আপস


সেবার দিন দশেকের জন্য নিয়ে কলকাতা গেলাম। গেলাম একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। অবশ্য উদ্দেশ্যটা এমন কিছু প্রবল ছিল না। বেড়াতেই আসলে যাওয়া। তো কলকাতায় পেঁৗছে গিয়ে একটু অর্থপূর্ণ করতে চাইলাম খরচ-পত্তর করে এদ্দুর আসাটাকে। আনন্দবাজারে একটা বিজ্ঞাপন দিলাম। বিজ্ঞাপনটা হুবহু এরকম :
‘প্রিয় সোমেশ্বর, আমি এখন কলকাতায়। ফ্রাই ডে ক্লাবের ১৬ নম্বর কামরায় আছি। এ ঠিকানায় দিন তিনেক থাকব। তুমি যদি একটিবার এসে দেখা কর বা খবর দাও, আমার আনন্দের সীমা থাকবে না। ইতি আতিকুল আমিন। মৈমনসিংহ জিলা স্কুলে পঞ্চান্নর ব্যাচ।’
ফ্রাই ডে ক্লাব গড়ের মাঠের কাছে। ইচ্ছা করে রাস্তা, বাড়ি ও টেলিফোন নম্বর দিলাম না। টেলিফোন গাইড কিংবা ক্লাবের তালিকা থেকে ঠিকানা খুঁজে নিক। ফ্রাই ডে ক্লাব কোনো হেজিপেজি জায়গা নয়। ইচ্ছা থাকলে যে কেউ ফ্রাই ডে ক্লাবের ঠিকানা জেনে নিয়ে আমার এখানে পেঁৗছতে পারে। দেখা যাক, সোমেশ্বরের সেই ইচ্ছা বা গরজ আছে কি-না। কৈশোর ও প্রথম যৌবনে আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম। সোমেশ্বর থাকত জুবিলী ঘাটে, আমি কালীবাড়ি রোডে। আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে সোমেশ্বররা কলকাতা চলে গিয়েছিল। এখন থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগের কথা। এরপর পৃথিবীতে কত কাণ্ড ঘটল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল। আর্ট কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়ে কিছুদিন মাস্টারি করার পর আমি চলে গেলাম স্পেনে। বছর পাঁচেক পর ফিরেও এলাম। তারপর ছবি আঁকা, ঘর-সংসার করা, দিনগত পাপ ক্ষয় করতে করতে এদ্দুর চলে আসা। এদ্দিনে আতিকুল আমিন বেশ নামটাম করে ফেলেছে। সে যাই হোক, সোমেশ্বরের সঙ্গে ৩৪ বছরের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোনোদিন দেখা হয়নি। আমার কৈশোর ও প্রথম যৌবনের বহু স্মৃতি জুড়ে সে আছে। সোমেশ্বরকে ভুলে যাওয়া তাই অসম্ভব ব্যাপার। এককালে খুবই আহা-উহু ছিল তার জন্য। এখন বয়স হয়ে গিয়ে সেই কাঁচা ইমোশনটা কেটে গেছে। এখন যা আছে তার বেশির ভাগটাই কৌতূহল।
ছোটবেলা থেকে আমি আঁকাআঁকি করতাম। বন্ধুদের মধ্যে সেটাই ছিল আমার একমাত্র ব্রাইড। সোমেশ্বর খুব ক্যাজুয়েলি এটা-ওটা এঁকে মাঝে মধ্যে আমার সেই গর্বটুকুও ম্লান করে দেওয়ার জোগাড় করত। ওর সহজ ড্রয়িং আর রঙের ব্যবহার দেখে আমি বুঝতাম, সোমেশ্বরের মধ্যে অনেক বড় আর্টিস্ট লুকিয়ে আছে। আমি তাকে সময় সময় বলতামও সেকথা। কিন্তু সোমেশ্বর হেসে আমার কথা উড়িয়ে দিত। বলত, ‘ওইসব আর্টফার্ট আমারে দিয়া হইব না দোস্ত।’ সোমেশ্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখত। ইংরেজি ও বাংলায় অসামান্য দখল ছিল তার। পরীক্ষায় ওই দুটি সাবজেক্টে বরাবর সে ঢের নম্বরও পেত। কিন্তু সোমেশ্বর পণ করেছিল, অঙ্ক বা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়বে।
