ভাষণের ভাষান্তর

আমরা অনেকেই একে অন্যকে গোপন কথা বলতে গিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলি, ফিস্ ফিস্ করে বলি, কানে কানে বলি, কেউ ইশারায়ও বলি। আবার এসব কথা যাতে প্রকাশ না পায় সে জন্য অনেক সতর্কতা অবলম্বন করে বলি, ‘দেয়ালেরও কান আছে’। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো গোপন কথা ফাঁসের ক্ষেত্রে এই কথাটি যথার্থ নয়। কারণ দেয়ালের কান থাকলেও দেয়ালের মুখ নেই। সুতরাং প্রতীকী অর্থে দেয়াল শুনলেও বলতে পারবে না। কারণ তার মুখ নেই। আসলে ভুল শোনার চেয়ে ভুল তথ্য শোনানোর বিপদ আরো বেশি। নানান কথার যন্ত্র এই মুখই হচ্ছে প্রধান সমস্যা, অর্থাৎ মুখের কথায় যতই আমরা বলি এক কথার মানুষ—কথাটা ঠিক নয়। ঈশ্বর আমাদের একটি মুখ ও দুটি কান দিয়েছেন যাতে বেশি করে শুনি এবং কম করে বলি; কিন্তু এই এক মুখে আমরা হাজার কথা বলি। এই কথা নিয়েও অনেক কথা আছে। কারণ কোন কথা মূল কথা, আসল কথা, সার কথা, কান কথা, শোনা কথা, কথার কথা, কথা রাখার কথা, না রাখার কথা, কথা দেওয়ার কথা, না দেওয়ার কথা, এরপর আছে মোদ্দা কথা। এবার সেই মোদ্দা কথায় আসা যাক। কিন্তু এই মোদ্দা কথা নাকি বেশি বলা হয় ‘রাজনাীতির কথায়’। যদিও রাজনীতি শাস্ত্রে বলাই আছে, রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নাই। রাজনীতিতে কেউ চোখের জলে সিক্ত হয়—কেউ প্রশংসায় অভিসিক্ত হয়। এইসব কথার তালি গালি নিয়ে আবার জবর খবর হয়। ঘটিত ঘটনার গঠিত বিবরণ পঠিত হয় ভিন্ন ভিন্ন কথায় নানা কণ্ঠে, নানা পর্দায়। নিজস্ব কায়দায় ও বিশ্বাসে। যার সম্পর্কে যেভাবেই বলা হোক না কেন কিংবা যেভাবেই বলি না কেন, আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের মনের কথা আর মুখের কথা এক নয়। এদের মুখ একটা হলেও মুখোশ থাকে অনেক। সে জন্যই বলে ভোল পাল্টানো বোল যাদের—মনের গণ্ডগোল তাদের। সুতরাং তাদের কথা বলে লাভ নেই। আবার এই কথার বাজার হচ্ছে, নির্বাচনী আচার। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্তত জনসাধারণের কাছে। সেটা জাতীয় বা স্থানীয় যে নির্বাচনই হোক। পণ্যের প্রচার প্রচারণে কিছু বিধি থাকলেও নির্বাচনী প্রচারে আচার-বিচার জানতে এবং মানতে খুব একটা দেখা যায় না। তখন মূলত শুরু হয় আত্মপ্রচারের মহোৎসব। চারিত্রিক সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য নানা এলাকায় আমদানি হয় নানান কিসিমের ব্যক্তিত্ব। এদের মধ্যে মাস্তানজাতীয় ব্যক্তিত্বও(!) আছে। এদের সম্মিলিত প্রচারণার কারণে এলাকায় যে শব্দজট সৃষ্টি হয় সেই জট খুলে চট করে কিছু বোঝা সম্ভব হয় না।

