বয়সকাল

untitled-4_118184সকাল থেকে ভার্সিটির অবস্থা ভালো না। বেশ কয়েক জায়গায় ককটেল ফুটেছে। ছাত্ররা মিছিল নিয়ে বেরিয়েছিল, অপর পক্ষ তাদের ওপর হামলা করছে। গুলি-টুলিও হয়েছে বোধহয়। টেলিভিশনের স্ক্রলে গণ্ডগোলের খবর দেখাচ্ছে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, আজ আর ভার্সিটি যাবো না। এমনিও ক্লাস হবে না। এমন পরিস্থিতিতে ছেলেমেয়েরা ক্লাসে আসে না। শীতকালে ক্যাম্পাসের আবহাওয়া হঠাৎ করে এমন গরম হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। মেয়েটাকে ফোন করা দরকার।

কিন্তু মেয়েটাই ফোন করলো। ওর নাম রিজওয়ানা চৌধুরী।

‘আজ নিশ্চয়ই ডিপার্টমেন্টে যাবেন না?’

‘তুমি কী করে বুঝলে?’

‘টেলিভিশনে নিউজ দেখে।’

‘ঠিকই ধরেছো। আজ বাদ দাও। তোমাকে যে অংশটা রি-টাইপ করতে বলেছি, ওটা বরং আজ লেখো। কাল পরিস্থিতি দেখে আসতে বলবো তোমাকে।’

রিজওয়ানা সালাম দিয়ে ফোনটা রেখে দিল।

রিজওয়ানা আমার তত্ত্বাবধানে মাস্টার্স ক্লাসের থিসিস করছে একটা। দুবাইয়ের একটা কলেজে গ্র্যাজুয়েশন করে বাংলাদেশে চলে এসেছে ও। ওর স্কুলিংটা লন্ডনে হয়েছে। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই। রেজাল্ট ভালো। চমৎকার ইংরেজি বলে এবং লেখেও। ওর থিসিসের বিষয়টা ওরই ঠিক করা- ‘The Partition of Bengal in 1947 : The Demographic Impact and Paradox of Bengali People..’ বিষয়টা আমার পছন্দ হয়েছিল। ওর সঙ্গে আলাপ করেছিলাম বিষয়টা নিয়ে, কেন সে বিষয়টা বেছে নিল তা জানবার জন্য। ও এক পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা সারসংক্ষেপ দিয়েছিল আমাকে। ভালো লেগেছিল আমার। ও নতুন কিছু বলতে চায়। এ বিষয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, তার পরও আমি ওর নতুন চিন্তা-ভাবনার জন্য বিষয়টা পছন্দ করি। ডিপার্টমেন্টের একাডেমিক কমিটি ওটা পাস করে দেয়।

রিজওয়ানাকে আমি ইন্টারনেট থেকে সব রিলেটেড লিটারেচার সংগ্রহ করতে বলেছিলাম। ওটা শেষ হলে ভার্সিটির লাইব্রেরি ঘেঁটে ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ নিয়ে যা বই আছে তা পড়ে একটা সিনোপসিস তৈরি করতেও বলি। মেয়েটা ঠিক ঠিক সব করে। সব কথা শোনে। কিন্তু ওর দোষ বা গুণ যা-ই বলি না কেন, বড় চঞ্চল ও। আমি যখন ওর লেখা দেখি বা বই খুলে কিছু খুঁজি ও ভীষণ উসখুস করে। চবি্বশ-পঁচিশ বছর বয়সের একটা মেয়ে চঞ্চল হতেই পারে। কিন্তু গবেষণা এমন একটা বিষয়, যা খুব স্থিরভাবে স্থির চিন্তায় করতে হয়। রিজওয়ানার ওটা নেই।

কিন্তু কোনো বিষয়ে ও একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই হয়, মূল বিষয়টা ও ধরে নেয়, দ্বিতীয়বার সে ওটা আর পড়ে না। আমি তার এই বিষয়টা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি। কিন্তু দশ দিন আগে পড়া কোনো বিষয় নিয়ে যখন আলোচনা করি তখন ও ঠিক ঠিক রেফারেন্স ধরে সব বলে দিতে পারে। ফলে, ওর কাজের সততার নিচে ওর চঞ্চলতা চাপা পড়ে যায়। রিজওয়ানা অসম্ভব মেধাবী এটা আমি মেনে নিয়েছি। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ও আমার রুমে চলে আসে। থিসিসের পার্টগুলো দেখায়। কখনও আমি সঙ্গে সঙ্গে দেখে দিই, কখনও রেখে দিই পরে দেখে দেবো বলে।

রিজওয়ানা একদিন বলেছিল,

‘স্যার, ডিপার্টমেন্টে আপনি ব্যস্ত থাকেন। সময় পান না। আমিও ক্লাসে থাকি। বিকেলের পর বাসায় গেলে কি অসুবিধে আছে?’

