সাড়ে তিন হাত ভূমি

প্রথম পর্ব
তুমি কি ঘুমিয়েছিলে, মা!
ফজরের নামাজ শেষ করে বাবা আর শোয় না। তোমার একটু শোয়ার অভ্যাস আছে। নামাজ শেষ করে, মিনিট পনেরো কোরআন শরিফ পড়ে তুমি আবার একটু শোও। ঘণ্টাখানেক বা মিনিট চল্লিশ-পঞ্চাশের মতো ঘুমাও।
আজও কি তেমন ঘুমে ছিলে তুমি!
প্রথমে বুটের শব্দ, তারপর গুলির শব্দে কি তোমার ঘুম ভেঙেছিল! হঠাৎ ভাঙা ঘুমচোখে তুমি কি পাগলের মতো ছুটে এসেছিলে বসার ঘরের দিকে! তার আগেই সামনের দিককার উঠানে বাবাকে ওরা গুলি করেছে! বাবার লাশ উঠানে লুটিয়ে পড়ার পর ওরা ঢুকেছিল বসার ঘরে! আর ঠিক তখনই বোধহয় ছুটে আসছিলে তুমি। তোমাকেও বাবার মতো করেই গুলি করেছে ওরা। তুমি লুটিয়ে পড়েছ বসার ঘরের মেঝেতে! তোমার শরীর ঝাঁঝরা করে ওদের গুলি গিয়ে বিঁধেছে আমাদের বহু বহু বছরের পুরনো বাড়ির, বসার ঘরের দেয়ালে। দেয়ালের আস্তর খসে পড়েছে মেঝেতে। তোমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে চুন-সুরকি। তোমার শাড়ি ভিজিয়ে রক্তের ধারা পুরনো কালের সিমেন্টে গড়িয়ে যাচ্ছিল। বাইরের দিককার দরজার কাছাকাছি গিয়ে আর যেতে পারেনি। জমাট বেঁধে গেছে।
আমি যখন বাবার লাশ দেখে বসার ঘরে ঢুকেছি, মাগো, এই যে আমি তিন মাস পর বাড়ি ফিরেছি মাত্র একটা রাতের জন্য, উঠানে বাবার লাশ দেখার পর, কিভাবে কী হয়েছে ভাবতে ভাবতে আমার মাথাটা যখন শূন্য হয়ে গেছে, তখন তোমাকে আমি দেখতে পেলাম।
তুমি পড়ে আছ বসার ঘরে। তোমার মুখটা দরজার দিকে। চোখ দুটো বন্ধ। কাত হয়ে একটু যেন দুমড়ে আছ তুমি।
মা, আমার মা, মাগো, এই দৃশ্য সহ্য করতে পারে কোন সন্তান! তার তো বুক ফেটে যাওয়ার কথা, কলিজা ফেটে মরে যাওয়ার কথা, তার তো চোখের জল কোনো বাঁধ মানবে না।
কিন্তু আমি কাঁদতে পারছিলাম না, মা। আমার বুক কলিজা কোনোটাই ফেটে যায়নি। আমি কেমন যেন নির্বোধ হয়ে গেলাম। আমার শরীরে-মনে কোথাও যেন কোনো অনুভূতি নেই। আমি যেন কোনো মানুষ নই, আমি যেন এক জড় পদার্থ। প্রথমে তাকিয়ে দেখলাম বাবার লাশ, তারপর কেমন যেন উদাস-নির্বিকার ভঙ্গিতে ঢুকলাম বসার ঘরে, তোমাকে দেখলাম। বকুলের ঘরে ঢুকে বকুলকে দেখলাম। আমার আর মায়ার ঘরের দিকে গিয়ে দেখি সেই ঘরে কেউ নেই। আমি যেন খুব স্বাভাবিক মানুষের মতো একটু অবাক হলাম। মায়া, কোথায় তুমি? এ রকম একটা ডাকও যেন আমার ডাকতে ইচ্ছা করল।
শেষ বিকালটা মায়ার খুব প্রিয় সময়। সে রবীন্দ্রনাথে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা মেয়ে। প্রকৃতি তাকে খুব আকর্ষণ করে। শেষ বিকালের রোদ যখন উঠে যায় গাছপালার মাথায়, চারদিকে ডাকাডাকি শুরু করে দিনশেষের পাখিরা, শ্রাবণ আকাশে আজ মেঘ নেই বলে ঝকঝকে নীল আকাশ, রজতরেখার ওদিক থেকে, বর্ষার ধানি বিল মাঠ পেরিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে উড়ে আসা হাওয়া, গাছের পাতায় পাতায় হাওয়ার খেলা দেখতে মায়া নিশ্চয়ই পেছনের বাগানের দিকে গিয়েছে ভেবে আমি ঘর থেকে বেরোলাম।
আশ্চর্য ব্যাপার মা, আমি যে ততক্ষণে আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান দুজন মানুষের গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া লাশ দেখেছি, হৃদয়ের টুকরো বোনটিকে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি তার বিছানায়, তাকে আর গুলি করার প্রয়োজন মনে করেনি দানবরা, এমনিতেই মরে গিয়েছিল সে, সেই বোনটিকে দেখেছি, তারপর নিজের রুমে এসে মায়াকে ওভাবে ডাকতে ইচ্ছা করল আমার, এমন হয় নাকি, মা! একজন মানুষ কেমন করে পারে এমন নির্বিকার হয়ে যেতে!
