আট কুঠুরি নয় দরজা-০১

opwnl5laxz4_1483779885_215l
দুরন্ত গতিতে লাল মারুতিটা ছুটে যাচ্ছিল।
তখন আকাশে শেষ বিকেলের চোরা আলো পঞ্চাশের রূপসীর হাসির মত অপূর্ব মায়াময়। পাহাড়ি রাস্তায় একদিকে পাথরের আড়াল অন্যদিকে আদিগন্ত সেই আকাশ আর আকাশ। রাস্তাটায় আপাতত কোনও বাক নেই বলে গতি বাড়ছিল গাড়ির। হাওয়ারা পৃথার শ্যাম্পূ ধোওয়া চুল ঢেউ তুলছিল। ইচ্ছে মতন। স্টিয়ারিং-এ বসে স্বজনের মনে হচ্ছিল সে বিজ্ঞাপনের ছবি দেখছে।
হঠাৎ গাড়ির গতি কমে গেল। পৃথকে বিস্মিত করে ব্রেকে শেষ চাপ দিয়ে স্বজন বলল, এই আমাকে একটু আদর করবে?
সঙ্গে সঙ্গে দুহাত বাড়িয়ে সমুদ্র হয়ে এল পৃথা। নিজেকে খড়কুটো ভাবতে ওই সময় কী আরামই না লাগে! সব মেয়ে কি পৃথার মত এই রকম আদর করতে পারে। স্বজন কোথায় যেন পড়েছিল অযত্নে অবহেলায় ঈশ্বর জন্মলগ্নেই বাঙালি মেয়েদের শরীর এবং মনে সংকোচ শব্দটাকে এটে দিয়েছেন। পৃথা ব্যতিক্রম। তাই আনন্দ।
ঝড় থেমে যাওয়ায় পরও যেমন হাওয়ারা বয়ে যায় তেমনি পৃথা বলল, আই লাভ ইউ।
উঁহু, ওভাবে নয়।
তার মানে?
ওই পাহাড়ের দিকে মুখ করে চিৎকার করো শব্দ তিনটে, পাহাড় আমাকে শোনাবে।
ঝটপট দরজা খুলে নেমে গেল পৃথা। শূন্য চরাচরে শুধু নীড়ে ফেরা পাখিরাই এখন সঙ্গ দিচ্ছে। কোনও গাড়ি নেই, মানুষ তো বহুদূরের। পৃথা মুখ তুলে শেষ শক্তি দিয়ে যখন শব্দ তিনটে উচ্চারণ করল তখন তার নাভিতে ঈষৎ কুঞ্চন। আর সমস্ত আকাশ গেয়ে উঠল গান, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ।
প্ৰতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সে ঘুরে দাঁড়াল, আর তুমি?
তুমি আমার ভাঙা দাওয়ায় স্বর্ণচাঁপা রাজেন্দ্ৰানী!
ফ্যান্টাসিটক। কার লাইন?
এই মুহুর্তে আমার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীকে চাই না। স্বজন গাড়িতে বসেই হাসল।
চোখ বন্ধ করে মুখ আকাশে তুলল পৃথা। স্বজনের মনে এল এক ছবি। ছবির নাম ঈশ্বরী।
ও পাশের আকাশে এখন ধুন্দুমার রঙের খেলা। সূর্যদেব পাটে যেতে বসেছেন। তার বাস এখন পৃথিবীর তলায়। রাস্তায় ধারে গিয়েও বুকে দর্শন পাওয়া যাবে না। আকাশটা কেমন নীলচে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
স্বজন ডাকল, উঠে এসো।
পৃথা কয়েক পা এগোল, আই, তুমি সরো, আমি চালাই। পাহাড়ি রাস্তা। থার্ড গিয়ারেই তোলা যাবে না বেশির ভাগ সময়। ঠিক আছে, চলে এসো, সাধ পূর্ণ করো।
