দায় ও বিদায়

dayঅঙ্কন : এস এম রাকিবুর রহমান

বিদায় একটি চিরন্তন সত্য।

মানুষ এই পৃথিবীতে আসে

পৃথিবীকে ভালোবাসে

মায়ায় জড়িয়ে কাঁদে হাসে

কেউ এসে দাঁড়ায় পাশে

তারপর বিদায় নিলে সবাই শোকে ভাসে।

তবে এই চিরবিদায় ছাড়াও নানা রকম বিদায় আছে। ক্ষণিক দেখার পর একা হওয়ার বিদায়, প্রিয়জনের মন থেকে বিদায়, কর্মজীবন শেষে বিদায় ইত্যাদি। এই প্রতিটি বিদায়ের পেছনেই কিছু স্মৃতি থাকে, কিছু কথা থাকে। প্রিয়জনের মন থেকে বিদায় হলে দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণা হয় সঙ্গী। আর চিরবিদায় হলেও অনেকের কীর্তিকর্ম তাকে বাঁচিয়ে রাখে।

এই বিদায় নিয়ে অনেক গল্পও রয়েছে, বিশেষ করে বিদায় সংবর্ধনা। প্রতিটি মানুষেরই কর্মজীবনে যাঁদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন তাঁদের সঙ্গে মজার মজার স্মৃতি যেমন রয়েছে, তেমনি অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। তেমনি এক ব্যক্তির কর্মজীবন শেষে কর্মস্থল থেকে বিদায় নেওয়া উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিদায় সংবর্ধনার গল্প দিয়েই শুরু করছি এই লেখা। আমার পরিচিত একজন চাকরিজীবীর কাছ থেকে গল্পটি শুনেছিলাম। বিদায় সংবর্ধনার মঞ্চে বিদায়ী অতিথি এবং সেই অফিসের এমডি, জিএম, এজিএম বসে আছেন। ঘোষক এসে বললেন, ‘সম্মানিত সুধীমণ্ডলী, আজকে আমাদের প্রাণপ্রিয় সহকর্মী মোতালেব ভাইয়ের বিদায় উপলক্ষে আয়োজিত এই বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ। শুরুতেই বক্তব্য রাখবেন আমাদের এজিএম রহমত আলী সাহেব। ’

রহমত আলী বক্তৃতা শুরু করলেন : “মাননীয় এমডি স্যার, প্রাণপ্রিয় বিদায়ী সহকর্মী মোতালেব সাহেব, উপস্থিত সহকর্মীবৃন্দ, আজকের এই দিনে মোতালেব সাহেবের উদ্দেশে একটি কথাই বলব, ‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়। ’ আমরা জানি একটা সময়ে সবারই চাকরি থেকে বিদায় নিতে হয়, কিন্তু মোতালেব সাহেবকে বিদায় দিতে গিয়ে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে। ” কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি দুঃখিত, আমি আর কিছু বলতে পারব না’, বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন।

বিদায়ী অতিথি মোতালেব সাহেব বক্তার কথা শুনে অবাক হলেন। পাশে রক্ষিত টিস্যু বক্স থেকে দুটি টিস্যু পেপার নিয়ে রহমত সাহেবকে দিলেন। রহমত সাহেব টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে নিজ আসনে গিয়ে বসলেন। কয়েকজন তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। মোতালেব সাহেব কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না।

এমন সময় আবার ঘোষকের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘এবারে বক্তব্য রাখবেন আমাদের জিএম স্যার মো. কোরবান আলী স্যার। ’ উল্লেখ্য, এজাতীয় কর্মচারীরা তাঁদের বসকে ঘন ঘন স্যার বলতে অভ্যস্ত।

কোরবান আলী সাহেব খুব গম্ভীর হয়ে বক্তৃতা শুরু করেন, ‘আজ আমি আপনাদের উদ্দেশে শুধু একটি কথাই বলব—মোতালেব সাহেবের মতো ত্যাগী, কর্মঠ, পরিশ্রমী, সৎ, নীতিমান ও মেধাবী মানুষ আমার কর্মজীবনে আমি খুব কমই দেখেছি। তাঁর মতো মানুষ যেকোনো অফিসের জন্যই গর্বের। তাঁর বিদায়ের এই মুহূর্তে আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ’

জিএম সাহেবের কথা শুনে মোতালেব সাহেব কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। বারবার মাথায় একটি প্রশ্নই ঘুরছিল, মানুষ এত দ্বৈতসত্তার হয় কী করে? কারণ চাকরিজীবনে তিনি এই জিএম সাহেবের মুখে দুর্নাম ছাড়া কোনো দিন প্রশংসাবাণী শোনেননি। কিন্তু একি কথা শুনি আজ! বিদায়বেলায় এই ভরা মজলিশে এসব তিনি কী বলছেন? বিস্ময়ের ঘোর না কাটতেই আবার জিএম সাহেবের কণ্ঠ কানে এলো—