ইন্টারমিডিয়েটে সোমেশ্বরের রেজাল্ট খুব আশানুরূপ হয়নি। হায়ার ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিল ঠিকই, তবে মেধা তালিকার ধারেকাছে ছিল না। রেজাল্ট বের হওয়ার পর কিছুদিন খুব মন খারাপ করে থাকত সে। তারপর তো সোমেশ্বররা আমাদের প্রায় না জানিয়েই চলে গেল। এদ্দিনে সে কী হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাকি প্রশাসনের কিছু। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। ১৯৫৭ সালে সোমেশ্বররা ইন্ডিয়া চলে গিয়েছিল, এখন ১৯৯২ সাল, এই দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরে তার সঙ্গে দেখা হয়নি। এ নিয়ে মনের মধ্যে আমার একটা দুঃখ আছে।
বিজ্ঞাপনটা পরের দিন আনন্দবাজারে ছাপা হলো। ক্লাবের পিবিএক্স এবং রিসেপশন দুই জায়গায়াই বলা ছিল। ছাপা হওয়ার পর সকাল থেকেই অপেক্ষা চলছিল। কিন্তু কিসের কী! বারোটা পর্যন্ত অপেক্ষাই সার, কোনো টেলিফোন পাওয়া গেল না। রিসেপশন থেকেও পাওয়া গেল না কারও আসার ম্যাসেজ। বারোটা পর্যন্ত দেখে আমি বেরিয়ে গেলাম।
বিজ্ঞাপন দিয়ে সাড়া না পাওয়ায় মন একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। কষ্ট হলেও যৎসামান্য। সেটা আমি ট্যাক্সিতে করে যেতে যেতে কলকাতা শহর দেখতে দেখতে ভুলে যাই। ক্লাবে ফিরলাম সন্ধ্যায়। নিজের কামরায় গিয়ে একটা বিচিত্র ম্যাসেজ পাই। ১৯৫৬-৫৭ সালে মৈমনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে পড়া জনৈক চিত্রা সেন আমার খোঁজ করেছিল। সেও ম্যাট্রিকে পঞ্চান্নর ব্যাচ। কাগজে তার বাসার ফোন নম্বর দেওয়া আছে। রাত ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে আমি যেন তাকে ফোনে যোগাযোগ করি।
চিত্রা সেন! মনে আছে, কলা বিভাগের ছাত্রী ছিল সে, আমারই সহপাঠিনী। তক্ষুণি চিনে গেলাম। নতুনবাজার বড় রাস্তার ধারে সামনে অনেকখানি ফাঁকা জায়গা নিয়ে ওদের প্রকাণ্ড একতলা বাড়িটা ছিল। ক্লাসে ওর সঙ্গে কোনোদিন আমার কথাবার্তা হয়নি। চিত্রা সেন ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল জেনে একটু অবাক হই। সেও আইএ পরীক্ষা দিয়ে ইন্ডিয়ায় মাইগ্রেট করেছিল। আতিকুল আমিন নামটা তার তেমন জানার কথা না। বিজ্ঞাপনে আমার নাম পড়ে সে কী করে বুঝল যে, আমি মৈমনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে পড়া তার সেই সহপাঠী? সে সময় আমি লাস্ট বেঞ্চে বসা নিতান্তই অনুজ্জ্বল ও অতি সাধারণ এক ছেলে। নাম, খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠা যেটুকু হয়েছে তা বহু পরে। চিত্রা সেনের তা জানার কথা নয়। বেশ অবাক হই। তবে কি চিত্রা সেন মাঝে মধ্যে বাংলাদেশে যায় এবং কারও কাছে আমার খ্যাতি আর প্রতিষ্ঠার কথা শুনেছে? বিরাট টাইম গ্যাপের পর বিখ্যাত হয়ে ওঠা, সহপাঠী বা পরিচিতজনের কথা অনেকে জানতে পারে এভাবেই।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে চিত্রাকে ফোন করি। ফোন ধরে চিত্রা নিজে। কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছিল জাঁদরেল কোনো মহিলা। দু’চারটা কথার পর চিত্রা যে সেই চিত্রা সেন, রোল নম্বর থার্টি এইট, তা পরিষ্কার বুঝে যাই।
