কাজী নাসির মামুন-এর দুটি দীর্ঘ কবিতা……

 

এই শেষ চুমুক তোমার

মেঘের নিতম্ব নাই; নাচতে পারে না তাই ভাসে ।
আমরা সবাই নিতম্ব রহিত মেঘ; দেবদারু পাতাবাহারের মতো
বাপ চাচা ফুপুদের সরল ব্যঞ্জনে ফুলহীন ফলহীন
সতীর্থ রচনা করে চলেছি কেবল ।
সবুজ টিয়ার মতো লাল ঠোঁটে তুলে নিয়ে
ভাগ্যের হলুদ খাম গণক প্রবঞ্চকের,
নিজেই জানি না কার ভাগ্য কতটুকু ।
অথচ মাটির এক ভাঙ্গা ঠুলি গতকাল রাতের বৃষ্টির
অবোধ নিরীহ জল বুকে নিয়ে উঠোনের নিকট উপান্তে
ব্যাঙের ছাতার নিচে চুপচাপ । সে-ও জানে সূর্যের সফল
অত্যাচারে হয়তো ফুরাবে তার স্পন্দপ্রাণ, মৌন ঘনঘটা…
যদি এই নিরুত্তাপ দেহত্যাগ, পরিনত হত্যা-রং, নিষ্প্রাণ বাষ্পের দিকে
আর এই জল বিলীনতা রোজ অকুন্ঠ দর্শন ভেবে জপ করি ডালিমের নীরব ছায়ায়
লাল ফাটা মগ্ন বিরহের
কবর দেখাবো বলে—তবে, হে বাতাসদেহ, রসনিকুঞ্জের
পরপারে বেদন-বৃষ্টির পরিচারিকা, তুমি কি
ভাববে, আমিও জীবনের
বিফল উপাত্তে অপারগ
লাটিম ঘুরাচ্ছি শুধু ? যেন আমি কাদাখোঁচা পাখি;
সোনাবউ খুঁজছি কাদায় ?খরচের প্রজাপতি হাতে নিয়ে আমি চিরদিন ভেসে গেছি
কেবলি বিরল অপচয়ে ।
পেয়ারার তিরোধানে আজ তাই হল্লা করে ছুটে যায় দাঁতের আক্ষেপ ।
জীবন দেখেছি এক জলঢোঁড়া সাপের মতন ।
কামড় দিয়েছি, তবু বিষহীন উপদ্রুত ক্ষতের চিহ্নটি
ছাড়া অন্য ধ্রুবতারা কুশ রক্ত রিরংসা অভয়
খই লালা অমৃত চুম্বন কাক–এত সব অবগত আলো পাখি প্রেম বৈরিতার অধিকারে
পোড়াতে পারিনি আজও জীবনের অভিধানে নতুন শব্দের মতো
রহস্যের নারীকে, দারুণ অল্পে ভোলে
এ রকম বালক, বিরল বন্ধু, মাতৃকা অথবা খুকী যার
ফ্রকপরা প্রথম যৌবন ক্যান্ডি চকলেট হাতে পেলে
মুঠোয় আকাশ নিয়ে নাচতে পারতো । আকাঙ্খার মতো বিশাল আকাশ !
আজ তাই আলোগঞ্জনার, মনোবিকৃতির নতুন বিগ্রহে
চন্দ্রমল্লিকার এক সোহাগ দুপুর যদি হঠাৎ আমাকে দেয় গন্ধ পরিমল,
মনে হয় নগরীর গণিকা পাড়ায় মানিব্যাগ ফেলে এসে ঠিক ভেবে নেবো,
পৌরুষ অপরাজিত !……
যেন বা নগর
প্রিয়ক তরুর নীচে গিরিকা দেবীর মতো জ্বলজ্বল করে ।
তার প্রেম, প্রভা, পরিচয়হীন ধুম্রল যৌবনে কালো পিচ হয়ে
গলে যাচ্ছি বসুরাজ; কথক রাজার মতো ডাকছি হাতের
সেলফোনেঃ ওগো বুকপোড়া পাথরের সম্রাজ্ঞী,
ট্রাফিক জ্যামের কোনো বিভীষিকা নাই; দাও, দাও,
লম্পট রাত্রির হেরোইন, স্তন বিমোহনে ঘুমিয়ে কাটাই ।
তারপর পথিক নারীর দেহ-বাতায়নে বিনামূল্যে উঁকি দেয়
জলপাই রঙে আঁকা মিলিটারি ভ্যান ।
সারারাত পুলিশ পুলিশ; তবু বারবনিতার দগ্ধ কামুক শরীর
চেয়ে নেয় টুংটাং রিকশার মাতাল শ্রমিক ।
সশ্রম প্যাডেল ছেড়ে আজকে সে মোহমগ্ন, প্রেমিক মিথ্যুক ।
আর ট্রাক–মহামতি সৌরচাকা, পথের ধর্ষক
তেলের পাম্পের কাছে নগদ টাকায় কিছু যৌন যোগাযোগ ফেলে
চলে যায়, চলে যায় দূরে…
শুধু আমি রক্তবিরচিত বুনো সভ্যতার তিক্ত উপহাস;
মানুষের গীতল পশ্চাতে লাথি মেরে
অগত্যা মাস্তান । খলনগরীর পাঁজাকোলে
গিরিকা দেবীর কথা ভাবছি; যেন সে
জাদু বীণা, বাঁশি; প্রাণে তিলোত্তমা হাতে আখগাছ
দেখিয়ে বলছেঃ এই নাও, লাঠিভরা শরবত,
এই শেষ চুমুক তোমার…