অতএব লাল মারুতির স্টিয়ারিং-এ পৃথা, পাশের জানলায় স্বজন। পা হাত এবং চোখ জুড়ে যে সতর্কতা তা এখন পৃথকে নিবিষ্ট রেখেছে। গাড়ি উঠেছে উপরে। স্বজন ঘড়ি দেখল, এই গতিতে গেলেও পাহাড় ডিঙিয়ে শহরে পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে যাবে। টুরিস্ট লজে একটা ঘর তাদের নামে স্থির করা হয়েছে আগাম। ডান দিকে এখন নদী, অনেক নীচে অদ্ভুত গোঙানি তুলে ছুটে যাচ্ছে। মারুতির চোখ জ্বলেছে এর মধ্যে। আকাশে ধূপছায়া আঁধার কুপকুপ করে চেহারা পাল্টাচ্ছে। সতর্ক হাতে গাড়ি চালাবার সময় পৃথার কথা বন্ধ হয়ে যাবে। আর এখন বাকের পর বাক। দু মাসের বিবাহিত জীবনে এমন সিরিয়াস মুখের পৃথকে কখনও দ্যাখেনি স্বজন।
বিয়ের পর হানিমুন বলতে যা বোঝায় তা হয়নি ওদের। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে প্ৰায় সতের ঘন্টাই নিঃশ্বাস ফেলার সময় হয় না। স্বজনের। নিজেকে গড়ার সময়গুলো থেকে গত দুইমাস একটুও আলাদা করতে পারেনি। স্বজন। আর তাই পৃথা মাঝে মাঝেই ঠোঁট ফোলায়। তাই এবার যখন সিনিয়র ডেকে বললেন অফারটা নিতে তখন সামান্য দ্বিধা সত্ত্বেও রাজি হয়ে গিয়েছিল সে। এতটা পথ পৃথার সঙ্গে এক গাড়িতে যাওয়া আসা করা যাবে। এক টুরিস্ট লজে চমৎকার আবহাওয়ায় থাকা যাবে। এটা তো বাড়তি লাভ। সে যে তারই একটা কাজের সুবাদে এদিকে আসছে তা পৃথকেও জানায়নি, জানলে পৃথার আনন্দটা ফিকে হয়ে যেতে পারে।
ডাক্তারি পড়ার সময় থেকেই স্বজনের বাসনা ছিল আর পাচজনের মত চেম্বার সাজিয়ে পেশেন্ট দেখবে না। দু-বেলা। একটি বিশেষ বিভাগ, যার চর্চা ভারতবর্ষে এর আগে তেমন ব্যাপকভাবে হয়নি তাঁকে আকর্ষণ করেছিল। তখন থেকেই সিনিয়রের সঙ্গে তার গাঁটছড়া। মাঝখানে বছর দুয়েকের জন্য জাপানে গিয়েছিল ওই বিষয় নিয়ে বিশদ পড়াশুনা করতে। ফিরে এসে কাজ শুরু করে দেখল তার চাহিদা পাড়ার জনপ্রিয় ডক্তারবাবুর চেয়ে কম নয়। সতের ঘন্টাই কেটে যাচ্ছে এ ব্যাপারে। ফলে পৃথা অসম্ভষ্ট হতেই পারে। অর্থ আসছে কিন্তু পৃথার কাছে অর্থই শেষ কথা নয়। এ বার ওরা তাকে প্লেন ভাড়া দিয়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। এয়ারপোর্টে গাড়ি রাখতে চেয়েছিল। পৃথকে নিয়ে লম্বা পাড়ি দেবার লোভে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গাড়ি চালিয়েই আসছে। পৃথা যেমন জানে না সে চিকিৎসার কারণে পাড়ি দিচ্ছে তেমনই ওরাও জানে না পৃথা সঙ্গে আসছে। স্বজনের ধারণাপেশেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ লোক। তাকে পাহাড় থেকে নামানো যাচ্ছে না। চিকিৎসার জন্যে যা যা দরকার তার তালিকা সে পাঠিয়ে দিয়েছে। মানুষটি অবশ্যই বিত্তবান। মাঝখানে তার সিনিয়র থাকায় এ বিষয়ে বেশি কৌতূহল দেখায়নি। স্বজন। এখন কেবলই মনে হচ্ছিল সে যে একটা কাজেই এতদূর এসেছে তা জানলে পৃথা কি ভাবে নেবে? কি ভাবে ওকে ঠান্ডা করা যায়!