তারপর মায়াকে খুঁজতে আমি ঘর থেকে বেরোলাম। তাকে পড়ে থাকতে দেখলাম পেছন দিককার উঠানে। বেয়নেটের পর বেয়নেট চার্জ করা হয়েছে তার পেটে। মায়ার গর্ভে ছিল আমার সাত-সাড়ে সাত মাসের সন্তান। মুখ মাথা হাত পা_সবই তৈরি হয়ে গেছে তার। মায়ের গর্ভেও নিরাপদে থাকতে পারেনি সে। বেয়নেট মায়ার মতোই লণ্ডভণ্ড করেছে তার ওইটুকু শরীর। শুধু মুখটুকু অক্ষত। ফোলা ফোলা বন্ধ দুটো চোখ। বিকাল শেষ হওয়া আলোয় সেই মুখ দেখেও আমি যেন কিছুই অনুভব করলাম না। মায়ার মায়াবী মুখ, আমার সন্তানের অসম্পূর্ণ শরীর, ছোট্ট মুখখানি কোনো কিছুই আমাকে বিচলিত করল না।
কেন মা?
কেন এমন হলো আমার?
বরং মায়া আর আমার সন্তানের লণ্ডভণ্ড শরীর ঘিরে, রক্তমাংস মেদ-মজ্জার ঘ্রাণে নীল বড় সাইজের যে মাছিগুলো ওড়াউড়ি করছিল, ওদের শরীরে বসছিল, ওদের সামনে কিছুক্ষণ বসে ডান হাত হাতপাখার মতো নাড়িয়ে মাছিগুলোকে আমি তাড়াবার চেষ্টা করলাম।
আমি এমন হয়ে গেলাম কেন, মা?
এই অবস্থাটাকে কী বলে? অধিক শোকে পাথর! এই কি অধিক শোকে পাথর হওয়া!
তারপর বাবার কাছে ফিরলাম আমি। বাবার পাশে মাটিতে লেছড়ে-পেছড়ে বসে তার বুকে হাত বুলাতে লাগলাম। বাবাকে ঘিরে জীবনের কত কথা যে মনে পড়ল! কতক্ষণ, কতক্ষণ বসে রইলাম বাবার পাশে, মনে মনে কত কথা যে বললাম, কখন দিনের আলো ফুরিয়ে গেল, কখন আবছা অন্ধকারে বাড়ি ভরে ওঠার আগেই যে চাঁদ উঠে গেল পুব আকাশে, টেরই পেলাম না।
আজ কি পূর্ণিমা?
নাকি পূর্ণিমার এখনো দু-একদিন বাকি?
কী জানি!
