মায়ের মিনার থেকে বিশ্বের মিনার

image_1465_224287মিনারটা আমার দিকে তাকায়। তার দৃষ্টিতে ঝরে পড়ে স্নেহ ও করুণা। জানি, এই দেশটাকে সে আমাদের মতোই ভালোবাসে। ওর বুকের ভেতরে গুমরে ওঠে কান্না, যখন এই সুন্দর দেশের মাটিতে ঘটে হানাহানি আর নিষ্ঠুরতা। সে যেন বলতে চায়, ওই যে আমি আগলে রেখেছি আমার সোনার সন্তানদের। দেখ তোমরা। শেখ। রক্ষা কর তোমাদের বিবেক। গর্জে ওঠ অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
একসময়ে মিনারটা ছিল নবীন। সবুজ ঘাস জমিন হয়তো ছিল তার চারপাশে। আবেগে, যন্ত্রণায়, ব্যাকুলতায় ভরা হৃদয়ে কিছু তরুণ হাতে হাতে ইট আর চুন-সুরকি বয়ে এনে গড়েছিল তাকে। সেই রক্তস্নাত ২১ ফেব্রুয়ারির সকালবেলাটা ছিল রোজকার মতোই। সূর্যের আলোঝলমলে প্রাণের উত্তাপে ভরপুর। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘোষণা করা হয় ১৪৪ ধারা। বিগত দিনগুলো ছিল বেদনাবিদ্ধ, বিক্ষুব্ধ বাংলার জায়গায় উর্দু হবে গোটা পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা : এ ছিল সরকারপ্রধানের নির্দেশ ও ঘোষণা। কিন্তু দেশের পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষই বাংলাভাষী। তা ছাড়া বাংলা ভাষার বিতর্ক কয়েক বছর ধরেই অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিদ্বৎ সমাজের আলোচনায় ছিল। ১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে অবিভক্ত ভারতের কাঙ্ক্ষিত ভাষা কী হবে, তা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দির পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বাংলার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। এতে বোঝা যায় বাংলা ভাষার বিষয়টি গোড়া থেকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রসমাজ ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়েও বহু বিপরীত প্রতিবাদ হয় একসময়। এ হলো ইতিহাসের কথা। ১৯৪৭ সালে রাজনৈতিকভাবে বিভক্তির ফলে দুটি আলাদা দেশ গঠিত হয়। তার পরই আসে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা_ এ ঘোষণা। সারা দেশের বুদ্ধিজীবী ও বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। প্রতিদিন ছাত্র ও সাধারণ মানুষের মিছিল রাজপথকে উত্তাল করে তোলে। ১১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় পতাকা দিবস। পথে পথে বজ্র গর্জনে সস্নোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এ আন্দোলনে এসে যুক্ত হয় স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী ও নারী। ক্রমে ভাষার দাবিটা একটি বেগবান রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়।
এ কথা যখন ভাবী, বিস্মিত হই। দেশ বিভাগের পরপরই অদ্ভুতভাবেই ভাষার যুদ্ধ এসে এ দেশের জনজীবনকে ওলট-পালট করে দেয়। হয়তো বা আরো বৃহত্তর ত্যাগ ও পরিবর্তনের জন্য। ফেব্রুয়ারিজুড়েই সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ ছিল চলমান দিনের প্রতিদিনের বিষয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সরকারি নির্দেশে উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিপক্ষে বাংলা ভাষাকেই প্রধান ভাষা করার দাবি ও প্রস্তাব করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এর উত্তরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। দুঃখের বিষয় পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনও উর্দুর পক্ষে সমর্থন জানান। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলার জনমত ছিল এর পুরোপুরি বিপরীত।