পাহাড়ের বাকিগুলো ক্রমশ মারাত্মক হয়ে উঠেছে। একটা হাল্কা সরের মত আলো ছড়িয়েছে এখন। গাছেদের পাহাড়ের ছায়ার ফাকে ফাঁকে কখনও সেটা রাস্তায় নেতিয়ে পড়ছে। পেছন থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ ভেসে এল। দক্ষ ড্রাইভারের হাতে বেশ জোরেই উঠে আসছে সেটা। সেই সঙ্গে অনেক মানুষের গলার আওয়াজ। লোকগুলো যেন পিকনিক করতে যাচ্ছে। মুখ ঘুরিয়ে স্বজন দেখল একটা বড় ভ্যান উঠে আসছে অনেক লোক নিয়ে। সে পৃথকে বলল, চওড়া জায়গা দেখে ওকে সাইড দাও।
চওড়া জায়গা খুঁজে পাওয়ার আগেই ভ্যানটা ঘড়ের ওপর এসে পড়ল। পৃথা নার্ভাস হাতে স্টিয়ারিং ঘোরাল এবং ব্রেক চাপল। ভ্যানটা জায়গা পেয়ে ছুটে গোল ওপরে এবং সেই সঙ্গে মানুষগুলোর উল্লাস আকাশে পৌঁছে গেল। মারুতি গাড়িটা তখন পাহাড়ের এক ধারে জমানো পাথরের ওপর চাকা তুলে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেছে। পৃথা চিৎকার করে উঠল, বদমাশ! সে হাপাচ্ছিল।
অ্যাকসিডেন্টটা হতে গিয়েও হল না। স্বজন নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর পৃথকে শান্ত করতেই বলল, ওটা খুব নিরীহ গালাগাল।
মানে? পৃথা চকিত মুখ ফেরাল।
তোমার স্টকে কি রকম গালাগাল আছে?
ও গড! তুমি ইয়ার্কি মারছ? আর একটু হলেই-।
স্বজন দরজা খুলে নামল। গাড়িটা একটা দিকে কাত হয়ে আছে। নামতে গিয়ে দুলিয়ে দিল স্বজন। পৃথাও নেমে এল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হল ক্ষতি তেমন কিছু হয়নি। দুজনে ধরাধরি করে পাথরটা থেকে নামিয়ে আনল গাড়িটাকে স্বজন বলল, লোকে ঠাট্টা করে বলে মুড়ির টিন। ভারী হলে সারারাত এখানেই বসে থাকতে হত। এবার যদি অনুমতি দাও আমি চালাতে পারি।
কথা না বাড়িয়ে পৃথা গাড়িটাকে ঘুরে এল এ পাশের দরজায়। এসে নাক টেনে বলল, পেট্রলের গন্ধ পাচ্ছি।
গন্ধ স্বজনও পেয়েছিল। সামান্য ঠেলতেই দেখা গেল পেট্রল পড়ছে টপটপ করে। গাড়ির পেট্ৰল ট্যাঙ্কটা ফুটো হয়েছে নিশ্চয়ই। স্বজন অসহায়ের মত জিজ্ঞাসা করল। সাবান নেই, না?
থাকলে টেস্পোরারি বন্ধ করা যেত।
সাবান সুটকেসে আছে। নতুন সাবান।
সঙ্গে সঙ্গে পেছনের সিট থেকে সুটকেশ বের করে রাস্তায় রেখে ডালা খোলা হল। প্যাকেট থেকে সাবান বের করে স্বজন চলে গেল ট্যাস্কের গর্ত খুঁজতে। এই নিচু গাড়ির পেট্রল ট্যাস্কের তলায় হাত পৌঁছাচ্ছে না। তার। অনেক চেষ্টার পর ভিজে। একটা উৎস খুঁজে অন্ধকারেই সাবানের প্রলেপ দেবার চেষ্টা করল সে। টর্চ ছাড়া সেটা প্ৰায় অসম্ভব।
মিনিটখানেক চলার পরেই পৃথা বলল, আবার গন্ধটা পাচ্ছি।
স্বজন নামল। হ্যাঁ, রাস্তায় পেট্রল পড়ার চিহ্ন ছড়ানো। অর্থাৎ সাবানে কোনও কাজ হয়নি এই রকম অবস্থায় ট্যাস্কের শেষ হবার আগে কিছুতেই শহরে পৌঁছানো যাবে না। সে তাড়াতাড়ি নিজের আসনে ফিরে এসেই গাড়ি চালু করল। যত দ্রুত ওপরে ওঠা যায় ততই বাঁচোয়া। অয়েল ইন্ডিকেটারের কাঁটাটা নীচে নামতে শুরু করেছে। ইচ্ছে করলেই এই রাস্তায় যাট কিলোমিটার স্পিড তোলা যায় না।
পৃথা জিজ্ঞাসা করল, পৌঁছাতে পাবে? মনে হয় না। সামনে যদি কোনও পাস্প থাকে- বেশ জোরেই পড়ছে বলে মনে হচ্ছে।
সারারাত এই রাস্তায় বসে থাকতে হবে দেখছি।
কাছাকাছি কোনও রেস্টহাউস নেই?