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে নিতে, চাঁদের হিসাব আমার মাথা থেকে উধাও হয়ে গেছে। অথচ তোমরা সবাই জানো, আমি চাঁদপাগল ছেলে। পূর্ণিমা রাত, প্রখর জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া জগৎ সংসার খুবই প্রিয় আমার। বাড়িতে থাকলে, আমাদের এই গাছপালা ঘেরা বাড়িতে, জ্যোৎস্নারাতে একা একা আমি ঘুরে বেড়াতাম। রাত একটা-দুটো বেজে যেত, আমি এদিক যাচ্ছি, ওদিক যাচ্ছি। কোথাও বসে তাকিয়ে আছি চাঁদের দিকে। রাত কত হলো খেয়ালই করছি না।
আমাকে নিয়ে অদ্ভুত একটা ভয় ছিল তোমার।
ভূতের ভয়।
এতবড় গাছপালাঘেরা বাড়ি, বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় রাতের বেলা কিছুতেই যেন আমি না যাই, বারবার এসব বলতে। ওদিকটায় নাকি ‘স্কন্ধকাটা’ নাম তেনাদের একজনের বসবাস। অন্ধকার রাতে তার চলাচলের শব্দ পাওয়া যায়, চোখে দেখা যায় না। জ্যোৎস্নারাতে দেখা যায়। বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় হাঁটাচলা করেন। ওই জিনিসের ধড় আছে, মাথা নেই। ঘাড়ের ওপর থেকে কাটা। এ জন্য ওরকম নাম, স্কন্ধকাটা। তবে সারা শরীরেই তার চোখ। দেড়-দুশো নাকি চোখ শরীরে। কোনো কোনো নির্জন দুপুরেও নাকি কদম তাকে দূর থেকে দেখেছে। বারেকের মা নাকি প্রায়ই দেখত।
ওই মহিলার কথা আমরা কেউ বিশ্বাস করতাম না। গল্পবাজ মহিলা। ভূতের গল্প বলেও হাসত। তার হাসি দেখে ভূতের ভয় উধাও হয়ে যেত আমাদের। বুঝতাম বানিয়ে বানিয়ে গল্প করছে।
তবে বারেকের মায়ের জান হচ্ছে বকুল।
না না, এখন তো বলতে হবে ‘ছিল’!
বকুলকে সে ডাকত ‘কুট্টি’। অর্থাৎ ছোট্ট। বরিশাল অঞ্চলের মানুষ। বহু বছর ধরে আমাদের বাড়িতে। বকুলকে জন্মাতে দেখেছে। তোমাকে ডাকত মা। বিয়ে হয়েছিল এক ডাকাতের সঙ্গে। প্রথমে জানত না লোকটা ডাকাতি করে। বিয়ের কিছুদিন পর জানতে পারে। ততদিনে বারেক তার গর্ভে। বারেককে পেটে নিয়েই বাপের বাড়িতে চলে এসেছিল। ডাকাতের সংসার সে করবে না। হতদরিদ্র বাপ-ভাই ভালো রকম বিপদে পড়ল তাকে নিয়ে। নিজেদের সাধ্যমতো অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। বাচ্চা পেটে এরকম মেয়েকে কে বিয়ে করবে!
বারেক জন্মাল। সেই ছেলে কোলে নিয়ে বাপ-ভাইয়ের সংসার ছাড়ল সে। কেমন কেমন করে এসে উঠল আমাদের সংসারে। মহিলাটি বাজখাঁই টাইপের। কথা বলে চিৎকার করে। গলার স্বর পুরুষালি। কিন্তু মনটা খুব নরম। মানুষের জন্য খুব মায়া।
বারেকের মায়ের ভূতের গল্প শুনে বারেক পর্যন্ত হাসত। আমাদের কাউকে তো আর ধমক দিতে পারে না সে, বকুল হয়তো তার কোলে বসে আছে, হাসতে হাসতে নিজের ছেলেকেই একটা ধমক দিল সে।
বারেক ওসব ধমক পাত্তা দিত না। শরীরে ডাকাত বাপের রক্ত বলে ওইটুকু বয়স থেকেই বারেক বেশ সাহসী। ডর-ভয় একদমই নেই তার। আট-দশ বছর বয়সেই গভীর অন্ধকার রাতে বাড়ির এদিক-ওদিক অনায়াসেই চলে যেত। বারেকের মা কত রকমভাবে শাসন করত, শুনতই না।
তোমার মনে আছে মা, বারেককে আমাদের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা। ক্লাস টু না থ্রি পর্যন্ত অতিকষ্টে সে পড়ল। বাবা তুমি আমি, এমনকি ছোট বকুল পর্যন্ত তাকে পড়াবার চেষ্টা করত, পড়ায় ওর মনই বসে না। পড়তে বসলেই উসখুস উসখুস করে। একদিন স্কুলে যায় তো দুদিন যায় না। স্কুলের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়ে যে পালিয়ে থাকে! বারেককে কিছুতেই আমরা সামলাতে পারছিলাম না।
এসব দেখে একদিন বারেকের মা মহা খ্যাপা খেপল।
রান্নাঘরের সামনে বসে তার সেই বাজখাঁই গলায় গালাগাল করতে লাগল ছেলেকে। ওই ডাকাইতের পো, তুই কি মানুষ হবি না ডাকাইত হবি?