বিদেশি কালচারে বড় হয়ে ওঠা একটা মেয়ে এমন কথা বলতেই পারে।

তবুও আমি বলি,

‘না মানে, বাসায় যাবে কেন?’

‘না স্যার, অন্য কিছু না। জাস্ট থিসিসটার কাজ নিয়ে যেতে চাচ্ছি।’

‘ও আচ্ছা।’ বলে আমি অনুমতি দিয়েছিলাম। রিজওয়ানার উদার ও খোলামেলা চরিত্রটিকে আমি নষ্ট করতে চাইনি। আসলে আমার বাসায় একটা কাজের ছেলে ছাড়া কেউ থাকে না। ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টার। আমি সাধারণত ছাত্রীদের আমার বাসায় আসতে উৎসাহিত করি না। ছাত্ররা আসে। পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা ছাড়াও সিনিয়র স্টুডেন্টরা আড্ডাবাজিও করে। ওরাই আমার বন্ধু-সন্তান-ভাই, আমার বাসাটা আমার নয়, মাঝে মাঝে ওরাই দখল করে ফেলে। আমি যে আমার বাসায় ছাত্রীদের অ্যালাউ করি না, এই ছেলেগুলো জানে। কিন্তু রিজওয়ানার বিষয়টায় ওরা কেউ কিছু জানতে চায়নি আমার কাছে।

রিজওয়ানা কি আমাকে পছন্দ করে?

মেয়েটাকে আমারও পছন্দ প্রথম থেকেই। যেদিন প্রথম ও ডিপার্টমেন্টে আমার রুমে ‘মে আই কাম ইন স্যার?’ বলে ঢুকে পড়েছিল, সেদিন ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল আমার। ঝকঝকে চেহারা, নাক-মুখ কাটা-কাটা, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চুলগুলোকে পনি-টেল করে ছেড়ে দেওয়া পিঠের ওপর। ভালো লেগে যাবার মতো মুখটা।

আমার ভেতরে কি তখন অন্য কিছু খেলা করছিল? অন্য কোনো চিন্তা অথবা আকাঙ্ক্ষা? অথবা সব পুরুষেরই যা হয়, তেমন কিছু? পুরুষ সবসময়ই পুরুষ, সত্তরেও সে থাকে ত্রিশের যুবকের মতো। যদিও বিয়ে-থা করিনি বলে আমার ভেতর এক ধরনের নীরবতা আছে। আমার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা সেই উদ্দাম পুরুষটাকে আমি সামলে রাখি সবসময়। কিন্তু রক্ত-মাংসের মানুষ তো, জ্বলন্ত চুলোর ওপর কড়াইয়ের দুধের মতো মাঝে মাঝে বলক দেয়। তখন চুলোর আগুনটা কমিয়ে দেই।

তার পরও সহকর্মীদের চোখ এড়ায়নি বোধ হয়। দুপুরে চায়ের আড্ডায় প্রফেসর আজম তো একদিন বলেই বসেন,

‘কী ব্যাপার চিরকুমার? কী সব শুনছি?’

‘কী শুনছেন?’

আমার তো চমকে ওঠারই কথা।

পাশ থেকে আরেক সহকর্মী ফিসফিস করে বলেন,

‘মনে রাখবেন, বয়স কিন্তু পঞ্চাশ পেরিয়েছে।’

‘পঞ্চাশ তো আপনারও।’

ওদের প্রশ্নের উদ্দেশ্য পরিষ্কার আমার কাছে।

‘না মানে, আমরা তো ত্রিশেই মরেছি, আপনি কি পঞ্চাশে এসে মরতে চান?’

এ ধরনের উস্কানিমূলক কথা গ্রাহ্য করতে নেই। আমি বলি,

‘ছাত্রী তো।’

‘ছাত্রী তো মেয়ে। নাকি মেয়ে নয়?’