স্বজন হেসে ফেলল। কিন্তু তার চোখ বলে দিল সময় বেশি নেই। পেট্রল পড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়ি ছোটালে বড়জোর দশ কিলোমিটার যাওয়া যাবে। এখন যতটুকু যাওয়া যায় ততটুকুই লাভ। খানিকটা এগোবার পর প্রাইভেট লেখা একটা বোর্ড তার নজরে এল। পাশ দিয়ে একটা কাটা রাস্তা ওপরে চলে গিয়েছে। একটুও না ভেবে সে গাড়িটাকে ওই রাস্তায় তুলে দিল। ইঞ্জিন খানিকটা আপত্তি করে ওপরে উঠেই প্রায় সমান পথ পেয়ে গেল। দুপাশে জঙ্গল এবং পথটা সরু। মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর হঠাৎ স্থির হয়ে গেল গাড়িটা। পৃথার মুখ থেকে ছিঁটকে এল, শেষ?
মালুম হচ্ছে।
তুমি এ দিকে এলে কেন? বড় রাস্তায় থাকলে অন্য গাড়ির হেল্প পেতাম।
ভাবলাম কাছে পিঠে কোনও বাড়ি আছে, ব্যাড লাক।
চারপাশে বড় বড় গাছের জঙ্গল। সরু পথটা ডানদিকে বেঁকে গিয়েছে। স্বজন হেডলাইটটা নিভিয়ে দিতেই অপূর্ব এক আলো ফুটে উঠল চরাচরে। চাঁদ উঠেছে পাহাড়ি আকাশে। গোলাকার চাঁদ নয়। ফলে তার আলোয় বিক্ৰম নেই। গাছেদের শরীরে, পাহাড়ের পাথরে মশারির মত নেভিয়ে আছে কিন্তু অদ্ভুত মায়াময়।
স্বজন বলল, ফ্যান্টাসিটক।
পৃথা জানালা দিয়ে দেখছিল। দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল। মুখ না ফিরিয়ে সে বলল, এমন চাদকেই বোধ হয়। ঘুম ঘুম চাঁদ বলে।
স্বজন বলল, আমি বাজি ধরে বলতে পারি, বড় রাস্তায় থাকলে তুমি পরিবেশের সাক্ষী হতে পারতে না। এই, একটা কিস দেবে?
না। আমি এখন চুপচাপ চাঁদ দেখব। পৃথা ঘোষণা করল।
স্বজন এবার জঙ্গলের দিকে তাকাল। অদ্ভুত সব আওয়াজ ভেসে আসছে। পাখি এবং পতঙ্গরা স্বরাজ্যে স্বাভাবিক হয়ে আছে। রাস্তার মুখে প্রাইভেট বোর্ড ট্যাঙানো ছিল। অতএব কাছে পিঠে বাড়ি থাকতে বাধ্য। কতদূরে? নেমে দেখতে হয়।
সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি হাঁটবে?
কোথায়?
আশ্চর্য এ ভাবে বসে থাকবে নাকি? কাছেই বাড়িটা রয়েছে।
তুমি কি করে জানলে?
থাকাটাই স্বাভাবিক। স্বজন গাড়ি থেকে নামছিল।
আমি একা বসে থাকব নাকি? জানালার কাছ তুলে দিয়ে দরজায় হাতলে চাপ দিল পৃথা।
জ্যোৎস্নায় পথ দেখা যাচ্ছে। কয়েক পা হাঁটতে না হাঁটতেই পৃথার গলায় গান ফুটল। মৃদু অথচ স্পষ্ট গলায় সে চাদের গান গাইতে লাগল স্বজনের একটা হাত জড়িয়ে। বাকটা ঘুরতেই ওরা দাঁড়িয়ে, গেল। পরিষ্কার একটা ভ্যালির ওপর ঝকঝকে বাংলোটা ছবির মত দাঁড়িয়ে। দূর থেকেই জ্যোৎস্নামাখা বাংলোটাকে ওদের ভাল লেগে গেল। সামনে একটা লম্বা বারান্দা রয়েছে। কিন্তু কোনও ঘরে আলো জ্বলছে না, জানালার কাচগুলো অন্ধকার।
কেউ নেই? পৃথার গলায় বিস্ময়।
না থাক। দরজা খুলতে পারলেই হল। মনে হচ্ছে এককালের কোনও সাহেবি বড়লোকের গ্রীষ্মবাস। গাড়িটাকে ওখানে রাখা ঠিক হবে?