নির্বাচন ছিল, নির্বাচন আছে, নির্বাচন থাকবে। কোন নির্বাচন কেমন সেই বিষয়ে আমরা যাব না। কারণ আমাদের বিষয় কথামালা বা কথা বলা। সেই কথারই একটি রূপকে বলা হয় বক্তৃতা, কেউ বলেন ভাষণ। তবে ভাষণ হয় খুবই ‘মূল্যবান’। কারণ এ সময় মাইকে মাইকে অমায়িক কণ্ঠে বলা হয় মূল্যবান ভাষণ দেবেন জনদরদি সংগ্রামী জননেতা, বিপ্লবী কণ্ঠস্বর, এলাকার গর্ব—এমনি বিশেষণের নানান ঘোষণা শোনার পর একসময় বক্তার নাম জানা যায়। তবে এসব ভাষণের মূল্য কত সেটা নির্ধারণ করেন সাধারণ মানুষ। এসব নির্বাচনে আর যাই থাক না থাক থাকে গরম গরম চড়া গলায় কড়া ভাষায় ভাষণের ছড়াছড়ি। শ্রাব্য-অশ্রাব্য, শোভন-অশোভন, শালীন-অশালীন কথামালা। এইসব ভাষণ আবার নানান গড়নের, নানান ধরনের হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ভাষণ হচ্ছে বিবরণধর্মী ভাষণ, প্রশ্নধর্মী ভাষণ, বিদ্রূপাত্মক ভাষণ (পিন দেওয়া বা প্রতিপক্ষকে খোঁচা দেওয়া সম্পর্কিত) এবং উত্তেজনাধর্মী ভাষণ।

বিবরণধর্মী ভাষণে প্রার্থী তার অতীত কর্মকাণ্ডের বর্ণনা তুলে ধরেন। যেমন—ভাইসব আপনারা জানেন এই গ্রামের উন্নতির জন্য আমি কী করেছি। গ্রামে স্কুল করেছি, কলেজ করেছি, বিশ্ববিদ্যালয় করব। গ্রামের প্রতিটি কোনায় কোনায় শিক্ষার আলো ছড়াইয়া দিয়েছি। (বক্তৃতার মাঝে মাঝে আঞ্চলিক ভাষা এসে যায়)। শুধু তাই নয়—বর্ষায় কি আপনাদের পায়ে কাঁদা লাগে? লাগে না। লাগবে কি করে—কাদা লাগতে হইলে কাঁচা রাস্তা দরকার। এই গ্রামে একটি রাস্তাও কাঁচা পাবেন না। আমি আপনাদের চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট করেছি। বাজারের সংস্কার করেছি। শুধু তাই নয়, খালপাড় হয়ে বাজারে যাওয়ার জন্য যে বাঁশের সাঁকো তৈরি হয়েছে, সেই বাঁশ তো আপনাদের দিছি আমি! বিনা মূল্যে। আমি…(চলতে থাকে) এ ধরনের ভাষণ অনেক দীর্ঘ হয় কারণ কাজ করুক আর না করুক ফিরিস্তি মোটামুটি একই রকম থাকে এবং সেটা অনেক লম্বা। কেউ আন্দাজ করতে পারেন না উনি কখন থামবেন। আর উনিও বুঝতে পারেন না তার কখন থামা উচিত। তাই পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা চাটুকাররা স্মরণ করিয়ে দেন—হুজুর এখন থামা উচিত। হুজুরও থামেন।

এরপরে প্রশ্নধর্মী ভাষণ-এ ধরনের ভাষণের শুরু নবাবী আমল থেকে। অর্থাৎ নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকেও আমরা বহুবার শুনেছি। সেই যে দরাজ গলায় বলতেন, বর্গির হাঙ্গামার কথা তোমাদের মনে আছে? বর্গির হাঙ্গামার সময় নবাব আলী বর্দীর সঙ্গে সঙ্গে সমরে শিবিরে, দিবসে-নিশীথে আমিও কি ছুটে বেড়াইনি? আমার হাতের অস্ত্র কি মারাঠা দস্যুদের উদ্ধত শির দ্বিখণ্ডিত করেনি। তারই পুরস্কার কি এ কণ্টকাসন? তারই পুরস্কার কি ওই ছিন্ন পাদুকা? তারই পুরস্কার কি তস্করলব্ধ লাঞ্ছনা?