‘মোতালেব সাহেবের বিদায়ে এই অফিসের যে কী অপূরণীয় ক্ষতি হবে, তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আমরা তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করছি। ’

এই পর্যন্ত বলে জিএম সাহেব তাঁর নিজ আসনে গিয়ে বসলেন। আবার যথারীতি ঘোষক এলেন, তাঁর কণ্ঠও বেশ ভারী—

‘আসলেই আমাদের মোতালেব স্যারের বিদায়ে সবারই মন অশ্রু ভারাক্রান্ত। স্যার, আপনি যেখানেই থাকেন, আমাদের এই ভালোবাসা ভুলবেন না। এবারে আমরা বিদায়ী অতিথি জনাব মো. আবদুল মোতালেব স্যারকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি। ’

মোতালেব সাহেব আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে মাইক্রোফোনের সামনে গেলেন। এই চেনা অফিসে আজ তাঁর সব কিছুই কেমন যেন অচেনা লাগছে। মোতালেব সাহেব বক্তৃতা শুরু করলেন : ‘মাননীয় এমডি স্যার, জিএম স্যার ও এজিএম স্যার এবং আমার প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ, আসসালামু আলাইকুম। আমি এজিএম স্যারের কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছি।

এ কথা শুনে সভার অনেকেই একটু অবাক হলেন। এজিএম ইতস্তত বোধ করছিলেন। মোতালেব সাহেব আবারও কথা শুরু করলেন, ‘আমার বিদায়ে জিএম স্যারের কষ্ট দেখে আমারও চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। তাই আজকের এই বিদায়ের দিনে আমি একটি আনন্দের কথা শোনাতে চাই। জিএম স্যার বললেন, আমার বিদায়ে নাকি এই অফিসের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। আমি বেঁচে থাকতে সেটা হতে দেব না। স্যার যদি চান আমাকে আরো কিছুদিন চাকরি করার সুযোগ দিতে পারেন। আমি কাজ করতে চাই। ধন্যবাদ। ’

মোতালেব সাহেবের কথা শুনে সভায় চাপা গুঞ্জন শুরু হয়। মঞ্চে উপবিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা স্তম্ভিত। কী করবেন, কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। হঠাৎ করে কী হতে কী হয়ে গেল, কেউ বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এমন সময় এমডি সাহেব উঠে মাইক্রোফোনের সামনে গেলেন, তিনি অত্যন্ত শান্তভাবে বললেন, ‘আপনারা যাঁরা আজ এখানে মোতালেব সাহেবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তাঁরা সব সময় তো মোতালেব সাহেবের নামে আমার কাছে কমপ্লেইন করেছেন। আর এখানে এসে উল্টা বক্তৃতা দিলেন। এবার সামলান। ’

পরবর্তী ঘটনা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। তবে ওই অফিস থেকে মোতালেব সাহেবের বিদায় হয়েছে, নাকি কর্তৃপক্ষ সদয় হয়ে আবার তাঁকে স্বপদে বহাল রেখেছে, সেটা জানা যায়নি।