২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণ সব মানুষের অনুভূতির ওপরে এক প্রচ- আঘাত। শহীদ সালাম, বরকত, জব্বার ছাড়াও বিচ্ছিন্ন গুলির ঘটনায় সালাহউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি ও নবাবপুরে অহিউল্লাহ নামে এক কিশোর নিহত হয়। সারা দেশে শোকের ঝড় বয়ে যায়। সেই সঙ্গে ইতিহাসের এক অলিখিত অধ্যায়ের প্রারম্ভ।
মিনারের কাছে ফিরে যাই। একুশের মর্মান্তিক ঘটনার পরে শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের গেটে ১২ নাম্বার ব্যারাকের কাছে হাতে হাতে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। দলে দলে সর্বস্তরের মানুষ গিয়েছিলেন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। অজস্র ফুল, মোমবাতি ও চুড়ি-মালা, দুল ইত্যাদি নানা অলঙ্কার দিয়েছিলেন মা-বোনেরা। তাদের মধ্যে একটি হার দিয়েছিলেন যে মা, তার নাম সৈয়দা খাতুন। তিনি ছিলেন ড. আনিসুজ্জামানের মা। ড. আনিসুজ্জামান তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙতে যাওয়ার আগে মা তার আট বন্ধুকে যত্ন করে নাশতা খাইয়ে দেন। তাদের উৎসাহ ও সাহস দেন। ২১ ফেব্রুয়ারির পরদিন প্রচুর ধরপাকড় চলে। তবে ওই সময়ে মা সৈয়দা খাতুন ও তার স্বামী হাতে গড়া শহীদ মিনারে যান। সেখানেই তিনি তার অকালপ্রয়াত শিশুকন্যার গলার হারটি রেখে আসেন। পরে পুলিশ ওই মিনারটি ভেঙে ফেলে। (সংগৃহীত, দৈনিক বাংলা, আহমেদ নুরে আলম কর্তৃক লিখিত সংবাদ থেকে : শিরোনাম : ‘শহীদ মিনারে এক মা গলার সোনার হার খুলে দিলেন’। ঢাকা, বুধবার, ১৯ মাঘ, ১৩৯৪; ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮)।
‘একবার যে মিনার গড়া হয়, তাকে ভাঙা সহজ তো নয়’। কাজেই সেই মিনার বছরের পর বছর ধরে পরিত্যক্ত মনে হলেও দ্রুত বৃহৎ পরিসরে আবার গড়া হয়। সরকারি নীতিরও পরিবর্তন ঘটে কালক্রমে। আকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায় একুশের শহীদ মিনার। মানুষের কাছাকাছি মানুষের ভালোবাসায় গড়া এ মিনার। কিন্তু ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ভয়াবহ ক্র্যাক ডাউনের সময়ে মিনারটি বিধ্বস্ত করে ফেলা হয়।
এখন কথা হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের মিনারের ওপরে এ ঈর্ষা কেন। বাংলা ভাষা কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে এত মর্যাদা পেয়েছে যার প্রতীকটি পর্যন্ত শত্রুর হাত থেকে রেহাই পায়নি? এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে বাংলা ভাষার বিশালতা ও ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা, ভাষাগত প্রকৃতি তার উদ্ভবের পর থেকে কখনো থেমে থাকেনি। ফারসি, ইংরেজি, ডাচ্, পর্তুগিজ ও অন্যান্য ভাষা থেকে অনায়াসে শব্দ গ্রহণ করেছে। সেসব শব্দ এখন আর বাংলা ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করার উপায় বা সুযোগ নেই। অন্যদিকে মিশ্রিত ভাষা মনে হওয়ারও উপায় নেই। এ প্রসঙ্গে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের কথা মনে পড়ে। তিনি লিখেছিলেন_ মানসিংহ পত্রিকায় হইল যে বাণী
উচিত সে আরবী পারসী হিন্দুস্তানী
প্রাচীন প-িতগণ গিয়াছেন ক’য়ে,
যে হোক তে হোক ভাষা কাব্যরস লয়ে।
অতঃপর বাংলা ভাষার বিশালতার কারণটি অনুমান করতে কষ্ট হয় না। জীবনদৃষ্টি, ভাষার সাবলীল গতি, সর্বস্তরের মানুষের কাছে সুখ-দুঃখ গতি-স্থিতির সংবাদ পেঁৗছে দেয়ার দক্ষতা এই ভাষার প্রসাদগুণ।
