর্জাল। মেঘ অথবা মর্টার দুয়ের শব্দই হতে পারে। কেয়া চট করে চেয়ার ছেড়ে পাশে এসে দাঁড়াল। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ওরা কোথাও গোলা ছুড়ল!’
‘গোলা ছুড়বে কেন?’
‘মানুষ মারার জন্য।’
মৃত্যু এত সহজ হয়ে উঠবে আমাদের জীবনে কোনো দিন ভাবিনি। কেয়ার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নিলাম। মৃত্যুকে পরাস্ত করে বেঁচে ওঠার প্রয়াসের মতো এই স্পর্শ। কেয়ার হাত নরম এবং ঠাণ্ডা। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমি ভাবছি সোনিয়ার কথা। আচ্ছা, ওরা যদি আমাকে সোনিয়ার মতো ধরে নিয়ে যায়, নেওয়াটা যেখানে এমন বেশি কিছু নয়, তাহলে তুমি কী করবে?’
‘আমি?’ প্রশ্নে আকস্মিকতায় আমি বিব্রত। মেয়েরা বিব্রত মুহূর্তে এমন বিভ্রান্ত করে দিতে পারে প্রশ্নের আঘাতে, আমি ভাবি।
কেয়া বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি। বাচ্চা দুটোর জন্য এখন ভাবি না। এটা আল্লার মেহেরবানি, ওরা গণ্ডগোল শুরু হওয়ার আগেই গ্রামে নানির কাছে চলে গেছে। ওদের নিয়ে আপাতত আমি ভাবি না; কিন্তু নিজেকে নিয়ে ভাবি। কাল রাতেই নাকি দুটো ট্যাঙ্ক এসে ঘুরে গেছে এ পাড়ায়। উপরের ফ্ল্যাটের খালেক সাহেব তাঁর ফ্যামিলি পাঠিয়েছেন গ্রামে। পাড়া বলতে গেলে খালি হয়ে গেছে। তুমি তো নড়তে চাও না এবং আমিও না। কোনো কোনো গ্রামে এর চেয়েও অঘটন ঘটেছে। ধরো, সোনিয়ার মতো অঘটন যদি আমার জীবনেও ঘটে? কী করবে তুমি?’
জবাব নেই এ কথার। আর থাকলেও এই মুহূর্তে আমার জানা নেই। আমার হাতের মুঠো শিথিল হলো। শিথিল মুঠো থেকে কেয়ার হাতটা ঝরে পড়তে চাইল। অন্ধকার অসহ্য মনে হলো। বললাম, ‘কেয়া, এক সেকেন্ডের জন্য হলেও আলোটা একটু জ্বালাবে।’
‘বেশ, সুইচটা অন করে দাও।’ ঠাণ্ডা ভিজেভিজে গলা কেয়ার।
কিন্তু সুইচটা অন করতে হলো না। তার আগেই টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল।
‘খবরদার, ওটাকে ছুঁয়ো না।’ কেয়ার গলা বড় ক্রূর মনে হলো আমার কাছে। দু’পা পিছিয়ে গেলাম। টেলিফোন বেজে চলেছে। স্বৈরিণী শব্দ যদি এখন শরীরিণী হয়ে উঠতে পারত, তাহলে, কেয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঝগড়া করত, কেন, তুমি আমায় ছুঁতে দিচ্ছ না? কেয়াও আমার কাছে এখন শব্দ। অন্ধকারে তার শরীর দেখা যায় না। একদিকে কেয়ার কণ্ঠে নিষেধ। অন্যদিকে টেলিফোনের ধাতব কণ্ঠে আমন্ত্রণ। কিছুক্ষণ ভেবে দ্বিধা জয় করলাম। কেয়ার কথা-ই রইল। টেলিফোনটা বেজে ক্লান্ত হয়ে থামল। বললাম, ‘কেয়া, এবার ভেতরে আলো জ্বেলে খেতে দাও। রেডিওটা লো ভলিউমে অন করবে নাকি?’