টেলিফোনের ওপারে চিত্রা ছিল খুব উচ্ছ্বসিত। সে জানায়, তার বাসা আমার ক্লাবের কাছেই, বড়জোর মাইল দুয়েক দূরে, এটুকু দূরত্ব কলকতার জন্য কিছুই না, ইচ্ছা করলে কাল সকালবেলা ৮টা সাড়ে ৮টার দিকে তার বাসায় গিয়ে ব্রেকফাস্টটা করতে পারি। আমি সানন্দে হ্যাঁ বলি।
চিত্রার সঙ্গে ফোনে বেশ দীর্ঘ আলাপ। ভূমিকা না করে খুব দ্রুত সে তার জীবন ও সংসারের কয়েকটা প্রয়োজনীয় সংবাদ আমাকে দিয়ে দেয়। বাসায় সে ছাড়া আছে তার পালক মেয়ে যুঁই। হাজব্যান্ড বহু বছর ধরে লন্ডনে আছেন। হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না। তাই বিয়েটা টিকে আছে। হাজব্যান্ড খুবই চমৎকার লোক, বন্ধু এবং আত্মীয়-পরিজনের কাছে সজ্জন আর অমায়িক হিসেবে খুবই জনপ্রিয়, বলতে গেলে একটু বেশি জনপ্রিয়; কিন্তু চিত্রার এসব ভণ্ডামি ভালো লাগে না। ভণ্ডামি? হ্যাঁ, ভণ্ডামিই! চিত্রা হাসতে হাসতে আমাকে বলে। আমার হাজব্যান্ডের নাম শুনলে তুমি খুব অবাক হয়ে যাবে আতিক! সেও তোমার মতো খুব অবাক হয়ে যাবে আতিক! সেও তোমার মতো খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী। ইন্ডিয়ার খুব নামকরা আর্কিটেক্ট। কিন্তু আমার সঙ্গে মেলে না। হয়তো দোষটা আমার। মানিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। কত মেয়েই তো মানিয়ে নেয়। আমি পারি না বাপু। তো দশ-বারো বছর এভাবে চলছে। সে লন্ডনে, আমি কলকাতায়।
চিত্রাকে বলি :তোমার বাসায় কাল সকালবেলা শিওর আসছি। তয় তুমি আমারে কেমতে চিনলা চিত্রা সেন? চিননের তো কথা না…
চিত্রা বলে :তোমার কথা আমি বহু বছর ধইরাই জানি। কেমতে? সেইটাই কমু না। আগে আমার বাসায় আসো। জরুরি কথা আছে তোমার লগে…
: তয় কেমতে চিনলা কইবা না?
চিত্রা বলে :বিখ্যাত মানুষগোরে চিনা কি খুব কঠিন? তাগো ছবি ছাপা হয় পত্রিকায়। খবর বাইর হয়। চিননের অসুবিধা কী?
মৈমনসিংহের অ্যাকসেন্ট এখনও খুব ভালো আসে চিত্রার। তার সঙ্গে কথা বলে বেশ তৃপ্তি পাওয়া গেল। আঞ্চলিক ভাষা আর অ্যাকসেন্টে কথা বললে দূরও কাছের হয়ে যায়। এ রকম আমি বহু দেখেছি। আমার বিখ্যাত হওয়ার খবরটা কীভাবে পেয়েছিল, একটু পর সেটা চিত্রা আমাকে খুলে বলে। বছর চারেক আগে তার হাতে পড়েছিল ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’ নামে একটা বই। এ বইয়ে নানা ক্ষেত্রে নামকরা মৈমনসিংহের কৃতী ব্যক্তিদের ছবি ও পরিচিতি ছিল। চিত্রশিল্পী আতিকুল আমিনের ছবি এবং পরিচিতিও ছিল। দেখে চিত্রা অবাক হয়ে গিয়েছিল। আতিকুল আমিন যে অত বড় আর্টিস্ট, বাংলাদেশে দু’একজনের মধ্যে তার স্থান; লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদ ও টোকিওতে তার ছবি নিয়ে মাতামাতি, তা জানা ছিল না চিত্রার। জেনে খুবই অবাক হয়েছিল সে। আনন্দমোহন কলেজের সেই গোবেচারা, লাস্ট বেঞ্চে বসা, সবকিছু থেকে পালিয়ে বেড়ানো ছোটখাটো চেহারার ছেলেটা এমন খ্যাতিমান হয়ে দেখা দেবে, ভাবাও কঠিন।
চিত্রার কথা মনে পড়ল ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’ বইটা ম্যালা অর্থ ব্যয়ে বের করেছিল ময়মনসিংহের ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড। চিত্রা সেই বই পড়ে আমার বিখ্যাত হওয়ার কথা জেনেছে শুনে একটা বিচিত্র অনুভূতি মনে খেলে যায়। চিত্রা হঠাৎ বলে_
:সোমেশ্বরকে কেন খুঁজছ আতিক?