বারেক নির্বিকার গলায় বলল, ডাকাইত হমু।
বারেকের বয়স তখন দশটসের বেশি না। দশ বছরের ছেলে এভাবে কথা বলছে মায়ের সঙ্গে, বারেকের মা আরো খেপল। কী? কী হবি তুই?
ডাকাইত হমু। মানুষের গলা কাটুম।
কচ কী তুই?
হ, ঠিকই কই। আমার পড়তে ভাল্লাগে না, আমি পড়ুম না। আমি ডাকাইত হইয়া যামু।
বারেকের মা দুপুরের রান্না চড়িয়েছিল। রান্নাটা তাকে খুব ভালো শিখিয়েছিলে তুমি। চুলার পাড়ে বসে ছেলেকে বকছিল আর রান্না করছিল। বারেকের ওসব কথা শুনে চুলায় মাত্র গুঁজতে যাবে এমন একটা লাকড়ি নিয়ে লাফ দিয়ে বেরোলো। ধামা ধামা দু-তিনটা বাড়ি মারল বারেককে। ডাকাইত হবি তুই, ডাকাইত! যেই ডাকাইতের লেইগা আমি সংসার ছাড়ছি, আমার পেটের পোলা হইব সেই ডাকাইত! ডাকাইতের বংশ আমি রাখুম না। পিডাইয়া মাইরা হালামু।
আবার বাড়ি দিতে গেছে বারেককে, বারেক ঝাড়া একটা দৌড় দিল, দৌড় দিয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় চলে গেল।
সেদিন বাবার স্কুল ছিল না। ছুটির দিন। আমরা সবাই বাড়িতে। বারেকের মায়ের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে সবাই এসে দাঁড়িয়েছি রান্নাঘরের ওদিকটায়। বারেক পালিয়ে গেছে দেখে, তাকে ইচ্ছামতন পেটাতে পারেনি বলে শরীরের রাগ মেটেনি বারেকের মায়ের। আমাদের সবাইকে দেখে রাগটা অভিমানে রূপান্তরিত হলো তার। হাতের লাকড়ি ছুড়ে ফেলে রান্নাঘরের সামনে অসহায় ভঙ্গিতে বসে পড়ল। বসে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল। যার লেইগা এত কষ্ট করছি আমি, জীবনডা শেষ কইরা দিছি, হেই পোলায় আমারে আইজ কয় লেখাপড়া করব না, ডাকাইত হইব। তয় আর এই রকম পোলা রাইখা লাভ কী? ও মইরা যাউক। নাইলে অরে আমি নিজেই পিডাইয়া মাইরা হালামু।
বাবা খুব নরম গলায় বললেন, থামো বারেকের মা। কান্নাকাটি করে কোনো লাভ নেই। সব মানুষের সব কিছু হয় না। তুমি যা চাও তোমার ছেলের তা হবে না। আমি মাস্টার মানুষ। অনেক ছাত্র দেখেছি জীবনে। চেষ্টা তো কম করলাম না তোমার ছেলেকে নিয়ে। লেখাপড়া ওর হবে না। ওকে অন্য কাজে লাগাতে হবে। কদমের মতো ক্ষেতখোলার কাজ করুক। গরুর রাখাল হোক। আজ থেকে এইসব কাজে ওকে লাগিয়ে দাও।
কিন্তু সারা দিন বারেকের দেখা নেই। সেই যে দৌড়ে পালাল, বাঁশঝাড়ের ওদিকে গেল, দুপুর গড়িয়ে যায় ফেরার নাম নেই।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করলাম আমরা। আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর কদম বারেকের মা বারেক আর পারুল রান্নাঘরে বসেই খায়…
আরে, পারুলের কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, মা!