এ লেখার শুরুতে সামনে রেখেছিলাম আমাদের আত্মার প্রতীক শহীদ মিনারকে। বিগত দীর্ঘ যুগান্তরের পট পরিবর্তনে তার অস্তিত্ব যেন আমাদের জীবনের অস্তিত্বে মিশে একাকার হয়ে গেছে। সাহিত্যের নতুন প্রবাহ সৃজনশীলতার পথ ধরে তৈরি করেছে সাহিত্যের নব নব সৃষ্টি। সে যেন এই দেশ ও জাতির এক অতন্দ্রপ্রহরী। জাগ্রত বিবেক।
সময়ের সুদীর্ঘ পরিক্রমায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ও তারপর দীর্ঘকাল কাটে। এ দেশের সন্তানদের অক্লান্ত প্রয়াসের ফলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষার স্বীকৃতিও দেয়া হয়। বিশ শতকের শেষ প্রান্তে এসে বিশ্বের স্বীকৃতি। বহু পূর্বের ইতিহাস থেকে মনে পড়ে, বিশ্বভারতীর বিদ্যোৎসাহী প-িতদের সম্মেলনে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছিলেন _ ইধহমষধফবংয ঁহরঃবং সবষষরভষঁড়ঁংহবংং ড়ভ ওঃধষরধহ রিঃয ঃযব ঢ়ড়বিৎ ঢ়ড়ংংব ৎবফ নু এবৎসধহং ড়ভ ঢ়বহফরহম পড়সঢ়ষবী রফবধং. এ যেন বাংলা ভাষার মধ্যে নিহিত বিশ্বাসানুভূতির কণ্ঠস্বর। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে ভাষা আন্দোলনের শহীদ মিনার তার অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে। বর্তমান বছরে শান্তিসংঘ মিশনের সামনে বসানো হয়েছে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হলো এভাবেই। একুশের দিনে গোটা পৃথিবীর মানুষ গেয়ে উঠবে মাতৃভাষার বিজয়ের গান। ইতোমধ্যে সিয়েরালিওনের ছেলেমেয়েদের সম্মিলিত কণ্ঠে শুনছি ও টেলিভিশনে দেখছি_ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ সম্মেলক সঙ্গীত। বুকের মধ্যে তোলপাড় করে উঠেছে। মা বলিতে প্রাণ করে আনচান চোখে আসে জল ভরে।
কোথায় যেন যাত্রা শুরু করেছিলাম? সেই বায়ান্ন সালের এক ক্ষুদ্র শহীদ মিনার থেকে। কত বছর চলে গেছে, শত শত মানুষের মিছিলের আহ্বান_ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই; এ যেন হাজার বুলেটের রক্তাক্ত ঘাতক শক্তিকে উপেক্ষা করে লাখো মানুষের পায়ের চিহ্নকে চিরস্থায়ী করে রেখে গেছে। মধ্যরাত্রির অন্ধকারে ও ভোরের কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে সেখানে রক্তস্নাত মানুষদের দেহের ওপরে ঝরে পড়েছে, ফাল্গুনের ঝরে পড়া ফুলের পাপড়ি, গলায় বেজে উঠেছে ভাষার গান।
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু বৃহৎ কর্মকা- আমরা করতে সক্ষম হইনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদস্মৃতি পুরস্কার প্রবর্তন করা হয় আজ অবধি। প্রচুর তর্কবিতর্ক ও লেখালেখি ও সমালোচনার পরে দু-একটি শহীদ বরকত বিদ্যালয় ও দু-একটি ক্ষুদ্র লাইব্রেরি হয়েছে শহীদদের নামে নামে। তা-ও স্থানীয় উদ্যোগে। এ বিষয়ে আমাদের গঠনমূলক কাজ করা সম্ভব। তবে এও সত্য যে, একুশের পথ ধরে এগোচ্ছে আমাদের রক্তে প্লাবিত স্বাধীনতা।
দেশ, জাতি ও মানুষ অমূল্য যে আদর্শকে ধারণ করে, তাই তার আপন জিনিস। তার সব উত্থান-পতন আদর্শের যুদ্ধ, তাকেই ধরে রাখে।
এ পথ মানুষের। এ দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎকে সে নির্দেশ করছে। তাই তাকিয়ে আছি, পথের শেষে বিশ্বের সম্মিলিত মানুষের কাছে মাতৃভাষার আহ্বান পেঁৗছে দিতে। বলছি, মিনার জেগে আছ? তো থাকো। কারণ এ আমার মায়ের স্নেহের উপহার। যাত্রা করেছিলাম মায়ের মিনার থেকে, পেঁৗছে গেছি বিশ্বের মিনারে। এত ত্যাগ, এত মানুষের ভালোবাসা বৃথা হয়নি। সেই মানচিত্রটির সত্যের পথেই আমাদের এ যাত্রা।