‘ইত্যাদি’তেই আমরা বহুবার বলেছি, একদল অলস মানুষের চেয়ে একজন কর্মঠ মানুষ অনেক বড়। একদল অযোগ্যর চেয়ে একজন যোগ্য মানুষ অনেক বড়। একদল অসৎ মানুষের চেয়ে একজন সৎ মানুষ অনেক বড়। কিন্তু আমাদের সমস্যা হচ্ছে, এখন চারদিকে এই অসৎ, অযোগ্য, অদক্ষ লোকের ছড়াছড়ি। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি—যেদিকেই তাকাই না কেন, সৎ মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর অলসতার মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে এক গ্লাস পানি খেতে হলেও বাড়িতে বুয়া, অফিসে পিয়ন প্রয়োজন। দোতলায় উঠতে-নামতে লিফট ছাড়া চলে না। বাড়ির কাছেই দোকান, অথচ সেখানে যেতে হলে বিত্তশালীদের গাড়ি আর মধ্যবিত্তদের রিকশা ছাড়া চলে না। আর যোগ্য-অযোগ্যর বিচার তো এখন কল্পনাতীত। শুধু নির্বাচন এলে শোনা যায়, ‘যোগ্য জায়গায় যোগ্য লোক—এখন সবার লক্ষ্য হোক’। এই লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কারণ তো এখন সবার কাছেই স্পষ্ট। তার পরও সময়ের সাথে জীবন চলছে। ইদানীং তোষণ বা তোষামোদও একটি পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কাউকে তোষণ করে—শোষণ করলেও শাসন করা যায় না। কারণ আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা তোষামোদকে ভালোবাসেন। আসলে নানা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনেক আজেবাজে লোক আমাদের সমাজের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে। তাই মৃত্যুও আমাদের এখনকার নোংরা রাজনীতি থেকে বাদ যায়নি। মৃত্যুর আগেও দলবাজি, মৃত্যুর পরেও দলবাজি। যে যত খ্যাতিমান বা বিদ্বানই হোন না কেন, মৃত্যুর পরে তার রাজনৈতিক পরিচিতিটাই এখানে মুখ্য হয়ে ওঠে। তাই তার জন্য শোক প্রকাশ বা সমবেদনা জ্ঞাপন সেই পরিচয়ের ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ মৃত্যু নিয়েও রাজনীতি। শুধু তা-ই নয়, আজকাল কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি বা শিল্পী অসুস্থ হলে তাঁকে নিয়েও এক ধরনের রাজনীতি ও প্রচার-প্রচারণা লক্ষ করা যায়। কে কাকে দেখতে গেল, কেন গেল, কেন গেল না—এসব বিষয়ও এখন আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই কোনো মুমূর্ষু কিংবা অসুস্থ শিল্পীকে দেখতে গিয়ে নানা ভঙ্গিতে তাঁর সঙ্গে সেলফি তোলেন। শুধু সেলফি তুলেই শান্ত হন না, সেগুলো আবার ফেসবুকে পোস্ট করেন। কেউ বা পত্রিকায়ও সরবরাহ করেন। অসুস্থ রোগী নিয়ে এ ধরনের আত্মপ্রচারে অনেকেই হাসেন আবার অনেকেই ক্ষুব্ধ হন। বলা বাহুল্য, শিল্পীদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে বললে এঁদের অনেকের হাতই পিছিয়ে যায়। সাবিনা ইয়াসমিন, আজম খান, খালিদ হাসান মিলুসহ অনেক শিল্পীর অসুস্থতার সময় তাঁদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই সেলফি তোলা দলকে শিল্পীর মৃত্যুর পর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না—না কবরস্থানে, না শহীদ মিনারে, এমনকি পরবর্তী সময়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নিতেও দেখা যায় না। এই অভিজ্ঞতাটা আমার হয়েছে মিলুর এবং অন্য অনেকের পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে গিয়ে। নিজের দায়িত্ববোধ থেকে মিলুর দুটি সন্তানকেই চেষ্টা করেছি ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে তুলে ধরতে। আমি আনন্দিত, ওরা দুজনই এখন ভালো করছে। স্বনামে পরিচিত। এটাই একজন শিল্পীর জন্য বড় পাওয়া।

গত ২৯ মে ছিল বন্ধুবর ফরীদির জন্মবার্ষিকী। বেশ নীরবে-নিভৃতে চলে গেল জন্মদিনটি। আজকাল যেভাবে অখ্যাত এবং জোর করে বিখ্যাত অনেক ব্যক্তির জন্মদিবসে নানা আয়োজন দেখা যায়, ফরীদির জন্মদিনটিতে তেমন কোনো আয়োজন ছিল না। ফরীদির বিদায়ের সময় ওর কাছে ছিলাম। মনে পড়ে অনেক কথা। ফরীদির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে যখন ওর বাসায় গেলাম—গিয়ে দেখি তখনো ফরীদি বাথরুমে পড়ে আছে। তার প্রাণহীন দেহটা খাটে তুলে চাদর গায়ে দিয়ে দিলাম। ঘরে আমি, ফরীদির সহকারী রুবেল আর ফরীদির নিথর দেহ। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। সংবিত ফিরে পেলাম কয়েকজনের কান্নার শব্দে। দেখতে দেখতে শূন্য ঘরটি পূর্ণ হয়ে গেল শিল্পী-কলাকুশলীদের পদচারণে। টেলিভিশন ক্যামেরা, স্টিল ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ, থেকে থেকে কান্নার শব্দ। টিভি ক্যামেরার সামনে চলছে প্রতিক্রিয়ার বন্যা, অনুভূতি প্রকাশ। কেউ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলছে। কেউ বা হাত দিয়ে চোখ মুছছে। কেউ মন্তব্য করতে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে, মাঝপথে কথা থামিয়ে বলছে, ‘আমি আর বলতে পারব না। ’