সেও তো আমাদের সংসারে আছে দশ-বারো বছর ধরে। ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা একটি মেয়ে। যখন আমাদের বাড়িতে কাজে এলো, তখন এত রোগা, একদম বাঁশের মতো। বাঁশ না, বারেকের মা বলত কঞ্চির মতো।
একবার বৈশাখ মাসের দুপুরের পর বাড়ির সামনের দিকে কী কাজে গেছে, হঠাৎই শুরু হলো কালবৈশাখী। দমকা একটা বাতাস এলো, পারুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেল সেই দমকা বাতাস খড়নাড়ার মতো দশ-বারো হাত দূরে উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে তাকে।
একজন মানুষকে এভাবে উড়িয়ে নিয়ে যায় হাওয়া!
পরে এই ঘটনা প্রায়ই বলত পারুল আর খুব হাসত।
ছোটবেলায় বসন্ত হয়েছিল। মুখভর্তি বসন্তের দাগ। ঝিমকালো গায়ের রং। এতিম মেয়ে। জন্মের পর প্রথমে মা মরেছে, তারপর বাপ। মা মরেছে বসন্তে, বাপের হয়েছিল যক্ষ্মা। মায়ের সঙ্গে ছোট্ট পারুলেরও বসন্ত হয়েছিল, কিন্তু সে টিকে গেল। বেঁচে থাকল মামাদের গলগ্রহ হয়ে। পদ্মার ওপারকার মাতবরের চরে বাড়ি। আমাদের এলাকায় এই ধরনের মানুষদের খুবই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে সবাই। বলে ‘চউরা’। চউরা শব্দটা গাল হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। পুরুষরা চউরা, মহিলারা ‘চউরানি’।
আমাদের বাড়িতে এসব অসভ্যতা নেই। পারুলকে ভুলেও কেউ আমরা চউরানি বলি না, এমনকি কদম বারেকের মাও না।
কদম বলবে কেন? সেও তো চরেরই লোক।
আমাদের বাড়িতে আসার পর এমনভাবে পারুল আমাদের সঙ্গে মিশে গেল, মা-বাবার কথা, মামা-মামি, অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের কথা সে বলতই না। সবার কথাই যেন সে ভুলে গেছে। আমরা ছাড়া তার যেন পৃথিবীতে আসলে আর কেউ ছিলই না।
তবে পারুলের অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হলো আমাদের বাড়িতে থাকতে থাকতে। কঞ্চির মতো মেয়েটি ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যবতী হতে লাগল। এমনিতেই ছয় ফুটের মতো লম্বা, তার ওপর স্বাস্থ্য ভালো হতে হতে প্রায় মোটা হয়ে গেল। এরকম মোটা লম্বা একটি মেয়ে, আচমকা দেখলে কী রকম একটা ধাক্কা যেন লাগে। তার ওপর ঝিম কালো।
বারেকের মা ঠাট্টা করে বলত, ওই পারু, তুই কি মানুষ?
পারুল অবাক হয়ে বলত, তয় আমি কী?
মাইয়া ভূতগো কী কয়, জানচ?
জানি। পেতনি।
তারপরই বারেকের মায়ের ঠাট্টা সে ধরে ফেলত। রেগে গেলে বারেকের মাকে সে বলত বুড়ি। মারমুখো ভঙ্গিতে বলত, ওই বুড়ি, তুমি কি আমারে পেতনি মনে করো?
বারেকের মা খাওয়াদাওয়া শেষ করে একটা পান মুখে দিয়েছে। পান চিবাতে চিবাতেই হাসল। হ, তরে তো অমুনি লাগে। একলা একলা বাঁশঝাড়ের ওইদিকে যাইচ না।
পারুটা একটু বোকা-সোকাও আছে। কথার মারপ্যাঁচ সহজে বোঝে না। বারেকের মা তাকে পেতনি বলেছে, সেটা ভুলে বাঁশঝাড়ের ওদিকে কেন তাকে যেতে মানা করা হচ্ছে ওই নিয়ে পড়ল।
ক্যান, ওইদিকে যামু না ক্যান?
বাঁশঝাড়ে যে একজন থাকে জানচ না?
জানি তো!
দেখছস কোনো দিন?
