তারা তিনজন

হুমায়ূন আহমেদ বসে বসে লিখছিলেন। তাঁর ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটের দখিনা দুয়ার খোলা যেমনটা থাকে। তিনি চা খাচ্ছেন তবে সিগারেট খাচ্ছেন না। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর তাঁর ৩৫ বছরের প্রিয় বন্ধুকে বিদায় জানিয়েছেন তিনি। ঠিক তখনই দরজায় একটা ছায়া দেখা গেল।
কে?
স্যার, আমি।
হুমায়ূন আহমেদ ভ্রু কুঁচকে ভালো করে তাকালেন। লেখালেখির সময় কেউ এলে তিনি বিরক্ত হন। হলুদ পাঞ্জাবি পরা এক তরুণ দাঁড়িয়ে। খালি পা…
কে, হিমু?
জি স্যার।
কী ব্যাপার?
স্যার, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। হুমায়ূন আহমেদ কলম রেখে তার দিকে ঘুরে বসলেন- ‘জলদি বলো। খুব বেশি সময় আমি তোমাকে দিতে পারব না…আমি লিখছি…।’
স্যার, আমার বেশ কিছু অভিযোগ আছে।
আমার বিরুদ্ধে?
জি স্যার।
বেশ, বল।
এক নম্বর হচ্ছে খালি পায়ে ঘুরতে ঘুরতে আমার হুকওয়ার্ম হয়ে গেছে। আমার স্যান্ডেল পরা দরকার। আর…
আর?
আর আমার রুপার সঙ্গে একটা স্থায়ী প্রেম-ভালোবাসা হওয়া দরকার…এভাবে আর চলে না। তা ছাড়া পাঞ্জাবির রংটা কি বদলানো যায় না? হলুদ রংটা বড্ড কটকটে। ইদানীং চোখে লাগে…তা ছাড়া হলুদ রংয়ে পোকামাকড় ছুটে আসে…
তোমার কথা শেষ হয়েছে?
‘স্যার, আমারও কিছু বলার ছিল…’ হুমায়ূন আহমেদ আশ্চর্য হয়ে দেখেন হিমুর পেছনে শুভ্র দাঁড়িয়ে।
তুমি কখন এলে? বল, কী বলবে?
স্যার, আমি এই ভারী ফ্রেমের চশমা আর পরতে চাই না।
বাহ, তোমার চোখ খারাপ, মাইনাস নাইন পয়েন্ট…
স্যার, আমি ল্যাসিক করাতে চাই। এখন ঢাকায় নতুন টেকনোলজি এসেছে, চোখের ভেতর লেজার দিয়ে কর্নিয়ার লেন্সে পাওয়ার অ্যাডজাস্ট করা যায়।
যা ইচ্ছে করো। আমাকে লিখতে দাও…সামনে ঈদ…ঈদ সংখ্যায় একটা উপন্যাস দেব, ওদের কথা দিয়ে ফেলেছি… হূমায়ূন আহমেদ ওদের এক রকম উপেক্ষা করে কলম তুলে নিলেন।
‘…যুক্তিতে এটা হয় না!’ হুমায়ুন আহমেদ দেখেন তাঁর সামনে মিসির আলী বসে আছেন, হিমু, শুভ্র দরজায় দাঁড়িয়ে।
‘ আরে, আপনি আবার কখন…?’
– ওদের পিছে পিছেই চলে এসেছি। বয়স হয়েছে…মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না। ভাবলাম একটু দেখা করে যাই… বলছিলাম লজিক-এন্টিলজিক বলে সত্যিই কিছু থাকলে…আপনি কিন্তু আর লিখতে পারেন না।
– মানে?
– মানে, মৃত মানুষ লিখতে পারে না। আপনি কি জানেন, আপনি মারা গেছেন?
– লেখকদের মৃত্যু হয় না।
– এ তো দার্শনিক টাইপের কথা…মহৎ মৃত্যু কখনো কখনো মানুষকে অমর করে, হয়তো আপনাকেও করেছে…কিন্তু…
– কিন্তু?
– আপনি তো বিজ্ঞানের ছাত্র…আপনি তো জানেন মৃত্যু আসলে মৃত্যুই। যে যায় সে চলেই যায়…ওয়ান ওয়ে জার্নি…
– কিন্তু আমার এই উপন্যাসের নায়িকার কী হবে? সে তো বাসস্ট্যাডে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রেমিকের জন্য…এটা শেষ করি?
– দরকার নেই। অপেক্ষা করুক না।
– কিন্তু অপেক্ষা ব্যাপারটা অনেক কষ্টের না?
– তার থেকেও কষ্টের কোনো লেখকের হঠাৎ চলে যাওয়া…
হুমায়ূন আহমেদ মন খারাপ করে উঠে দাঁড়ান। প্রায় পেটের কাছে লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে তাঁর লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে যান, আর বের হয়ে আসেন না। হঠাৎ দমকা বাতাসে ঘরের পর্দাগুলো নৌকার পালের মতো উড়তে থাকে। শূন্য ঘরে একটা হাহাকারের মতো শব্দ হয়…।

দুই
নুহাশপল্লীর লিচু বাগানে হুমায়ূন আহমেদের সমাধির পাশে তাঁরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছেন। মিসির আলী, হিমু আর শুভ্র।
তোমার চশমা কই? ল্যাসিক করিয়েছ নাকি? ফিস ফিস করে বলে হিমু শুভ্রকে।
নাহ। চশমার একটা ডাঁটি ভেঙে গেছে, তাই পরা যাচ্ছে না।
তুমি কি সাদা পাঞ্জাবি পরে এসেছ? শুভ্র প্রশ্ন করে হিমুকে।
না, কেন? চশমা নেই বলেই ধরতে পারছ না। হলুদ বিহারি পরেছি, পাঞ্জাবি না, কটকটে হলুদ বলে এটা পাঞ্জাবি, না বিহারি…হা হা।
হিমুর হঠাৎ হাসিতে মিসির আলী কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে তাকালেন ওদের দিকে। ফিস ফিস করে বললেন, ‘তোমরা কি জানো হুমায়ূন আহমেদ এই সমাধির লিচুগাছগুলো শুধু পাখি আর বাদুড়দের জন্য নির্দিষ্ট করে গিয়েছিলেন? মানুষের জন্য নয়?’
শুনেছিলাম, স্যার।
তারা তিনজনেই একসঙ্গে ওপরের দিকে তাকালেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, লিচুগাছগুলোতে পাখি আর বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মিসির আলী দেখলেন, শুভ্র অন্ধের মতো এগিয়ে গিয়ে সমাধির ওপর হাত রাখল। স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার কোমল স্পর্শ। হিমু দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল মূর্তির মতো… তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে যেন এই সমাধিরই কোনো ভাস্কর্য। তার ঢোলা হলুদ পাঞ্জাবি উড়ছে পতাকার মতো। আর কী আশ্চর্য, ঠিক তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামল…যেন জোছনাকে আড়াল করল বৃষ্টি…মিসির আলীর হঠাৎ করেই মনে হলো…লেখকের আসলেই মৃত্যু নেই…কারণ লেখক যে আসলে স্রষ্টা। স্রষ্টারা চিরকাল অবিনাশী অমর…।

তিন
লিচুগাছের বাদুড় আর পাখিদের দল শব্দ করে উঠল একসঙ্গে, যেন তারাও মিসির আলীর সঙ্গে একমত।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
আহসান হাবীব- র আরো পোষ্ট দেখুন