চল, ঠেলে বাংলোর সামনে নিয়ে আসি।
ওরা ফিরল। এখন সমস্যাটা অনেক হালকা বলে মনে হচ্ছে। ঘড়িতে বেশি রাত হয়নি। ওরা গাড়ির কাছে পৌঁছে ঠেলতে লাগল। হাক্কা গাড়ি, সহজেই চলতে শুরু করল সেটা। বাকের কাছে পৌঁছানো মাত্র আওয়াজটা কানো এল। রাগী জানোয়ারের হুষ্কার। পৃথা চাপা গলায় বলল, কিসের আওয়াজ।
জীবনে প্রথমবার ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারল স্বজন, চটপট গাড়িতে উঠে বসো। সে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই পৃথাও পাশের আসনে চলে এল। আওয়াজটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে। স্বজন হেডলাইট জ্বালল এবং তখনই একটা প্রমাণ সাইজের চিতা বাঘ গম্ভীর চালে এসে দাঁড়াল যেখানে একটু আগে তারা দাঁড়িয়েছিল। গাড়ির দিকে হিংস চোখে তাকিয়ে আছে জন্তুটা।
পৃথা দ্রুত সরে আসার চেষ্টা করল স্বজনের কাছে, আমার ভয় করছে। ওই দ্যাখো, ওটা এগিয়ে আসছে।
স্বজন দেখল। হঠাৎ মনে হল হেডলাইটের আলো চিতাটাকে রাগী করে তুলতে পারে। স্বজন হেডলাইট নিভিয়ে দিতেই জঙ্গলটা যেন আদিম হয়ে উঠল। বাঘটাকে দেখা যাচ্ছে। গাড়ির দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হয় তো আলো আঁধারীর রহস্য বোঝার চেষ্টা করছে।
একটা রাতের পাখি ট্টিহা ট্টিহা আওয়াজ করে উড়ে গেল।
স্বজন ঘামছিল। এই গাড়িটা যদি একটা ভারী জিপ, নিদেন পক্ষে অ্যাম্বাসাডার হত তা হলেও কিছুটা নিরাপদ বলে মনে করা যেত। মারুতির শরীরটাকে চিতা খেলনা বলে মনে করতে পারে। যদিও কাছে আসার পর চিতাটাকে বেশি বড় মনে হচ্ছে না। তবু, স্বস্তি পাওয়ার কোনও জায়গা নেই। স্বজন শরীরে চাপ অনুভব করল। পৃথা গিয়ার টপকে তার বুকের কাছে চলে এসেছে। ওর শরীরের মিষ্টি গন্ধ এখন সর্বাঙ্গে টের পাচ্ছে সে। পৃথার মুখ দেখার চেষ্টা করল সে। ভয়ে সাদা হয়ে দিয়েছে পৃথা। সে পৃথার মাথায় হাত বোলাল, ভয় পেয়ো না, আমি আছি।
তুমি কি করবে?
মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বলব তুমি আছ আমি আছি।
আঃ। ভালো লাগছে না। দ্যাখো, আসছে।
চিতাটা এবার দুলকি চালে হেঁটে আসছিল। আলতো লাফে গাড়ির বনেটের ওপর উঠে দাঁড়াল। বিশাল মুখ খুলে হাই তুলল। ও যখন বনেটের ওপর উঠল তখন গাড়িতে যেন ভূমিকম্প হল। এবার চিতাটা উঠে গেল ছাদে। স্বজন ওপরে তাকাল। ছাদটা যেন সামান্য নিচু হয়ে গেল। পেছন দিকে নেমে গেল চিতাটা। তারপর হঠাৎই ছুটে এসে ধাক্কা মোরল পৃথার জানালায়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা ছিঁটকে সরে গিয়ে একটা গাছের গুড়িতে আটকে স্থির হল। পৃথা চিৎকার করে উঠল। আর স্বজন দ্রুত বলে উঠল, দরজা লক করো, তাড়াতাড়ি।
হুড়মুড়িয়ে পৃথা দরজার দিকে সরে গিয়ে লক হাতড়াতে লাগল। জানালার ওপাশে চিতার মুখ। কয়েক সেকেন্ড লকটাকে খুঁজে পাচ্ছিল না পৃথা। শেষ পর্যন্ত পেয়ে সেটাকে চেপে দিয়ে দু হাতে মুখ ঢাকল। চিতাটা সরে গেল খানিকটা তারপর লাফ দিল। মাথার ওপর দাঁড়াম শব্দটা যেন বোমা ফাটার চেয়েও ভয়ঙ্কর। গাড়ির ছাদটা যে অনেকটা বসে গিয়েছে তা সহজেই বুঝতে পারল স্বজন। তাই গাড়ি বেশিক্ষণ চিতাটাকে সামলাতে পারবে না। এখনও কাচে আঘাত করার বুদ্ধি ঢোকেনি চিতার মাথায়। সেটা করলেই তাদের সব আড়ালে শেষ।
রাজকীয় ভঙ্গিতে চিতাটা নেমে এল বনেটের ওপর। তারপর চার পা গুটিয়ে উইন্ডস্ক্রিনের দিকে মুখ করে বসল। একেবারে দেড় হাতের মধ্যে চিতার মুখ। একটা থাবা ছুঁড়লেই কাঁচটা ভেঙে যাবে। তারপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওদের দুজনের শরীরে খুঁজে পাবে না কেউ। একটা কিছু করা দরকার। এভাবে চুপচাপ ওর শিকার হওয়ার কোনও মানে হয় না। চিতাটা জ্বলজ্বল চোখে এখন পৃথার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু যদি নড়াচড়া দেখতে পায় তা হলেই আক্রমণ করবে। অতএব যেটুকু সময় পাওয়া যায় ততটুকুই জীবন। খালি হাতে এই জন্তটার সঙ্গে লড়াই করার
কোনও সুযোগই নেই। গাড়িতে কোনও অস্ত্র নেই। শুধু, হ্যাঁ, একটা লম্বা ভু-ড্রাইভার রয়েছে। ওটা নিয়ে কিছুই করা যাবে না।
বসে থাকতে চিতাটার যেন ঝিমুনি এল। থাবার ওপর মুখ রেখে সে চোখ বন্ধ করল। আরও একটু সময় পাওয়া যাচ্ছে তা হলো! এইভাবে শিকার সামনে রেখে চিতাটা ঘুমাচ্ছে কেন? স্বজনের মনে হল প্রাণীটা খুব একা। এবং বেশ খিদে পেয়েছে।
অনেকদিন পরে দুটো ভাল খাবার পেয়ে সামনে রেখে একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে মেজাজ করে খাবে বলে। সে আড়চোখে পৃথার দিকে তাকাল। পৃথা সেই একই ভঙ্গিতে সিটে হেলান দিয়ে পড়ে আছে। ও কি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে?
