আজ বাইশে শ্রাবণ

Rabindra
বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭২তম মহাপ্রয়াণ দিবস। বাংলা ১৩৪৮ সালের এ দিনে ৮০ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তবে তার এ চলে যাওয়া শুধু দেহান্তর মাত্র। তার অসামান্য রচনা ও কাজের মধ্যে তিনি বেঁচে আছেন ও থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে । ১২৬৮ বঙ্গান্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত জমিদার পরিবারে তার জন্ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, নাট্যকার, কথাশিল্পী, চিএশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, ছোট গল্পকার, ভাষাবিদ। সাহিত্যের সব শাখাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন তিনি।বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক কিছুরই প্রথম তিনি। ছোটগল্পের জনক, এমনকি বাংলা গদ্যের আধুনিকায়নের পথিকৃৎও তিনি। নোবেল জয় করে একটি প্রাদেশিক (তৎকালীন) ভাষাকে বিশ্ব সাহিত্যে স্থান করে দিয়েছিলেন তিনি। ব্যক্তিগত চিঠিও যে কী অসাধারণ সাহিত্য আর দার্শনিকতার দৃষ্টান্ত হতে পারে, তার ‘ছিন্নপত্র’ সৃষ্টির আগে তার তো কোনো নজির ছিল না। গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায়, প্রবন্ধে, নতুন সুরে ও বিচিত্র গানের বাণীতে, অসাধারণ সব দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধে, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতিসংলগ্ন গভীর জীবনবাদী চিন্তাজাগানিয়া অজস্র নিবন্ধে, এমনকি চিত্রকলায়ও সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথ চির নতুন।
জন্মদিন নিয়ে যিনি লিখেছিলেন
‘ওই মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্ত্য ধূলির ঘাসে ঘাসে…’
সেই রবীন্দ্রনাথই জীবনসায়াহ্নের জন্মদিনে মৃত্যুভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে লিখলেন
‘আমার এ জন্মদিন মাঝে আমিহারা,
আমি চাহি বন্ধুজন যারা
তাহাদের হাতের পরশে
মর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসে নিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ
নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ…।’
তাঁর সেই আকাঙ্ক্ষার মতোই শুধু ‘বন্ধুজন’ নয়, সর্বস্তরের মানুষের শেষ আশীর্বাদ আর ভালোবাসার অশ্রুতে সিক্ত হয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে কেওড়াতলা শ্মশানঘাট পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। কলকাতার সেদিনের (১৯৪১) বিবরণ তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় আর রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে, কবির জীবনের সমাপ্তি হয়েছিল সর্বজনীন শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের মধ্য দিয়ে। দীর্ঘ মিছিল ছিল তার শবযাত্রায়।
মানুষের শেষ আশীর্বাদ চেয়েছিলেন, পেয়েছেনও। এমনকি যারা ছিলেন তীব্র সমালোচক-নিন্দুক, তারাও নিন্দা প্রত্যাহার করে বিশ্বকবির অন্তিমযাত্রার খবরে বিষণ্ন হয়েছেন। সে যুগের দৈনিক আজাদের মতো ঘোরতর রবীন্দ্রবিরোধী পত্রিকা যে বিস্ময়কর শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়েছিল প্রথম পৃষ্ঠাজুড়ে, তা অকল্পনীয়ই বটে।
আশি বছরের জীবনে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে নানাভাবে ঋদ্ধ করে গেছেন। শুধু বাংলা ছোটগল্পের কিংবা বাংলা গানের ক্ষেত্রেই আধুনিকতার পথিকৃৎ বা জনকমাত্র নন, তিনি তৈরি করেছেন সাহিত্যের নানা পথ। সে জন্য একই সঙ্গে যিনি বাউল দার্শনিক অধ্যাত্ম চেতনায় বিশ্বাসী আস্তিক, আবার সেই তিনিই প্রবল বস্তুবাদী দর্শনে জাগ্রত, মানবমুক্তির লড়াইয়ে শামিল। যিনি বলেন_