ওদের যুক্তির কাছে কথা বলা মুশকিল।

রিজওয়ানা মাঝে মাঝেই আমার বাসায় আসে এখন। ড্রয়িংরুমে বসে। কাগজপত্র বের করে, নোট দেখায়। আমরা ঘণ্টা ধরে কাজ করি একেক দিন। চা-বিস্কুট খায়। কিন্তু কখনও ভেতর ঘরে যায় না, যদিও মাঝে মাঝে দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেখতে চেষ্টা করে।

প্রথম যেদিন রিজওয়ানা এসেছিল আমার বাসায়, হাত থেকে থিসিসের কাগজপত্র নামিয়ে রাখতে রাখতে বলেছিল,

‘স্যার, আপনার বাসাটা বেশ নিরিবিলি মনে হচ্ছে। পড়াশোনা করার চমৎকার জায়গা।’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ওপর একটা প্রবন্ধ লিখছিলাম আমি দৈনিক পত্রিকার জন্য।

আমি চোখ তুলে বলেছিলাম,

‘তোমার পড়াশোনার জন্য আমার বাসা ফ্রি। পুরো বাসাটাই তোমার।’

কিন্তু তবুও ড্রয়িংরুম ছাড়া অন্য ঘরে যায়নি ও।

একদিন কী একটা জটিল বিষয় নিয়ে আমরা আলাপ করছিলাম, হঠাৎ আচমকা, বলা নেই কওয়া নেই, আমাকে প্রশ্ন করে বসেছিল,

‘স্যার, আপনি বিয়ে করেননি কেন?’

আমি ঠিক ওই সময়ে বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছিলাম না। ফলে, কী জবাব দিয়েছিলাম এখন আর মনে নেই। তবে হয়তো বলেছিলাম, ‘বিয়ে করব না কে বলেছে?’

আমার এই কথায় কি-না জানি না, দিন পনেরো আগে আমার লেখা নোটটা পড়তে পড়তে হঠাৎ ও সোফা থেকে উঠে ভেতর ঘরের দিকে চলে গিয়েছিল।

ও ঘুরে ঘুরে দেখেছিল আমার বাসা। বইপত্র, ম্যাগাজিন, ফাইল, আরও কি সব খুলে খুলে চোখ বুলাচ্ছিল। একসময় ড্রয়ার খুলে অ্যালবাম বের করে বলেছিল,

‘স্যার, ছবিগুলো দেখি?’

আমি না করতে পারিনি। যদিও ওই অ্যালবামে একটি মাত্র ছবি ছিল যেটি রিজওয়ানার করা একদিনের প্রশ্নের জবাব হয়ে যেতে পারে।

অ্যালবাম খুলে ছাত্রীটি আমার বোকাই হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়।

‘স্যার, এই এতো বড় অ্যালবামে একটি মাত্র ছবি রেখেছেন?’

‘হ্যাঁ, ওটাই আমার ছবি। আর কোনো ছবি রাখার প্রয়োজন মনে করি না।’

সাদা-কালো একটা ছবি, আমার আর নীতুর। আমার বয়স তখন চবি্বশ, নীতুর বোধ হয় বাইশ।

‘স্যার, মেয়েটি কে?’

‘ওটা রেখে দাও রিজওয়ানা।’

আমি একটু গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলাম।

‘আপনার পরিচিত?’

তারপর আরেকটা প্রশ্ন,

‘আপনি ভালোবাসতেন?

তারপর একসঙ্গে অনেকগুলো,

‘আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে? দোষটা কি ওই ছবির মহিলার? বিট্রে করেছে আপনাকে?’

আমি লক্ষ্য করেছিলাম রিজওয়ানা বার বার ছবিটার দিকে তাকাচ্ছিল। কিছু কী খুঁজছিল ছবিটার মধ্যে? আমি আবার ওটা রেখে দেওয়ার জন্য ধমকের মতো দিতেই ওটা ড্রয়ারে রেখে আমার সামনে এসে বসেছিল। ক্ষুব্ধ দেখাচ্ছিল ওকে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম,

‘কী খাবে? চা চলবে?’