ফরীদির ভক্তের কোনো অভাব ছিল না। তাকে যে মানুষ কতটা ভালোবাসত সেটা শহীদ মিনারে ফরীদির প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের দিনই লক্ষ করা গেছে। তবে আশা করেছিলাম মৃত্যুর পরে অন্তত প্রতিটি জায়গায়ই ফরীদির কাছের মানুষদের দেখতে পাব। তবে তিনজন মানুষকে সব জায়গায়ই দেখেছি—প্রবাসী বন্ধু মানিক, জিলানী আর চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেন বুলুকে, যাদের ক্যামেরার সামনে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখিনি। তাদের অনুভূতির প্রকাশ ছিল চোখের পানিতে। সুসময়ে ফরীদির চারপাশে বন্ধু-বান্ধবের অভাব ছিল না। মুত্যৃর পরেও টিভি ক্যামেরার সামনে তার অনেক সুহৃদকে দেখলাম, তাদের প্রতিক্রিয়া শুনলাম; কিন্তু ফরীদির অসুস্থতার সময় যে ১১ দিন হাসপাতালে ছিল, সেই ১১ দিনে ১১ জন মানুষও তাকে দেখতে যায়নি। মৃত্যুর পর ফরীদির এত ঘনিষ্ঠজনের চেহারা দেখে নিজের মনকে প্রশ্ন করে কোনো উত্তর পাইনি। শুধু মনে হয়েছে, ফরীদির অসময়ে তার অনেক সঙ্গ প্রয়োজন ছিল, যেটা আমরা তাকে দিতে পারিনি।

পপগুরু আজম খানের বেলায়ও এমনটি ঘটেছে। আজম খানের মৃত্যুর পর সিএমএইচ থেকে শুরু করে তার মরদেহ কমলাপুরের বাড়িতে নেওয়া হয়, সেখান থেকে শহীদ মিনার। এরপর বায়তুল মোকাররম মসজিদ হয়ে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নেওয়া পর্যন্ত সঙ্গে থাকতে চেষ্টা করেছি। তবে সব সময় ছিলাম টিভি ক্যামেরার বাইরে; যদিও একটি দল সব সময় টিভি ক্যামেরার সামনে আসার জন্য প্রতিযোগিতা করছিল। দু-একটি চ্যানেল তো তার মৃত্যুর আগেই মৃত্যুসংবাদ প্রচার করেছিল। সে জন্য অবশ্য কোনো দুঃখ প্রকাশও করেনি তারা। আজম খানের মৃত্যুর পরও টিভি চ্যানেলগুলোতে অনেক টক শো দেখলাম, অনেকের প্রতিক্রিয়া শুনলাম, পত্রিকায় শোক মন্তব্য পড়লাম। কিন্তু আজম খানের অসময়ে তাদের অনেককেই দেখতে পাইনি। বিশেষ করে তার জন্য অর্থ সাহায্য চাইতে গেলে অনেকের বিরূপ ও আপত্তিজনক মন্তব্যও আমাকে হজম করতে হয়েছে, যা আমাকে প্রচণ্ডভাবে আহত করেছে। তার মৃত্যুর পরে যখন পত্রিকার পাতায় এদের কারো কারো প্রতিক্রিয়া পড়ি, তখন নিজের অজান্তেই মনে সেই একই প্রশ্ন জাগে—আমাদের মধ্যে এত দ্বৈতসত্তা কেন?