: জানি না।
: ওকি তোমার কোনো ক্ষতি করেছিল?
: নাহ্।
: কোনো দুঃখ দিয়েছিল?
: তা বলতে পার। ওর ইন্ডিয়ায় চলে আসায় খুবই দুঃখ পেয়েছিলাম। তারপর দ্যাখো, এই চলি্লশ বছর আমাদের আর দেখা-সাক্ষাৎ নেই। আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিল সে। তাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু কিছুই জানি না। সে জন্যই বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলাম। তা তুমি কি সোমেশ্বরকে চেনো চিত্রা…
: খুব ভালো করে। মৈমনসিংহ থাকতেই চিনতাম। কলকাতা এসে সেটা ঘনিষ্ঠ হয়েছিল।
: তুমি ওর ঠিকানা জানো?
: বাঃ জানব না কেন? সবই জানি। কিন্তু আগে আমার বাসায় আসো, সব বলা যাবে।
পরদিন সকালবেলা। চিত্রার বাসা খুঁজে পেতে দেরি হলো না। প্রকাণ্ড এক পুরনো বাড়ির দোতলায় দুটো রুম এবং ছাদের অনেকটা খোলা জায়গা নিয়ে বাস করে চিত্রা। বাড়িটা তাদের ঠাকুরদার আমলের। ফাঁকা জমি এবং ভবনের অনেকটা ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি আছে চিত্রার ভাগটুকু। বিল্ডাররা এখন সেটুকু কিনে নিতে চাইছে। তাদের ইচ্ছা, এখানে হাই রাইজ বিল্ডিং করার। চিত্রার বাধা দেওয়ার কারণে সেটা হয়ে উঠছে না।
দেখতে চিত্রা আগের মতোই পাতলা ছিপছিপে আছে। যদিও মুখে, ত্বকে, মাথার চুলে বয়সের ছাপ কিছুমাত্র গোপন নেই। আমার আসার অপেক্ষায় দোতলার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল। দোতলায় উঠে তার মুখোমুখি হওয়ার পর আত্মীয়ের মতো সে আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখায়। ছোট হলেও বাসাটা খুব সাজানো ঝকমকে। ঘরে সব দামি ফার্নিচার।
লুচি মোহনভোগ ও পেড়া দিয়ে দুর্দান্ত একটা ব্রেকফাস্ট হলো। কে বলবে, কলেজে পড়ার সময় একদিনের জন্যও আমাদের কথা হয়নি? ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পরমাত্মীয়ের মতো আমরা কথা বলছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর পর দু’জনকে খুব নিকটে নিয়ে আসার কাজটা করেছে আর কেউ না, মহান স্মৃতি। তারই জাদুটোনা এটা। কৈশোর হচ্ছে মানুষের জীবনের মর্মমূল। মানুষ সারা জীবন এর চারপাশে ঘোরে। আমি যে বায়ান্ন বছর বয়সে কলকাতা এসে আনন্দবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সোমেশ্বরকে খুঁজছি, সেও তো কৈশোর-দগ্ধতারই ব্যাপার। মানুষের মনের এ একটা জায়গাই ভারি নরম, ভারি নাজুক।
চা খাওয়ার জন্য আমরা বসি খোলা ছাদের একপাশে, মুখোমুখি চেয়ারে। আমি বলি : সোমেশ্বরকে তুমি তাহলে চিনতে?
: খুব ভালো করে। হাড়ে হাড়ে।
: মৈমনসিংহ থাকতেই?
: হ্যাঁ, মেমনসিংহ থাকতেই।
: আশ্চর্য।
: কী আশ্চর্য?
:আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হয়েও সোমেশ্বর সে কথা আমাকে বলেনি। চিত্রা হেসে ফেলে বলে
:বোধহয় সোমেশ্বর ভয় খেয়ে গিয়েছিল। আমি একটু অবাক হয়ে বলি
:কিসের ভয়?