ও কিছুই বলেনি, এমনকি মাথাও নাড়ায়নি। আমি কাজের ছেলেটাকে চা-বিস্কুট দিতে বলেছিলাম। আমি তখন ভাবছিলাম, মেয়েরা সত্যিই বড় অভিমানী হয়, নাকি পরশ্রীকাতর হয়? রিজওয়ানা কি আমাকে নিয়ে তেমন কিছু ভেবেছে, যেটা আমার সহকর্মীরা ইঙ্গিত করেছিলেন? এমন তরুণী একটা মেয়ে আমার মতো বয়সী মানুষকে নিয়ে ভাববে কেন? আমি যথাসময়ে বিয়ে করলে রিজওয়ানার মতো একটা মেয়ে থাকতে পারত আমার। তাছাড়া, রিজওয়ানার চরিত্রের সঙ্গে আমার চরিত্র মেলে না। ও চঞ্চল, প্রজাপতির মতো মেয়ে, আমি ঠিক তার বিপরীত, অন্তর্মুখী। সেই আমার সঙ্গে অন্য একটা মেয়ের ছবি দেখে রিজওয়ানা কি ক্ষুব্ধ হয়েছিল আমার ওপর?

রিজওয়ানা কয়েকদিন আর যোগাযোগ করেনি আমার সঙ্গে। ক্লাসেও আসেনি। প্রায় সপ্তাহ পার করে দিয়ে ও এলো। বেশ মলিন মনে হলো ওকে। বোঝাই যাচ্ছিল ঝড়-ঝাপটা পার করে সুস্থির হয়ে আবার পুরনো রূপে ফিরে এসেছে। ব্যাগ খুলে একটা টিফিন বক্স বের করে সেটা খুলে আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল,

‘আপনি খান।’

তখন সবেমাত্র একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম আমি। একটু ইতস্তত করাতে ও বলেছিল,

‘সিগারেটটা ফেলে দিয়ে লুচি আর সুজি খান। আমার নিজ হাতে বানানো।’

‘তুমি এসব আনতে গেলে কেন?’

‘কেন, আমি কি আপনাকে খাওয়াতে পারি না? কেউ আপনাকে খাওয়াবার অঙ্গীকার করেছিল, খাওয়ায়নি, অথবা বলতে পারেন খাওয়াতে পারেনি। তাই বলে আমি পারব না তা আপনার মনে হলো কীভাবে?’

রিজওয়ানা এসব কী বলছে? ও কি নীতুর বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নিয়েছে? আমি তো নীতুর সম্পর্কে কিছুই বলিনি ওকে। এমনকি নামটাও না। তবু আমার সঙ্গে নীতুর ছবি দেখে এমন ক্ষুব্ধ হলো কেন ও?

আমি ঘটনাটাকে আর দীর্ঘ করতে চাইনি। সিগারেটটা এসট্রেতে গুঁজে নির্বোধ বালকের মতো লুচি আর সুজি খেয়েছিলাম সরাসরি ওর টিফিন বক্স থেকে।

লুচি আর সুজি আমার খুব প্রিয় খাবার। রিজওয়ানার সেটা জানবার কথা নয়।

এরপর থেকে রিজওয়ানা কেমন যেন পাল্টে যেতে শুরু করেছিল। দেখা করবার আগে টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিয়ে আমার অফিস রুমে দেখা করতে আসত। আমি যখন ওর থিসিসের বিভিন্ন অংশ কাটাকুটি করতাম, ও কাগজপত্রের দিকে নয়, তাকিয়ে থাকত আমার মুখের দিকে। আমি দু’একবার হঠাৎ মুখ উঁচু করে ওর দিকে তাকালে দেখতাম, ও ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন একটা মায়াবী মুখ ওর, একটা ঘোরলাগা ভালোবাসা লেপ্টে থাকত ওর চোখের ভেতর। আমি অস্বস্তিতে পড়ে যেতে শুরু করি।

একদিন রিজওয়ানা খুব ইমোশনাল ছিল বোধ হয়। বলছিল,

‘আপনি তো জানেন আমার বাবা বেঁচে নেই। আমার আর কোনো ভাইবোনও নেই। মা’ই আমার সব। আমার সব কথা মাকেই বলি। ভালোমন্দ সবকিছু শেয়ার করি তার সঙ্গে। বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, লন্ডনে একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। আমার জন্ম ওখানেই। স্কুল লেভেলের লেখাপড়াটা লন্ডনে করি। তারপর কোম্পানি বাবাকে দুবাইতে একটা প্রজেক্টে পাঠায়। কন্সট্রাকশনের কাজ। আমরা সবাই দুবাই চলে যাই। ব্যস, ওখানেই প্রজেক্টের একটা অ্যাক্সিডেন্টে বাবা মারা যান। আমার গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করি ওই অবস্থাতেই।’ আমি কথার মাঝখানে জিজ্ঞেস করেছিলাম,

‘দুবাই থেকে তো লন্ডনে চলে যেতে পারতে। বাংলাদেশে এলে কেন?’