শস্যমালা

বাজারের নাম শস্যমালা ।
সুতিয়া নদীর পাশে অতনু দেহের মতো সাবলীল মানুষের ভীর;
তামাগলা সূর্যের সিথানে তবু অরণ্যশোভন এই নীরবতা খান খান ভেঙ্গে যাবে আজ ।
সরব উত্থানে কোন উজ্জীবন
জড়িয়ে রয়েছে এই প্রাণের পেখম জনতার ?
তেমাথায় গোল হয়ে সুতিয়া নদীর পাশে অভিলাষহীন ?
পণ্যের জঠরে বসে কেউ বুঝি জাদুর দোলক শুধু দু’হাতে নাড়েন;
চিলতে রোদের মতো প্রতিপাদ্য সোনার হৃদয় এখানে দারুন বেচাকেনা হয় ।
মনের ব্যঞ্জনে খুব শিখর ছুঁয়েছি বলে মানুষের
আজ বাঁশি হয়ে যাই; উড়ে আসি রঙ্গিন ফানুস আমি হাওয়ায় হাওয়ায় পলাতক ।
উলম্ব গতির দিকে মুখ করে প্রতিভায় জেগে আছে গগন শিরীষ;
একটি সজনে গাছ, পাতা নাই; ডালে ডালে নিরীহ বিকেল ;
মনে হয় ভৌতিক কংকাল–শুধু নিরন্ন আঙ্গুলগুলো থাবা মেলে আছে ।
পাঁচটি সতীর্থ পাখি এই মাত্র সহসা দুর্বার উড়ে গেল;
জীবনের ভাঁজে ভাঁজে পরিবৃত স্বাধীনতা কোথায় লুকিয়ে থাকে এতটা সুলভ ?
শুকনো নদীর বুকে ফসলের ঢেউ…
প্রতিবর্ণ সভ্যতার সবুজ আগুন বুঝি জল কেড়ে নিল !
সুবর্ণ কৃষক ছাড়া লোল অভিশাপ তবে কে বোঝে এমন ?
বনেদি বাড়ির দিকে ওই যে মেয়েরা তাই গগনবিদারী সুখ, তবু
নিরুপায় একটি বেদনা শুধু আঁচলে বেঁধেছে ।
আর বুড়ো বৃক্ষের কোটরে থাকা কুন্ডলিত সাপের মতন
অনন্য খোঁপায় তারা গুঁজে নিচ্ছে ফুল, সাদা জবা ।
মোড়ল বাঁশের মতো আমার যৌবন কেন স্ফীত হয়ে যায় ?
নিজেকে খরচ করে সজল ঋণের ভারে নুয়ে পড়ি ।
আকাশ এখানে রোজ সহস্র মেঘের কুঁড়েঘর;
হিমের কুন্তলে আজ জেগে আছে রমণীসুলভ ।
আহা নারী ! আমাকে ছোবল দাও,
সভ্যতা বিলীন করে অরণ্যবাসরে সমধিক নীলকন্ঠ হয়ে উঠি ।

 

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars ( votes, average: ৪.০০ out of ৫)
Loading...
কাজী নাসির মামুন- র আরো পোষ্ট দেখুন