প্যারিসের চিঠি

প্রিয় আকাশি,

গতকাল ঠিক দুপুরে তোমার চিঠি পেয়েছি । খামের উপর নাম ঠিকানা পড়েই চিনতে পেরেছি তোমার হাতের লেখা , ঠিকানা পেলে কিভাবে লিখনি ,
কতদিন পর ঢাকার চিঠি, তাও তোমার হাতের লেখা,
ভাবতে পারো আমার অবস্থা ?

গতকাল প্যারিসে ঝড়েছিল এ বছরের রেকর্ড ভাঙ্গা তুষারপাত ।
তামাক ফুরিয়ে গেছে আনতে পারিনি
এই প্রথম আমি অনেকটা সময় নিয়ে ভুলেছিলাম তামাকের গন্ধ ।

তোমার চিঠিতে পরিবর্তন আর বদলে যাওয়ার সংবাদ
তুমি কষ্ট পেয়ে লিখেছো,
রাত্রির ঢাকা এখন নিয়নের স্নিগ্ধতা ছেড়ে নিয়েছে,
উৎকট সোডিয়ামের সজ্জা,
আমাদের প্রিয় রমনা রেস্তোরা এখন কালের সাক্ষী,
শীতের বই মেলা পরিনত হয়েছে মিনাবাজারে,
টি এস সি র চত্বর যেন উত্তপ্ত বৈরুত।

বদলে যাওয়া কষ্টের অপর নাম স্মৃতি,
এখন তাই নিয়ে বুঝি মেতে আছো,
এই পরবাসে আমার চোখের সামনেও
বদলে যেতে দেখলাম কত সুদৃঢ় ইতিহাস
বালির বাঁধের মত ভেসে গেল পুর্ব ইউরোপ
নদীর পাড় ভাঙ্গার মত ভেঙ্গে গেল বার্লিন প্রাচীর
ইংলিশ চ্যানেলের তল দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলছে ট্রেন
ইউরোপের মানচিত্র এখন রুটি হয়ে গেছে ,
ক্ষিদে পেলেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাও …
স্বাধীনতা মানেই যেন উদর পুর্তি

তুমি লিখেছ “তোমাকে ভুলে গেছি কিনা ?”

প্রিয় আকাশি,
আমি জেনে গেছি
পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ
ভুলে থাকা।
স্মৃতি থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য
এই সুদীর্ঘ প্রবাসের অর্ধেকটা কাটিয়েছি
বোহেমিয়ানদের মত ঘুরে ঘুরে
মাদ্রিদ থেকে হামবুর্গ,
নিউক্যাসল্ নেপোলি থেকে প্রাগ বুখারেষ্ট মাসিডোনিয়া
নর্থ সি থেকে মেডিটোরিয়ান কিংবা ব্ল্যাক সি।
তবু বাঁচতে পারিনি স্মৃতি থেকে,
ফ্রাঙ্কফুটের বই মেলায় নতুন বইয়ের গন্ধে মনে পড়েছে তোমাকে।
সিসটাইন চ্যাপেলের “লাষ্ট জাজমেণ্টে”র মত মহান সৃষ্টি পিয়েতা”র সামনে দাঁড়িয়ে
প্রথমেই মনে পড়েছে তোমাকে।
সিসিলির কার্নিভেলে
এথেন্সের কফি শপের জমজমাট কবিতা পাঠের আসরে, মনে পড়েছে তোমাকে ।
সুইজারল্যন্ডের লেকের কাছে স্বচ্চ জলে নিজের ছায়ার পাশে যাকে খুঁজেছি,সে তুমি।
ভ্যাটিক্যানের প্রার্থনা সভা শেষে
এক গ্রীক তরুনীকে বাংলায় কি বলেছিলাম জানো ?
বলেছিলাম- “তুমি আমার আকাশী হবে ?”
ভুলতে পারিনি তোমাকে,
শত চেষ্টা করেও পারিনি ।

আর কেউ না জানুক
অসংখ্য জিপসি রাত জানে সেই না ভুলতে পারার ইতিহাস।

তুমি জানতে চেয়েছো প্যারিসের কথা –
সত্যি বলতে কি –
প্যারিস খুলে দিয়েছে আমার আত্নার চোখ
সংগীত আর শিল্পের অভিন্ন সুর আমি শুধু প্যারিসেই শুনেছি ।
ক্লিয়নে কনসার্টে যতবার মোৎসার্ট
কিংবা বিটোভেন শুনেছি
ততবারই কেন যেন চিরদুঃখী পাগল ভিনসেন্ট ভ্যানগগের কথা মনে পড়েছে।
সমস্ত প্যারিসের রাস্তায়, গ্যালারিতে, ফেষ্টিভেলে ,খুঁজে ফিরেছি ভিনসেন্টের কষ্ট ।
তোমার প্রিয় গায়ক
জিম মরিসনের শেষ দিনগুলো কেটেছে এই প্যারিসে ।
প্যারিসেই জিমের কবর ।
অগনিত শিল্পীর কষ্ট থেকে প্যারিস পেয়েছে সৌন্দর্য,
কষ্টই প্যারিসের ঐশ্বর্য ।

আমাদের সুবর্ন সময়ের স্বপ্নের প্যারিসে
আজ নিজেকে ভীষন একা মনে হয়
এলোমালো পড়ে আছি
শিল্প সাহিত্যের এই জাগ যজ্ঞে।
তীব্র শীতের শ্বাসকষ্ট ভোগায় মাঝে মাঝে
এইতো সেদিন
আবারও বদলালাম চশমার কাঁচ।
প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছি, সময়ের কাছে,
তুমি মনে রেখো
পরিবর্তনের দমকা হাওয়ায়
আমি বদলাইনি এতটুকু ।
বাইজেনটাইন সম্রাজ্ঞীর মত
তোমাকে ঘিরে থাক পৃথিবীর সমস্ত সুখ ।
তুমি অনিন্দ্য সুন্দরী হয়ে ওঠো তোমার সৃষ্টিতে ।

তুমি ভালো থেকো …….
কবির নাম জানলে খুশী হব

      Priyo Akashi

২ টি মন্তব্য

Comments are closed.