রিজওয়ানা মাথাটা নিচু করে নিয়ে স্বগতোক্তির মতো বলেছিল,

‘হয়তো আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে বলে।’

বুকের ভেতরটা আমার দুলে উঠেছিল হঠাৎ করে।

অবিবাহিত পুরুষের সামনে এ ধরনের কথা ইঙ্গিতপূর্ণ। আমার ভেতর রিজওয়ানা কী পেল যে, অমন করে বলতে পারল? ভালোবাসা জিনিসটা কেমন, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থ-উচ্চতায় কতটুকু হয়, কতটুকু আকার তার, বুকের কোথায় তার স্থায়ী আবাস, এসব বুঝে ওঠার আগেই আমি হারিয়ে ফেলেছি ভালোবাসার মোহ। নীতু যাবার সময় সবটুকু খাবলে-খুবলে তুলে নিয়ে চলে গেছে শিকড়সহ। রিজওয়ানা কি আবার কিছু পুঁতে দিল এই অবেলায়?

সেদিন বিকেলে আমি ক্যাম্পাস থেকে বাসায় না ফিরে চলে গিয়েছিলাম বসুন্ধরা শপিং মলে। আমি একবারই মাত্র গিয়েছিলাম মলটি চালু হওয়ার পর। তাও কেনাকাটা করতে নয়। সিনেপ্লেক্সে একটা ছবি দেখার জন্য আমার ছাত্রবন্ধুদের সঙ্গে। ওরাই জোর করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল।

এবার আমি একলাই যাই।

নানা দোকান ঘুরে ঘুরে আমি একটা গর্জিয়াস শাড়ি কিনি। আমি আসলে শাড়ি-টাড়ি কখনও কিনিনি। মা বেঁচে থাকতে বাড়িতে মায়ের কাছে টাকা পাঠিয়ে দিতাম, মা কিনে নিতেন। নীতুর সঙ্গে সম্পর্কটা শাড়ি দেবার পর্যায়ে গেলেও তখন তা কিনে দেওয়া যায়নি আর্থিক কারণে। যখন কিনে দেওয়ার মতো অর্থকড়ি জমেছে তখন নীতু অনেক দূরে চলে গেছে।

মনে পড়ে, নীতু একদিন হাসতে হাসতে বলেছিল,

‘এবার পহেলা বৈশাখে তুমি আমাকে একটা শাড়ি কিনে দেবে। আমি ওটা পরে সারা শহর ঘুরে বেড়াব।’

খালি মানিব্যাগ উল্টে দেখিয়ে বলেছিলাম,

‘এই মানিব্যাগে ভবিষ্যতে যত টাকা জমবে সব টাকা থাকবে শুধু তোমার শাড়ি কেনার জন্য।’

নীতু কি কষ্ট পেয়েছিল ওকে শাড়ি কিনে দিতে পারিনি বলে? হতে পারে। মেয়েরা কখন কিসে কখন কষ্ট পায় বোঝা মুশকিল।

শাড়িটা আমি রিজওয়ানার জন্য কিনেছিলাম। গিফট দেব শুনে সেলসম্যান চমৎকার র‌্যাপিং করে দিয়েছিল। টিএসসির মোড়ে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে আমি হাঁটতে শুরু করেছিলাম। চমৎকার একটা আকাশ, আকাশভরা তারা, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমি পা ফেলে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিলাম বাসার দিকে। কলাভবনের সামনের সড়কের ফুটপাথে আমি আনমনে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। কিছু কি দেখেছিলাম আমি? নাকি ভাবছিলাম জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে আমি কীভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি ভালোবাসার মায়াজালে? ভালোবাসা কি তেমনই কিছু যে পৃথিবীর তাবত কিছুকে অগ্রাহ্য করে জায়গা করে নেয় সবার ওপরে?