‘না। হুক্কামে মার্শাল ল’ শোনার ইচ্ছে আমার নেই। আমি ভেতরে যাচ্ছি।’
এবার দরজায় মৃদু অথচ স্পষ্ট টোকা। থেমে থেমে একবার দু’বার তিনবার। আমরা নিশ্চয়ই পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়েছি। আমি আর কেয়া; কিন্তু অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখলাম না।
আবার টোকা। আরো স্পষ্ট। আমি দরজার দিকে এগোলাম। কেয়া ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমি ও ঘরে যাচ্ছি। তুমি নাম জিজ্ঞেস করো।’
দরজার হাতলে হাত রেখে বললাম, ‘কে?’ আমার গলা কেঁপে গেল। এবার ভারী গলার উর্দু কথা এবং ভারী বুট পরা পায়ের শব্দ আশঙ্কা করলাম। তার বদলে আমারই কম্পিত গলার সাড়া পাওয়া গেল, ‘সুলেমান সাহেব ঘরে আছেন?’
‘কে?’
‘আমি উপরের ফ্ল্যাটের রহমান। হবস অ্যান্ড রব কম্পানির ম্যানেজার।’ আমি ঝটিতি দরজা খুলে দিলাম, ‘আরে আসুন আসুন রহমান সাহেব। আলো জ্বালা বারণ, মার্শাল ল অথরিটির নয়, স্ত্রীর। কমপ্লিট ব্ল্যাক-আউট।’
রহমান বললেন, ‘আমারও তাই; কিন্তু এইমাত্র একটা মিলিটারি লরি কী অর্ডার প্রচার করে গেল জানেন?’
কেয়া কখন ফের ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে জানি না। সেই বলল, ‘কী অর্ডার বলুন তো? আমরা নিচের তলায় থাকি। অনেক সময় মাইকের ঘোষণাও শুনি না।’
রহমান অন্ধকারেই হাতড়ে একটা চেয়ার টেনে নিলেন। বললেন, ‘ঘরে আলো নেভানো চলবে না। রেডিও রেকর্ড প্লেয়ার বাজাতে হবে; অর্থাৎ কমপ্লিট নরম্যালসি দেখাতে হবে।’
কেয়া বলল, ‘যদি হুকুম মানা না হয়।’
রহমান বললেন, ‘মিলিটারির হুকুমে যদি বলে কিছু নেই। হিটলার প্যারিস দখল করার পর যা করেছেন, ইয়াহিয়াও তাই করতে চান ঢাকা দখলের পর।’
‘হিটলার কী করেছেন প্যারিসে?’ কেয়ার গলাটা কেঁপে উঠল, আমার মনে হলো।
রহমান সশব্দে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি ধরালেন। বললেন, ‘এঙ্কিউজ মি ম্যাডাম, আপনার অনুমতি সাপেক্ষে একটা সিগারেট ধরাচ্ছি। গলাটা অনেকক্ষণ যাবৎ খড়খড়ে হয়ে আছে।’
অনেকক্ষণ পর নিবু নিবু আলোয় দেখলাম কেয়াকে। আলোয় উদ্ভাসিত কেয়ার পাথুরে স্ট্যাচু যেন। শীর্ণ চোয়াল। চোখ জ্বলছে। শীতের নদীর দূর থেকে বাঁক ঘোরার আলোর সংকেত যেমন দেখায়, তেমনি দেখাচ্ছে কেয়ার দু’চোখের মণি। শাড়ির নীল বুটি আর সবুজ পাড় এখন এক। কেয়া বলল, ‘আপনারা ভেতরে বেডরুমে বসে গল্প করুন। আমি দু’কাপ চা করে দিচ্ছি।’ রহমান বললেন, ‘আমি চা খেতে আসিনি। নতুন মার্শাল ল অর্ডার শুনে ভাবলাম, আপনারা কী ভাবছেন শুনি? বার দুই টেলিফোনে ডাকলাম, সাড়া পেলাম না। আমার টেলিফোনটা আজই রেসটোর করে দিয়েছে। আপনার দেয়নি?’
