দুপুরের দূরবীন

এই দুপুরটি অন্যরকম,
এই দুপুরটি বুকের উপর চেপে-বসা
নষ্ট দুপুর_
এই দুপুরটি শ্বাসরুদ্ধকর,
অবিশ্বাসের দোদোল দোলায়
অসহ্য এক ভ্রষ্ট দুপুর…
এই দুপুরটি জীবনগ্রাসী :
এই দুপুরটি আকাশউপুর
কান্না জরায় দু’চোখ পুকুর!

এই দুপুরটি বুকের ওপর
বিশাল ভারী কৃষ্ণপাথর,
জগদ্দল-ও বলতে পারো_
এই দুপুরটি কুরে খাচ্ছে
হাড়মাংস ও মজ্জাসহ;
এই দুপুরটি গলার কাছে
অস্বস্তিকর আটকে আছে,
এই দুপুরটি সকাল-দুপুর-রাত্রি ব্যেপে
অস্থিরতা বাড়ায় কেবল; …

উনিশশ’ বিরাশি সালে এভাবেই লিখেছিলাম ‘অপর দুপুর’। জীবনের এ এক অন্য দুপুর। এই দুপুরগুলো আসলেই অন্যরকম। জীবনে এমন অনেক দিন গেছে, যে দিনগুলোতে মনে হতো_ এই দুপুরটি একটু-একটু করে আমার জীবনটাকে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলছে। দুপুরগুলোই কখনও কখনও চোরাবালির মতো জীবনকে শুষে নিতে থাকে। আমাকে এবং আমার মতো অনেককেই হয়তো থামিয়ে দিতে চায় এই দুপুর। এমন শ্বাসরুদ্ধকর দুপুর গেছে_ যেখানে মনে হয়েছে এই বুঝি জীবনের অন্তিম মুহূর্ত, শেষ দৃশ্য। যেন পৃথিবীর শেষ সীমান্তে এসে গেছি, তারপর শূন্য_ অসীম। বুকের ওপর চেপে বসে থাকা এমন দুপুর শ্বাসরুদ্ধকর।
জন্ম-মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ে জীবনের যেমন নানা অধ্যায় আছে, তেমন অধ্যায় আছে আমাদের একেকটি দিনেরও। দুপুর একটি দিনের এমনই এক অধ্যায় যেখানে এসে ঝিমিয়ে পড়তে চায় জীবন। রাত তো নির্জন_ দুপুরটা তার চেয়েও বড্ড বেশি নির্জন হয়ে যায় কখনও কখনও। নিঃসঙ্গতার অচলায়তন হয়ে ওঠে যেন সময়। আমি বাধ্য হই নিজের সামনে পুনরায় দাঁড়াতে নিজে। আর পালাতে পারি না। কিন্তু নিজের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ার এমন মুহূর্ত কি শুধু দুপুর! তা না। কারও কারও জীবনে দুপুরেই যদি ঘটে যায় তেমন ঘটনা, তেমন বিয়োগ।
দুপুরের এমনও অভিজ্ঞতা আছে, যেন দুপুর দিনের একটা নির্দিষ্ট অংশ নয়_ দুপুরই রাত, দুপুরই দিন। কোনো গোপন শূন্যতার ভেতর দিয়ে এই দুপুরে বন্দি হয়ে পড়ে সমস্ত দিন-রাত্রি। পার হয় না সময়। প্রতীক্ষাও শেষ হয় না। যদিও সমস্ত জীবনই এক দুরন্ত প্রতীক্ষারই সমগ্র অধ্যায়। সেখানে দুপুর আছে_ কাঠফাটা নির্জনতায় ঘেরা, রাত্রি আছে অন্ধকারের আশ্রয় নিয়ে। আমরা প্রত্যেকে কেবল একেকটি অধ্যায় পূর্ণ করে চলে যাই কোনো না কোনো দুপুরকে ফাঁকা করে দিয়ে। যেমন আমার হয়েছে।