রিজওয়ানাকে আমি ছোট্ট একটা মেসেজ দিয়েছিলাম পরদিন বাসায় আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য।

ও ফিরতি মেসেজে জানিয়েছিল রিসার্চের লিটারেচার রিভিউ অংশটা প্রায় শেষ করে এনেছে। ওটা শেষ হলেই সে বাসায় সেগুলো নিয়ে আসবে আমাকে দেখাবার জন্য।

আমি শাড়িটা আলমারিতে উঠিয়ে রেখেছিলাম। রিজওয়ানা শাড়িটা পেয়ে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। চঞ্চল মেয়েরা অল্পতেই খুশি হয় বলে কোথায় জানি পড়েছিলাম।

আজ আসার কথা ছিল রিজওয়ানার। কিন্তু ভার্সিটিতে গণ্ডগোল সব পরিকল্পনা নষ্ট করে দিল।

কাল যদি রিজওয়ানা আসে!

দিনটা ভালো গেল না। ছাত্রদের কয়েকজন এলো সন্ধ্যেবেলায়। ওরা আসায় কিছুটা স্বস্তি পেলাম বোধহয়। চানাচুর, মুড়িভাজা, পাকুড়া আর গরম চায়ে আড্ডাটা জমে উঠল। আড্ডাটা জমলো প্রধানত রাজনীতি নিয়ে। গণতন্ত্র, অবরোধ, হরতাল ইত্যাদি প্রসঙ্গই ঘুরে-ফিরে চলে এলো। রাজনীতিবিজ্ঞানের ছাত্রদের আড্ডাবাজি মানেই লেখাপড়া। বই খুলে পড়ার দরকার হয় না, চোখে যা দেখছো তা-ই তোমার বিষয়। যেন প্রশ্ন তৈরি, ব্যাখ্যা করো_ হোয়াট ইজ ডেমোক্রেসি অ্যান্ড হোয়াট ইজ অটোক্রেসি।

কিন্তু দেশ বিভাগ নিয়ে রিজওয়ানা যে গবেষণা শুরু করেছে তা যেন কোনোদিন শেষ না হয়। চলতেই থাক। একটা ঘোরের ভেতর কথাগুলো আমার মনে হয়। ডিপার্টমেন্টে দেখা করতে এলো ও। আমি বললাম, ‘বাসায় চলো।’

‘কেন?’

কেন বলল বটে, কিন্তু ওই কেন’র ভেতর লুকিয়েছিল ফুলের সৌরভ, যেন শব্দটা ধারণ করেছিল পৃথিবীর সব মায়া-মমতা আর ভালোবাসা।

কলাভবন থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।

‘গাড়ি নেবো না?’

‘প্রয়োজন নেই। চলো হাঁটি। ভালোই লাগছে হাঁটতে।’ আমি বলি।

বাসায় পেঁৗছে দেখি কাজের ছেলেটা মাগুর মাছের ঝোল আর ডিম ভাজি করেছে।

আমি রিজওয়ানাকে বললাম,

‘এ তরকারি দিয়ে লাঞ্চ করতে আপত্তি নেই তো?’

ও কোনো জবাব দিল না। ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে পড়লো। আমি টেবিলে দুটো প্লেট লাগাতে বলে ওয়াশরুমে যাই। পানির ঝাঁপটা দিই চোখেমুখে। আয়নায় চোখ যায় আমার। কানের ওপরে সাদা চুলগুলোতে আঙুল যায়। চোখের নিচে গভীর কালি না থাকলেও কপালের ভাঁজটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি এভাবে কেন দেখছি ভেবে নিজেরই হাসি পায়। পঞ্চাশ বছর বয়স পেরুনো মানুষ আমি, চাইলেই ত্রিশে নামতে পারব না। সময় সব মানুষকে ক্রমেই ঠেলে নিয়ে যায় না ফেরার সীমানায়।

শাড়িটা রিজওয়ানা নিল কোনো প্রতিবাদ না করেই। শুধু জিজ্ঞেস করল,

‘শাড়িটা আপনি আমার জন্যই কিনেছেন?’