সত্য কথাই বললাম, ‘দিয়েছে; কিন্তু কল রিসিভ করছি না। কেয়া লেক সার্কাসের যে কাহিনী শোনাল, তাতে টেলিফোন বাজলেও রিসিভার তোলার ভরসা পাই না।’
রহমান বললেন, ‘লেক সার্কাসের কাহিনী তাহলে আপনারাও শুনেছেন। ওটা আমার স্ত্রীর ভাই_মানে মেজো শ্যালক বহন করে এনেছে। ও লেক সার্কাসে থাকত কি না!’
কেয়ার দিকে তাকিয়ে রহমান বললেন, ‘আপনি আবার শুনেছেন আপনার স্ত্রীর কাছে তাই না?’
ছোট্ট দম দেওয়া পুতুলের মতো কেয়া মাথা নাড়ল। রহমানের হাতে দিয়াশলাইয়ের কাঠিটা নিভে গেল। অন্ধকারে আমরা তিনজনই মুছে গেলাম। আমার সেই ছেলেবেলার শ্লেটে লিখে লিখে মুছে ফেলার খেলার কথা মনে পড়ল। কালো শ্লেটে পেনসিলের দাগ বোলালেই সাদা সাদা লেখা। মুছে ফেললেই আবার কালো শ্লেট। আমরা যেন এতক্ষণ ছিলাম অন্ধকারের কালো শ্লেটে তিনটে সাদা দাগ। এইমাত্র কেউ আমাদের মুছে ফেলল। পেনসিলের মতো কালো সুইচ টিপলেই আমরা আবার ফুটে উঠব।
কেয়া এবার সত্যি সত্যি সুইচ টিপল। উত্তরের জানালাটা বন্ধ করে দিল। উদ্ভাসিত আলোয় আমরা অনেক দূর থেকে পরস্পরের যেন অনেক কাছাকাছি এলাম। রহমান বললেন, ‘আলোটা জ্বেলে ভালোই হলো। না জ্বেলেও বাঁচোয়া নেই। ওদের মেথড বড় ক্রুয়েল। এই যে বেঁচে আছি এটাই বিস্ময়, বেঁচে না থাকাটা নয়।’
দূরের কোথাও টা-টা-টা শব্দ হলো। আমি আড় চোখে কেয়ার দিকে তাকালাম। সেই সাদা মার্বেলের মতো চোখ। কেয়া যেন অনেকক্ষণ আগে প্রস্তুরীভূতা হয়ে গেছে। রহমান কেয়ার উপস্থিতি গায়ে মাখলেন না। বললেন, ‘আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, এলএমজির শব্দ। চায়নিজ মেড এলএমজি। ভেরি পাওয়ারফুল। মিনিটে নাকি দুই শ লোক মারতে পারে।’
‘নিরস্ত্র লোক মেরে কী লাভ?’ আমি বলার কিছু না পেয়ে বোকার মতো বলে ফেললাম।
‘নাপাম বোমা দিয়ে বস্তি পুড়িয়ে লাভ?’ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন রহমান। জিজ্ঞেস করুনগে নিঙ্ন অথবা চেয়ারম্যান মাওকে। কী জন্য ওঁরা পাকিস্তানকে অস্ত্র দিচ্ছেন? আমার তো ইচ্ছে হয় পারলে চেয়ারম্যানকে ডেকে নিয়ে আসি ঢাকায়। সদরঘাট আর শাঁখারীপট্টির মৃতদেহগুলো দেখাই; বলি, কমরেড, এগুলো কি বুর্জোয়া পার পাতি বুর্জোয়ার মৃতদেহ, না বাংলাদেশের গরিব রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, বস্তির ভিখিরিদের মৃতদেহ? কাদের মারছে ইয়াহিয়া কমিউনিস্ট অস্ত্রে?’