না। তোমার মুখে হুনছি। কদম মামার মুখে হুনছি।
কদমকে পারুল মামা ডাকত। কেন, কে জানে। দুজনই চরের মানুষ বলেই কিনা, নাকি মামাদের সংসারে বড় হয়েছে বলে মামাদের বয়সী লোককে মামা ডাকার অভ্যাস হয়েছে, কে জানে!
কিন্তু বাবাকে সে মামা ডাকত না। বাবাকে ডাকত ‘ছার’। অর্থাৎ স্যার। উচ্চারণ-দোষে সেটা ছার হয়ে যেত। আর তোমাকে ডাকত আম্মা। আমি হচ্ছি ভাইজান, বকুল আপা। বয়স বকুলের মতোই।
সেই দুপুরে বকুলও বোধহয় ওদের কাছাকাছি ছিল। বারেকের মা আর পারুলের কথা শুনছিল। কদম থাকত গোলাঘরে। ওদিকটায় বসে নারকেলের হুঁকায় গুড়ুক গুড়ুক করে তামাক টানছে। পারুল আর বারেকের মায়ের দিকে তার মন নেই। তামাক টানার সময় তামাকে এতটা মগ্ন থাকে, অন্য কোনো দিকে তাকাবার যেন সময় নেই।
ঘটনাটা আমাকে বলেছিল বকুল। বলে কী যে হাসি!
বাঁশঝাড়ের ওদিকে তাকে যেতে মানা করেছে বারেকের মা। ওদিকে যিনি থাকেন তেনার কথাও বলেছেন। কিন্তু আসল কথাটা তখনো বলেনি।
বারেকের মাকে পারুল ডাকে খালা। উতলা গলায় সে তারপর বলল, ও খালা, কইলা না, কির লাইগা আমি বাঁশঝাড় তলায় যামু না!
ওই যে কইলাম একজন আছে।
হেইডা তো হুনলাম। জানিও তো। তার বাদেও তো হুকনা বাঁশপাতা আনতে যাই।
আর যাইচ না।
ক্যান? আমি তো রাইত্রে যাই না। যাই দিনে। তাও দোফরে যাই না। বিয়ানের দিকে যাই।
তাও যাইচ না।
ক্যান যামু না হেইডা কইবা তো?
তেনায় থাকেন একলা।
হ, হেইডাও জানি।
বউ নাই।
একলা থাকলে আবার বউ থাকব কেমনে?
তার একটা বউ দরকার।
পারুলও এবার ঠাট্টা করল। তোমার লগে দেখা হইছিল? কইছে তোমারে?
বারেকের মা হাসল। হ, দেখা হইছিল। কইছে আমারে।
কী কইছে?
তার একটা বউ দরকার। তরে তেনায় বহুত পছন্দ করেন। দূর থিকা দেখছেন। তেনার চেহারার লগে তর মিল আছে। তেনার খালি মাথাডা নাই, তর মাথা আছে। একলা পাইলেই সে তরে বিয়া কইরা ফালাইব।
এই শুনে পারুল মহা চেতা চেতল। বলল, আমি তো দেখি তোমার চেহারাও তেনার মতন। তোমার লগে যহন দেহা হইছিল, তোমারে তেনায় বিবাহ করেন নাই ক্যান?
বারেকের মা নির্বিকার। আরে আমি তো বুড়ি হইয়া গেছি। বুড়ি তেনায় বিবাহ করবেন না। আর আমার লগে তার জাতপাতও বনে না। তেনায় তো মানুষ বিবাহ করবেন না, তেনার দরকার তার জাতের জিনিস। পেতনি। ভূতের বউ পেতনি।
বোকা মানুষ রাগলে ভয়ংকর হয়। বারেকের মায়ের কথাবার্তা শুনে ভয়ংকর হয়ে উঠল পারুল। কী রেখে কী বলবে বুঝতে না পেরে তোতলাতে লাগল। রাগলে তোতলাবার স্বভাব তার।
বকুল গিয়ে থামাল পারুলকে। বারেকের মাকে কপট ধমক দিল হাসতে হাসতে, আর পারুলের হাত ধরে তাকে টেনে সরিয়ে আনল।
মা, আমি কি আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি?