‘হ্যাঁ, বলতে পারো শুধু তোমার জন্যই।’

কথাটা বলতে পেরে আমার বুকটা অনেকটাই হালকা হয়ে গেল। শাড়িটা কেনার পর থেকে মুহূর্তগুলো জগদ্দল পাথরের মতো বুকের ভেতর একটু একটু করে ভারী হয়েছে, রিজওয়ানা যদি রি-অ্যাক্ট করে এই আশঙ্কায়। কিন্তু ও স্বাভাবিকভাবে নেওয়ায় হঠাৎ আমার ভেতর কী যে হলো, আমি দু’হাতে রিজওয়ানার কাঁধটা শক্ত করে ধরে ওর ঠোঁটে চুমু দিতে চাইলাম। মেয়েটা এবারও রি-অ্যাক্ট করল না। শুধু কপালটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ঠোঁটে নয়, কপালে দিন।’

একটু থমকে গেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে ওর কপালে আলতো করে আমার ঠোঁটের স্পর্শ বসিয়ে দিলাম। রিজওয়ানা কি কেঁপে উঠল ভেতরে ভেতরে? হয়তো কাঁপল না। কিন্তু আমি কাঁপতে থাকলাম, আনন্দে নাকি আশঙ্কায় বুঝতে পারলাম না। পুরো ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, আমি নিজেকে সামাল দিতে পারলাম না। ভালো-মন্দ, সঠিক-বেঠিক কোনো চিন্তা করার আগেই সব সিদ্ধান্ত যেন গৃহীত হয়ে গেল এক চুম্বনে। আমি অপরাধীর মতো সোফায় গিয়ে বসলাম। রিজওয়ানার দিকে চোখ তুলে তাকাতে সংকোচ হতে লাগল, ভীষণ অপরাধী মনে হলো নিজেকে। শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রীর সম্পর্ক পিতা-কন্যার মতো, ছিঃ আমি এ কী করলাম?

শাড়িটা ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে থিসিসের টাইপ করা কাগজপত্রগুলো আমার সামনের সেন্টার টেবিলে গুছিয়ে রেখে রিজওয়ানা ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল দরজা ঠেলে।

আমি কতক্ষণ ওইভাবে বসেছিলাম মনে নেই।

হয়তো কিছুক্ষণ, অথবা অনেকটা সময়।

জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে চোখ গেল বাইরে, অন্ধকার নামছে। ক্যাম্পাসের ছোট-বড় বৃক্ষরাজিতে অনেক পাখির বাস, ওদের কিচিরমিচির শব্দ ভেসে এলো কানে।

হঠাৎ মোবাইল ফোনে একটা মেসেজ আসার শব্দ হলো। হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলাম।

রিজওয়ানার মেসেজ। লিখেছে আগামীকাল সন্ধ্যায় ওর বাসায় আমার দাওয়াত। গাড়ি পাঠিয়ে দেবে, আমি যেন সেজেগুজে যাই। না, রিজওয়ানা স্যার সম্বোধন করেনি আমাকে। ইদানীং ও আমাকে স্যার বলে ডাকছে না, সেটা লক্ষ্য করেছি। ‘সেজেগুজে যাই’ কথাটায় হাসি পেল আমার। ছাত্রীর বাসায় শিক্ষক যাবে, সেজেগুজে যাওয়ার কী আছে? নাকি রিজওয়ানা সত্যি সত্যি কোনো ডিসিশন নিতে যাচ্ছে? আজ রাতটায় ভালো ঘুম হবে ভেবেছিলাম, কিন্তু টেনশনে আমি প্রায় জেগেই থাকলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে খুব বিষণ্ন বোধ হতে লাগল। এটা অপরাধ না আনন্দের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারলাম না। আমি আর ক্যাম্পাসে গেলাম না। একটা চিঠি পাঠিয়ে ছুটি নিয়ে নিলাম।

সকাল থেকে সন্ধ্যা অনেক দীর্ঘ সময় বোধহয়। অন্তত আমার কাছে আজ তাই মনে হচ্ছে। লেখার টেবিলে বসলাম, লেখা হলো না। এক কলমও লিখতে পারলাম না। টিভি খুলে বসলাম, আমি সাধারণত সিএনএস, বিবিসি, আলজাজিরা দেখি, আজকে সেখানেও মন বসাতে পারলাম না। ঘরের ভেতর হেঁটে বেড়ালাম কিছুক্ষণ, কিন্তু টেনশন কাটছে না। হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’র লম্পট মাস্টারটার কথা ঘুরে-ফিরে মাথায় আসছে।