‘আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
তোমার সোনার তরী’ সেই সৌন্দর্যের সুদূর পিয়াসী কবি কী অবলীলায় ক্ষুব্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন মানবতার অপমানের প্রতিশোধবাণী
‘দিকে দিকে দানবেরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’
ঔপনিবেশিক শাসকরূপী দানবের বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে প্রস্তুতি লক্ষ্য করেছেন রবীন্দ্রনাথ। জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও অবলীলায় কষ্টসহিষ্ণু এক সংগ্রামশীল মানুষ তিনি। কী গভীর মৃত্তিকাসংলগ্ন হলে উচ্চারণ করতে পারেন
‘দুই বিঘা জমি’র উপেনদের মতো শোষিত মানুষের দুঃখ! কী জীবনঘনিষ্ঠ কাব্যবোধ থাকলে প্রতীক্ষা করা যায়
‘কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন
যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।’
তাঁর আশি বছরের জীবনের সবটুকু জুড়েই গভীর মানবপ্রীতির এই আকাঙ্ক্ষা নানাভাবে উৎকীর্ণ। গল্পগুচ্ছের গল্পমালায় পূর্ববঙ্গের পদ্মাতীরবর্তী মানুষের সুখ-দুঃখ আর নর-নারীর জীবনতৃষ্ণার যে নিখুঁত চিত্র, তার তুলনা নেই। কবিতায়, সঙ্গীতে, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে, চিত্রকলায়_ এমনকি স্মৃতিকথার মধ্যেও মানবতাবাদী উদার প্রগতিশীল রবীন্দ্রনাথের দ্রোহ আর প্রেম, বাউল দর্শন আর বস্তুবাদী দর্শন মিলেমিশে একাকার। সোনার তরী, মানসী, চিত্রা’র কবি হয়েও দু’দুটি মহাযুদ্ধের ভয়াবহতায় আঁতকে ওঠেন। লেখেন ‘সভ্যতার সংকটে’র মতো অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রবন্ধ। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গোরা’র মতো উপন্যাস, নারীমুক্তির অমর বাণী চিত্রাঙ্গদা কাব্যনাট্য আর ‘যোগাযোগ’র মতো প্রতিবাদী উপন্যাস। একদিন যে পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে মুগ্ধ ছিলেন, সেই পশ্চিমের প্রতি কী বিরূপ হলেই না ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করা যায়! করবেন না-ই বা কেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ-হত্যাকাণ্ড সহ্য করেন কেমন করে অমন মানবতাবাদী কবি!
জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে বড় বেশি পার্থক্য দেখেননি রবীন্দ্রনাথ। একটি অধ্যায়ের পরিপূরক যেন অন্যটি। না হলে কিশোর বয়সে কেমন করে লিখলেন ‘মরণরে, তুঁহু মম শ্যাম সমান…/মৃত্যু অমৃত করে দান।’ মানবের মাঝে বাঁচতে চেয়েছেন বটে পরিণত বয়সে পুষ্পিত কাননে জীবন্ত হৃদয়ে ঠাঁই পাওয়ার শর্তে ‘মরিতে চাহি না’ বলে। কিন্তু প্রকৃতই খণ্ডের মাঝে যেমন অখণ্ডকে দেখতে চেয়েছেন, তেমনি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের পূর্ণতার স্বরূপ উপলব্ধি করতে চেয়েছেন বারবার। নানা গানে, কবিতায় এমনকি ছিন্নপত্রে সে কথা লিখেছেন তিনি। ক্ষুদ্রতার অচলায়তন ভেঙে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠেছেন বলেই তিনি সগর্বে বলতে পেরেছেন
‘এ বিশ্বরে ভালোবাসিয়াছি
এ ভালোবাসাই সত্য এ জন্মের দান
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।’
তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থাকবেন চিরকাল মানুষের সুগভীর ভালোবাসায়।

মন্তব্য করুন