এই যে তুচ্ছ জীবন, যা আমি এদ্দিন যাপন করেছি_ সামান্যই সময়, অন্যসব মহাজন মান্যবরদের তুলনায়। তবু এ আমারই জীবন, অন্য কারও জীবনের সঙ্গে সে প্রতিযোগিতায় নামেনি, কলার বরপুত্র ভেবে মূল্য তার হাঁকেনি কভু চড়া, তুচ্ছও করেনি এই ক্ষুদ্র জীবনকে_ নিংড়ে সে নিয়েছে যাপিত সময়ের সারাৎসার, ফোঁটায় ফোঁটায় তুচ্ছ জীবন চুষে নিংড়ে নিয়েছে সে অমৃত মাধুরী। জীবনে সাফল্য নেই_ ব্যর্থতাই জন্ম-জমজ। তবু জীবনের স্বাদ মধুর; জীবন অপরিমেয়_ এই স্বপ্নটিই যেন আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, জাগিয়ে রাখে জীবনে। আরও আরও সময়কে দেখায়। প্রতি মুহূর্তের ভেতর দিয়ে বসবাসের একটা নিঃশ্বাস হয়ে পুনরায় দাঁড় করিয়ে রাখে এই মানুষের পৃথিবীতে, সময়ের তীক্ষষ্টতার মধ্যে।
শব্দ নিয়েই আমার কারবার। শব্দ বোবা-কালা নয়, জড়ভরত নয়। পঙ্ক্তির মধ্যে, স্তবকের মধ্যে, পুরোপুরি একটি পদ্যের মধ্যে নড়ে-চড়ে বসে শব্দ। শব্দের ওঠা-বসা, হাঁটাচলা, দৌড়ূনো কবির কাছে অর্থময় মনে হয়। পাঠকের কাছেও, বিশেষ করে দীক্ষিত পাঠকের কাছে, ওইভাবে ধরা দ্যায় শব্দ। আলাদাভাবে, অন্যত্র, থান-ইটের মতো ভারী ও নিথর হয়ে পড়ে থাকে এই শব্দ। কৈশোরে, এমনকি শৈশবে, শব্দ আমাকে সমূহ টেনেছে। জগতের শব্দ-সাম্রাজ্যের মধ্যে বড় বেশি আকর্ষণ করত হাটের শব্দ। বাবার হাত থেকে ফসকে ফুরফুর করে ঘুরে বেড়াতাম হাটময়_ উৎকর্ণ হয়ে শব্দ শুনতাম।
দুপুরেরও কিছু শব্দ আছে, ঘ্রাণ আছে। ঋতুতে ঋতুতে বদলায় এ দুপুরের শব্দ-স্বাদ। শব্দের ছায়া ধরে দুপুরকে চিনে নেওয়া যায়। গ্রীষ্মের দুপুরের শব্দের থেকে বসন্তের দুপুরের শব্দ অনেক আলাদা। পাখির ডাক আলাদা, বাতাস আলাদা, উত্তাপও আলাদা। আমরা নিজেরাও এসব ভিন্ন দুপুরে ভিন্নরকম হয়ে থাকি।
কবিতার কাছে এ দুপুর আবার সহসা জাদুর মতো আসে কখনও। কখনওবা কবিতার শত্রুও হয়ে ওঠে সময় ও শরীরের অজুহাতে। কিছু দুপুর নিছক গুম হয়ে যায়_ তারা আর ফিরে আসে না। এ দুপুরগুলোই খরচ হয়ে যায় জীবনের খাতা থেকে।
নিজেকে একলা পেয়ে যাওয়ার মতো অবসর রচনা করে এই দুপুর। কিন্তু সেই অবসরই নিদারুণ বেদনা হয়ে অতীতের কোনো এক অন্য দুপুরের দিনে নিয়ে যেতে চায়। যে দুপুর থেকেই মূলত ক্রমাগত দূরে নিয়ে যেতে সচেষ্ট থাকি, বুঁদ হয়ে থাকি। তবু আবারও আসে দুপুর_ আমাকে ছাড়ে না।