আমি কি এখন আর বাস্তবে নেই! আমি কি এই সময়ের মধ্যে নেই! এই যে আমি তোমার মাথাটা আমার কোলে নিয়ে বসে আছি, তোমার গালে গলায় হাতে পিঠে হাত বুলাচ্ছি কিন্তু তোমার কথা আমি বলছি না। বাড়ির অন্যান্য মানুষের কথা বলছি। বারেকের মা, বারেক আর পারুলের কথা বলছি। কদমও আছে সঙ্গে। তাদের ঘিরে কত টুকটাক স্মৃতির কথা বলছি।
এত কথা আমার কেন মনে পড়ছে, মা!
আরে, ওই দেখো, এখনই আমার মনে পড়ল, বাবার পাশে বসে বাবাকে নিয়ে যখন কথা বলছিলাম তখন বাড়ির কাজের লোকদের মধ্যে আমার শুধু কদমের কথাই মনে আসছিল। বাড়ির পোষা জীবগুলোর কথা মনে আসছিল। আমাদের কুকুর, বিড়াল, কবুতরগুলোর কথা মনে আসছিল। খোঁয়াড়ের ওদিকটায় না কোথায় যেন কবুতর ডাকার মৃদু শব্দও পেলাম। অথচ বাড়িতে যে জলজ্যান্ত আরো দুজন মানুষ ছিল, বারেকের মা আর পারুল, তাদের কথা আমার মনেই পড়ল না।
কেন মা?
আমার এমন হচ্ছে কেন?
স্মৃতিশক্তি, স্মরণশক্তি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন?
আর মানুষ দুজন গেলই বা কোথায়?
গোলাগুলির শব্দে, ভয়ে আতঙ্কে ওরা দুজন কি ছুটে গিয়ে কোনো ঝোপঝাড়ে লুকিয়েছিল! নাকি বর্ষার পানিতে নেমে নিজের জীবন বাঁচাতে সাঁতরে চলে গিয়েছিল কোনো দিকে! ওরা কি বেঁচে আছে? নাকি বাড়ির সবাইকে শেষ করে, বাড়ি লুটপাট করে খুঁজে খুঁজে ওদেরও বের করেছিল হায়েনারা! ঝোপঝাড়ের আড়ালে কিংবা মাঠের ওদিককার বর্ষার জলে খুঁজে পেয়েছিল ওদের। ওখানেই গুলি করে শেষ করে দিয়েছে।
ওদের লাশও কি এতক্ষণে ভেসে উঠেছে ধানি মাঠের ওদিকে!
বল্টু কুকুরটা গেল কোথায়?
বিড়ালটা?
গোলাগুলির শব্দে কুকুরটাও কি ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে নেমেছে বর্ষার পানিতে? সাঁতরে চলে গেছে অন্য কোনো বাড়িতে!
বিড়ালটা কি কোনো ঝোপঝাড়ে গিয়ে লুকিয়েছে! নাকি কোনো গাছে গিয়ে চড়েছে! পাতার আড়ালে বসে কাঁপছে!
বিড়াল পানিতে নামে না। সে নিশ্চয় এই বাড়িতেই আছে। এতক্ষণে ফিরলে পারত। তাও তো সংসারের জীবিত কারো সঙ্গে আমার দেখা হতো।
খোলা দরজা-জানালা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকেছে চাঁদের প্রখর আলো। তোমার আমার শরীরে পড়েছে। তোমার মুখ থেকে আমি চোখ ফেরালাম চাঁদের আলোর দিকে। তাকিয়ে অবাক হলাম। আরে, দরজা-জানালার কপাটগুলো তো নেই! জানালার শিকগুলোও নেই। তার মানে ওসবও খুলে নিয়ে গেছে রাজাকাররা। তোমাদের লাশ ছাড়া আর কিছুই ফেলে যায়নি।
মা, ওমা, সেই যে একদিন তুমি এক মায়ের আত্মার গল্প বলেছিল, আত্মা কথা বলে উঠেছিল, তুমি কি আমার সঙ্গে তেমন করে কথা বলতে পারো না, মা! গল্পের সেই মা তো তার ছেলের ব্যথা পাওয়া নিয়ে কথা বলেছিল। তুমি কি পারো না সেইভাবে কথা বলতে!
মা, ওমা, বলো না! একটু কথা তুমি আমার সঙ্গে বলো না!

[চলবে]