: সীতাকে তুমি কেড়ে নিয়েছিলে না সোমেশ্বরের কাছ থেকে, সেই ভয়।
আমি আরও অবাক হয়ে বলি
: তুমি কী করে জানো?
: সোমেশ্বরই আমাকে বলেছিল।
জুবিলীঘাট থেকে আমি ও সোমেশ্বর স্বদেশী বাজার হয়ে দুর্গাবাড়ির রাস্তা ধরে জিলা স্কুলে যাচ্ছি। উল্টোদিকে রাস্তা ধরে যাচ্ছিল সীতা এবং আরও দুটি মেয়ে। ওরা যাবে বিদ্যাময়ী স্কুলে। রাস্তার মোড় পার হওয়ার পর হঠাৎ দেখি আমাদের পায়ের কাছে একটা কাগজের ঢেলা এসে পড়েছে। ঢেলাটা ছুঁড়ে ফেলে ততক্ষণে স্কুলের কম্পাউন্ডে ঢুকে গেছে সীতা। ঢেলাটা চোখের নিমিষে কুড়িয়ে নেয় সোমেশ্বর। একটু পর কাগজটা সে আমাকে দিয়ে দেয়। বলে, আতিক, তোর চিঠি। জীবনের প্রথম বিস্ময়, বেদনা ও আনন্দ নিয়ে পড়ি চিঠিটা। সীতা নিজের নাম না দিয়ে চিঠিতে লিখেছিল, আতিক, ‘গাছের পাতা নড়েচড়ে, তোমার কথা মনে পড়ে’। ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবু চিঠিটা আমার জীবনের পরম পাওয়া। পরের বছর কুমিল্লা নাকি চট্টগ্রাম বদলি হয়ে ওরা চলে গিয়েছিল মৈমনসিংহ ছেড়ে। চিত্রা এই কাহিনীও জানে, ভাবা যায়?
আমি বলি : সোমেশ্বরের সঙ্গে তাহলে তোমার ভালোই সম্পর্ক?
চিত্রা হাসতে হাসতে বলে : সে আর বলতে
: তাহলে তো সোমেশ্বরদের বাসা কোথায় তুমি জানো?
: বা, জানব না?
: আমাকে নিয়ে যাবে না?
আমার আবেগ-উচ্ছ্বাসের জবাবে শুকনো গলায় চিত্রা শুধু হ্যাঁ বলে। আমার তক্ষুণি ইচ্ছা হচ্ছিল চিত্রাকে নিয়ে সোমেশ্বরের বাসার দিকে বেরিয়ে পড়ি। আমার তর সইছিল না। সোমেশ্বরকে আমি হয়তো আমার নিজেকেও দেখাতে চাই। পড়ন্ত বয়সে বন্ধুদের মনে কাঁচা ইমোশনটা থাকে না। কার কোনদিকে কতটা হলো; এ প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে। আমি হয়তো দেখাতে চাইছি। সোমেশ্বরও নিশ্চয়ই দেখাতে চাইবে। এই হলো মানুষের গল্প।
সোমেশ্বরের বাসার দিকে যেতে আমার আর তর সইছিল না। কিন্তু চিত্রার তক্ষণি বেরিয়ে পড়ার কোনো আগ্রহ ছিল না। সে আমার কাছ থেকে আশফাকের কথা জানতে চাইছিল।
গান গায় বলে ১৯৫৬-৫৭ সালে আশফাক মৈয়মনসিংহ শহরের অনেকের চেনা ছিল। তার ছিল রোগা, ক্ষয়াটে চেহারা। ইন করে পরা ফুল হাতা শার্ট আর ঢোলা প্যান্টের ভেতর লিকলিক করত তার শরীরটা। চোখ দুটি শুধু ছিল বড়, টলটলে ও ভাষাময়। রাজ্যের যত সৌন্দর্য ছিল ওর চোখে। গান করতে শুরু করলে ওর ক্ষয়াটে রোগা চেহারার কথা সবাই ভুলে যেত। শ্যামল মিত্র আর হেমন্ত কুমারের গানগুলো সে গাইত খুব দরদের সঙ্গে। আশফাককে চিনত না কলেজে এমন ছাত্রছাত্রী কমই ছিল। আমার সঙ্গে ওর ভালোই পরিচয় ছিল। মাঝে মধ্যে সে খুব ঠেকার সময় এসে আমার কাছে দুই-দশ টাকা ধার করত। প্রথমদিকে আমি ছিলাম তার ঠেকার সময়ের বন্ধু। আশফাকের কথা জিজ্ঞেস করায় একটু অবাক হয়ে
তাকাই চিত্রার দিকে। চিত্রা হেসে বলে :ওভাবে তাকাচ্ছ কেন দোস্ত?