অভিমান নিয়ে কেউ কেউ দূরে চলে গেছে। আপন কেউ অন্তরের গভীরে টোকা মেরে জীবনের ওপারে চলে গেছে। কোনো এক দুপুরেই আমার মা হারিয়েছে তার এক সন্তানকে। এমন অনেক বিয়োগ বেদনায় আমাদের মন দুপুরগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আমরা থমকে যাই।
কখনও কখনও রাতকেও অনেক বেশি আপন মনে হয়েছে এই দুপুরের চেয়ে। অন্ধকার, আমাকে আগলে রেখেছে। আমার মতো অনেককেই আগলে রাখে। চারদিকে অবিরল আলোকিত স্রোত বয়ে যায় দেখেও_ আমি একাকী নিমজ্জিত থাকি অন্ধকারে। তবু সুপ্রিয় অন্ধকারকেও এই দুপুর এক ঝটকায় ভুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যদি কেউ ফিরে আসবে বলে এই দুপুরেই চলে যায় দূরে আমাদের দৃশ্যের ওপারে_ প্রতীক্ষা ছাড়া আর কিইবা থাকে। আমরা এমন এক দুপুর থেকে অপেক্ষা করতে থাকি জীবনের অন্যসব দিনখণ্ড পর্যন্ত।
এই যে জীবন। এ জীবনকে আমি যতদিন ধরে চিনি_ ততদিন ধরে জীবনের অনেক দুপুরকে নষ্ট হতে দেখেছি। দুপুরের সঙ্গে সঙ্গে আমিও নষ্ট হয়েছি অতীতের আগুনে পুড়ে। যদিও সেইসব আগুন দিবারাত্রি দহন করেছে আমাকে। অচেনা ওই আগুনে নিজেকে দাহ্য বস্তু হিসেবে আবিষ্কার করেছি বারবার। তবু আগুনকে বলেছি_ আগুন, তুমি কাঁদছো কেন?
এমন কতো যে দুপুর গেছে আমার জীবন থেকে খসে। নিষ্পত্র বৃক্ষের মতো নিঃস্ব, রিক্ত, নিঃসঙ্গ, একাকী। আবার বছরের পর বছর প্রতীক্ষার পর উপহার হিসেবে পেয়ে গেছি সবুজ দুপুর। সে দুপুর অরণ্য, সে দুপুর নদীর স্রোতের মতো জীবনকে সামনের দিকে ধাবিত করতে চায়। দুপুর চলে যায়_ শুধু কারও নীরব দু’চোখ জেগে থাকে মনের ভেতরে। আর স্তব্ধ হয়ে থাকা দুপুরকে মনে করিয়ে দেয়।
দুপুরকে আজীবনই নির্জন দেখেছি। শৈশবে দেখেছি, যৌবনেও পার করেছি দুপুর-নির্জনতা। অনেক দুপুর গেছে চায়ে কিংবা চেয়ে থেকে। তবু হঠাৎ আলাদা এক দুপুর তার ভিন্নতা দিয়ে বেঁধে রাখে আমাকে। হয়তো এভাবে আমাদের অনেককেই এ দুপুর বাঁচিয়েও রাখে। সব ব্যথা ভুলে দুপুর তার দূরবীনে আমাদের চোখকে টেনে নিয়ে যায়। আমার জীবন দৌড়ের ফাঁকে ফাঁকে কিছু দুপুরকে পেয়ে যাই স্বতন্ত্রভাবে। নিজের একটা দুপুর হয়ে অনেক অতীত থেকে যায় আমাদের মনের আড়ালে।
দুপুর_ এও এক মুহূর্ত। সংক্ষিপ্ত তবু অসীম।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
রফিক আজাদ- র আরো পোষ্ট দেখুন