সেই থেকে এ পর্যন্ত এই প্রশ্নধর্মী ভাষণ চলে এলেও এখনকার ভাষণের ভূষণ গ্যাছে পাল্টে। এখনকার প্রশ্নধর্মী ভাষণে জনগণের জন্য তেমন কিছুই থাকে না। থাকে আত্মপ্রশংসা আর প্রতিপক্ষের প্রতি কুৎসা রটনা। যেমন-ভাইসব এই গ্রামের উন্নয়ন কে করেছে? আমার অবদান কি আপনাদের চোখে পড়ে না? এই এলাকার রাস্তাঘাট কি আমি বানাই নাই? ভাঙা স্কুল কি আমি মেরামত করি নাই? আর আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কী করেছে? সে কি রিলিফের টিন চুরি করে নাই? বাজার ইজারা লইয়া মাস্তানি করে নাই? এলাকার সমস্ত কাজের কমিশন খায় কে? এলাকা ছাইড়া সেকি ঢাকায় পইড়া থাকে নাই? আমার সঙ্গে তার তুলনা হয় কিভাবে?

প্রশ্নের শেষ নেই। তবে মজার ব্যাপার হলো এলাকার মানুষের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর সব জানা; কিন্তু এই জাতীয় বক্তারা তা বোঝেন না।

এবারে বিদ্রূপাত্মক ভাষণ অর্থাৎ অন্য প্রার্থীকে খোঁচা দেওয়া। এই ভাষণের শুরুটা এভাবে,—

ভাইসব আমার সম্পর্কে আপনারা সব জানেন। আমি খানদানি ঘরের ছেলে। আমার বাপের অনেক আছে কিন্তু ওনার? আমি কি পাস সবাই জানেন কিন্তু উনি? আমার কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স নাই আমি কালো টাকা হোয়াইটও করি নাই কিন্তু উনি? বিদেশি ব্যাংকে আমার কোনো টাকা নাই কিন্তু ওনার? আমি জনগণ নিয়া চলি, জনগণের জন্য কথা বলি। জনগণের জন্য রাজনীতি করি কিন্তু উনি? আমি তো সবসময় এলাকার উন্নয়নের চিন্তা করছি কিন্তু উনি কী করছে—সেটা তো আপনারা জানেন।

এ ধরনের খোঁচা সর্বস্ব ভাষণের বক্তব্য অন্যকে উত্তেজিত করে এবং তা স্বভাবতই অশান্তি বাড়ায়। অবশেষে উত্তেজনাধর্মী ভাষণ—এ ধরনের ভাষণেও মূলত জনগণের জন্য কিছু থাকে না। থাকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রতি তর্জন-গর্জন এবং হুংকার। এই ভাষণ দেওয়ার সময় মাইক না হলেও চলে কারণ গলা তখন সপ্তমে থাকে। কেন জানি এ জাতীয় বক্তারা আস্তে কথা বলতে পারেন না, চিত্কার দিয়ে বলতে থাকেন—

ভাইসব, আপনাদের সাক্ষী রেখে আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই, বহুৎ সহ্য করেছি কিন্তু আর না আমি কিল খেয়ে কিল হজম করার মানুষ না। আর একবারও যদি আমার বিপক্ষের প্রার্থী আমার নামে কোনো গিবত গায় তাহলে আমি এই এলাকায় তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করব। আমার কর্মীরা তাকে এলাকায় ঢুকতে দেবে না—বইলা দিলাম। খামোস্ (হঠাৎ হুংকার দিয়ে ওঠেন) ইটের জবাব আমি পাথর দিয়া দেব। বলেন আপনারা কি তৈরি? (তার খাস লোকজন হাত উঁচিয়ে জানিয়ে দেয় তৈরি)। তবে এই ধরনের কাজের জন্য অন্য কেউ তৈরি নয়। তৈরি শুধু তারাই যারা তার অনুসারী এবং এ ধরনের ভাষণে প্রার্থী যতই আর্তি জানান না কেন কিছুই আসে যায় না। কারণ মানুষ কথায় বিশ্বাসী নয়, কাজে বিশ্বাসী হতে চায়। তাই এসব কথায় সাধারণ মানুষ খুব একটা আমলে নেয় না। যে কারণে এসব ভাষণের কথায় কথা বাড়ানো হয়—কথা ছড়ানো হয়। কথার প্যাঁচে অন্যকে জড়ানো হয়। ফলে নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়। কথায় কথা বাড়ে এটা যেমন ঠিক তেমনি কথায় কথায় বেঠিক কথাও সঠিক হয়ে যেতে পারে। তাই কথারও একটা মাপ থাকা প্রয়োজন। মানুষ যে ধরনের ভাষণ শুনতে চায় তা হলো গঠনমূলক, সমঝোতামূলক এবং জনহৃদয়স্পর্ষী ভাষণ, যা খুব একটা দেখা যায় না, শোনাও যায় না।