সর্বশেষ লাকী আখন্দের অসুস্থতার সময়ও সেই একই দৃশ্য চোখে পড়ল। অনেকেই তাঁকে দেখতে গেছেন পিজিতে। সঙ্গে বোধ হয় ক্যামেরা প্রস্তুত ছিল। আর ক্যামেরা না থাকলেও অসুবিধা নেই, মোবাইল তো আছেই। ব্যস্, ওই মোবাইল দিয়েই সেলফি অত্যাচার। পরদিন পত্রিকায় প্রকাশ। কী অদ্ভুত তামাশা! আমি যেদিন পিজিতে লাকী ভাইকে দেখতে গেলাম, তাঁকে দেখে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ক্ষীণকায় শরীর, বিছানায় শুয়ে আছেন। ভাবলেশহীন দৃষ্টি। আমাকে দেখে ঠোট দুটো কাঁপছিল। অসুস্থ শরীরেই জিজ্ঞেস করছিলেন আমার সুস্থতা সম্পর্কে। লাকী ভাই জীবিত থাকতে তাঁর গান যত না শোনা গেছে, তার চেয়ে বেশি শোনা গেছে তাঁর অসুস্থতার সময় এবং মৃত্যুর পর। টিভি চ্যানেলগুলোতে তাঁর ওপর টক শো, বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে তাঁর গান গাওয়ার হিড়িক, তাঁর গান নিয়ে রিয়ালিটি শো ইত্যাদি। কিন্তু রিয়ালিটি হচ্ছে, তিনি যখন সুস্থ ছিলেন তাঁকে নিয়ে কখনো কোনো টিভি চ্যানেলে এভাবে আলোচনা অনুষ্ঠান, তাঁর গান নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান, গান নিয়ে অ্যালবাম প্রকাশ—এসব এভাবে চোখে পড়েনি। তাহলে হয়তো লাকী ভাই তাঁর গানের এই মূল্যায়ন দেখে অনেক খুশি হতেন। আনন্দ পেতেন। আমাদের এখানে আবার মূল্যায়নের পদ্ধতিটা বেশ অদ্ভুত। শিল্পীর জীবদ্দশায় খুব কমই মূল্যায়ন হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্যিকার শিল্পীরা মূল্যায়িত হন তাঁর মৃত্যুর পর। দেওয়া হয় মরণোত্তর পুরস্কার। অথচ জীবদ্দশায় এই মূল্যায়ন তাঁকে আরো অনুপ্রাণিত করত। অবশ্য আজকাল পুরস্কারও তার মান হারিয়ে এমন জায়গায় এসেছে যে কিসে সম্মান আর কিসে কম মান, সেটা বোঝা মুশকিল। লাইনবাজরা লাইনের কল্যাণে নানা রকম পুরস্কারে ভূষিত হয়; যদিও এসব পুরস্কার কেন পেল এবং কে কেন দিল তা নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেন। আজকাল পুরস্কার পেলে একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়—পুরস্কার আমার দায়িত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, পুরস্কার পাওয়ার আগে কি দায়িত্বটা কম ছিল? পঞ্চমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার পর শিল্পী সুবীর নন্দীর একটি মন্তব্য পড়লাম পত্রিকায়। তিনি বলেছেন, ‘পুরস্কার পেয়ে নিজের কাজের দায়িত্ববোধ বেড়ে যাবে, এটা বলব না। কারণ গানকে কখনো দায়িত্বহীনভাবে চর্চা করিনি। পুরস্কার মানুষকে আনন্দ দেয়, সম্মান বাড়ায়; আর সেটা দায়িত্ববোধের চর্চা থেকেই। ’ আসলেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেসব মানুষ সমাজ উন্নয়নে, শিক্ষার প্রসারে, সর্বোপরি জনকল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের কজন পুরস্কৃত হচ্ছেন বা হয়েছেন? তাঁরা কিন্তু মূল্যায়ন বা পুরস্কারের লোভে কাজ করেন না, করেন নিজের দায়বোধ থেকে। নীরবে-নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণে। আর আমাদের মধ্যে যারা কাজে নয় কথায় বিশ্বাসী, তাদের মধ্যে এই দায়বোধের অভাবটা পরিলক্ষিত হয় বেশি।

আবার সেই বিদায় প্রসঙ্গ। কর্মজীবন থেকে বিদায়ের স্মৃতি কখনো সুখের, কখনো দুঃখের। নানা স্মৃতি বুকে নিয়ে এই বিদায় মনে করিয়ে দেয়, মানুষের জীবন খুবই ছোট। একসময় তাকে সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে। মৃত্যুর পরে মানুষকে স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখবে তার কাজ। ধনে নয়, মানে নয়, খ্যাতিতেও নয়; কর্মেই মানুষের পরিচয়।

একটি গানে শুনেছি, ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’, কিন্তু সব ভুলে আর্থ-সামাজিক কারণে সেই মানুষই আজ হয়ে পড়েছে স্বার্থপর। আত্মস্বার্থ, ব্যক্তিলোভ কেড়ে নিয়েছে মানুষের মানবিক গুণ, মানব জন্মের শ্রেষ্ঠত্ব, সার্থকতা। কিন্তু আশার কথা হলো, মানবসত্তা ও মানবিক গুণের কখনোই মৃত্যু হয় না। অনেক জাগতিক স্বার্থের নিচে তা চাপা পড়ে থাকলেও তাকে জাগিয়ে তোলা যায়। মহানুভূতি ও সহানুভূতিতে জেগে উঠতে পারে মানুষ, নিজেকে করতে পারে মানবসেবায় উৎসর্গ, যা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল।

রেটিং করুনঃ
1 Star2 Stars3 Stars4 Stars5 Stars (No Ratings Yet)
Loading...
Alternative Textহানিফ সংকেত- র আরো পোষ্ট দেখুন