দোস্ত আমাকে বলত সোমেশ্বর। অন্তত সোমেশ্বরকে চিত্রা যে ঘনিষ্ঠভাবে জানে, এতে সন্দেহ নেই। আমার এবং সোমেশ্বরের বহু কথাও সে জানে। নিশ্চয়ই সোমেশ্বর তাকে বলেছে। কিন্তু সে যা-ই হোক, চিত্রার মধ্যে আশফাকের রহস্যটা কী?
বললাম :মনে হচ্ছে ডালমে কুছ কালা। দেরি করো না। ঝটপট গল্পটা বলে ফেলো।
চিত্রা বলে :আশফাক খুব ডিসটার্ব করত। জানত ওর গান পছন্দ করি, ব্যস। যখন-তখন বাসায় চলে আসত। যেন আমি তার প্রপার্টি। দিনে প্রেমপত্র দিত দুটো-তিনটে করে।
: বল কী! আশফাক?
: হ্যাঁ, আশফাক! খুব গরিব ঘরের ছেলে ছিল, তাই না। কাপড় জামা যা ময়লা থাকত। বছরখানেক খুবই জ্বালাতন করেছিল ছেলেটা। সে সময় আমি আবার একতরফা একজনের প্রেমে পড়েছিলাম। বোঝো, আমার মনের অবস্থাটা। শেষে ব্যাপারটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল দেখে বাবাকে বললাম। বাবা একদিন আশফাককে ডেকে মানা করে দিলেন আমাদের বাসায় আসতে। এও বলে দিলেন, বাড়াবাড়ি করলে জেল-হাজতে পাঠানো হবে! এরপর আর বাসায় আসত না আশফাক।
বললাম :আমার কাছে তোমার জরুরি কাজটা কী, এই আশফাক?
চিত্রা একটু ম্লান হেসে বলে : আহা, ছেলেটাকে অত বড় একটা আঘাত দিয়েছিলাম, সে বাঁচল না মরল একটু জানতে ইচ্ছা করে না?
বলি :এর মধ্যে আশফাকের কোনো খবর পাওনি?
: না। আশ্চর্য মনে হয়, তাই না?
: আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমিও তো সোমেশ্বরের খবর জানি না।
চিত্রা বলে :তবু তো তুমি বিজ্ঞাপন দিয়ে সোমেশ্বরকে খোঁজার চেষ্টা করছ! কই, সোমেশ্বর তো ভুলেও কোনোদিন মৈমনসিংহে একবার বেড়াতে গেল না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কত লোক নিজের দেশ, নিজের বাড়ি দেখতে গেল, সোমেশ্বর কখনও গিয়েছিল? কখনও না। ইট-পাথরের কাজ করতে করতে তার মনটাও পাথর হয়ে গেছে। মানবিক অনুভূতি ওর মধ্যে এবসেন্ট।
বলি :আমার দোস্তকে তুমি এত বক্ছ কেন চিত্রা সেন? আমি তো তোমার দোস্তের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলিনি।
: আমার দোস্ত মানে আশফাক?
: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!
: আশফাক আমার দোস্ত ছিল না। আমি ওর গান খুব পছন্দ করতাম। ঈশ্বর ওকে গানের এমন একটা চমৎকার গলা দিয়েছিলেন!