ভাষণ থেকে টক এ আসি। শুরুতেই গোলটেবিল টক। এসব টকে থাকেন আয়োজক এবং আমন্ত্রিত আলোচক। থাকে নানা জনের নানান মত। কারো কথা তেতো—কারোটা টক। কারো কথায় ঝাঁজ কারোটায় ধক। কখনো বিষয় হয় বিস্তৃত এবং ব্যাপক। কখনো বা নিষ্ফল বকবক। এসব কথায়ও কথা বাড়ে, মাথায় ব্যথা বাড়ে, যেটা কমে সেটা হলো কাজ। অথচ শুধু কথা বলাই অনেকের প্রধান ব্যবসা আজ। গোলটেবিল থেকে রাত জাগা টক শোতে আসা যাক। এ ব্যাপারে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। দুই বন্ধুর মধ্যে কথা হচ্ছে—একজন জিজ্ঞেস করল, বলতো টক শো মানে কি?

বন্ধুটি উত্তর দিল, প্রথম অংশ এদের দ্বিতীয় অংশ আমাদের।

মানে?

দ্বিতীয় বন্ধু উত্তর দিল—মানে হচ্ছে ওরা টক করে আর আমাদের বলে শো। অর্থাৎ শুয়ে পড়। আমরাও শুয়ে ঘুমিয়ে যাই। তাই বলে টক শোতো থেমে থাকতে পারে না চলবেই। চলেছে-চলছে-চলবে। তবে টক শো দেখে যাতে কারো এমন অবস্থা না হয় সেটাই কাম্য। আসলে মাইক্রোফোন পেলে বা মাইক্রোফোনে এলে, ‘কথা কম কাজ বেশি’ এই বাক্যটি অনেকেই মনে রাখতে পারেন না। তাই তর্কে কেউ কারো কাছে হারেন না। অনেক বক্তা এটাও ভুলে যান যে শ্রোতাদের মধ্যে তাদের চেয়ে জ্ঞানী বা গুণী মানুষ থাকতে পারেন। এমন মানুষও থাকতে পারেন যাদের কাছে এসব কথার কোনো প্রয়োজনই নেই, মূল্যও নেই। সত্য কথা বলতে কি—সেই মানুষের সংখ্যাই শতকরা আশি ভাগ। যারা উদয়াস্ত জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত। কথায় আছে, ‘কথায় চিড়ে ভেজে না’, আসলেই এই শ্রেণির মানুষের কাছে এসব কথার কোনো গুরুত্ব নেই। তবে কথায় চিড়ে না ভিজলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ ভেজে। কারণ যারা ভালো মানুষ সেজে, মানুষ ভেজে খান তাদের কথার তেজে লেজে গোবরে অবস্থা হয় অনেকেরই। কথা দিয়ে যেমন মানুষ চেনা দায়, কথা দিয়ে তেমনি মানুষ চেনাও যায়। এ প্রসঙ্গে এক নেতার গল্প বলে লেখাটি শেষ করব। অত্যন্ত উত্তেজিত ভঙ্গিতে তিনি এলাকায় একজন শিক্ষকের বাসায় গেলেন। শিক্ষক এলাকায় বেশ পরিচিত এবং সম্মানিত ব্যক্তি। সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। চেয়ারম্যানের উত্তেজনা দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,—

: কি ব্যাপার চেয়ারম্যান সাহেব আপনি এভাবে ফোঁস ফোঁস করছেন কেন?

: রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে

চেয়ারম্যানের কথা শুনে শিক্ষক অবাক।

: কি বলেন? আপনার মত প্রভাবশালী, বিত্তশালী, শক্তিশালী চেয়ারম্যানের রাগের কারণ থাকতে পারে কিন্তু দুঃখটা তো আপনার চরিত্রের সঙ্গে যায় না।

চেয়ারম্যান আবার বলতে শুরু করলেন—

: আমরা কোথায় যাচ্ছি চিন্তা করছেন। এই ঈদের সময় প্রকাশ্য দিবালোকে এক মহিলার কানের দুলসহ কান আর পুরো ঈদের বাজার রিকশা থামিয়ে নিয়ে গেল, নিজের চোখে দেখলাম।

: আপনার চোখের সামনে ঘটল?