এবার সত্যি সত্যি মেঘ গর্জাল। বিদ্যুৎ চমকাল আকাশে। দরজার কপাটের ফাঁকে আলোর রেখার চমক খেলে গেল। বললাম, ‘আজ বৃষ্টি হবে।’
রহমান বললেন, ‘হোকগে।’ তাতে সমস্যার সমাধান নেই। আমি এলাম পরামর্শ করতে। কী ঠিক করলেন? রাতে নিচেই থাকবেন, না উপরে আমাদের ফ্ল্যাটে আসবেন?
‘উপরে গিয়ে লাভ?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘লাভ কিছু নেই। সান্ত্বনা।’ রহমান হাসলেন, ‘ওই মার্শাল ল অর্ডার শুনে আমার স্ত্রী বললেন, ওদের গিয়ে জিজ্ঞেস করো, ওরা উপরে আসতে চান, না আমরা নিচে যাব? একসঙ্গে থাকলে ভয়টা অন্তত কমে।’
এতক্ষণে কেয়া মুখ খুলল। এই প্রশ্নের জবাব দেওয়াটা ওর জুরিসডিকশনের মধ্যে। বলল, ‘আপনারাই বরং আসুন। বাচ্চাদের বেডরুমটা ছেড়ে দেব। অসুবিধা নেই। এটাচড বাথ আছে। তা ছাড়া সুবিধার দিকটা ভেবে দেখুন …’
হঠাৎ থেমে গেল কেয়া। তার মুখের ভাব দেখে আমার মনে হলো একটা সচল ছবি যেন হঠাৎ স্থির ছবি হয়ে গেল। রহমান তার শেষের কথাটা ধরলেন, ‘হ্যাঁ, সুবিধার দিকটা বলুন।’
কেয়া আমার দিকে তাকাল। বলবে কি বলবে না এই প্রশ্ন তার চোখে। দ্বিধা জয় করে বলল, ‘আমরা আজকাল পেছনের প্যাসেজের গেট খোলা রেখে ঘুমুই। কারফিউর রাত। চোর-ডাকাতের ভয় নেই।’
‘তারপর?’ রহমান সাগ্রহে ঝুঁকে বসলেন।
‘ধরুন রাত্রে যদি সামনের দরজায় টোকা পড়ে …’ কেয়ার কথা এবার সত্যি সত্যি জড়িয়ে গেল।
‘দরজায় টোকা পড়বে?’ রহমান বিচলিত হলেন। কথাটা বুঝতে পারলেন না। কেয়া কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিল, ‘বলছিলাম, সোনিয়াদের বাড়ির মতো ঘটনা তো এখন ঢাকার পাড়ায় পাড়ায় ঘটছে। তাই পেছনের প্যাসেজের দরজা খোলা রেখে ঘুমুই। ওরা যদি আসেই সামনের গেট দিয়ে আসবে। পেছনের সরু গলি পথে নিশ্চয়ই আসবে না। কোনো বিপদের আশঙ্কা কিছু দেখলে পেছনের গলিপথে পালাতে পারব। উপরের ফ্ল্যাটে থাকলে তা হবে না।’
রহমান গম্ভীর হলেন, বললেন, ‘প্ল্যানটা ভালো; কিন্তু কথা হচ্ছে কি জানেন, ওদের অপারেশন বড় ক্রুয়েল। ওরা ঠিক আপনার ঘরের দরজায় এসে নক করবে না।’
‘সোনিয়াদের বাড়িতে কিন্তু ওরা তা-ই করেছিল।’ কেয়া বলল।
রহমান বললেন, ‘আপনার কথা সত্যি; কিন্তু সবটা নয়। সোনিয়াদের বাড়ির দরজায় নক করার আগে ওরা গোটা পাড়া এনসারকেল করে ফেলেছিল। ওটাই ওদের মেথড। তারপর অপারেশন।’
‘তাহলে?’ কেয়ার চোখেমুখে এবার স্পষ্ট ভীতির আভাস।
‘তাহলে যেখানেই থাকুন মনের জোর নিয়ে থাকতে হবে। আমি মহিলাদের সামনে এসব আলোচনা সাধারণত করি না। আপনাদের নার্ভের খবর আমার জানা আছে। তবু এখন করি। নিজের স্ত্রীর সঙ্গেও খোলাখুলি আলোচনা করি। রিয়ালিটি ইজ রিয়ালিটি। এখন বাস্তবকে স্বীকার করে বাঁচতে হবে প্রয়োজনে মরতে হবে। ভয় পেয়ে লাভ নেই। আপনি হিটলারের গল্প শুনতে চেয়েছিলেন না?’