একটু থেমে চিত্রা বলে :আমার আজকাল খুব অনুতাপ হয় আশফাকের সঙ্গে ওমন নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলাম বলে। আশফাককে দেখতেও ইচ্ছা করে আজকাল। জানতে ইচ্ছা করে ও কী করে-টরে আজকাল, গান গেয়ে কতটা নাম করেছে, ওর স্ত্রী দেখতে কেমন…
:আশফাকের লেখাপড়া বিশেষ হয়নি, ওই ইন্টারমিডিয়েট পাস করা পর্যন্ত। এখানে-ওখানে গান গেয়ে বেড়াত। এটা তো সে আমলে কোনো পেশা ছিল না। গান গেয়ে বড়জোর যাতায়াত ভাড়াটা পাওয়া যেত। তো এভাবে চলে যাচ্ছিল আশফাকের। বহু কষ্টে সে ঢাকা বেতারে সি গ্রেডের আর্টিস্ট হতে পেরেছিল। ছ’মাস-আট মাস পর একটা প্রোগ্রাম পেত। পয়সাও পেত সামান্য কিছু। তবু রেডিও আর্টিস্ট হতে পেরে ওর ইগো কিছুটা শান্ত হতে পেরেছিল। শেষে যা হয়, বিয়ে করল, বাসা নিল শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে। শখের আর্টিস্ট ছিল, বিয়ের পর হলো গানের মাস্টার। একটা সাইকেল ছিল আশফাকের। সাইকেলে চেপে সে শহরে আসত, এক বাসা থেকে আরেক বাসায় যেত গান শেখাতে। এভাবে তার চলছিল বলে জানি। মাঝে মধ্যে পুরনো পাগলামিতে পেয়ে বসত তাকে। হয়তো বউ-বাচ্চার খাবার নেই ঘরে, সে চলে যেত গান গাইতে দু’দিন-তিনদিনের জন্য দূরান্তের গ্রাম-গঞ্জে।
চিত্রা আমাকে থামিয়ে দেয়।
:ঠিক আছে আর বলতে হবে না। ও যে কী রকম আছে তা বেশ বুঝতে পারছি…
:অল্প একটু বাকি আছে, অনুমতি দাও তো বলে ফেলি।
এই বলে বিশেষ বর্ণনায় না গিয়ে বছর দুই আগে যক্ষ্মায় ভুগে আশফাকের মৃত্যু হওয়ার সংবাদটা দিলাম চিত্রাকে। সোমেশ্বরের মতো আশফাক অতটা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল না আমার। তবে ওর খোঁজ-খবর নিয়মিতই রাখতাম। ওর দুটো ছেলেকে আশ্রমে ভর্তি করে দেওয়ার এবং ওর স্ত্রীকে একটা মেসে রান্নার কাজ জোগাড় করে দেওয়া আমাকেই করতে হয়েছিল। সেসবও অল্প কথায় বললাম। চিত্রা আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। অর্ধস্ফূট একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক ঠেলে। আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। বলল : নায়কের ট্র্যাজেডি যেমন হয়, আশফাকের গল্পটা তেমনি। খুব খারাপ লাগল শুনে! আশফাক ওয়াজ অ্যা গ্রেট সোল। সোমেশ্বরের মতো সে অন্তত কাউকে ঠকায়নি…
চিত্রা এরপর আর একবারও আশফাকের কথা জিজ্ঞেস করে না। তাকে দুঃখিত বা শোকার্তও মনে হচ্ছিল না। মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল। বলল : তুমি আমার এখানে খেয়ে যাবে আতিক?
বললাম : না। আমি বরং উঠি। তুমি যদি সোমেশ্বরের ওখানে আমাকে নিয়ে যেতে মনস্থির কর তাহলে দয়া করে জানিও।
চিত্রা বলে : আচ্ছা।
আমি ইতিমধ্যে চিত্রার গল্পটা প্রায় জেনে গেছি। ক্লাবে ফিরে এসে দেখি প্রশান্ত বেরা আমার অপেক্ষায় লবিতে বসে। সঙ্গে তার স্প্যানিশ স্ত্রী মারিয়া। সময় কাটানোর কোনো চিন্তাই রইল না আমার। ফিরলাম রাত সাড়ে ১১টায়। না, চিত্রার কোনো ম্যাসেজ ছিল না।
মিসৌরি যাওয়ার দিন, সকালবেলা, খুব সেজেগুজে চিত্রা এসে হাজির। আমার ফ্লাইট ১১টায়। আমি সে সময় বাক্স-প্যাটরা গুছাচ্ছিলাম।
লবিতে সে বসেছিল। দেখা হতেই হাসি মুখে বলে : চা খাওয়াও দোস্ত। তৃষ্ণার্ত হয়ে আছি।
ক্যান্টিনে নিয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসি। চা ও স্ন্যাকসের অর্ডার দিয়ে আমি বলি : দোস্ত, তুমি যে সোমেশ্বরের স্ত্রী, সেটা কি প্রথমেই বলা উচিত ছিল না?
চিত্রা বলে :তোমাকে বোঝার যথেষ্ট ক্লু দিয়েছিলাম। মুখে বলতে হবে কেন!