হঠাৎ কাছাকাছি একটা শব্দ হতেই চিতাটা চকিতে মুখ তুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে শব্দের উৎস খুঁজল। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল। স্বজনের মাথায় সেই মুহুর্তে চিন্তাটা চলকে উঠতেই হাত চলে গেল সুইচে। সঙ্গে সঙ্গে মারুতিটা ঘড়ঘড় করে আওয়াজ তুলল বনেট কাঁপিয়ে। আর সেই শব্দ পায়ের তলায় পেতেই চিতাটা লাফ দিয়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। প্ৰাণীটিকে এই প্ৰথম ভয় পেতে দেখল। স্বজন। সে ক্ৰমাগত ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করে যেতে লাগল। পেট্রলের অভাবে গাড়িটা নড়ছিল না এতটুকুও। সে হেড লাইট জ্বেলে দিল। ব্যাটারি ডাউন হোক সে শব্দ করে যাবে।
কি করছ? ফ্যাসফেসে গলায় পৃথা জিজ্ঞাসা করল।
চুপ করো।
মিনিট তিনেক আওয়াজ করার পর স্বজন থামল। চিতাটা আর সামনে আসেনি। হয়তো ঝোপের আড়ালে বসে লক্ষ করে যাচ্ছে। এতক্ষণে পেছনের আসনে নজর দেবার অবকাশ পেল স্বজন। দুটো সুটকেশ রয়েছে সেখানে। একটা সুটকেশ হাত বাড়িয়ে তুলে নিল সে। ভেতরে অপারেশন করার যন্ত্রপাতি রয়েছে। এ গুলো দিয়ে চিতা মারার কথা পৃথিবীতে কেউ কল্পনা করেনি।
হঠাৎ পেছনে একটা তীব্র ধাক্কা লাগল। এবং সেই সঙ্গে চিতার গর্জন। আর সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে গড়িয়ে যেতে লাগল গাড়িটা। চটপট স্টিয়ারিং ধরে ফেলল স্বজন। চিতাটা ধাক্কা দিচ্ছে পেছন থেকে। সেই ধাক্কার তীব্রতায় গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। বাক ঘোরাতেই ভ্যালির মুখে এসে পড়ল গাড়িটা। এবার স্বাভাবিক নিয়মেই নীচের দিকে গড়িয়ে চলল অনায়াসে। ব্রেকে পা নয়, শুধু স্টিয়ারিং কন্ট্রোল করে গাড়িটাকে বাংলোর সামনে নিয়ে এল স্বজন। এতটা পথ পেট্ৰল ছাড়াই তারা যেভাবে গাড়িটাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল তার থেকে অনেক দ্রুতবেগে পৌঁছাতে পারল। ব্রেকে চাপ দিয়ে গাড়ি থামিয়ে পেছনে তাকাল স্বজন। চিতাটা দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়েই বোধ হয় এ দিকে তাকিয়ে আছে। এক মিনিট দু-মিনিট, শেষ পর্যন্ত ফিরে গেল সেটা জঙ্গলে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেও তার কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
স্বজন তাকাল পৃথার দিকে, দৌড়াতে পারবে?
দৌড়াবে?
এক দৌড়ে বারান্দায় চলে আসবে। আমি বলা মাত্র।
তুমি কোথায় যাচ্ছ?
ওই দরজাটা খুলতেই হবে।
কি করে খুলবে? তোমার কাছে তো চাবি নেই। আর ওটা যদি ফিরে আসে?
এলে আসবে। এভাবে মরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। সুযোগ নিতেই হবে। বলতে বলতে স্কুরডাইভারটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে নিচু গাড়ির সামনেটা ঘুরে বরান্দায় চলে এল সে। একবার পেছন ফিরে দেখল ঢালু মাঠটায় কোনও প্রাণী নেই। দরজায় বড় তালা ঝুলছে। দ্বিতীয় দরজায় চলে এল সে। ভেতর থেকে বন্ধ। ওপরের কাচে সজোরে আঘাত করতেই সেটা ভেঙে পড়ল। হাত ঢুকিয়ে ছিটিকিনি নামাল সে।
এবার দরজা খুলল। সে চাপা গলায় ডাকল, এসো।
পৃথার দরজা খুলতে গিয়ে হতভম্ব, দরজা খুলছে না।
স্বজন দূর থেকেই বুঝল চিতার আঘাতে দরজাটা বেঁকে গিয়েছে। সে পৃথকে তার দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখল। দৌড়ে দরজার কাছে পৌঁছানো মাত্র মনে হল একটা আগুনের তীর ছুটে আসছে জঙ্গল থেকে। তাড়াতাড়ি পৃথকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করল স্বজন। ছিটিকিনি তুলে দিয়ে সে বড় নিঃশ্বাস ফেলতেই ধক করে গন্ধটা নাকে এল। পৃথা অন্ধকার ঘরে স্বজনের কাছে সরে এসে বলল, কী বিশ্ৰী গান্ধ!
বাইরে চিতাটা তখন গাড়িটার ওপর গর্জন করছে।
পৃথকে জড়িয়ে ধরে ঘরের ভেতরে স্বজন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। ডাক্তার হিসেবে সে জানে এ গন্ধ মানুষের শরীরের। পচে যাওয়ার পরেই এমন তীব্র হয়।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
সমরেশ মজুমদার- র আরো পোষ্ট দেখুন