কেয়া আবার দম দেওয়া পুতুলের মতো ঘাড় নাড়ল, ‘হ্যাঁ।’
‘শুনুন।’ রহমান স্ট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝাড়লেন। বাইফোকাল লেন্সের চশমাটা নাকের ডগায় ঠিক করে বসালেন। বললেন, ‘হিটলার প্যারিস দখল করলেন। ক্ষমতায় বসালেন এক বৃদ্ধ ফরাসি মার্শালকে। নাম মার্শাল পেতাঁ। ভারদুনবিজয়ী মার্শাল পেতাঁ। ওর নাম নিশ্চয়ই আপনারা জানেন। হ্যাঁ এই ফাঁকে বলে রাখছি ইয়াহিয়া যদি-পূর্ববাংলা কবজা করতে পারেন, তাহলে এখানে ক্ষমতায় বসানোর জন্য এক বুড়ো বাঙালিকে খুঁজে বের করবেন। বাঙালিদের মধ্যে তো আর মার্শাল-টার্শাল নেই। হয় রিটায়ার্ড সিভিল সারভেন্ট নয় বুড়ো হাবড়া পলিটিশিয়ান, এদের মধ্য থেকেই পাপেট গভর্নমেন্টের একজন হেড বেছে নিতে হবে।’
‘কেন, নূরুল আমিন, সবুর খাঁ তো আছেনই।’ আমি বললাম।
‘আমি সে ডিবেটে যাচ্ছি না।’ রহমান বললেন।
‘হিটলারের কথা বলুন।’ কেয়া নরম করে বলল।
রহমান আরেকটা সিগারেট ধরালেন, ‘আমি সেই কথাই বলছি। হিটলার প্যারিস দখল করলেন। সৈন্যদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো শহর। ভয়ে ছেলে-বুড়ো-মেয়ে সবাই পালাল। যারা পালাতে পারল না তারা আমাদেরই মতো ঘরের আলো নিভিয়ে দরজা-জানালার খড়খড়ি বন্ধ করে যিশুর নাম নিয়ে পড়ে রইল ঘরে। জার্মান সৈন্যরা ঢুকল দলে দলে বারে, থিয়েটারে, অপেরায়, একটি যুবতী মেয়ে নেই কোথাও। এক পানশালায় ঢুকে প্রৌঢ় জার্মান মেজর হুকুম দিলেন পাড়া সার্চ করে যত মেয়ে আছে ধরে নিয়ে এসো। আজ এখানে ডান্স হবে, পান-ভোজন ফুর্তি হবে। পাড়া সার্চ করতেই ডজন দুই মেয়ে বেরিয়ে পড়ল। তার মধ্যে দু-তিনটে আবার যুবতী এবং সুন্দরী। সারা রাত নাচল ফরাসি মেয়েরা। কেউ কেউ মদ খেল। কেউ কেউ ভিরমি খেল। হট্টগোল আর হৈ-হল্লায় কারো কারো কান্না চাপা পড়ে গেল। প্রৌঢ় মেজর সবচেয়ে সুন্দরী এবং বিদূষী মেয়েটিকে বেছে নিয়েছিলেন। শেষ রাতে স্খলিত কণ্ঠে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, সুন্দরী, তোমার অ্যাপার্টমেন্টে যাব। আপত্তি আছে? মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, না নেই। মেজর খুশি হলেন। কোমরে রিভলবার গুঁজে নিলেন। ইউনিফর্ম ঠিক করে নিলেন শরীরে। মেয়েটির কাঁধে ভর রেখে বেরিয়ে গেলেন আলোকিত নাচঘর ছেড়ে। পেছনে তখনো চলছে অশ্লীল চিৎকার হৈচৈ। মেয়েকে অত রাতে ফিরতে দেখে ফরাসি মা খুশি হলেন। বাবা বললেন, ফিরেছিস? পেছনে জার্মান মেজরকে দেখে তাঁরা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মেয়ে বলল, তোমরা ঘরে যাও। আমার জরুরি কাজ রয়েছে। কেউ আমাকে আজ ডিস্টার্ব কোরো না। বলেই সে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। মেজর ফরাসি ভাষা জানেন না, বললেন, কী বলল তোমার মা-বাবা? মেয়ে বিশুদ্ধ জার্মান ভাষায় বলল, ওরা তোমাকে দেখে খুশি হয়েছে। প্রৌঢ় মেজর আনন্দে গোঁফ চুমরে নিলেন। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মেজরের কণ্ঠলগ্না হয়ে ফরাসি মেয়ে বলল, এতক্ষণ ভারি কষ্ট পাচ্ছিলাম। তোমার ওই খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফের জন্য। কদ্দিন শেভ করো না? মেজর বললেন আজ তিন দিন। প্যারিস ফল করার পর এই তিন দিন তো তোমাদের নিয়েই মেতে আছি। শেভ করব কখন? মেয়েটি মেজরের বুকে আরো সেঁধিয়ে গিয়ে আহ্লাদি গলায় বলল, ঊহু, সেটি হবে না। আমি নিজে তোমায় শেভ করিয়ে দেব। তারপর চান করে আসো বাথরুম থেকে। আমি ততক্ষণে দুটো ‘হাইবল’ রেডি করব। মেজর খুশিতে বাগ বাগ। বললেন, আমি তোমার হাতে শুধু শেভ হওয়া নয়, মরতে পারি। মেয়েটি বলল বেশ। তার বাবার ঘর থেকে রেজার, ব্লেড, সাবান নিয়ে এলো সে। সাবান ঘষল অনেকক্ষণ মেজরের গালে এবং গলায়। মেজর আবেশে চোখ মুদে রইলেন। সে চোখ তাকে আর খুলতে হলো না। সাবান মাখা গলায় ধারাল ব্লেডটা অনেকখানি ঢুকে তখন কণ্ঠনালি ছিন্ন করছে। গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ল মেঝেয়। প্রৌঢ় জার্মান মেজরের ভারী শরীরটা চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
গল্প শেষ করে রহমান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কেয়ার দিকে চেয়ে বললেন, ‘কেমন লাগল গল্পটা?’
কেয়া বলল, ‘ব্লেড দিয়ে মানুষ খুন। এটা তো গল্পই।’
‘হ্যাঁ গল্প। সেকেন্ড ওয়ারর্ল্ড ওয়ারের ওপর লেখা গল্প; কিন্তু আমাদের জীবনে এই গল্প যেকোনো সময় সত্য হয়ে উঠতে পারে।’ রহমান বললেন।
‘তা পারে।’ আমি সায় দিলাম। অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আমরা যেন অনেকক্ষণ হয় নিজেদের মধ্যে ফিরে এসেছি। অন্ধকারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম নিজেদের থেকেই। এই উপলব্ধিটা সহসা আমাকে সাহস দিল। বললাম, ‘রহমান সাহেব, সব গল্পেরই একটা শেষ কথা থাকে। এই গল্পেরও শেষ কথা আছে। আমরা যেন ভয় না পাই। আমরা শুধু মরতে পারি না। মারতেও পারি। তাই না? রহমান কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল। কেয়া এবার নিষেধ করল না। এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুললাম। হ্যালো বলে এক সেকেন্ড কথা শুনে রিসিভারটা বাড়িয়ে দিলাম রহমানের দিকে, ‘আপনার স্ত্রী। কথা বলতে চান।’
রহমান উঠে দুই মিনিট কথা বললেন। রিসিভার রেখে বললেন, ‘ব্যাড নিউজ; সোনিয়া আজ দুই দিন বাড়ি ফিরছে না।’
‘খবরটা কে দিল?’