বোঝনি কেন?
আমি বললাম :তাপরও আমি বুঝিনি জানো!
:কখন বুঝলে?
:বুঝলাম, যখন তুমি বললে আশফাক ওয়াজ অ্যা গ্রেট সোল, সোমেশ্বরের মতো সে অন্তত কাউকে ঠকায়নি…
:আমি ঠিকই বলেছিলাম।
চা খেয়ে আমরা লবির শেষ কোণে গিয়ে বসি। সকালবেলায় লবিতে লোক নেই। শুধু আমি ও চিত্রা।
আমি বলি : সোমেশ্বর তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়নি?
:না। বরাবর স্বপ্ন ছিল সেটাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হলো আর্কিটেক্ট। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরি করেছে আশি সাল পর্যন্ত, তারপর নেমেছে নিজেই কোম্পানি খুলে রিয়েল এস্টেট বিজনেসে। ভারতের সবচেয়ে নামকরা বিল্ডার হয়তো সোমেশ্বরই। বিদেশেও বিস্তর নাম আছে ওর। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করে সোমেশ্বর। টাকা উড়ায়। মদে চুর হয়ে থাকে সর্বক্ষণ।
সোমেশ্বরের আরও খবরাখবর পাওয়া গেল চিত্রার কাছ থেকে। একটা সময় সে তার গোটা ফ্যামিলিটাই টানত। এখন অবশ্য তার ভাই-বোন সবাই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সোমেশ্বর সবাইকে বলতে গেলে পেলেছে। বছরের পর বছর টাকা ঢেলেছে ভাই-বোনদের পড়াশোনা এবং ব্যবসার পেছনে। শুধু কী নিজের ভাই-বোন, গরিব মাসতুতো, পিসতুতো, খুড়তুতো ভাই-বোনদেরও সে ছিল ঠেকার সময় অভিভাবক। প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে গেছে। এরপরও সোমেশ্বর নিয়মিত ওদের খবর নিতে ভোলে না। ভাই-বোন এবং ভাগ্নে-ভাগি্ন, ভাইপো-ভাইজিদের জন্মদিনে কিংবা বিশেষ দিনে দামি উপহার পাঠায় বিদেশ থেকে।
চিত্রা আরও অনেক খবর দেয় সোমশ্বেরের। সোমেশ্বর গত বছর রানী এলিজাবেথের আমন্ত্রণে আরও কয়েকজন বিশিষ্ট প্রবাসী ভারতীয়ের সঙ্গে বড়দিনে বাকিংহাম প্যালেসে গিয়েছিল। অক্সফোর্ডে সে মাঝে মধ্যে ক্লাস নেয় অ্যাডভান্সড আর্কিটেকচারের ওপর। লন্ডনে সে নিজের বাড়ি করেছে। নীল রঙের বড় মার্সিডিস চালায় সে। লন্ডনে বাঙালিদের একটা আড্ডা আছে, হাইড পার্কের কাছে, সেই আড্ডার সে প্রধান ব্যক্তি।
আমার খুব ভালো লাগল সোমেশ্বরের বিশাল সাফল্যের কথা শুনে। বরাবরই সে ছিল ব্রাইট আর ব্রিলিয়ান্ট। জীবনে বিশাল সাফল্য পাওয়াটা ছিল তার প্রাপ্য। আমার বুকটা ভরে গেল আনন্দে। সে সঙ্গে হয়তো কিছুটা অভিমান এবং ঈর্ষাও ছিল। অভিমান ও ঈর্ষা হয়তো ভালোবাসারই জারক। আমার হাতে বিশেষ সময় ছিল না। চিত্রাকে বললাম :ঝগড়াটা মিটিয়ে ফেল দোস্ত। আমার মনে হয় সোমেশ্বর এবং তুমি দু’জনই দু’জনের জন্য অপেক্ষা করছ!
চিত্রা এই কথার উত্তর দেয় না। একটু পর সে চলে যায়। আমি লবিতে বসে থাকি আরও কিছুক্ষণ। হঠাৎ আমার মনে হয়, চিত্রা, সোমেশ্বর, আশফাক ও আতিকুল আমিনের মধ্যে আসলে জিতেছে কে? আশফাক?
বারবার তার নামটাই উঠছিল। আমাদের মধ্যে সে-ই শুধু আপস করেনি।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
রাহাত খান- র আরো পোষ্ট দেখুন