সন্ধ্যার পর পর দরজায় বেল দিল ড্রাইভার। আমি প্রায় প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অবলোকন করেছি নিজেকে। মন্দ লাগছে না। বহুদিন এভাবে নিজেকে দেখা হয়নি। আজ দেখলাম। রিজওয়ানা কেন আমাকে ডেকে নিচ্ছে ওর বাসায় আমি জানি না, জিজ্ঞেসও করিনি। তবে ও যদি আমাকে নিয়ে কিছু ভেবে থাকে, আমি আপত্তি করব না। ওর মাকে কি ও রাজি করাতে পেরেছে? বয়সের এমন বিস্তর ফারাক, কোনো অভিভাবকের রাজি হওয়ার কথা নয়।

আমি কেন এমন ভাবছি আজ? গত পঁচিশ বছরে যে আমি কখনও কোনো নারী, নারীর সংসর্গ বা বিয়ে নিয়ে ভাবিনি, সে আমি কোন্ মোহে নতুন করে জীবনের পাতা খোলার পরিকল্পনা করছি? রিজওয়ানা আমাকে কিছু বলেনি, কিন্তু ওর সব ইশারা-ইঙ্গিত আমাকে শেষ পর্যন্ত ওই দিকেই ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে তা আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম।

গাড়ির কাছে এসে দেখি, রিজওয়ানা গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ ওর আসবার কথা ছিল না। চমৎকার একটি শাড়ি পরেছে ও, কিন্তু গতকাল আমার দেওয়া শাড়িটা নয়। দুটো বিষয়ই আমাকে ভাবালো। কিন্তু ভাবনাটা মুহূর্তকালের মধ্যে উবে গেল, যখন রিজওয়ানা বলল,

‘আপনাকে চমৎকার লাগছে, একেবারে আমার মনের মতো।’

রিজওয়ানা গাড়িতে আমার পাশে বসল।

গাড়ি গলি পেরিয়ে এসে উঠল রাজপথে। তারপর সোজা ছুটে চলল বারিধারার দিকে। আমি জানতাম রিজওয়ানা বারিধারায় ওদের নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে থাকে।

রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। গাড়ির তেমন চাপ নেই রাস্তায়। রিজওয়ানা খুব সন্তর্পণে কিন্তু স্বাভাবিকভাবে ওর বাঁ হাতটা আমার ডান হাতের ওপর রাখলো। আমি দেখলাম, কিন্তু হাতটা সরালাম না। ও যদি এতে আনন্দ পায় পাক।

বিশাল ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে গাড়িটা থামল। রিজওয়ানা গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে এসে আমার পাশের দরজা খুলে আমাকে নামাল। তারপর আমার হাত ধরে একরকম টানতে টানতে লিফটের গোড়ায় নিয়ে এলো। লিফটের দরজা খুলে গেলে আমাকে নিয়ে ঢুকল ভেতরে। আমি মেয়ের সাহস দেখে বাঙালিচোখে অবাকই হচ্ছিলাম। লন্ডনে-দুবাইয়ে বড় হওয়া মেয়ে, এসব হয়তো ওর কাছে কিছুই নয়।

লিফট থেকে নেমে কয়েক কদম এগোতেই চমৎকার ডিজাইন করা সেগুন কাঠের ভারী একটি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। ও আঙুলে টিপ দিয়ে বেল বাজালো।

‘এটাই তোমাদের বাসা?’

আমি পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম।

‘জি্ব।’

‘চমৎকার দরজাটা।’

আমার কথা শেষ হবার আগেই খুলে গেল ওটা। আর দরজাটা খুলে যে আমার সামনে দাঁড়াল সে আর কেউ নয়, ফারজানা আহমেদ। আমি যাকে নীতু বলে ডাকতাম।

রিজওয়ানা আঙুল তুলে বললো_

‘সি ইজ মাই মাদার, আমার মা।’

নীতুর পরনে সেই শাড়িটা, যেটা আমি রিজওয়ানাকে কাল দিয়েছিলাম।

আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না। পা দুটো খুব ভারী মনে হলো।

নীতুর মুখটা ঠিক ওই রকমই আছে, শুধু ভারী হয়েছে শরীরটা, চুলগুলো একটু একটু সাদাটে হয়েছে, এই যা তফাত।

নীতু একটু হাসলো, সেই পরিচিত হাসি। তারপর বলল,

‘ভেতরে এসো।’

রিজওয়ানা আমার ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দিল আলতোভাবে।