‘আমার সেই শালা। তবে খবর এটা নয়, আরেকটা। দুটি ট্রাকবোঝাই মিলিটারি আসছে এদিকে। ওদের মুভমেন্ট রহস্যজনক। কেউ বলছে, নারায়ণগঞ্জে যাবে, কেউ বলছে, টার্গেট এদিকের কোনো পাড়াই।’ কেয়ার মুখে ভাবান্তর নেই। সে শক্ত হাতে চেয়ারটা চেপে ধরেছে দেখলাম। এখন ওই চেয়ার চেপে ধরার মধ্যেই তার মনের প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ। রহমান বললেন, ‘আমার স্ত্রী ভয় পেয়েছিল। বললেন, তোমরা কী করবে? উপরে আসবে, না নিচে যাব?’
বললাম, কেয়া, ‘কী বলছ?’
কেয়া কথা বলল না। হয়তো বলতে পারল না। তার চোয়াল শক্ত হয়ে রয়েছে! ওর মুখের সতেজ লাবণ্যটুকু শুষে যেন ঘরে বিজলির আলো জ্বলছে। রহমান কেয়ার মুখের দিকে তাকালেন। হয়তো ওকে বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘আমরাই বরং নিচে আসি। একটা বেডরুম যখন খালি রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের তো একটা বাচ্চা। অসুবিধা হবে না।’
নিজের হাতে দরজা খুলে বেরোতে যাচ্ছিলেন রহমান। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মাস দুই আগে ট্রাপ ফর সেভেন ছবিটা দেখেছি। তখনও বুঝিনি, ট্রাপ কাকে বলে! এখন এই বাড়িটা ট্রাপ ফর ফাইভ না হলেই হয়। না, না ভয় পাবেন না। যতক্ষণ বেঁচে আছি, একটু ঠাট্টা-তামাশাও করব না।’
রহমানের গলা নির্লিপ্ত আত্মগত শোকবাণীর মতো। আমার বুঝতে বাকি রইল না, রহমান ঠাট্টা করছেন না, নিজেকেই নিজে সাহস জোগাচ্ছেন।
দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়ালাম। কেয়া নেই। খাবার ঘরে পেয়ালা-পিরিচের টুংটাং আওয়াজ পেলাম। হঠাৎ মনে সাহস এলো। ওই টুংটাং আওয়াজ যেন কোনো বড় ওস্তাদের হাতে মধ্যরাতের বাজনা। দরবারি আলাপের মতো থেমে থেমে বাজছে। এখনো দ্রুতলয়ে ওঠেনি। কেয়ার যেন এই মধ্যরাতের দরবারি।
পর্দা ঠেলে। খাবার ঘরে ঢুকলাম। টুংটাং আওয়াজ থেমে গেল। কেয়া চোখ তুলে তাকাল। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘর কাঁপিয়ে, আকাশ আলোময় করে একটা ভয়াবহ শব্দ ছুটে গেল। কেয়ার শক্ত চোয়াল ধীরে ধীরে নরম হলো। দৃঢ়বন্ধ ঠোঁট ফাঁক হলো। বলল, ‘বাজ?’