: তবে আর বলছি কি? শুধু আমার না অনেকের চোখের সামনে ঘটল। কেহ কিছু বলতে পারল না। সন্ত্রাস-মহাসন্ত্রাস-এসব কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।

: তাতো বটেই। তা আপনি কী করলেন? শিক্ষক জানতে চাইলেন।

: চেয়ে চেয়ে দেখলাম। একটা মানুষও প্রতিবাদ করল না, দেখে অবাক হলাম।

: ওই একটা মানুষের মধ্যে তো আপনিও পড়েন—আপনি প্রতিবাদ করলেন না কেন? আপনি তো একজন প্রভাবশালী লোক, ক্ষমতাবান। এলাকার নেতা। শিক্ষক বিরক্ত হয়ে বললেন।

: দেখেন মাস্টার সাহেব—আমি তো বসে থাকিনি। আমি ঠিকই আমার কাজ করেছি। চেয়ারম্যান হিসেবে এসব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছি। তারপর খুব কঠিন ভাষায় তীব্র নিন্দা প্রকাশ, উষ্মা প্রকাশ, ক্ষোভ প্রকাশ, উদ্বেগ প্রকাশসহ যত রকমের প্রকাশ-প্রতিক্রিয়া আছে সবগুলোই করেছি। এ ছাড়া বিভিন্ন চ্যানেলে কয়েকটি টক শোতে কথা বলেছি। আর কয়েকটা চ্যানেল লাইনে আছে, সেখানেও বলব। এ ছাড়া আর কী কী করা যায় ভাবছি।

শিক্ষক অনেকক্ষণ চুপ করে শুনলেন—তারপর মৃদুস্বরে বললেন,

: আপনারা ভাবতে থাকুন আর ওরা ওদের কাজ করতে থাকুক। এসব আবেগহীন, উদ্বেগ প্রকাশে কোনো লাভ হবে না। বরং তাত্ক্ষণিকভাবে আপনাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত ছিল। তাহলে সবার প্রতিরোধের মুখে ও আত্মসমর্পণে বাধ্য হতো। কিন্তু আপনারা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখলেন—এটাই তো আপনাদের দোষ।

চেয়ারম্যান নির্দোষের ভঙ্গিমায় বললেন,

: আমি আবার কি দোষ করলাম?

: অনেক দোষ। শুধু আপনার নয়—আমাদের সবারই। আমরা কেউই নিজেদের দোষ দেখি না। সবসময় অন্যের দোষ ধরতেই ব্যস্ত থাকি। নইলে সরকারের ওপর চাপিয়ে দিই। এই যে ধরুন ঈদের সময় বাস-লঞ্চে ভাড়া বাড়ে—এটা বাড়ায় কারা?

আমরা।

ঈদের সময় ফাইল ঠেকিয়ে যে ঘুষ নেয়, সেটা করে কারা?

আমরা।

ঈদের সময় কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকিট কিনে তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে কে? আমরা—

ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই লঞ্চে ওঠা নিষেধ থাকলেও লঞ্চে উঠছে কারা? আমরা—

সুতরাং সবসময় কর্তৃপক্ষের দোষ দিলে চলবে না। আমাদেরও সচেতন হতে হবে। মনে রাখবেন আত্মশুদ্ধিই হচ্ছে বড় ওষুধ। মুখে বলে আর কাগজে লিখে অনেক কথাই প্রকাশ করা যায়। অনেক উপদেশ-নির্দেশ দেওয়া যায় কিন্তু নিজে সেই কাজটি অন্তরে লালন এবং কাজে আন্তরিকভাবে পালন যদি করা না যায় তবে মুখের কথা যাবে সরে আর লেখার পাতা যাবে ঝরে। তাই লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন আমাদের কর্মক্ষেত্রের সর্বক্ষেত্রে আমরা যেন সতর্ক থেকে সতত সৎ এবং সততা নিয়ে চলতে পারি—বলতে পারি সত্য কথা। কথায় আছে, দিন যায় কথা থাকে। সেই কথার বড় কথা হলো দিন যায় কিন্তু সমান যায় না। তাই সুদিনে দুর্দিনের কথাটা মাথায় রাখা ভালো।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
Alternative Textহানিফ সংকেত- র আরো পোষ্ট দেখুন