বললাম, ‘সম্ভবত।’ সেই মধ্যরাতের দরবারি মূর্ছনা তখন আমার মনে নেই। স্পষ্টই দেখলাম, কেয়ার চোখে অবিশ্বাস। আমরা দুজনই দুজনের কাছ থেকে মনের ভাব লুকোচ্ছি।
সে রাত্রে আমরা খেলাম ফ্রিজে রাখা শুকনো মাংস, পাউরুটির শুকনো স্লাইস। বয়-সার্ভেন্ট পালিয়েছে। ঝিটা আসছে না সেই মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে। বেঁচে আছে কি না জানি না। কেয়া হিটারে জল চাপিয়ে দুই কাপ ওভালটিন তৈরি করল।
রহমান তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ করেছেন অনেকক্ষণ হয়। শুভরাত্রি জানানোর সময় বারবার বলেছেন, দেখবেন, তেমন বিপদের আশঙ্কা কিছু দেখলে দরজাটা টোকা দেবেন।’ ইচ্ছে হয়েছিল রহমানকে সেই পোয়াতি মেয়ের গল্পটা শুনিয়ে দিই, যে তার মাকে বলেছিল, মা, বাচ্চা বিয়োনোর সময় হলে আমাকে জাগিয়ে দিও। মা বলেছিল, আমাকে জাগাতে হবে না বাছা, তুমিই কতজনকে জাগাবে; কিন্তু কেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে গল্পটা বলিনি। অমন সুন্দর একটা ঠাট্টার লোভ সংবরণ করেছি। কেয়া কেমন ফুলে আছে। ফুঁসে আছে। কিন্তু ফুঁসছে না। আমি ঝড়ের আগে নদী দেখেছি। বৃষ্টির আগে নদী দেখেছি। তখন নদীর জল বড় শান্ত। বড় উদাস; কিন্তু কেমন যেন ফুলে ফুঁসে থাকে। ঔদাস্যের সঙ্গে ফুলে থাকাটা বেমানান। আর বেমানান বলেই আমার চোখে বাজে বেশি। নদী আর নারী। আমি এই দুয়ের কোনো অমিল দেখিনি কখনো।
বিছানায় বসতেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের চেহারা দেখলাম। খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি। রোজ এখন শেভ করি না। এমন অফুরন্ত সময় হাতে পেয়েও না। গায়ের জামা ভাঁজ নষ্ট হয়ে কুঁচকে আছে। অফিসে যাই না আজ কত দিন! তত দিন জামা বদলও হয়নি।
আয়না থেকে মুখ ফেরাতেই দেখি, কেয়া কেমন অদ্ভুত চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। তার কালো চোখের তারায় ভয়ের শিহর। অথবা সেই ফুলে ফুঁসে ওঠা ভাবটা বাড়ছে। বললাম ‘কী দেখছ?’
কেয়া হঠাৎ আমার কাছ থেকে সরে গেল। একটা বালিশ আঁকড়ে ধরল দু’হাতে। আমি তার পিঠে সস্নেহে হাত রাখলাম। সে হাতটা সরিয়ে দিল।
‘ভয় পেয়েছ?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘না।’ কেয়া আরেকটু দূরে সরে গেল। বালিশে মুখ গুঁজল, ‘আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছ’ আমার মনে হলো, কেয়া হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল।
‘ও, এই কথা।’ আমি হাসতে চাইলাম। ‘আয়না যখন ঘরেই রয়েছে তখন দেখব না কেন? কিন্তু তা নিয়ে অমন করার কী আছে?’
‘তো-মা-কে, তো-মা-কে,’ কান্নার আবেগে কেয়া থেমে থেমে বলল, ‘তোমাকে জার্মান মেজরের মতো দেখাচ্ছে।’
‘কার মতো, কার মতো দেখাচ্ছে বললে?’ আমি বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম। যেন ওই একটি কথাই দ্বিতীয়বার না শুনলে আমার বিশ্বাস হবে না যে, কেয়া বলছে।